বিয়ের তেরোতম রাত — ষোল বছরের মান্নুরাম চিডিমার তার পনের বছর বয়সী বউ সোনাবতীর দিকে পিঠ ফিরিয়ে শুয়ে আছে। সোনাবতীর সাথে তার রাত্রিযাপন প্রেমঘন নয় বরং যন্ত্রণাদায়ক, আনন্দদায়ক নয় বরং কষ্টকর হয়ে উঠেছে।
মান্নুরাম জানে না সোনাবতীর কেমন লাগছে, কিন্তু তার একটুও ঘুম আসছে না। মনে হচ্ছে যেন জানালা আর দরজা দিয়ে, কারা যেন তাদের দেখছে। বিব্রত বোধ করে সে। মনে হচ্ছে যেন সে জীবনের কঠিন কোনো পরীক্ষায় বসেছে।
এরকম পরিস্থিতিতে সে ফিরে দেখে গত তেরোটি রাতের পথ, যা সে পেরিয়ে এসেছে।
***
মান্নুরাম জানতই না যে তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। যখন তার বয়স সাত বছর, তার চল্লিশ বছর বয়সী কাকী ভারতের নাকাহা-বরদহা এলাকায় গিয়েছিলেন মান্নুরামের জন্য ছয় বছরের সোনাবতীর পাণি গ্রহণের জন্য। প্রথমে কথা বলেন সোনাবতীর সত্তর বছর বয়সী দাদার সাথে, তারপর তার পঁচিশ বছর বয়সী বাবার সাথে। সবাই রাজি হয়ে যায়। আর মান্নুরাম – অনেকটা সময় পেরিয়ে তবেই জেনেছিল যে সে বাগ্দত্ত।
সম্ভবত সোনাবতীও অনেক পরে জেনেছিল। মান্নুরাম যখন জেনেছিল, তখন সে এমন ভাব করেছিল যেন কিছুই জানে না। সে কাউকে, এমনকি তার বাবা-মার কাছেও অভিযোগ করেনি যে কেন তাকে আগে জানান হয়নি।
***
একদিন বিকেলে গ্রামের সবচেয়ে পুরনো পিপল গাছের নিচে বন্ধুদের সঙ্গে খেলা শেষে, বসন্তের হাওয়ায় শিস বাজাতে বাজাতে মান্নুরাম যখন বাড়ি ফিরছিল, তার বাবা রামফেরান তাকে হাসিমুখে ডাকলেন। তার বাগ্দানের পরে দুই বছর কেটে গেছে — নয় বছরের মান্নুরাম দেখল, বাবার চোখে-মুখে খুশি। কাঁধে হাত রেখে রামফেরান বললেন, “বাবা, কাল তোর বিয়ে। এখন তুই বর হবি, বুঝলি?”
“এতদিন আমি কী ছিলাম, বাবা?” মান্নুরাম জিজ্ঞেস করল নিষ্পাপভাবে।
“এতদিন শুধু ছেলে ছিলি মান্নুরাম, এখন তুই বর হবি।”
“বর হলে আমি কি আর তোমার ছেলে থাকব না, বাবা?”
“ছেলে তো সব সময়ই থাকবি। কিন্তু কে জানে, সব সময় বর থাকতে পারবি কিনা? ”
মান্নুরাম জানত, বর হলে নতুন জামাকাপড় পরা যায়, তাই সে বেশ খুশি হয়েছিল। তার বন্ধুরাও খুশি হয়ে বলল, “মান্নুরাম, আমাদেরকে তোর বিয়েতে খাওয়াবি না?”
সে বলল, “খাওয়াবো না কেন? কালই তো আমার বিয়ে। এসে খেয়ে যাবি।”
সবাই এসেছিল। ভালো খাওয়া পেয়ে তারাও খুশি হয়েছিল। তাদের খুশিতে মান্নুরামের আরও ভালো লাগল।
তখনকার কথা মনে পড়ে — তার বাবা যখন বরযাত্রী নিয়ে গেলেন বউ আনতে, সঙ্গে পাঁচ কেজি মাছ আর মিষ্টি নিয়েছিলেন। তবে তার বাবা মাছ কেন নিয়েছিলেন, সে জানে না। শুধু জানে এটাই নিয়ম। আরও একটা জিনিস সে জানে যে মাছ জল ছাড়া বাঁচে না। বোধহয় জলে সব সময়ই স্নান করতে থাকে, আর তাই জল থেকে তুললেই গায়ে দুর্গন্ধ হয়। মাছের গন্ধ তার ভালো লাগে না, তাই খেতেও ভালো লাগে না। শুধু যখন মাছেরা জলে সাঁতার কাটে, তখন দেখতে ভালো লাগে।
মান্নুরাম চিডিমার সম্প্রদায়ের, যারা পাখি শিকার করে। তবে সে কখনও একটি পাখিও মারেনি। তার ভালো লাগে পাখির ডাক আর তাদের ওড়াউড়ি। মান্নুরাম জানে তার বাবা পাখি শিকার করেন। তবে আজকাল জঙ্গল কমে গেছে, তাই পাখিও খুব কম।
তার মনে পড়ে, বিয়েতে শ্বশুরবাড়ি থেকে সে পেয়েছিল পাঁচটি পিতলের থালা, একটি কলসি, দুটি গ্লাস, আর এক সেট নতুন জামাকাপড়। নতুন কাপড় পেয়ে সে খুব খুশি হয়েছিল। কিন্তু তার বউ সোনাবতী কাঁদছিল। সে ভাবছিল, কী করে সোনাবতী জানল যে কনেরা কাঁদে?
