Home » সিকিমের লোকগল্প // সুকন্যা দত্ত

সিকিমের লোকগল্প // সুকন্যা দত্ত

ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্য সিকিম। হিমালয়ের পাহাড়ী কোলে এই রাজ্যের আদিম অধিবাসী  লেপচা। এরা প্রকৃতি পূজক। এই জাতির লোকগল্পে তাদের আচার, বিশ্বাস, ভাবধারা, রীতিনীতি প্রকাশ পায়। একটি জাতির সমগ্র পরিচয় পাওয়া যায় লোকগল্পকে ভিত্তি করে।  লোকগল্প কেবল শিক্ষার জন্য নয়, এর সাথে মিশে আছে বিনোদন, জনজীবনের ইতিহাস।  সংগৃহীত চারটি লোকগল্প লেপচা জনজাতি এবং সিকিমের ঐতিহ্যের অনুসারী।

তিস্তা এবং রঙ্গিত….. 

মাঘ সংক্রান্তি “লেপচাদের একটি জনপ্রিয় উৎসব। প্রতিবছর মাঘ মাসের শেষ তিনদিন কালিম্পং এর ” Lovers Meet View Point” এ এই উৎসব ধূমধাম করে পালিত হয়। তিস্তা ও রঙ্গিত নদী উত্তর ও পশ্চিম সিকিম থেকে বয়ে এসে এখানে মিলিত হয়েছে। এদিন পুরুষ নারী নির্বিশেষে সকলে নদীর সঙ্গমস্থলে জলে ডুব দেয়। তিস্তা ও রঙ্গিত দেবতার পুজা সেরে রাত অবধি নাচগান করে উদযাপন করে।  উভয় নদীর ভালোবাসাকে স্মরণ করে গান গায়। তবে তিস্তা এবং রঙ্গিত এর মিলনের পিছনে সিকিম এর একটি লোকগল্প প্রচলিত আছে। তিস্তা উত্তর সিকিমের ” Tso Lhama” লেক থেকে উৎপন্ন হয়ে সোজা পাহাড়ের ঢাল পেরিয়ে বয়ে এসেছে সমতলের দিকে। অথচ পশ্চিম সিকিম থেকে বয়ে আসা রঙ্গিতের যাত্রা এঁকেবেকে। নদী দুটি সিকিম থেকে হিমালয় উপত্যকার ঘন সবুজ জঙ্গল পেরিয়েপাহাড়ী ধাপ অতিক্রম করে কালিম্পং এ মিলিত হয়ে একসাথে প্রবাহিত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের সমতলের দিকে। কিন্তু কেউ কী জানেনদুই নদীর মিলনের গল্প?

অনেককাল আগের কথা দুইজন নদী দেব দেবী হিমালয়ের কোলে মহা সুখে বাস করতো। তিস্তা ছিলো দেবী এবং রঙ্গিত দেবতা।  একদিন খেলাচ্ছলে তারা ঠিক করলো , নিজেরা একটি প্রতিযোগীতা করবেন। সমতলের  বুকে কে আগে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে সেই নিয়ে এই খেলার আয়োজনে দুজনেই উচ্ছ্বসিত। তিস্তা ও রঙ্গিতের ইচ্ছে তারা ভিন্ন পথে যাত্রা করবে। সেই মতো শুরু হলো তিস্তা এবং রঙ্গিতের প্রতিযোগিতা।

তিস্তা বললো, সমতলের পথ তো আমরা কেউ চিনিনা। পথ চেনানোর জন্য একজন পথ প্রদর্শক প্রয়োজন।”

রঙ্গিত উৎফুল্ল হয়ে বললো, ” অবশ্যই।  আমি পাখিদের রাজাকে আমার পথ প্রদর্শক রূপে নির্বাচন করলাম। পাখি দ্রুতগামী। সে আমায় শীঘ্রই আমার গন্তব্যে পৌঁছে দেবে।”

তিস্তা খুব বুদ্ধিমতী। সে বললো, ” বেশ। আমি নির্বাচন করলাম সর্প রাজকে। সেই আমায় পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে।”

অবশেষে শুরু হলো প্রতিযোগীতা। নির্দিষ্ট দিনে যাত্রা শুরু হলো। তিস্তা নাগ রাজ কে অনুসরণ করে সোজা  এগিয়ে চলল। কিন্তু বিপদে পড়ল রঙ্গিত নদী। বিহগ রাজ কে অনুসরণ করা একেবারেই সোজা নয়। ধরিবাজ পাখী চলার পথে এ গাছ ও গাছ উড়ে বেড়ায়, ডালে বসে ফল খায়, কোথাও চাষের জমির শস্যদানা খুঁটে খায় । রঙ্গিত তাকে বললো, ” বিহগ রাজ, আপনি তো মহান । সব জানেন। এভাবে থেমে থেমে পথ চললে   আমরা যে প্রতিযোগিতায় হেরে যাবো।

