দুঃখবাদের অন্তরালে জীবনতৃষ্ণার রূপকার যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত // তৈমুর খান
আধুনিক কবিতার পটভূমি যে কবি রচনা করেছিলেন,নঞর্থক জীবনের দুঃখ ও হতাশার গান যে কবি গেয়েছিলেন, যে কবি নিঃসঙ্গ হয়ে একাকী পাঁজরের ব্যথা নিয়ে অ্যান্টিপোয়েট্রির পথ দেখিয়েছিলেন, সে কবি কি বাঙালির কাছে বিস্মৃত হতে পারেন? তিনিই প্রথম কবি যিনি সরাসরি রবীন্দ্রনাথের আনন্দলোকের বিপরীতে দুঃখকে দেখেছিলেন। দুঃখই সারসত্য জীবনের—এই ঘোষণা তিনিই প্রথম করেছিলেন। সেই দুঃখবাদী কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত(১৮৮৭-১৯৫৪) মরুহৃদয় নিয়েই বাংলা কাব্য জগতে প্রবেশ করেছিলেন। প্রথম তিনটি কাব্য এই মরুঘোষণায় ব্যঞ্জনাশ্রয়ী হতাশা আর যন্ত্রণারই প্রকাশ করে। কাব্যগুলির নামকরণেই তা স্পষ্ট হয় : মরীচিকা (১৯২২), মরুশিখা(১৯২৭) ও মরুমায়া(১৯৩০)— তিনটিই যেন একই সুরে বাঁধা । রূঢ় বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে তিনি কোনো অবাস্তব স্বপ্ন-কল্পনার জগৎ দেখতে পাননি। যন্ত্রণা ও আঘাত নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকে। তার বেঁচে-থাকাও মৃত্যুর দিকেই এগিয়ে যাওয়া। সুখ-সৌন্দর্যের যারা কথা বলে তারা ভন্ডামি করে, প্রকৃত সত্যকে চাপা দিতে চায়। কবি সে পথ মাড়াতে চান না। দুঃখকে একমাত্র সম্বল করেই তিনি ‘সুখবাদী’ কবিতায় লিখলেন:
‘সৃষ্টির সুখে মহাখুশি যারা, তারা নর নহে,জড় ;
যারা চিরদিন কেঁদে কাটাইল, তারাই শ্রেষ্ঠতর।
মিথ্যা প্রকৃতি, মিছে আনন্দ, মিথ্যা রঙিন সুখ;
সত্য সত্য সহস্রগুণ সত্য জীবের দুখ !’
এই দুঃখের আয়নায় যেমন নিজেকে দেখলেন, তেমনি জগৎ-জীবনকেও দেখলেন। প্রকৃতির যা কিছু সুন্দর সবই ছলনা মাত্র। এমনকী খেজুর-গাছের-রসকেও তিনি গাছের কান্না ভাবলেন। মানুষ প্রত্যেকেই ভারবহনকারী গাড়োয়ান। সবাই এই দুঃখের ভার বহন করে চলেছে। চিরনিদাঘ নিয়েই মানুষের অন্তর ‘চিরবৈশাখ’। ঈশ্বরের প্রতিও কবির সংশয় জেগে উঠল:
‘সবার উপরে মানুষ শ্রেষ্ঠ স্রষ্টা আছে বা নাই’
সুতরাং সবই মায়াজাল। সুখ-আনন্দ-প্রেমের ছলনায় মানুষ নিজেকে ভুলিয়ে রাখে মাত্র। বিশ্বপ্রকৃতির কোনো চেতনা নেই। ঈশ্বর বলেও যদি কেউ থাকেন তবে তিনিও দুঃখময় দেবতা। মানুষকে দুঃখ যন্ত্রণায় আঘাত করে তিনি নিজেও কৌতুক অনুভব করেন:
‘আনন্দ নহ নহ
দিচ্ছ দুঃখ
দুঃখের ফেরি বহ।’
জগৎময় এই দুঃখের ফেরি দেখতে দেখতেই জীবন অন্ধকার হয়ে আসে। না-পাওয়ার যন্ত্রণাও বেড়ে যায়। অভিযোগ দীর্ঘ তালিকায় লিপিবদ্ধ হয়। বৃদ্ধ কচিডাবওয়ালাকে ‘শিব’ মনে হয়। নিরন্তর দুঃখের কর্মকাণ্ডে কোথায় স্থিরতা? গঙ্গাও তো পতিতোদ্ধারিণী নয়, চির ক্রন্দনময়ী দুঃখী।