ঘরে ফিরে বিয়ের বেদীতে বসে থাকার কথা মনে পড়ে। সাত বছরের সোনাবতী তার পাশে বসেছিল, ঘোমটায় ঢাকা। সোনাবতী তখন আর কাঁদছিল না, শুধু বিদায়ের সময় একটু কেঁদেছিল। মান্নুরামের আশেপাশে ছিল অল্প কয়েকজন বরযাত্রী, আর অনেক পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন। পুরুতঠাকুর কোন একটা দুর্বোধ্য মন্ত্র পাঠ করছিলেন — কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। সে যেন পুরুতের নির্দেশ ঠিকমতো অনুসরণ করতে পারে সেজন্য তার বাবা রামফেরান পাশেই বসেছিলেন।
ফাগুনের হালকা শীত আবার নেমে এসেছিল রাত্রির সঙ্গে। কিন্তু নতুন জামাকাপড় পরার কারণে মান্নুরামের ঠান্ডা লাগছিল না। বেদীর আগুনের তাপে তার ঘুম পেয়ে যাচ্ছিল। তার বাবা ধাক্কা দিয়ে বলেছিলেন, “ছেলে দ্যাখ, এই তোর বউ। জেগে ওঠ, বাবা, নিজের বিয়েতে ঘুমাতে নেই।”
মান্নুরাম জেগে উঠার ভান করে। তারপর চোখ রাখল নববধূর দিকে — এটাও ভানই। তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়ল। তার মধ্যে বরের চোখই ছিল না। সে ভাবল, বর হওয়া সহজ নয়। ঠিকমতো ঘুমানও যায় না।
সোনাবতীও বেদীতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। তার মা তাকে জাগানোর চেষ্টা করছিলেন। তিনি চাচ্ছিলেন তার মেয়ে যেন নিজের বিয়ের দিনটা ভুলে না যায়। ডেকে বলছিলেন “দ্যাখ মা, ওই তোর বর, তোর দেখাশোনা করবে, যার সঙ্গে সারাজীবন কাটাবে। তার জন্য একটু জেগে ওঠ!”
কিন্তু সোনাবতীরও ছিল না কনের দৃষ্টি। সেও চোখ খুলে সঙ্গে সঙ্গে আবার ঘুমিয়ে পড়ছিল।
মান্নুরামের সামনে ছিল বেদি, পুরুতঠাকুর, আত্মীয়-স্বজন আর পাড়াপড়শি। কয়েকজন বন্ধু এসেছিল, তারাও ছিল। সবাই জেগে ছিল। তবু তারই কেন এত ঘুম পাচ্ছিল? নববধূও ঘুমোচ্ছে। কনে আর বর ঘুমোবে, না জেগে থাকবে—এ নিয়েও কোন নিয়ম ছিলও কিনা তার ঠিক জানা ছিল না। তবে বন্ধুরা যে তাকে নিয়ে ঠাট্টা করেছিল, সেটা মনে পড়ল। মাঝে মাঝে সে হাসছিল। হাসতে হাসতে বাবার হাত ধরে পুরুতের কথা মেনে চলছিল — কখনো জেগে, কখনো আধোঘুমে।
এসব কি হচ্ছে? সে বুঝতে পারছিল না। সবাই বলল, এটাই বিয়ে। কিন্তু বিয়ে মানে কী? কেন বিয়ে করতে হয়? তার মনে পড়ল, শ্বশুরমশাই তার পা ধুয়ে দিয়েছিলেন। শ্বশুরমশাইয়ের মুখে যেন নিজের বাবার বয়সটা দেখতে পেয়েছিল। সে জানত না, শ্বশুর মানে কী। মা সাধারণত তার পা ধুয়ে দিতেন। কখনো-সখনো বাবা। এই অচেনা মানুষটা কেন তার পা ধুচ্ছেন? তার হাতে একটা তামার কড়ি তুলে দিলেন শ্বশুরমশাই। যেমন ঠাকুরের পায়ে দেওয়া হয়। এমন করে দেবতা হিসেবে কেন তাকে দেখছে?