পাখি শুনে তো হেসেই কুটিপাটি।  সে বললো, ” খাবার না খেলে একটি একটু ও উড়তে পারি না। খালি পেটে কী আকাশ পথে এগোনো যায়? ”

অগত্যা রঙ্গিত দেবতা চুপ করে গেলো । পথ চলতে  পাখি যেদিকে যায় রঙ্গিত ও সেদিকেই বয়ে যায়। ফলে   নিরুপায় রঙ্গিত দেবতাকে এঁকেবেঁকে সমতলের দিকে এগিয়ে যেতে হয়। ক্লান্ত,  হতাশ, পরাজিত রঙ্গিত সমতল এ পৌঁছোনোর কিছুটা পূর্বেই দূর থেকে দেখে তিস্তা আগেই গন্তব্যে তার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।  ক্ষোভে রঙ্গিত তিস্তাকে জানালো , ” একজন নারীর কাছে পরাজয় মেনে নেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব।  এ অপমান আমি মেনে নিতে পারছি না। ”

ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে রঙ্গিত পথ ছেড়ে গ্রাম, চাষবাসের জমি, গাছপালা, জীবজন্তু,  পশু পাখি জলে  ভাসিয়ে দিতে  শুরু করে। তিস্তা রঙ্গিত কে শান্ত করে বলে, ” তুমি অসহায় প্রাণী, জীবদের  ক্ষতি করছো কেন? এদের তো কোনো দোষ নেই। বিহগ রাজ সকল কিছুর জন্য দায়ী।  তুমি দয়া করে শান্ত হও।”

তিস্তার কথায় রঙ্গিতের সম্বিত ফেরে। শান্ত হয়ে রঙ্গিত তিস্তার সাথে মিলিত হয়ে একসাথে সমতলের পথে বয়ে চলে।

আজ ও আমরা দেখি তিস্তা ও রঙ্গিত মিলিত হয়ে সমতলের দিকে বয়ে চলেছে।

মিষ্টি আলু

বহুকাল আগের কথা।  সিকিমের  একটা পাহাড়ী জঙ্গলের ভিতর ছোট্ট একটি কুঁড়ে ঘরে এক ভাই ও এক বোন বাস করতো। তাদের না ছিলো  বাবা ,  না ছিলো মা। দরিদ্র অনাথ ভাই বোনের কোনো আত্মীয়স্বজন না থাকায় অন্ন সংস্থানের জন্য  বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতো। কোনোমতে যা জুটতো তাই দিয়ে কষ্টে দিন কেটে যেতো।

এই দুই লেপচা ভাই বোন একে অপরকে ভীষণ ভালোবাসতো। প্রতিদন দুজনে মিলে খাবার সংগ্রহের জন্য বনে যেতো। ঘুরে ঘুরে এ গাছ ও গাছ থেকে বুনো ফলমূল সংগ্রহ করে খেতো। কখনও কখনও  মাটি খুঁড়ে মিষ্টি আলু বের করে খেয়ে পেট ভরাতো। এইভাবে তাদের দিন কেটে যাচ্ছিলো। দরিদ্র হলে ও তাদের জীবনে ছিলো শান্তি।

একবছর দেশে  খরার প্রার্দুভাব দেখা দিলো । অনাবৃষ্টির ফলে  চাষের জমিতে  ফসল ফললো না। নদী, ঝর্ণা জল  শুকিয়ে যেতে লাগলো। সবুজ গাছপালা শুষ্ক  হলুদ বর্ণে পরিণত হলো।  পশু পাখি ক্ষুধা পিপাসায় কাতর হয়ে খাবার সন্ধানে   ঘুরে বেড়াতে লাগলো। লেপচা ভাই বোন অনাহারে  তৃষ্ণায় দুর্বল হয়ে পড়লো।  বনের গাছ  হলো ফলমূলহীন, মাটির তলায় মিষ্টি আলুর কণামাত্র নেই। বিস্তীর্ণ স্থান জুড়ে শুধু রুক্ষ্ম, হলুদ,  শুষ্ক মাটি।