কবিতার ভাষা পাল্টে গেল, ভাব পাল্টে গেল, দর্শনও পাল্টে গেল। জীবনানন্দের ‘বোধ’ লিখিত হবার আগেই বোধের আড়মোড়া ভাঙা মানুষটিই যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। সুখ, প্রেম-প্রকৃতি-জীবনের সর্বত্রই এক গোঁজামিল চলছে। জননীর কোলে সন্তান দিয়েও তাকে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। নিরীহ পাঁঠাকে শুধু ভক্ষণের জন্যই ঈশ্বরের দোহাই দেওয়া হচ্ছে। বেশ্যার মতো রূপ দেখিয়ে চাঁদ মন কাড়ছে। প্রকৃতিও একপ্রকার বেশ্যা। সবকিছুর মধ্যে পড়েই মানবজীবন বিভ্রান্ত। চতুর্দিকে বঞ্চনার ছোবল। এর থেকে বাঁচতেই তিনি হয়তো বিশ্রামকে খুঁজেছেন। আর সেই কারণেই ‘ঘুম’কেই মহাঔষধ ভেবেছেন। ‘ঘুমের ঘোরে’ কবিতায় ‘ঘুমিওপ্যাথি’ শব্দটি ব্যবহার করে বাংলা কাব্যের জগতেও এক পথের সন্ধান দিয়েছেন:
‘সকল দুঃখের খনি !
শিহরিয়া উঠে পরান তোমার ব্যথার অশ্রু গনি !
সারা বিশ্বের বেদনা বহিয়া কেমনে জীবন চলে
বুঝেছি প্রাণটা ঠান্ডা রেখেছ ঘুমিওপ্যাথির বলে ।’
ঘুম না থাকলে কি জীবনে আবার নতুন নতুন দুঃখের মুখোমুখি হওয়া যেত? যেত না বলেই মানুষ ঘুম না হলে ঘুমের ওষুধ খায়। যন্ত্রণাকে ভুলে থাকতেও ঘুমের দরকার হয়। সেই ঘুমও চিকিৎসার নতুন দিগদর্শন বলা চলে। কিন্তু মুশকিল হল ঘুমিওপ্যাথির আবিষ্কর্তার চোখেই ঘুম নেই। ‘মরুশিখা’ কাব্যের ‘ভক্তির ভারে’ কবিতাতেও জানিয়েছেন:
‘ঘুমিওপ্যাথির আবিষ্কর্তা!…. অনিদ্রা-ম্রিয়মাণ!’
জীবনকে বিদ্রুপ করতে করতে যে তীর্যক কৌতুকের আশ্রয় কবি নিয়েছিলেন তা নেতিবাচকেরও নেতিবাচক হয়ে উঠেছে। সাড়ে তিন হাত ঘরের বাসিন্দা হয়ে মানুষ যেমন নিজের ঘরেই নির্বাসিত, তেমনি অব্যবস্থার শিকার। কোনো দিকেই তার সুস্থিরতা আসেনি। কেবল মাথা ঠুকে ঠুকে নিয়তিকে দোষারোপ করেই চলে সে। এখানেই হয়তো নাগরিক জীবনযন্ত্রণার স্বরূপটি উঠে এসেছে যা আধুনিক কবিতার একটা চূড়ান্ত বৈশিষ্ট্য হিসেবে গণ্য হয়।
রবীন্দ্রনাথের কবিতায়, জীবনদর্শনে, শুভবোধ,সৌন্দর্যপ্রিয়তা এবং ঔপনিষদিক জীবনদেবতার প্রতি আনুগত্য ও আনন্দবাদে অবগাহন দেখা যায়, যতীন্দ্রনাথ সেই আনন্দবাদের বিপরীতে দাঁড়িয়েই একের পর এক প্রশ্ন করেছেন। চেরাপুঞ্জিতে প্রচুর বৃষ্টি হলেও গোবিসাহারায় একখন্ড মেঘও ধার পায় না কেন? গেনু দাসের বাঁশিতে সুর বাজে না, অশ্রু বিসর্জনের শব্দ হয়। কেতকী ফুলের পাপড়িতে সৌন্দর্য দেখা যায় না, তারা ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে। সবাই যদি আনন্দেই বিহার করে তবে কবির কপালে ‘তেঁতুল গোলা’। জীবনদেবতা আসলে ছদ্মবেশী দুঃখবাদী কৌতুকময় এক ‘বন্ধু’। যাকে বারবার কবি সম্বোধন করেন। দেশ স্বাধীন হলেও বা উদ্ধার হলেও কেউ স্বাধীন নয়। কেউ কখনোই স্বাধীন হতে পারে না। ‘দেশোদ্ধার’ কবিতায় জানিয়ে দিলেন কৃষকদের নিয়তি-হত চিরদুঃখের কথা:
‘ওরে চিরপরাধীন !