সেই রাতে অনেক তামার কড়ি পড়েছিল তার হাতে। এত টাকা সে আগে কখনও ছুঁয়ে দেখেনি। পুরুতের মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যে, বাবার হাত ধরে সোনাবতীর হাত রাখা হল তার হাতের ওপর। তার ওপর রাখা হল তিলৌজ, কয়েকটা কড়ি, একটা সুপারি, আর কী কী যেন। সেই প্রথম মান্নুরাম ছুঁয়ে দেখল সোনাবতীকে। স্পর্শটা একটু ঠান্ডা ঠান্ডা লেগেছিল।
যদিও মান্নুরামের ঘুম আসছিল বারবার, তবু বন্ধুদের ঠাট্টা করছিল, আর নতুন জামা-কাপড় সে উপভোগ করিছল। সোনাবতী ঘোমটার আড়ালে কী করছিল, সে জানত না। জানার ইচ্ছেও ছিল না। বিয়ের কথা স্পষ্ট মনে নেই। শুধু এটুকু মনে আছে যে বিয়ে হয়েছিল। সেই নিয়ে তার মনে কোনও সন্দেহ নেই। বিয়ের পরে, যেন সবকিছু ভুলেই গেল।
সে বুঝেছিল, বিয়ের পরেও বর-কনে আলাদা আলাদা বাড়িতে থাকে। সোনাবতী দু’দিন ছিল তাদের বাড়িতে, কিন্তু তার মুখ দেখেনি। মনে পড়ে না, কথা বলেছিল কিনা। এখন সব মনে করার চেষ্টা করে, মনে করতে পারে, সে সোনাবতীর সাথে একটাও কথা বলেনি।
***
চার বছর পরে মান্নুরামের মনে পড়ে যায় গৌনা অনুষ্ঠানের কথা। তাকে কিছু না জানিয়ে, বাবা আর আত্মীয়স্বজন গৌনা অনুষ্ঠানের জন্য শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলেন পাঁচ কেজি মাছ, মিষ্টি আর সোনাবতীর জন্য একটা শাড়ি, ব্লাউজ আর কিছু টিপ নিয়ে। ওরা রওনা হওয়ার পরে এসব জানতে পেরেছিল তার মা, পবিত্রার মুখে।
বিয়ের সময় তেরো বছর বয়সে মান্নুরাম যে নতুন জামাকাপড় পেয়েছিল, সেইগুলো ততদিনে ছোট হয়ে গেছে। গায়ের পুরোনো, ছেঁড়া জামা দেখিয়ে সে মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “আমা, গৌনাতে কি নতুন জামা পাওয়া যাবে?”
পবিত্রা হেসে বলেছিলেন, “তোর শ্বশুর যদি পাঠায়, তবে পাবি।”
সে বুঝে নিয়েছিল, এখন থেকে নতুন জামাকাপড় দেবে তার শ্বশুর, বাবা নয়। তারপর আর কিছু চিন্তা করেনি। ছুটে গিয়েছিল পাড়ার সবচেয়ে পুরনো পিপুল গাছটার নিচে, বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে। ফিরে এসে দেখে, মা যাঁতায় শস্য ভাঙছেন। তিনি বললেন, “তোর বাবা কাল সোনাবতীকে নিয়ে আসবে। সাথে তোর শ্বশুরবাড়ির লোকেরাও আসবে, আবার সোনাবতীকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।”
বিয়ের কথা মনে ছিল, কিন্তু সোনাবতীকে মনে করার চেষ্টা করলে চোখের সামনে ভেসে উঠত শুধু ঘোমটার আড়ালের এক আবছা অবয়ব। চেহারাও মনে পড়ত, যদি দেখত। আর দেখত, যদি ইচ্ছে করত। কিন্তু চেহারা দেখার কোনও আগ্রহই তার ছিল না।
বাবা তাকে না জানিয়ে গৌনাতে গিয়েছেন, এতে অবশ্য তার খারাপ লাগেনি। তাকে নিয়ে যেতে চাইলেও সে যেত না। ভাবছিল, বাবা মাছ-মিষ্টি-জামাকাপড় নিয়ে গেলেনই বা কেন। নিজের পেটের ওপর হাত রেখে, নিজের ছেঁড়া জামাকাপড়ের দিকে তাকাল একবার। তারপর মন চলে গেল সকালের যবের ছাতু দিয়ে নাস্তা করার কথায়।
পরদিন বাবা আর আত্মীয়রা সোনাবতীকে বাড়ি আনলেন। শ্বশুরবাড়িরও দুই-তিনজন আত্মীয় এসেছিলেন। তার মনে আছে, গৌনার জন্য সত্যনারায়ণ পুজো হয়েছিল। আরও মনে আছে—রীতিমতো, ঘরে ঢোকার সময় ছোট বোন সোনাবতীর পথ আটকে দাঁড়িয়েছিল।
সোনাবতী সেবার দু’দিন ছিল। তৃতীয় দিনে তার দাদাভাই এসে নিয়ে গেল। এই দুই দিনে মান্নুরাম সোনাবতীর সাথে একটা কথাও বলেনি। সোনাবতীও কিছু বলেনি তাকে। সে কথা বলেছিল জামাইবাবুর সঙ্গে। কী কথা হয়েছিল, মনে নেই।
