[অনূদিত তিনটি কবিতা মূলত হরিবংশ রাই বচ্চন এর হিন্দিতে লেখা তিনটি জনপ্রিয় কবিতা। কবিতাগুলোর মূল নাম যথাক্রমে হিম্মতওয়ালাকো কাভি হার নেহি হোতে ; ব্যাঠ যাতাহু আকসার মিট্টি পে এবং আগে সফর থা অর পিছে হামসফর।]
? সাহসীরা কখনো হারে না
ঢেউয়ের গর্জনে দমে গেলে
নৌকা নদী হয় না পার,
অবিরত চেষ্টাকারীর
সত্যি কভু হয় না হার।
ছোট্ট পিপড়া ছুটে যখন
খাদ্য কণা নিয়ে,
শতবার সে পিছলে পড়ে
খাড়া দেয়ালে চড়তে গিয়ে।
মনের বল আর চলার গতি
অটুট তবু থাকে তার,
যতবার পড়ে ততবার ওঠে
কিছুতেই সে মানে না হার।
শেষ পর্যন্ত যায় পেরিয়ে
প্রতিকূলতার সকল দ্বার।
অবিরত চেষ্টাকারীর
সত্যি কভু হয় না হার।
সিন্ধু তলে ঝাপিয়ে পড়ে
সাহসী বীর ডুবুরি,
মণি-মুক্তা নাহি পেয়ে
খালি হাতে আসে ফিরি।
হতাশাকে পাশ কাটিয়ে
গভীর জলে বারংবার,
ডুব দিয়ে মুঠোয় পুরে
উঠিয়ে আনে মতির হার।
অবিরত চেষ্টার ফলে
মুখে হাসি ফোটে তার,
চেষ্টা করে গেলে পরে
সত্যি কভু হয় না হার।
পরাজয় এক বিরাট চ্যালেঞ্জ
গ্রহণ তুমি করে নাও,
ভয় না পেয়ে ভুল ভ্রান্তি
যত আছে শুধরে দাও।
জয় না পাওয়া অবধি তোমার
বিশ্রাম ঘুম উড়ে যাক,
জীবন যুদ্ধে না পালিয়ে
জয়ের চেষ্টা চালু থাক।
চেষ্টা বিনা জীবন যুদ্ধের
জয়োরথে চড়া ভার,
অবিরত চেষ্টাকারীর
সত্যি কভু হয় না হার।
❀ ❀ ❀
? মাটির কোলেই বসি
মাটির কোলে বসে আমি
প্রাণ খুলে হাসি,
মাটির মানুষ এই পরিচয়
বড়ই ভালোবাসি।
নিরবধি বয়ে চলো
হাসি মুখে ভাইরে,
জীবনের এই মন্ত্রণা আমি
সাগর হতে পাইরে।
রক্ত মাংসের মানুষ আমি
ভুল-ভ্রান্তি আছে,
প্রতারণা বা ভন্ডামিকে
ঘেঁষতে দেই না কাছে।
ঘড়ির কাঁটা চলতে থাকে
যুগের হাওয়া পাল্টে যায়,
তবু বন্ধুগুলো একই থাকে
মোহাব্বত না বদলায়।
যেমন ছিলাম তেমনই আছি
বদলা-বদলির বালাই নাই,
শত্রুরা তাই হিংসা করে
জ্বলে পুড়ে হয় যে ছাই।
বাজার থেকে ঘড়ি কিনে
যেই বেঁধেছি হাতে,
সময় যেন কোমর বেঁধে
লেগে গেছে সাথে।
সুখের আশায় বুক বেঁধেছি
ঘর বেঁধেছি তাই,
ঘরই আমায় করল যে পর
পথে হলো ঠাঁই।
সুখের কথা বলবো কি আর
সুখ যে কেবল কল্পনা,
ছোট্টোবেলার নির্মল সুখ কেবল
স্মৃতির পাতার জল্পনা।
শখ আহ্লাদ হয় যে পূর্ণ
পিতামাতার পয়সাতে,
নিজের কামাই সব চলে যায়
প্রয়োজনটা মেটাতে।
জীবনের এই কঠিন যুদ্ধে
রঙগুলো কেন বদলে যায়?
হাসি খুশি কত জীবন
মুহুর্তেই হয় মলিন হায়!
হাসি মাখা সকালগুলি
হারিয়ে গেলো কোথায় হায়?
গোমরা মুখে সন্ধ্যা কত
হাসি বিহনে কেটে যায়।
বাঁধনগুলো আঁটতে গিয়ে
নিজেই হলাম বাঁধনহারা,
সবার মুখে ফুটিয়ে হাসি
হলাম আমি ছন্নছাড়া।
সবাই ভাবে ভীষণ সুখী
সদা মুখে থাকে হাসি,
ক্লান্ত আমি ভীষণ রকম
লুকাতে গিয়ে দুঃখ রাশি।
সবার মুখে ফুটিয়ে হাসি
আনন্দ তবু আমি পাই,
বেপরোয়া হয়েও সবার
পরোয়া যে করি তাই।
ইচ্ছে করে বইয়ে দিতে
আনন্দেরই ফল্গুধারা,
বিশ্বটাকে পাল্টে ফেলি
মুছে ফেলি সকল জ্বরা।
ইচ্ছেটাই আজ আছে শুধু
উপায় নাহি খুঁজে পাই,
এক পেটে ভাতের সংস্থানেই
দিন-ক্ষণ সব ফুরিয়ে যায়।
দামী ঘড়ি হাতে বেধেও
সময় বাঁধা শক্ত ভারী,
মনের সাফাইয়ে লাভ কি বলো
দামতো বেশী চেহারার-ই।
বৃথা তোমার প্রার্থনা সব
ঈশ্বর যদি মিথ্যা হয়,
ঈশ্বর যদি সত্য তবে
কিসের চিন্তা, কিসের ভয়?