লেপচা ভাইবোন বনের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে এককণা খাবার সন্ধানে ঘুরতে লাগলো । দীর্ঘ উপবাসে তাদের শরীর রুগ্ন, শীর্ণ হয়ে পড়লো ।  লেপচা বোন অতি  কষ্টে পথ চললে ও ভাইয়ের চলৎশক্তি একেবারে কমে এসেছিলো।

একদিন  দীর্ঘক্ষণ চলার পর ভাই বোন পরিশ্রান্ত হয়ে একটি জায়গায় এসে পৌঁছালো। তারা ভাবলো, আজ হয়তো সেখানে মাটি খুঁড়লে মিষ্টির আলুর খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। বোন দ্রুত মাটি খনন করতে শুরু করলো।  খাওয়ার চিন্তায় তো  ভাইয়ের প্রাণ ওষ্ঠাগত। চিৎকার করে অধৈর্য্য হয়ে ভাই বোনকে বলে চললো, “কিউ” ( লেপচা ‘কিউ ‘ শব্দের অর্থ মিষ্টি আলু)।

বোন প্রত্যুত্তরে বলল,” ক্যয়ন” ( লেপচা ‘ক্যয়ন’ শব্দের অর্থ আমি তোমায় দিচ্ছি)।

ক্ষুধার তাড়নায় বোন মিষ্টি আলুর সন্ধানে  ক্রমাগত মাটি খুঁড়ে চলতে লাগলো । ধীরে ধীরে সেখানে  বিরাটকায় গহ্বর তৈরী হলো। এদিকে সূর্য তখন পশ্চিমে ঢলে পড়ছে। এতক্ষণ মাটির খননের পর  হঠাৎ গর্তটা ভেঙে পড়লো আর লেপচা বোন মাটি চাপা পড়ে মারা গেলো।  বোনের শোকে   ভাই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো। না খেতে পেয়ে দুই ভাই বোনের অকালে মৃত্যু হলো।

অবশেষে লেপচা ভাই এবং বোন দুটি পাখির আকার ধারণ করলো। গ্রামবাসী তাদের নাম দিলো ‘কিউ’ ও ‘ক্যয়ন’।

এখনও সিকিমের সেই জঙ্গল থেকে যখন কোনো এক পাখি ” কিউ” স্বরে ডেকে ওঠে তখন অপরদিক থেকে আরেক পাখি উত্তর দেয় ” ক্যয়ন”।  গ্রামবাসীদের ধারণা এই পাখি দুটিই সেই ক্ষুধার্ত লেপচা ভাই- বোন।

জ্যামফি মুংএকটি ইয়েতি….

অনেকদিন আগে একসময় হিমালয়ের পাদদেশে একজন  খামারের মালিক বাস করতো। তিনি ছিলেন জাতিতে লেপচা। তার প্রচুর জমিজমা থাকায় একা সব কিছু দেখাশোনা করা কঠিন হয়ে পড়ছিলো।  তাই তার খামারের গবাদি পশুর দেখাশোনার জন্য আতেক নামে একটি  লেপচাকে  নিযুক্ত করলো। আতেককে সকল দায়িত্ব সঁপে দিয়ে খামারের মালিক তার বাবা -মায়ের সাথে পুরো  শীতকাল কাটাতে  নিজের শহরে চলে গেলো।

গ্রামের নির্জন পরিবেশে আতেক রয়ে গেল একা। সারাদিন পশু পালন করে, তাদের খেতে দেয়, খামারের যত্ন নেয় কিন্তু সন্ধ্যা হতেই চারিপাশ নিঝুম হয়ে গেলে কিছুতেই তার সময় কাটতে চায় না। এমনই এক সন্ধ্যায় একাকী  বিরক্ত হয়ে, আতেক তার “Puntaong Patit”( চারটি গর্ত করা  লেপচা বাঁশের বাঁশি) বের করলো। আতেক একজন দক্ষ বাঁশি বাদক ছিলো। সে বাঁশির গর্তে  আঙ্গুলের ছোঁয়ায়  মায়াময় বিষণ্ন,   মনোরম সুর বাজাতে লাগলো। এইভাবে দিনের পর দিন কেটে যেতে লাগলো । আতেক  সকালে পশুদের দেখাশোনা করতো আর রাত হলেই  বাঁশির সুর পাহাড়ে ছড়িয়ে দিতো।

পঞ্চম সপ্তাহের তৃতীয় রাতে সেই  খামারে একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো। সে রাতে, জ্যামফি মুং নামে একজন নারী  ইয়েতি হঠাৎ আতেকের  বাঁশি বাজানোর সময় তার পিছনে এসে দাঁড়ালো।