এই দুই দিনেও মান্নুরাম খেয়াল করেনি, সোনাবতী খেয়েছে কিনা, কোথায় ঘুমিয়েছে, আদৌ ঘুমিয়েছে কিনা। যা কিছু করণীয় ছিল, সব করেছে তার মা-বাবা।
সোনাবতীও তার দিকে কোনও খেয়াল ছিল না। বয়সে এক বছর ছোট হলেও সোনাবতীকে যেন অনেক বড়ো মনে হচ্ছিল।
মা বলেছিলেন, “মেয়েরা তাড়াতাড়ি বড়ো হয়ে যায়।” আর দিদি বলেছিল, “শাড়ি পরলে মেয়েদের বড়ো দেখায়।”
***
গৌনার দেড় বছর পর ঠৌনা হল। এইবার মান্নুরামের বাবা নয়, পিসি গেলেন সোনাবতীদের বাড়ি। এবারো তাকে কিছু বলা হয়নি। কে জানে, বাবা কীসব কথা দিয়েছিলেন। মিষ্টি পাঠানোর কথা একদিন যেন মুখে বলেছিলেন, নিশ্চয়ই পাঠিয়েছিলেন। কেন তাকে বলা হল না, বা কেন তাকে সঙ্গে পাঠানো হল না — এমন প্রশ্ন কোনোদিন মনে জাগেনি।
মনে আছে, পিসি ফিরেছিলেন —সঙ্গে ছিল আধা বস্তা ধান। শ্বশুরবাড়ি থেকে তার জন্য নতুন জামাকাপড়ও এসেছিল। সোনাবতীও এসেছিল পিসির সঙ্গে। তাকে অনেক বড়ো মনে হচ্ছিল। অদ্ভুত লাগছিল বাড়িতে ওর সাথে থাকা। তাই না চাইতেও ছুটে গিয়েছিল পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে খেলতে। বন্ধুরা মজা করেছিল “তোর বউ এসে গেছে, হ্যাঁ?” সে হেসে বলেছিল, “হ্যাঁ।”
বন্ধুরাও তখন বিয়ের নানা পর্যায়ে। কারও গৌনা হয়েছে, কারও ঠৌনা। শুধু লালজি আর নাইকুকোর বাগদান হয়েছিল – তখনো বিয়ে হয়নি।
সোনাবতী সেইবার সাতদিন ছিল। রাতের বেলা সে ঘুমোত মান্নুরামের মায়ের সঙ্গে। আর মান্নুরাম, আগের মতোই, বাবার পাশে। সপ্তম দিনে সোনাবতীর মা এসেছিলেন তাকে নিয়ে যেতে। এইটুকুই মনে আছে।
***
ঠৌনার এক বছর পরে এল আলোছালা আনুষ্ঠানিকতার পালা। আলোছালার পর সোনাবতী মান্নুরামের বাড়িতে থাকা শুরু করল। বাড়িটা ছোট—ছনের ছাউনি, একটিমাত্র ঘর, কোণেই রান্নাঘর। মান্নুরাম তখনও বাবার সঙ্গেই ঘুমাত, আর সোনাবতী, আগের মতোই, মায়ের পাশে।
বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন সবাই বহুবার বুঝিয়েছিলেন যে সোনাবতীই তার বউ। কিন্তু সে কিছুই বুঝত না। বউ কী করে হয়? এই প্রশ্নটা তার মনে গেঁথে রইল। সোনাবতী যদি বোঝাত, হয়তো বুঝতো। কিন্তু সোনাবতীও কিছু বলেনি। সে নিজেও যেন আরও বেশি বিভ্রান্ত।
মান্নুরাম সোনাবতীর সঙ্গে কথা বলে না দেখে বাবা রামফেরান কেমন যেন অস্বস্তি অনুভব করলেন। তার নিজের কৈশোরের কথা মনে পড়ে গেল। সে যখন ষোলো, পবিত্রা তখন মাত্র পনেরো— তখনই তাদের কোলজুড়ে কন্যা এসেছে।
মা পবিত্রাও ভাবলেন, এ কী রকম ছেলে! তার বউ-ও ঠিক তেমনি বোকা। তবু মনে মনে ভাবলেন, বয়স হলেই একদিন বুঝবে। কিন্তু তিন-চার মাস কেটে গেল, ছেলের মধ্যে কিছুই পরিবর্তন এল না।
পবিত্রা মান্নুরামকে এড়িয়ে চলতে শুরু করলেন; মান্নুরাম পানি চাইলে বলতেন, “তোর বউকে বল।” খেতে চাইলে বলতেন, “ওর কাছেই চাস। আমার কাছে কিছু চাওয়ার দরকার নেই। যা লাগবে, সব ওর কাছেই চাস।”
অবস্থা এমন দাঁড়াল যে, মান্নুরাম যখন মায়ের কোলে মাথা রাখত, মা বলতেন, “যা, তোর বউয়ের কোলে গিয়ে শুয়ে থাক।” কিছু বললে শুনতে হতো, “তোর বউয়ের সঙ্গে কথা বল। খিদে পেলে তাকেই বলবি।”
একদিন পবিত্রা তাকে ডেকে খুব গম্ভীরভাবে বললেন, “তোর বউকে দেখে পালাস কেন? একসঙ্গে বসে থাক, কথা বল।”
সে রেগে উঠে বলল, “তুমি কার মেয়ে এনে রেখেছ, আমা? আমি কী বলব তাকে? কেমন করে বলব?”
