কয়েক মাস আগে হঠাৎ করে জানতে পারলাম আমার নিউরোএন্ড্রোক্রিন ক্যান্সার হয়েছে। এই প্রথমবার আমি শব্দটি শুনলাম। অনুসন্ধানের পর দেখলাম, এই শব্দটি (রোগ) নিয়ে খুব বেশি একটা গবেষণা হয়নি, কারণ এটি একটি বিরল শারীরিক অবস্থার নাম যে কারণে এর চিকিৎসা নিয়েও অনেকটা অনিশ্চয়তা রয়েছে।
এখন পর্যন্ত আমার যাত্রাপথে আমি দ্রুতগতিতেই চলছিলাম…আমার সাথে আমার পরিকল্পনা, আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন এবং লক্ষ্য ছিল। আমি এই সবকিছুতে এতটাই ডুবে ছিলাম যে, আচমকা টিকিট কালেক্টর আমার পিঠ চাপড়ে বলল, ‘আপনার স্টেশন সামনেই, দ্রুত নেমে পড়বেন।’ আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। জবাব দিলাম, ‘না না আমার স্টেশন এখনো আসেনি…’
তখন উত্তর এলো, ‘তাহলে সামনে যেকোনো স্টেশনে নেমে পড়তে হবে। আপনার গন্তব্য কিন্তু চলে এসেছে।’
হঠাৎ করে উপলব্ধি হলো অজানা কোনো সমুদ্রের অপ্রত্যাশিত তরঙ্গের মতো ঢেউগুলো আমার উপর দিয়ে বয়ে চলছে… তরঙ্গগুলো নিয়ন্ত্রণের অবহেলার জন্য…
এই শোরগোল, সম্মতি এবং ভয়ে তটস্থ হয়ে আমি আমার সন্তানকে বললাম-আমার বর্তমান অবস্থায় আমি শুধু এইটুকু চাই, এই মানসিক পরিস্থিতিতে আতংক, ভয় আর অপমানজনক অবস্থায় বাঁচতে চাই না। যে কোনো মূল্যে আমাকে এমন একটি শক্ত নিরপেক্ষ অবস্থানে দাঁড়াতে হবে যার উপর দাঁড়িয়ে আমি বাঁচতে পারব। আমি আবারও দাঁড়াতে চাই।
এটাই আমার প্রণোদনা এবং উদ্দেশ্য ছিল…
কয়েক সপ্তাহ পরে আমাকে একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। এত ভয়ঙ্কর ব্যথা হচ্ছিল, আমি তো জানি ব্যথা হবে কিন্তু এমন ভয়ংকর ব্যথা… এখন ব্যথার তীব্রতা ধীরে ধীরে বুঝতে পারছি…কিছুই কাজ করছিল না। না কোনো আশা, না কোনো সান্ত্বনা। পুরো পৃথিবী যেন সেই ব্যথার মুহূর্তে নিভে গিয়েছিল… ব্যথা যেন খোদার চেয়ে বড় আর বিশাল ছিল…
আমি যে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি সেখানে একটি বারান্দা রয়েছে … বাইরের দৃশ্য দেখা যায়। কোমা ওয়ার্ডটি আমার ঠিক উপরে। রাস্তার একপাশে আমার হাসপাতাল এবং অন্যদিকে লর্ডস স্টেডিয়াম। ভিভিয়ান রিচার্ডসের একটি হাসির পোস্টার রয়েছে। আমার শৈশবকালের স্বপ্নের মক্কা, এটি দেখার পরে আমি প্রথম দর্শনে কিছুই বুঝতে পারিনি … যেন সেই পৃথিবী কখনও আমারই ছিল না।
আমি বেদনার জালে আটকা পড়ে আছি
তারপর একদিন আমার উপলব্ধি হলো, এই পৃথিবীতে নিশ্চিতভাবে দাবি করা যায়, এমন কোন কিছুর অংশীদার নই আমি। হাসপাতাল বা স্টেডিয়ামও নয়। আমার ভিতরে যা ছিল তা আসলে সারা দুনিয়ার অপার শক্তি আর বুদ্ধির প্রভাব ছাড়া আর কিছু নয়। আমার হাসপাতাল, সেখানে অনিশ্চয়তাই ছিলো নিশ্চয়তা।
এই উপলব্ধি আমাকে সমর্পণ আর ভরসার জন্য প্রস্তুত করেছে। এখন ফলাফল যাই হোক, এই ফলাফল আমাকে যেদিকে নিয়ে যাবে আজ থেকে আট মাস পর, অথবা আজ থেকে চার মাস পর অথবা দুই বছর পর…… এমন চিন্তা আমার পুরো মাথা এলোমেলো করে দিয়েছিল আবার সেই চিন্তাগুলো বিলীনও হয়ে গেছে। তারপর আমার ভেতর থেকে মৃত্যু চিন্তা একেবারে উধাও হয়ে গেল।
