স্থাপত্যকলার নোবেল হলো Pritzker; শিকাগোর বিখ্যাত Pritzker পরিবারই স্থাপত্যকলার এ পুরস্কার দিয়ে আসছে। একলাখ মার্কিন ডলার সম্মানী দেয়া হয় পুরস্কার বিজয়ীকে।আন্তর্জাতিক হোটেল চেইন সম্পর্কে যারা খোঁজ খবর রাখেন তারা Haytt Hotel এর যশ খ্যাতি সম্পর্কে জানেন ; এটিও Pritzker পরিবারের। গত ৭ মার্চ ৪৫ তম প্রিজকার প্রাইজ বিজয়ীর নাম ঘোষিত হয়। ১৬ মে কানাডার আগাখান মিউজিয়ামে এবারের লরিয়েটের হাতে এ পুরস্কার তুলে দেয়া হয়েছে।
এতদিন ধরে এ পুরস্কার এশিয়াতে জাপান আর চীনের হাতেই ঘুরে ফিরে যেত।জাপানের ৭ জন স্থপতি ৬ বার এ পুরস্কার পায়। আর চীনারা পায় দুবার। চীন-জাপানের বাইরে এবারই প্রথম ভারতের হাতে এ পুরস্কার আসলো; একই সাথে এই পুরস্কারের ৪৫ বছরের ইতিহাসে স্থপতি বালকৃষ্ণ দোশি সবচেয়ে বয়স্ক স্থপতি, যার বর্তমান বয়স ৯০ বছর।
বালকৃষ্ণ দোশি ১৯২৭ এর ২৬ এ আগস্ট পুণেতে জন্ম নেন। তার পূর্ব পুরুষেরা দুই প্রজন্ম ধরে আসবাবের ব্যবসায় নিয়োজিত ছিলেন।ঠিক পিটার জুমথরের মত। জুমথরও pritzker লরিয়েট। সদ্য স্বাধীন ভারতে ১৯৪৭ সালে স্থাপত্য কলা নিয়ে লেখা পড়া শুরু করেন মুম্বাইয়ের J.J School of Architecture এ।পরবর্তী লন্ডনে যান আরো সমৃদ্ধ হতে। আহমেদাবাদের ইন্ডিয়ান ইন্সিটিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট বিল্ডিং এর মূল স্থপতি লুই আই কানের সাথে ঐ প্রজেক্টে সহকারী হিসেবে ছিলেন। ১৯৫৬ সালে বাস্তুশিল্প নামে নিজের ফার্ম এর যাত্রা শুরু করেন। ১৯৮০ সালে Sangath নামে নিজের স্টুডিওর যাত্রা শুরু হয়। ১৯৭৮ সালে Vastu Shilpa Foundation for Study and Research in Environmental Design গঠন করে ভারতীয় সামাজিক ঐতিহ্য এবং লোকজ্ঞানকে কাজে লাগাতে মনোযোগী হন- ঠিক যেমনটা তাদাও আন্দো করেছেন তার চিন্তায় জাপানকে নিয়ে।বিশ্বের বহু নামীদামী সম্মাননা তিনি পেয়েছেন, পেয়েছেন ভারতের পদ্মশ্রীও। Royal Institute of British Architecture এবং American Institute of Architects এর ফেলো হিসেবে নিয়োজিত আছেন।
ফরাসি সাহিত্যিক, ছবি নির্মাতাদের সংযোগ-প্রভাব ভারতে আছে, সেটা কম বেশি সবাই জানেন। স্থাপত্যকলার ক্ষেত্রে সেটাকে ছড়িয়েছেন বালকৃষ্ণ দোশি। তিনি Le Corbusier এর দ্বারা প্রভাবিত এবং তাকে গুরু বলে মানেন।উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য লন্ডন এবং প্যারিসে যে সময় দোশি অতিবাহিত করেছিলেন সে সময়টাতে তিনি Le Corbusier এর সাথে কাজ করেছেন।Le Corbusier কে তিনি অনুসরণ করলেও, অনুকরণ কখনো করেননি। উৎসাহ- প্রেরণা- শিক্ষাই মূলত তিনি গুরুর কাছ থেকে গ্রহণ করেছেন।