মা বললেন, “বোকা ছেলে, ও তোর বউ! তোদের একসাথে জীবন কাটাতে হবে।”
“কেন সে আমার বউ?”
“একসাথে থাকলেই বুঝবি।”
“কেন একসাথে থাকব?”
“ও সব সময় তোর সাথেই থাকবে।”
“ওর মা নেই?”
“মা মারা গেছে, শুধু বাবা আছে।”
“তাহলে সে তার বাবার সঙ্গে কেন থাকে না, আমাদের এখানে কেন?” পবিত্রা আর কিছু বললেন না। রান্নাঘরে চলে গেলেন। চলে যেতে যেতে বললেন, “এখন থেকে যা বলার, বউকেই বলবি। যা চাই, ওর কাছেই চাস।”
মান্নুরাম একা দাঁড়িয়ে রইল। হতবুদ্ধি হয়ে। দেখল, পেছনের আঙিনায় সোনাবতী ছোলা তুলছে। মা বলেছিলেন, “যা লাগবে, বউয়ের কাছেই চাস।”
সে তাকিয়ে ভাবল, ওর কাছে কী আছে যা ওর কাছে চাওয়া যায়? ছোলা ছাড়া কিছুই তো নেই।
ছোলা চাইবে কিনা ভেবে আবার চুপ করে গেল।
ওর সঙ্গে কোনোদিন কথা বলেনি— এখন হঠাৎ করে কীভাবে বলবে? চাওয়ার জন্য তো কথা বলতে হয়। কিন্তু দেওয়ার জন্য লাগে না। ভাবতে ভাবতে মনে হল, চাওয়ার চেয়ে দেওয়া অনেক সহজ।
***
একদিন হঠাৎ, বিশেষ কোনো কারণে, বাবা বললেন, “মান্নুরাম, চল্ ঘরের সামনে একটা নতুন ঘর বানাই।”
“কেন, বাবা?”
বাবা বলতে চাইলেন, কিন্তু বললেন না যে তোর এখন আলাদা ঘর দরকার। শুধু এটুকু বললেন, “ঘরটা ছোট হয়ে গেছে। একটা আলাদা রান্নাঘরও করব। বুঝলি তো?”
এক মাসের মধ্যে ঘরটা দাঁড়িয়ে গেল। কাঁচা ইটের দেওয়াল, ছাউনি খড়ের। সব কাঠের কাজ বাবাই করলেন। দু’টা ছোট জানলা বানালেন, একটা দরজা দিলেন। দরজায় ছিটকিনি লাগালেন— ভেতর থেকেও খোলা যায়, বাইরে থেকেও। ঘরে একটা খাট পাতা হলো, তার উপর বিছানা। তারপর থেকে বাবা আর তাকে নিজের সঙ্গে শুতে দিলেন না। বললেন, “মান্নুরাম, এই ঘরটা তোর জন্য। এই খাটটাও তোর। শুধু তোর নয়, তোর বউয়েরও। তুই আর আমার সাথে শুতে পারবি না। আর তোর বউও, তোর মায়ের সঙ্গে আর থাকবে না।”
মান্নুরামের মুখে অস্বস্তির ছায়া ছড়িয়ে পড়ল।
“আমি ওর সঙ্গে ঘুমোব কেন?”
রামফেরান কড়া গলায় বললেন, “সে তো তোর বউ।”
বউ বলেই কি তার সঙ্গে ঘুমোতে হবে? মান্নুরাম হতবুদ্ধি। তবু বাবার সামনে কিছু বলার সাহস হলো না। একটুখানি লজ্জাও লাগছিল যেন। হয়তো একটু-একটু করে সে বুঝতে শুরু করেছে—বউ কথার মানে কী।
মা বুঝিয়ে বললেন, “সে তো তোর দিদি নয়, ছোট বোনও নয়। শালি নয়, নয় বউমা। সে তোর বউ।”
সে জানে দিদি কাকে বলে, বোন কাকে বলে।
শ্যালিকা বোঝে, বউমাও বোঝে। কিন্তু বউ—সে তো কিছুতেই বুঝতে পারে না। সোনাবতীকে বউ বলে ডাকতে তার বাঁধে। কেন বাঁধে, তাও বোঝে না। ঘোর বিভ্রান্তিতে মা-কে জিজ্ঞেস করল,
“তুমি তো বলো, ওকে জিজ্ঞেস করতে—
জল চাই, কিছু খেতে দাও, খাবার রেঁধেছ কি না।
কিন্তু কে ও? ওকে কেন সব জিনিস চাইতে যাব আমি?”
“সে তোর বউ।”
“দিদি মানে বড়, আর ছোট বোন, ছোট। বউ কেমন হয়?”
“কথা বললেই বুঝবি।”
“কী বলব?”
“বোকা! বল, খিদে পেয়েছে, খাবার হয়েছে?”