জ্যামফি মুং বিরাট  লম্বা, লোমশ এবং আক্রমণাত্মক, এবং তার বক্ষযুগল আজানুলম্বিত।  ইয়েতিকে দেখে আতেক আতঙ্কিত হলেও  তার বাঁশি বাজিয়ে যেতে লাগলো।  সারা রাত ইয়েতি বাঁশির সুর শোনার পর ভোর হতেই  সেখান থেকে চলে গেল।

এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি প্রতি রাতে  আতেককে জেগে থাকতে বাধ্য করলো। বিরতি নেওয়ার চেষ্টা করলেও   জ্যামফি মুং জোর করে বাঁশিটাকে আতেকের  ঠোঁটে গুঁজে দিতো। জীবন ভয়ে  হয়ে  ভীত আতেকের কাছে  ইয়েতির আদেশ মানা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না।

হতাশ এবং ক্লান্ত আতেক বহু চিন্তার পর ইয়েতির হাত থেকে নিস্তার পেতে  একটি পরিকল্পনা তৈরী করলো।  একদিন যে  জায়গায় সে বসে বাঁশি বাজাতো সেখানে আগুন জ্বালায়।   রাতে ভয়ঙ্কর ইয়েতি  খামারে এসে দেখে আতেক তার সমস্ত তখন  শরীরে মাখন লাগাচ্ছে। আতেককে  অনুকরণ করার চেষ্টা করে, জ্যামফি মুং সেই  একই কাজ করলো । ইয়েতির সমস্ত শরীর মাখনে চকচক করতে লাগলো। হঠাৎ আতেক  আগুনের ভিতর  রাখা কাঠের খন্ডকে তুলে নিয়ে এমন ভান করলো, যেন সেই আগুন দিয়ে নিজের শরীর ঝলসাতে চাইছে।  জ্যামফি মুং ও মহানন্দে আতেক কে অনুসরণ করে প্রজ্জ্বলিত কাঠের খন্ড তুলে তার শরীরে ছোঁয়াতেই দাউদাউ করে সারা দেহে আগুন লেগে গেলো। ইয়েতির লোমশ দেহ নিমেষে ঝলসে উঠলো।

ইয়েতিও অনুসরণ করেছে। আগুনের লেলিহান শিখায় কাতর হয়ে যন্ত্রনায় ছটফট করতে করতে জ্যামফি মুং বরফে ঢাকা পাহাড়ে পালিয়ে গেলো।

তখন থেকে লেপচা উপজাতিদের ধারণা, এই কারণেই  ইয়েতিরা সকল বসতি থেকে বহু  দূরে উঁচু পাহাড়ে বাস করে। ইয়েতারা।  শিস  ধ্বনি এবং বাঁশির আওয়াজে আকৃষ্ট হয়। সে কারণে  লেপচা উপজাতিরা এই দুটি কাজকেই নিষিদ্ধ বলে মনে করে।

নায় মায়েল কিংয় (স্বর্গ রাজ্য)

অনেক অনেক কাল আগে বহু  দূরে সিকিম নামের একটি স্থানে কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বতের ঢালে নায় মায়েল কিওং নামে একটি জাদুকরী জায়গা ছিলো। সিকিমের অপর একটি স্থানের একটি গ্রামে একটি পরিবার বাস করতো। সেই পরিবারের একটি শিশু তার বাবা, মা, ঠাকুমার সাথে দিন কাটাতো। একদিন সে  দেখলো, তার বাবা মন্ত্র উচ্চারণ করে হাতের স্পর্শে একটি আহত পাখিকে সুস্থ করছে।  ঘটনাটি দেখার পর সে তার ঠাকুমার কাছে দৌঁড়ে গেলো।  তারপর তাকে জিজ্ঞেস করলো, ” ও ঠাকুমা, আমায় বলো না গো? বাবা কোনো ওষুধ ছাড়াই পাখিটাকে কী করে সারালো?”

ঠাকুমা মুচকি হেসে বললো, ” তোমার বাবার জাদুশক্তি আছে। সেই শক্তি বলে মন্ত্র উচ্চারণ করে সকল পাখিদের ক্ষত সারিয়ে তোলে,তাদের পূর্ণজীবন দান করে।  ”

শিশুটি বলল, ” জাদুশক্তি? কীভাবে বাবা এই ক্ষমতা পেলো? আমায় বলো। ”

ঠাকুমা তখন বলতে লাগলো, একসময় তোমার বাবা একবার দক্ষ শিকারী ছিলো একবার শিকারের জন্য গভীর অরণ্যে গিয়েছিলো। সেখানে সে একটি  বুনো শূকরের সন্ধান পায়। শূকরটি তখনও ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে ছিলো। আসলে  শূকরটি কোনো সাধারণ প্রাণী ছিলো না।