জীবন গেল রসাতলে
হিংসা-দ্বেষে কাটল কাল,
অজ্ঞানতার অন্ধকারে
জীবন যে হয় টালমাটাল।
সুখ শান্তি অমূল্য ধন
পয়সাতে কি কেনা যায়?
বৃথা-ই করো দুঃখ ফেরি
এর যে কোনো ক্রেতা নাই।
সাদাসিধা থাকতে তুমি
পারবে কি ভাই সহজে?
এ পথতো নয় সরল মোটেই
অভিজ্ঞতা তাই বলে যে।
ভুল-ভ্রান্তির হিসাব কারো
করতে তুমি যেওনা,
আছেন সেথায় অন্তর্যামী
বিচার তুমি করো না।
❀ ❀ ❀
? সম্মুখে গন্তব্য পশ্চাতে প্রিয়তমা
সম্মুখে ঐ বিস্তীর্ণ পথ
গন্তব্যে গিয়ে মেশে,
পশ্চাতেতে প্রিয়তমা
মনোহারিণী বেশে।
প্রেমের টানে থমকে গেলে
গন্তব্যেতে পৌঁছান দায়,
সম্মুখ পানে এগিয়ে গেলে
প্রেম ছিন্ন হয়ে যায়।
প্রিয়ার প্রতি দুর্বল
লক্ষ্যেতেও অবিচল,
কোন পথেতে যাবো রে মন
তুই-ই আমায় বল।
এমন কেন হয় রে জীবন
বলতে কি তুই পারিস?
পিপাসাতে ছাতি ফাটে
আর পানিতে থাকে বিষ।
মৃত্যু কেবল সময়ের ব্যাপার
পান করি কিংবা না করি,
জনম ভর এমন দোটানাতেই
বেঁচে থেকেও ধুঁকে মরি।
স্বপ্ন শেষ হওয়ার আগেই
কাঁচা ঘুম ভেঙে যায়,
ধৈর্য্য বলে সময়ের অভাব
সময় বলে ধৈর্য্য নাই।
সকাল সকাল উঠা লাগে
ঘুম ভেঙে যায় যে হায়,
আরামেতে থাকতে গিয়ে
আরামের ঘুম হারাম তাই।
প্রতিভাগুলো অনাদরে
রাস্তাঘাটে পড়ে মরে,
ভাগ্য গুণে ভাগ্যবান
রাজমহলে রাজত্ব করে।
হে জীবন তোর বিরুদ্ধে আমার
অভিযোগের শেষ যে নাই,
চুপটি করে থাকি কারণ
যা পেয়েছি তা কজনে পায়?
লোভে পড়ে ছুটে গেলাম
টাকার পিছে পিছে,
কাছের মানুষ পর যে হলো
মোহ-মায়া সব মিছে।
সন্তানাদি নিয়ে সুখে
থাকার সুযোগ পেলাম কই?
তারাও এখন পয়সার পিছে
শূন্য গৃহে একলা রই।
সময় চতুর সওদাগর
বুঝিনিতো আগে,
যৌবনেরই লোভ দেখিয়ে
শৈশব নিয়ে ভাগে।
এখন আবার ধনী হবার
স্বপ্নে করে বিভোর,
হেচকা টানে চায় যে নিতে
যৌবনের এই প্রহর।
বেলা শেষে ক্লান্ত দেহে
যখন ফিরি ঘরে,
জীবন খাতার নগদ বাকির
হিসাব ঘিরে ধরে।
কাজের জন্য জীবন নাকি
জীবনের তরে কাজ?
পাইনি উত্তর কোনো কালে
মিলবে কী হিসাব আজ?
ছোট্ট বেলায়
শুধাত সবাই,
বড় হয়ে
কী হতে চাই।
বড় হওয়ার পরে
আমি সঠিক উত্তর পেয়েছি,
শৈশবেতে ফিরতে যে চাই
বড়তো অনেক হয়েছি।
ক্লান্ত আমি,শ্রান্ত আমি
জীবন স্রোতে ভেসে,
হিসাব নিকাশ চুকিয়ে দিলে
মুক্তি পেতাম শেষে।
⌑ ⌑ ⌑ ⌑
হরিবংশ রায় বচ্চন হিন্দি সাহিত্যের একজন স্বনামধন্য কবি। উনবিংশ শতাব্দীর গোড়া দিকে হিন্দি সাহিত্যে ‘নতুন কবিতা আন্দোলন’ এর অন্যতম কবি। তিনি বৃটিশ ভারতের সংযুক্ত আগ্রা ও অওধ প্রদেশ, বর্তমানে উত্তর প্রদেশের প্রতাপগড় জেলায় ১৯০৭ সালের ২৭ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। কায়স্ত বর্ণের পারিবারিক পদবী শ্রীবাস্তব হলেও তিনি বচ্চন ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন। তিনি মূলত অওধি ও হিন্দি ভাষায় কবিতা লিখতেন। ‘মধুশালা ‘ কবিতার জন্য তিনি সমধিক পরিচিত। এ ছাড়াও তাঁর অসংখ্য কবিতা যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। কর্মজীবনের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৭৬ সালে ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মভূষণ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি ২০০৩ সালের ১৮ ই জানুয়ারী মুম্বাইয়ে মৃত্যুবরণ করেন