এই প্রথম ‘স্বাধীনতা’ শব্দটিকে আমি প্রকৃতপক্ষে উপলব্ধি করলাম।
এই পৃথিবীর প্রকৃত রূপে (ক্রিয়া-কর্মে) আমার বিশ্বাস পূর্ণ সত্যে পরিণত হয়েছে। তারপর আমার উপলব্ধি হয়েছে এই বিশ্বাস আমার শরীরের প্রতিটি কোষে জড়িয়ে গেছে। শুধু সময়ই বলে দেবে সে থাকে কি না! এই মুহূর্তে আমি এটিই অনুভব করছি।
পুরো বিশ্ববাসী এই যাত্রায় আমার সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করছে। আমি যাদের জানি আর যাদের জানি না তারা সকলেই বিভিন্ন স্থান, বিভিন্ন সময় এবং দেশ থেকে আমার জন্য প্রার্থনা করছেন। আমি অনুভব করি যে, তাদের সম্মিলিত প্রার্থনা একটি দুর্দান্ত শক্তি হয়ে উঠেছে… দ্রুত জীবনের স্রোত, আমার মেরুদণ্ডের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আমার মাথার উপরে কপাল দিয়ে ফুটে উঠেছে। কখনো একটি কুড়ি হয়ে, কখনো একটি পাতা, কখনো একটি শাখা হয়ে… আমি খুশি হয়ে তাদের দিকে তাকাই। মানুষের সম্মিলিত প্রার্থনা থেকে উদ্ভূত প্রতিটি ফুল, পাতা আর শাখা আমাকে একটি নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখায়।
উপলব্ধি হচ্ছে, ঢেউয়ের মধ্যে যে তরঙ্গের দোলা সেটাকে নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন নেই কেননা আপনি প্রকৃতির তরঙ্গে দুলছেন প্রতিনিয়ত!
—————
[২০১৮ সালে পশ্চিম লন্ডনের সেইন্ট জনস ওডে, প্রিন্সেস গ্রেস হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চলচ্চিত্র সমালোচক এবং সাংবাদিক অজয় ব্রহ্মাত্মজকে নিজের একান্ত অনুভূতিগুলো জানান ইরফান খান। যেটি অনলাইন হিন্দি নিউজ পেপার ‘নিউজলন্ড্রি ডট কমে’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯ জুন, ২০১৮ সালে। ‘অনিশ্চিততা হি নিশ্চিত হে ইস দুনিয়ামে’- শিরোনামে প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ হিন্দি চিঠির বাংলা অনুবাদ ]

অজিত দাশ
কবি ও অনুবাদক।জন্ম ১৯৮৯ সালে কুমিল্লা শহরে। শৈশব ও বেড়ে ওঠা গোমতী নদীর তীরে। কলেজ জীবন থেকেই যুক্ত ছিলেন লিটল ম্যাগাজিন 'দৃক' এর সঙ্গে। কম্পিউটার সায়েন্স এবং ইঞ্জিনিয়ারিং এ অধ্যয়ন শেষে বর্তমানে চাকুরিজীবী। বর্তমান আবাস ঢাকার মোহাম্মদপুর। কবিতা ও ছোটগল্পের পাশাপাশি ইংরেজী ও হিন্দি থেকে অনুবাদ করেন। হিন্দি থেকে বাংলা অনুবাদের পাশাপাশি তার অনূদিত বাংলা থেকে হিন্দি কবিতা ইতিমধ্যে দিল্লী, উত্তর প্রদেশ এবং দেরাদুন থেকে প্রকাশিত স্বনামধন্য লিটল ম্যাগাজিন ও অনলাইন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে।
এ পর্যন্ত তার প্রকাশিত বই দুটি। 'ওশোর গল্প (বেহুলাবাংলা, ২০১৮), 'প্রজ্ঞাবীজ (মাওলা ব্রাদার্স, ২০১৯)। এ বছর নিজের প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থের পাশাপাশি বাংলায় হিন্দি কবিতা অনুবাদ সংকলণ এর প্রস্তুতি নিচ্ছেন।