তাঁর কাজের মাঝে ভারতীয় আধাত্ম্যবাদের প্রেরণার ছাপ স্পষ্ট দৃশ্যমান। স্থাপত্যকলা প্রথমত কবিতা বা ছবির চেয়েও বেশি জান্তব। সেখানে মূর্তের মধ্য দিয়ে বিমূর্তে কিংবা অধরায় যাত্রা বেশ কঠিন হলেও দোশির নির্মাণশৈলীতে তা যেন হয়ে উঠেছে সহজাত, স্বতঃস্ফূর্ত। বিশেষত তার শত কাজের মাঝে ভারতীয় কাজগুলো ভারতকেই উপস্থাপন করে।ব্যাংগালোরের ইন্ডিয়ান ইন্সিটিটিউট আহমেদাবাদের ইন্সুরেন্স বিল্ডিং এর জলন্ত প্রতীক।বালকৃষ্ণ বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পান ভারতের ৮০ হাজার গরীব মানুষের জন্য স্বল্প মূল্যের বসতি নির্মাণ করে।গরীবের ঘর আর গরীব রয়নি সেখানে, বেঁচে থাকার ‘সামাজিক সেতু’ হয়ে জীবনের না পাওয়ার বেদনাকে যৌথ আনন্দমহলে বাঙময় করে তুলেছে।
নিজ দেশ-প্রতিবেশ-ইতিহাস-ঐতিহ্য সবসময় যে কোনো ভাবনাকে ঋদ্ধ করে একই সাথে আন্তর্জাতিকও করে। বালকৃষ্ণদোশি ও তার সমসাময়িক চার্লস কেরো; এ স্থপতিও বেঁচে থাকতে বহির্বিশ্বে সুনাম কুড়িয়েছেন। কিন্তু সন্তের মানে নিজেকে উন্নীত করেছেন বালকৃষ্ণ। স্থাপত্য কলা ধনীদের আওতায় থাকে— এ রকম ভাবনার বাইরে গিয়ে প্রান্তিক মানুষের জন্য তারই উপকরণ এবং স্থানীয় জনপদের আধ্যাত্মিকতার প্রভাব পূর্ণমাত্রায় প্রকাশিত তার কাজে।
নোবেল বা অস্কার পাওয়া নিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো যেভাবে সরব থাকে অন্য কোনো বিষয়ে এমন কিছু থাকলেও না জানার কারণে হয়তো ততটাই নীরব থাকে। জীবন যাপনের আনন্দ, শিক্ষার আনন্দ হারিয়ে যায় যদি চিন্তার স্থূলতা আর অর্থ মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়।
স্থাপত্যকলার বিকাশ বাংলাদেশে না হওয়ার পিছনে খোদ স্থপতিগণের অনেকেই অর্থনৈতিক অবস্থার কথা বলেন। অন্য আট দশটা বিষয়ে যেমন রুটি রুজি এবং সামাজিক মর্যাদাকে কেন্দ্র করে নির্বাচিত করা হয় উচ্চ শিক্ষার জন্য স্থাপত্যকলাও তেমন । বরং বলা যায় স্থাপত্যকলা কিছুটা পিছিয়ে ! ঔপনিবেশিক প্রবণতার জন্য ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবো বোল যতটা সহজাত এ সমাজে ততটাই দূরে স্থাপত্যকলা । লক্ষ্য করবেন স্থপতি হবো – এটা বোল হয়ে ওঠেনি । এ বিপদের পাশাপাশি বিদ্যার ব্যাপ্তিহীনতার লয় ঘটতে পারে বলে বুয়েটে স্থাপত্যকলা বিভাগ খোলার বিরোধীতা করেছিলেন মাজহারুল ইসলাম , তিনি চেয়েছিলেন আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় । কিন্তু