Home » অতঃপর হিংসা / নূর সালমা জুলি

অতঃপর হিংসা / নূর সালমা জুলি

আম্মার সাথে রাগ, ছোট ভাইকে অহেতুক বকা, কাছের বন্ধুর সাথে খারাপ ব্যবহার করার মতো অপ্রিয় কাজ করে ফেলেছি। সোহান নামের মিষ্টি ছেলেটা আমার নূপুর পরা পায়ের প্রেমে পড়েছিল। মুগ্ধতার আবেশে মন আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল। অথচ কাল যখন বললো ‘তুমি আমার হৃদয়ের গভীরতম বিন্দু হবে?’ তখন এত রাগ করলাম! বেচারা কষ্ট পাবে জেনেও এমন করলাম। আসলে এরিকা কোহুটের মতো আমার কাউকেই ভালো লাগে না। কারণ ছাড়াই। না, সুনীলের মতো কেউ কথা রাখেনি বিষয়টা এমন না।

চতুর্দশীর উজ্জ্বলতা চোখে ধাঁধা লাগায়। সবকিছু ইলিউশান মনে হয়। আজ নবমী। এই আলোটায় যেন মমত্ব মাখানো আছে। বেশ লাগে। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। ছাদে খোলা আকাশের নিচে বসে আছি একা। ভীষণ ভালো লাগার মুহূর্ত। কিন্তু বিরক্ত লাগছে। খুব খুব খুব…

টানা বাহাত্তর ঘণ্টা আমি এভাবে আছি। মানে বিরক্তির দেয়ালে বন্দি। শ্রাবণের মেঘও আকাশকে এতটা সময় ভার করে রাখে না। আমার আকাশজুড়ে বিক্ষিপ্ত কালো মেঘের টুকরো ইতস্তত ছড়ানো। বৃষ্টি নামার আদৌ সম্ভাবনা নেই। অথচ ঝরাটা জরুরি।

সমুদ্র মন্থনে কেউ আর নীলকণ্ঠ হয় না এখন। চারপাশে গরলের সমারোহ। অমৃতের সন্তানদের ভালোবাসাহীনতায় পেয়ে বসেছে। কী অদ্ভুত এই প্রাণী! ভালোবাসতেও এর জুড়ি নেই আবার ঘৃণা ছড়াতেও সে অদ্বিতীয়। বিষণ্নতার নিবিড় আচ্ছাদন ঘিরে রয়েছে আমাকে। সম্ভবত কোনোকিছুতে হোঁচট খেয়েছি। অল্পেই এমন হয়। একবার কিছু মাথায় ঢুকলে আর বেরুতে চায় না। শুধু আমারই এমন হয়?

যা-ই হোক, আমি খুবই যুক্তিবাদী। বিরক্তির কারণ অনুসন্ধান জরুরি। এমন চললে আমি আরও খারাপ কিছু করতে পারি…যেমন: সব্জি কাটতে গিয়ে হাত কাটতে পারি, পিঁয়াজু ভাজতে গিয়ে হাত পুড়িয়ে ফেলতে পারি, বাথরুমে পড়ে গিয়ে পায়ে ব্যথা পেতে পারি, সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় হোঁচট খেতে পারি, ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছে হতে পারে। এমনিতে উঁচুতে উঠলেই আমার লাফিয়ে পড়তে সাধ জাগে…

বিরক্তি সমাচার
কারণ ন.১. পরশু বিরিয়ানিতে লবণ দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। সম্ভবত বিরক্তির শুরুটা তখন থেকে…

কারণ ন.২. মান্টো মাথাটা দখল করে ফেলেছে…। মানুষকে বারবার ঠিকানা বদল করতে হয় কেন? রাষ্ট্র বা প্রকৃতি যখন-তখন ব্যক্তিকে মুহাজির বানিয়ে তোলে এই সত্যটা আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। সভ্যতার আড়ালে কী নিঃসীম অন্ধকার!

কারণ ন.৩. বৃষ্টিটাকে যেভাবে নামাতে চাচ্ছি কিছুতেই সেভাবে হচ্ছে না। দশটা শিট ছিঁড়েছি…

কারণ ন.৪. ইলিয়াসে প্রথমবারের মতো মন বসলো না অকারণে…

কারণ ন.৫. অনামিকার নখটা বিশ্রীভাবে কেটে গেছে…

কারণ ন.৬. ‘গীতবিতান’ সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করেও খুঁজে পেলাম না…

কারণ ন.৭. পাঁচ বন্ধুকে প্রায় বিনা কারণে ব্লক করেছি…

কারণ ন.৮. প্লটটা মাথায় পোক্ত হয়ে বসে আছে অথচ অক্ষরের বিন্যাসে রূপ দিতে পারছি না…

কারণ ন.৯. সানফ্লাওয়ার মুভিটা বিষণ্নতায় ডুবিয়ে দিয়েছে…

কারণ ন.১০. একটা খবর

না। এটা কোনো খবর নয়। এটা জীবন-মৃত্যুর বিষাদের সুতোয় গাঁথা গল্প। লবণ-জলে লেখা। একজন বাবা তার দুটো শিশুসন্তানকে বুকে জড়িয়ে আদর করছে চোখের জলে ভাসতে ভাসতে। প্রথমে বুঝিনি। বাচ্চা দুটো মৃত! জীবনের ঊষালগ্নেই তাদের গল্পটা থামিয়ে দিয়েছে যারা তারাও তো রক্ত-মাংসেরই মানুষ! তাহলে? স্নেহ, মায়া, মমতা, ভালোবাসা সব বিক্রি হয়ে গেছে মাংসের বাজারে সের দরে…!

মানুষ মরে গেলেও কোথাও না কোথাও রয়ে গিয়ে স্নিগ্ধতা ছড়ায় কিন্তু মনুষ্যত্বের মৃত্যু হলে যে সব পশুতে ভরে যায়…। তখন দুরভিসন্ধির দুর্ভেদ্য দেয়াল ভেদ করে সূর্যরশ্মির একটি কণাও উঁকি দিতে পারে না। হাঙরের হা অবসন্নতা হয়ে গিলে ফেলে সকল সম্ভাবনা। সভ্যতার গৌরবের মুখে বিশাল একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন সেঁটে যায়। আর চেতনার মারিতে সৃষ্টি উজাড় হওয়ার জোগাড় হয়।

মানবতাহীন মানবের সমাজে বেঁচে থাকাটা ভীষণ দায়। গ্লানি হরণ করে সকল শক্তি। ক্লান্তি স্নায়ুকে ছেয়ে ফেলে। বিষাদের আস্তরণ ভেদ করে এক তীব্র অভিশাপ বেরিয়ে আসে ‘না-মানুষদের’ প্রতি…

গ্রীষ্মের খররৌদ্রের প্রখরতা আশ্রয় করেছে আমার সত্তাকে। এখনই বৃষ্টি দরকার। মেঘ এসো না, আকাশ ঝেঁপে। দিগ্বিদিক ভাসিয়ে দাও, ধুয়ে দাও সব অবসাদ। আমাকে শীতল করো।

রাত্রি প্রায় দ্বিপ্রহর। দূর থেকে ভেসে আসছে পরিচিত সুর। সন্ধ্যা একমনে গেয়ে চলেছে ‘তুমি নির্মল করো মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে…’

Ajit Dash

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ভাষা
Scroll to Top