***
বউ মানে কী, তা জানার জন্য সে গেল সোনাবতীর কাছে। সে তখন নতুন রান্নাঘরে, হাঁড়িতে কিছু একটা তুলছে। মান্নুরাম দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ। কিছুই করতে পারল না।
মা যে কথাগুলো ধার দিয়ে দিয়েছিল—
“আমার খিদে পেয়েছে, খাবার হয়েছে?”
একেবারে ঠিকঠাক লাগছিল সেগুলো, তবু মুখ ফুটে কিছুই বলতে পারল না। একভাবে দাঁড়িয়েও থাকতে পারল না। চুপচাপ ফিরে এল উঠোনে।
এইসবের কিছুই তো বাবা-মা আগে বলেনি। তারা শুধু বলেছিল, বাড়ি ছোট হয়ে গেছে।
ঘরটা তৈরি হওয়ার পরেই হঠাৎ বাবা জানালেন— তাকে এখন থেকে বউয়ের সঙ্গে ঘুমোতে হবে। এটা শুনে চমকে গিয়েছিল মান্নুরাম। তাহলে এত বছর কেন বাবা তার সঙ্গে ঘুমোতে দিয়েছিলেন? এখন হঠাৎ করে কেন না? আর মা-ই বা কেন হঠাৎ করে সোনাবতীকে নিজের পাশে ঘুমোতে না দিয়ে দূরে ঠেলে দিলেন, যখন চার-পাঁচ মাস আগেও তিনি ওকে নিজের পাশে থাকতে দিতেন?
পনেরো বছর বয়স হলেও, মান্নুরাম বাবার সঙ্গেই ঘুমোতে ভালোবাসত। সে ভাবছিল, মা-বাবা কীভাবে তাদের নিজের ছেলেমেয়েকে নিজেদের উষ্ণ বন্ধন থেকে সরিয়ে দিতে পারে? মনে হচ্ছিল, একটা মিষ্টি স্বপ্নের মাঝখানে, বাবা যেন তাকে বিছানা থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছেন, আর সে পড়ে গেছে ঠান্ডা মেঝেতে। তবু, কোথাও একটা… গভীর ভিতরে, সে নিজের বয়সটা নিয়ে লজ্জাও পেত। একধরনের সংকোচে থাকত, কেমন একটা অস্বস্তি।
সে আবার ফিরে গেল রান্নাঘরে। সোনাবতী তখনও ওখানেই ছিল। মা তো আর এখন খাওয়ায় না।
তবে কিভাবে সে সোনাবতীকে বলবে, “খেতে দাও”?
কিন্তু সে কিছু বলার আগেই, সোনাবতী নিজেই থালা সাজিয়ে তার সামনে খাবার রেখে দিল। না বলেই খাবার পেয়ে খুব স্বস্তি পেল মান্নুরাম। তবু, কোথাও একটা অস্বস্তি থেকেই গেল। তবে সে খুশি, কারণ তাকে কিছু বলতে হয়নি। আর তার খাওয়ার ধরণ দেখে, সে যে আরও চাইছে, সেটা বুঝে ফেলল সোনাবতী। নিঃশব্দে তার পাতে আরও খাবার তুলে দিল।
***
এই প্রথমবার, তাদের একই ঘরে, একই খাটে শুতে হলো। সন্ধ্যা নেমে এলো। খাওয়া-দাওয়ার পর, সে নিজের ঘরে যেতে পারল না। ঘরে সবাই দেখবে— পাশের বাড়ির লোক দেখবে। সবাই ভাববে, ওরা যেন কী একটা অন্যায় কাজ করতে চলেছে। কী লজ্জার ব্যাপার! সে বন্ধুদের বাড়ি পালিয়ে গেল।
রাত প্রায় এগারোটা নাগাদ সে ফিরল, যখন নিশ্চিত হয়ে গেল, সবাই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাড়ি নিস্তব্ধ। বিড়ালের মতো চুপিচুপি হাঁটতে হাঁটতে সে উঠোন থেকে বারান্দায়, বারান্দা থেকে নিজের ঘরে ঢুকল।
কেরোসিনের বাতিটা তখনও জ্বলছে। সোনাবতী দেয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে আছে, খাটের একেবারে প্রান্তে, যেন পড়ে যাবে আর একটু হলেই। সে দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ। চিরকাল তো আর দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। বাতিটা নিভিয়ে দিল। তারপর সোনাবতীর মতো, সে নিজেও খাটের এক পাশে বেঁকে শুয়ে পড়ল।
অনেকক্ষণ ঘুম এল না, ভয় হচ্ছিল যদি ভুল করে সোনাবতীর গায়ে হাত লেগে যায়! কখন সকাল হবে সেই অপেক্ষায় সে ছটফট করতে লাগল। দরজাটা সে বন্ধ করেনি। বন্ধ করলে মা-বাবা ভাবত, ওরা যেন নোংরা কিছু করছে! ভাবল সকালে সবার আগে ঘুম থেকে উঠলে কেউ কিছু মনে করবে না। শেষ পর্যন্ত ঘুমহীনতার ক্লান্তিতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল, টেরই পায়নি।
সকালে আতঙ্কে ঘুম ভেঙে দেখল সোনাবতী বিছানায় নেই। ভাবল, আর একটু ঘুমিয়ে নেয়— তারপরই মনে পড়ল, তাহলে মা-বাবা কী ভাববে? এ যেন চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়া চোরের মতো! তাই তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল, আর নিজেকে কাজে ব্যস্ত করে তুলল।
***
এইভাবে বারো রাত কেটে গেল। এই বারো রাত যেন তার কাছে বারো বছর। একসাথে ঘুমিয়েও, সোনাবতীর কোনো স্পর্শ সে পায়নি। তার কাছে সোনাবতী এখনও যেন এক, অচেনা কারো মেয়ে। এটুকু সে বুঝেছে যে সোনাবতী এখন তার সঙ্গেই থাকবে। কিন্তু আজও সে বুঝে উঠতে পারেনি, একজন ‘বউ’ আসলে কে!