শিক্ষার বিউপনিবেশিক প্রবণতা সেটা হতে দেয়নি । আজকের দুনিয়াতে এর ব্যাপ্তিহীনতার ব্যাপ্তি বাড়ছে । ছোট্ট উদাহরণ হলো মিমিক্রি । জীব বিজ্ঞানের ছাত্ররা কি জানছে তাদের স্থাপত্যকলায় কতটা জরুরী? বিদ্যার প্রতিটি শাখার বিশেষায়িত জ্ঞানের পরিধি বাড়ার সাথে সাথে একে অপরের সাথে মালার মতো যুথবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা মনে হয় ঢের দূরে। যোগ-বিয়োগের হিসেব করতে করতে পাঁচ বছরে যা শিখছি তাতে আশার প্রদীপ আশানুরূপ আলো দিচ্ছে না । পদ্ধতি এবং কাঠামোগত ভাবে স্থাপত্যবিদ্যা পশ্চিমা বলয়ের ঠিক আছে , কিন্তু মানুষ হিসেবে আপনার বেড়ে ওঠা, বসবাসকে কিভাবে সুন্দর সহজাত প্রাণ ও প্রকৃতির সহায়ক এবং ঐতিহ্য’র সিলসিলার ধারক বাহক বানাবেন সেটা নির্ভর করবে জানা-বোঝা ধারণ করার ক্ষমতার উপর।
বেসরকারি বা সরকারি প্রতিষ্ঠানে শত শত স্থাপত্যকলার ছাত্রছাত্রী বেরিয়ে আসছে । প্রায় দু’হাজার স্থপতি ইন্সটিটিউট’র সদস্য রয়েছেন । অথচ এ বিষয়ে ‘ক্রিটিক’ তৈরী হয় নাই । যারা নাম-যশ কামিয়েছেন সব দায় তাদের উপর দেবার একটা প্রবণতা আমাদের আছে বৈকি।
স্থাপত্যকলা পড়লেই স্থপতি হবেন বিষয়টা ঠিক এমন নয়, বরং কেউ কেউ স্থপতি হয়ে ওঠেন মাত্র— দর্শনে পড়লে দার্শনিক হওয়া তো দূরের কথা দর্শনটাই রপ্ত করা বা ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারেন না। সামাজিকভাবে এ নিয়ে চিন্তার যতটুকু বিকাশ হওয়ার দরকার তা হয়নি। তার জন্য পশ্চিমা সবকিছুর ভেতর-বাহির দেখার ক্ষমতাও গরহাজির। মার্টিন হাইডেগারের ফেনোমেনোলজি কিভাবে স্থাপত্যবিদ্যার সপ্রতিভু হয়ে ওঠে; তাকে বোঝা,ক্রিটিক করা একইসাথে বাংলার বসত-ঘর নিয়ে সাধু মহাজনদের চিন্তার সাথে বর্তমানের যোগ স্থাপন কিভাবে হতে পারে- এসব স্থাপত্যকলার কারো কারো কাছে হাসির পাত্র হতে পারে।
বাংলাদেশের স্থাপত্যকলা যতটা নিরস টেকনিক্যাল, বাইরে ততটা নয়। স্থপতি রবিউল হুসাইনের পত্রিকার লেখাগুলোকে এক করে ১৯৮৫ সালে সন্দেশ প্রকাশনী বই আকারে বের করেছিল। সেখানে ঝাঁঝের তীব্রতা ও ইতিহাসের চপেটাঘাত কিছুটা টের পাওয়া যায়। স্থাপত্যকলায় আগ্রহীদের এই বইটা পড়া জরুরি।
বাংলাদেশে যারাই মোটামুটি নাম যশ খ্যাতি পেয়েছেন তাদের মাঝে মেরিনা তাবাসসুম ও কাসেফ মাহবুব চৌধুরী আগাখান পুরষ্কার পেয়ে আন্তর্জাতিক ভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