তোরা না জানিস, মোরা জানি তোর কী কষ্টে কাটে দিন।’
একইভাবে দেখলেন নবান্ন দিনেও চাষার ঘরে নেই একছটাক অন্ন। চিরদুঃখে কীভাবে তাদের জীবন কাটছে। প্রেম-প্রকৃতির কারাগারে মানুষ বন্দি বলেই মিথ্যায় আশার ফানুস নিয়ে সুখের খোঁজ করছে। মিথ্যা কল্পনার জাল বুনে চলেছে। সৌন্দর্যের কাব্য রচনা করছে। সমস্ত আনন্দ-মরুর কথাই নির্দেশ করলেন। এই অন্তঃসারশূন্য উচ্চারণকে বাতুলতা বলেই ব্যঙ্গ করলেন ‘ঘুমের ঘোর’ নামক কবিতায়:
‘কে গাবে নূতন গীতা —
কে ঘুচাবে এই সুখ-সন্ন্যাস—গেরুয়ার বিলাসিতা?
একথা বুঝিবে কবে—
ধানভানা ছাড়া কোনো উঁচু মানে থাকে না ঢেঁকির রবে।’
তাহলে রোমান্টিক কাব্য-কবিতা, আশাবাদের সঞ্চার সবই কবির কাছে ‘ধানভানা’ মাত্র। ব্যঙ্গের চাবুক মেরে তিনি বুঝিয়ে দিলেন মিথ্যে কল্পনা বা সৃষ্টির অন্যকোনো ব্যঞ্জনা থাকতে পারে না। ঈশ্বর, আনন্দ, প্রেম সবই এই ‘ধানভানা’ ব্যতীত অন্যকিছুই নয়। বাস্তবের কাছে, মাটির কাছে, সবাইকেই ফিরে আসতে হয়। বাস্তবের প্রতিটি কবি আনুগত্য দেখাতেন প্রেম ও ধর্মের কথা উল্লেখ করেই, কিন্তু কবি বলেন :
‘প্রেম ও ধর্ম জাগিতে পারে না বারোটার বেশি রাতি।’
যতই এই দুটি আবেগকে মানুষ উচ্চাসনে বসাক না কেন, তাতেও ফাঁকি এবং অন্তঃসারশূন্যতার মনটি অস্বীকার করা যায় না। ‘রেলঘুমে’র মতো আমাদের জীবনটাও কেটে যাচ্ছে— ধক্ ধক্, ধিকিধিকি। যেখানে যেখানে সিগন্যাল আছে, লাল সবুজ আলোর খেলা আছে, ঠিক ঠিক লাইনে চলাও আছে। একটু ভুল হলেই বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে অর্থাৎ মৃত্যু। জীবনের সমাপ্তি ঘোষণা করতে পারে। সমস্ত সৃষ্টি জুড়েই এক অতৃপ্তির মেরুরেখা এবং নঞর্থক প্রপাত দেখতে পাই। ফুলের দোকানের পাশে কসাইয়ের মাংসের দোকানটি জোড়া। শীতে ঝরাপাতার ঝরে যাওয়ার নিদারুণ অসহায় রূপ। বস্ত্রহীন মানুষও কীভাবে কষ্ট পায় তার বিবরণ। সব দুঃখগুলি তাঁর সৃষ্টিতে উঁকি মারে, প্রবলভাবে সাড়া দেয়। শেষ পর্যন্ত এক মহাঅন্ধকার মহাকালের মহাকালী হয়ে নৃত্য করে চলে। জন্ম-মৃত্যুর দোলায় জীবন দোলায়। রহস্যময় বিশৃংখলায় জীবনকে আচ্ছন্ন করে।