এই চিন্তাভাবনা নিয়েই, তেরোতম রাতেও সে আগের মতোই সবাই ঘুমিয়ে পড়লে নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে পড়ল, দরজাটা যেমন খোলা ছিল, খোলাই রাখল। সোনাবতী ঘুমিয়ে আছে কিনা, তা সে বুঝতে পারল না।
প্রতিদিনের মতো সোনাবতী খাটের একেবারে ওদিকে, একদম নিথর হয়ে শুয়ে আছে। মান্নুরাম অস্থির হয়ে উঠল। খাট ছোট ছিল— অস্থির হয়ে নড়াচড়া করতেই হঠাৎ ভুল করে সোনাবতীর গায়ে গা লেগে গেল। স্পর্শ হতেই তার শরীরের ভেতর কোথা থেকে যেন এক অজানা আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল।
সে আবার একটু নড়তে চাইল— কিন্তু তার আগেই সোনাবতী নিজেই একটু নড়ে উঠল। এবার স্পর্শটা একটু দীর্ঘ হলো। আরও একবার সেই আনন্দটা তাকে ছুঁয়ে গেল— আরও গভীর, আরও স্পষ্ট।
যদিও তারা কিছু না বলেই কথা বলছিল, দু’জন শরীরের নড়াচড়ার মধ্যেই একটা নিঃশব্দ আনন্দ ছড়িয়ে ছিল, তবুও হঠাৎ, কে জানে কেন, মান্নুরাম ফিরে শুয়ে পড়ল খাটের একেবারে কিনারায়। আরও দূরে সরে যেত যদি খাটে আর জায়গা থাকত।
এখন সে ঘুমোতে চাইছে, কিন্তু ঘুম আসছে না। মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে। হঠাৎ বিয়ের বেদির কথা মনে পড়ে গেল— সেই যে বিয়ের মঞ্চেই সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ভাবতে ভাবতে নিজের অজান্তেই হেসে ফেলে। সে যদি তখন না ঘুমাত, তাহলে হয়তো এখন ঘুম এসে যেত।
ঠিক যেই মুহূর্তে ঘুম আসতে যাচ্ছে, কী যে হয় তার, সে নিজের তর্জনী দিয়ে সোনাবতীর পিঠ বেয়ে আলতো করে একটি রেখা টেনে দেয়। তারপর সঙ্গে সঙ্গেই হাত সরিয়ে নেয়— যেন কোনো অপরাধ করে ফেলেছে। হাতটা গুঁজে রাখে দুই উরুর মাঝখানে। কিছুক্ষণ পর, সোনাবতীও নিজের তর্জনী দিয়ে সেই ছোঁয়ার জবাব দেয়। সে হেসে ফেলে— এ যেন দুই তর্জনীর মধ্যেকার এক চুপিচুপি লেখা ভাষার সংলাপ।
এই ছোঁয়ার ফিসফিসে কথোপকথন চলতে থাকে। এবার আর শুধু তর্জনী নয়— সে মাঝের আঙুলও ব্যবহার করে। প্রথমে সে পিঠে ছোঁয়, তারপর এগিয়ে যায় পেটের দিকে। সোনাবতী কেঁপে ওঠে। তারপর মান্নুরাম নিজেও। এই নড়াচড়ার মধ্যেই তাদের শরীর একে অপরের গায়ে লেগে যায়। সোনাবতী আবার তার ছোঁয়ার জবাব দেয় নিজের মতো করে। এবার মান্নুরাম চারটে আঙুল দিয়ে পেটের ওপর, আর একটু ওপরে, বুকের কাছাকাছি ছোঁয়। সোনাবতী এই ছোঁয়াটাও ফিরিয়ে দেয়। ধীরে ধীরে ভয়ের চেয়ে উত্তেজনাই বেশি অনুভব করতে থাকে মন্নুরাম। সোনাবতীও যেন শিহরণে শিউরে উঠছে। তবুও, তারা দু’জনেই এখনও একে অপরের দিকে মুখ করে শোয় না।
একসময় সে মোরগের ডাক শুনতে পেল। আগে এই ডাক শুনে তার শান্তি লাগত— কিন্তু এখন বিরক্ত লাগছিল, মনে হল যেন মাঝখানে কোথাও সে আটকে গেছে।