ট্র্যাডিশনাল মসজিদ স্থাপত্য থেকে বেরিয়ে এসে মেরিনা দারুণভাবে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। নিজের পৈতৃক ভিটাতে করা এ মসজিদ আলো-ছায়ার খেলা দেখার জন্য হলেও দেখা দরকার। বাংলাদেশে মসজিদে ঢোকার যে স্টাইলে আমরা অভ্যস্ত এটি সে অবস্থা থেকে স্বতন্ত্র। বাহির হতে একে বোঝার উপায় নেই। জাহেরে সাধারণ ইট দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এ স্থাপত্যে বাতেনে পাবেন রূপের বিভিন্ন দিক। অন্য দিকে কাসেফ মাহবুবের করা গাইবান্ধার ফ্রেন্ডশীপ সেন্টার আমাদের ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়া বৌদ্ধ বিহারে ফিরে আসা যেন ।
২০১৬ তে আগাখান পুরষ্কার একসাথে দুটো পুরষ্কার একই দেশে দু’জন স্থপতি পাওয়াটা প্রথম । এ উদযাপনটা জাঁকজমকের সহিত হলে এ নিয়ে আরো উদ্দীপনা তৈরি হতো।
উদযাপনের প্রশ্ন আসলে কিছু গলদ বেরিয়ে আসত। যেমন মেরিনা তাবসসুমের আগে কাসেফ মাহবুব চট্টগ্রামের চাঁদগাও বাহিরসিগনাল এলাকায় যে মসজিদটি করেন সেটি কমিশনড হয় ২০০৭ সালে; এটি বাংলাদেশের প্রথম মসজিদ মিনার ও গম্বুজ ছাড়া , আবার হার্ভার্ডের লেকচার বা অন্য কোথাও তাবাসসুমের বক্তব্য শুনলে বুঝবেন না যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জাদুঘর ও কাঁচের টাওয়ার একটি যৌথ কাজ। আরো ছোট কিছু অসংগতি এ স্থপতি করেছেন , কাজের ক্ষেত্রে হয়তো এসব মৌলিক সমস্যার কারণ বলে চিহ্নিত হবে না কিন্তু সেক্ষেত্রে হয়তো তাদাও আন্দোর মতো একজন স্থপতির জন্ম বিলম্বিত হবে যিনি বলবেন আমার স্থাপত্য হলো ধ্যান ও কবিতা।
সাইফুল হক, রফিক আজম, মুস্তাফা খালিদ এরকম যারা কাজ ও সুনাম কুড়িয়েছেন তাদের কাজ নিয়ে কোনো ‘ক্রিটিক’ হাজির নাই। যার প্রভাব লজ্জার কারণ হয়। বছরখানেক আগে বালকৃষ্ণ বেঙ্গল আর্কিটেকচারের অনুষ্ঠানে এসে লেকচার ও প্রশ্নোত্তরের লম্বা আয়োজনে ছিলেন। সেখানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মত। কিন্তু প্রশ্নপর্ব ছিল ততটাই দুর্বল ও নিষ্প্রভ। কেন? কারণ নিজের গণ্ডির বাইরে আলোচনার অভাব। ইউটিউবে বাংলাদেশের স্থাপত্য জগতের মজহারুল ইসলামের উপর ডকুমেন্টারির ভিউজ সংখ্যা দেখলে চোখ কপালে উঠবে। আবার বালকৃষ্ণের বেঙ্গলের অনুষ্ঠানের ভিউজও কম— মন্তব্য তো নাই, এ নিয়ে বালকৃষ্ণর নাতনী বিস্মিত হয়ে মন্তব্যও করেছিলেন। বিষয়টা এমন না যে এখানে মন্তব্য বা ভিউজ না থাকার মানে বাংলাদেশের স্থাপত্য চিন্তার বিকাশ ঘটছে না। কিন্তু আদতে কী ঘটছে তা জানার জন্য রবিউল হুসাইনের ( বাংলাদেশের স্থাপত্য ভাবনা )১৯৮৫ সালের সেই আক্ষেপ সমগ্র হতে কতটুকু এগিয়েছে বাংলাদেশ?