কিন্তু এতদসত্ত্বেও পরবর্তী জীবনে যতীন্দ্রনাথ কি পুনরায় রবীন্দ্রদর্শনে ফিরে আসেননি? এ প্রশ্ন উঠছে তাঁর পরবর্তী কাব্যভাবনার প্রতি দৃষ্টিপাত করেই। প্রকৃতি-প্রেম-ঈশ্বরের প্রতি তাঁর যে বিরূপতা তা অনেকখানি কেটে গিয়েছিল। এই পর্বের কাব্যের নামগুলিতেও তিনি অন্ধকারের অবসানের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। যেমন ‘সায়ম'(১৯৪১)এর অর্থ সন্ধ্যা, ‘ত্রিযামা'(১৯৪৮)এর অর্থ রাত্রির তৃতীয় প্রহর, ‘নিশান্তিকা'(১৯৫৭)এর অর্থ রাত্রির অবসান। ‘মরু’ কাব্যগুলির দাবদাহ এবং অন্ধকার দুঃখে দিকভ্রষ্ট কবি পরবর্তী কাব্যগুলিতে হয়তো স্নিগ্ধ রাত্রি এবং রাত্রির অবসানের ইঙ্গিত পেয়েছিলেন। যে কবি মরুর বিপন্নতায় উপলব্ধি করেছিলেন :
‘এ ব্রহ্মাণ্ড ঝুলে প্রকাণ্ড মাকাল ফল।’
অথবা,
‘প্রেম বলে কিছু নাই —
চেতনা আমার জড়ে মিশাইলে সব সমাধান পাই।’
‘ত্রিযামা’ কাব্যে এই উপলব্ধির অনুশোচনা করে লিখলেন :
‘যে-দাবদহনে বহন করিয়া এ জীবন পোড়ালেম,
আজ মনে হয় এ দগ্ধ ভালে সেই ছিল মোর প্রেম।’
দুঃখও যে শেষপর্যন্ত প্রেম, মরুও যে শেষপর্যন্ত মাঙ্গলিক জীবনের কোনো শুভ যোগ, হয়তো এ কথার মধ্য দিয়েই প্রমাণ করতে চেয়েছেন। সুতরাং একটা ছদ্ম বিদ্রোহই ছিল তাঁর কাব্য-আদর্শের মূল পথ। এই পথেই তিনি তাঁর জীবনতৃষ্ণার প্রজ্বলিত আলোক শিখায় দুঃখবাদী হয়েও দুঃখকে অতিক্রম করেছেন চিরন্তন জীবনের আবেদনের কাছে। জীবনের অনুপম সৌন্দর্য তিনি দেখেছিলেন বলেই অন্ধকারকে উপলব্ধি করেছিলেন। দিন যদি না থাকে তো রাত্রের ধারণা যেমন পাওয়া যায় না, তেমনি রাত্রি না থাকলে দিনের আকাঙ্ক্ষাও জাগে না। দুঃখকে শুধু অনুধাবন করলেই জীবনের পূর্ণাঙ্গ রূপ দেখা যায় না। ভগবান ধারণার অন্ধকারে থাকলেও আলোকের ইশারাও ধারণাতেই পাওয়া সম্ভব। বাসনা ছিল, তাই দুঃখ ছিল, বৌদ্ধ ধর্মে বলা হয় বাসনাই সমস্ত দুঃখের কারণ; বাসনা না থাকলে দুঃখও থাকে না। ‘কঠোপনিষদে'(২/৩/১৪)বলা হয়েছে :
‘যদা সর্বে প্রমুচ্যন্তে কামা যেহস্য হৃদি শ্রিতাঃ।
অথ মর্ত্যোহ মৃতো ভবত্যত্র ব্রহ্ম সমুশ্নুতে॥’
অর্থাৎ হৃদয়ের যাবতীয় কামনা থেকে যখন মানুষ মুক্ত হয়, তখন সে-ই মর্তে অমর হয় এবং এই দেহেই ব্রহ্ম সম্ভোগ করে। কবি কামনা থেকে মুক্ত হতে পারেননি বরং নঞর্থক বোধে জীবনের এক চরম অতৃপ্ত ও শূন্যতাকে অন্তঃশীল প্রবাহে এক দ্বান্দ্বিক টানাপোড়েনে পৌঁছে দিয়েছেন, যা থেকে পরবর্তী কাব্যধারার পথটি আরও গতিময় হয়ে উঠেছে।