সোনাবতী উঠে পড়ে। তারপর মান্নুরাম, সে তার মা-বাবার জেগে উঠার আগেই উঠে পড়ে। মান্নুরাম এখনও জানে না সোনাবতী ঠিক কে— বউ কে, সেটা এখনো স্পষ্ট নয়। তবুও মনে হচ্ছে, সোনাবতী যেন… বিশেষ কেউ একজন। এই অনুভূতিই তার মন আর শরীরের মধ্যে একধরনের অস্থিরতা তৈরি করে।
***
চতুর্দশ রাতেও ছোঁয়ার সেই আলাপ শুরু হয়,
ঠিক যেমন ত্রয়োদশ রাতে হয়েছিল। কিন্তু এবার, সে আর হাত সরিয়ে নেয় না। হাতটা রেখে দেয় সোনাবতীর শরীরে। সেই হাত ওখানেই থাকে।
তারপর হাত ধীরে ধীরে সোনাবতীর শরীরের মানচিত্রে ঘুরে বেড়ায়, নিজের মতো করে রাস্তা খোঁজে, আবার কখনো রাস্তা তৈরি করে। তার হাত গরম হয়ে ওঠে, ভিজে যায়। দুই শরীরের সীমানা মিলিয়ে যায়, সোনাবতীর গরম শরীরের সিক্ততা তাকে ঢেকে ফেলে। তার শরীরের আগুনে রক্ত ফুটতে থাকে।
এখন ফাল্গুন মাস। তার বিয়ে হয়েছিল আট বছর আগে, এক ঠান্ডা ফাল্গুনের রাতে। সে চেষ্টা করে সোনাবতীর মুখ মনে করতে। তবুও এখনো যেন আবছা, যেন অনেক বছর পর কাউকে মনে করার চেষ্টা করছে। সে ঠিক করে, ভোরবেলা সোনাবতীর মুখটা ভাল করে দেখবে। সোনাবতী কেঁপে উঠে তার দিকে ফিরে শোয়। মান্নুরামও ফিরে আসে তার দিকে। এবার স্পর্শের সব সীমানা ভেঙে পড়ে। তারা একে অপরের শরীর স্পষ্টভাবে অনুভব করে, ছোঁয়ায় ঢেউ খেলে যায়।
হঠাৎ, সে থেমে যায়। দরজার দিকে তাকায়। দরজা খোলা। তার মন চায় সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াতে, কিন্তু সে ধীরে, সাবধানে উঠে পড়ে। দ্রুততার সাথে, কিন্তু ধৈর্য সহকারে, সে দরজাটা বন্ধ করতে চায়। দরজা বন্ধ হচ্ছে না। সে ভাবে, সবসময় তো খোলাই থাকে, এ কারণেই বুঝি বন্ধ হচ্ছে না। সে আর একটু জোর করে। এখন নব্বই শতাংশ বন্ধ, তবু ছিটকিনি লাগছে না। তার ধৈর্য ফুরিয়ে যাচ্ছে, সে সাবধানে চেষ্টা চালিয়ে যায়। দরজা ছোট হয়ে গেছে নাকি দরজার কাঠামো কি বেঁকে গেছে? নাকি ছিটকিনিটাই মরচে পড়ে গেছে? দরজা বন্ধ হচ্ছে না।
তার ধৈর্য ফুরিয়ে আসে, সে ক্রমেই অস্থির হয়ে ওঠে। সে ঘামছে — কপালে, পিঠে, হাতে। সে সাবধানে কিন্তু জোরে দরজার ফ্রেম ঠেলতে থাকে। আবার ঠেলে। এবং অধৈর্যতা, ভয়, লজ্জা, উত্তেজনা আর প্রত্যাশা— এই পাঁচটি রঙে রাঙা হয়ে, আরো অনেক অচেনা রঙ মিশিয়ে সে প্রথমবারের মতো ঘরের, কক্ষের, জীবনের ছিটকিনি লাগিয়ে দেয়।
নেপালি ঔপন্যাসিক ও গল্পকার অমর ন্যাউপানে’র জন্ম নেপালের চিৎয়ানে ১৯৭৪ সালে। তার উপন্যাস Seto Dharti মদন পুরস্কার ও রামরাজ পন্থ স্মৃতি পুরস্কার এবং গল্প সংকলন Paniko Gham (২০১০) পদ্মশ্রী সাহিত্য পুরস্কার লাভ করে। অনূদিত The Latch গল্পটি এই সংকলনের একটি গল্প।
নেপালি থেকে ইংরেজি অনুবাদ: অজিত বড়াল

খোদেজা সুলতানা লোপা
একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত। ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর। আগ্রহের বিষয় জেন্ডার সমতা, মানবাধিকার ও জলবায়ু ন্যায়বিচার। ফটোগ্রাফি তাঁর শখের একটা দিক।