“তারপর ওই শূকরের কী হলো? বল।” নাতির কথায় ঠাকুমা আবার বলতে শুরু করলো। ” তোমার বাবা শূকরটিকে মারার জন্য তীর ধনুক নিয়ে প্রস্তুত  হতেই শূকরটি ঝোপ থেকে লাফ দিয়ে শিকারীর মুখোমুখি দাঁড়ালো। সে তখন রূপ পরিবর্তন করে হিংস্র বাঘে পরিণত হয়েছে। শিকারী তো অবাক। সে  তখন ক্ষুধার্ত বাঘের মুখোমুখি ।  একটু সাহস সঞ্চয় করে বাঘের দিকে তীর তাক করতেই বাঘটি উড়ন্ত ড্রাগণে পরিণত হলো।  ডানা মেলে ড্রাগণটি  উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় আশ্রয় নিলো। শিকারী ড্রাগণকে অনুসরণ করে বহু কষ্টে সাদা বরফে আবৃত দুর্গম পাহাড়ের উপরে উঠে দেখলো ড্রাগন সেখানে বসে আছে। শিকারী তার দিকে এগোতেই ড্রাগণ মুখ থেকে আগুন বের করে তুষার ড্রাগণে পরিণত হলো। এই দৃশ্য দেখে  শিকারী আতঙ্কে পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে  পাহাড়ের শিখর থেকে পা পিছলে নীচে পড়তে লাগলো। সেই সময় ড্রাগণ একটি পাখির আকার ধারণ করে শিকারীকে ছোঁ মেরে নিয়ে আকাশে উড়তে শুরু করলো। শিকারী প্রাণে বেঁচে গেলেও ভয়ে অচেতন হয়ে গিয়েছিলো। পাখিটি শিকারীকে নিয়ে নায় মায়েল কিয়ং এ ফেলে দিলো  । কিছুক্ষণ পর সূর্যের আলো চোখে পড়তেই শিকারীর ঘুম ভাঙলো।  সে দেখলো, একটি অসাধারণ সুন্দর জায়গায় সে শুয়ে আছে আর সামনে দুজন  বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। শিকারী তাদের প্রশ্ন করলো, ” আমি কী এখানে থাকতে পারি?”

বৃদ্ধ উত্তর দিলো, ” অবশ্যই পারো, তবে শুধু আজ রাতটুকু।  কালই তোমাকে এখান থেকে চলে যেতে হবে।”

নায় মায়েল কিয়ং এ ধীরে ধীরে রাত নামতে লাগলো। শিকারীর চোখে ঘুম নেমে এলো। পরদিন ভোর হতেই সে দেখলো তার পাশে দুটি শিশু শুয়ে আছে। শিকারী আশ্চর্য হয়ে ভাবতে লাগলো, কারা এই দৈব্য শিশু?

কিন্তু সেখানে শিকারী আর কাউকে খুঁজে পেলো না। এমনকি গতরাতের সেই দুই বৃদ্ধ ও বৃদ্ধাকেও আর পাওয়া গেলো না। কিছু সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর শিকারী দেখলো দুজন যুবক ও যুবতী তার দিকেই আসছে। শিকারী তাদের পরিচয় জানতে চাইলে তারা বলল, “আমরাই গত রাতের বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধা। প্রতিদিন ভোর হতেই আমরা শিশু হয়ে যাই। দিন বাড়ার সাথে সাথে আমাদের বয়স বাড়তে থাকে আর রাতে আমরা বার্ধ্যকে উপনীত হই। আমরা বৃষ্টির ঋতুকে নিয়ন্ত্রন করি।  আমারা  সব সময় নায় মায়েল কিয়ং এ থাকি। তোমায় দেওয়া একটি দিন শেষ হয়ে গেছে। এবার তোমার নিজের গ্রামে ফেরার পালা। তুমি ফিরে যাও শিকারী।”

শিকারী তাদের বিদায় জানিয়ে সেখান থেকে বিদায় নিলো।

ঠাকুমা একটু থেমে বললো, একটি পাখী তোমার বাবার প্রাণ বাঁচিয়ে ছিলো।  তাই পক্ষীকুলের প্রতি শ্রদ্ধায়  সে শিকার করা বন্ধ করে দেয় এবং নায় মায়েল কিয়ং থেকে বিশেষ ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়ে গ্রামে পাখীদের চিকিৎসায় মনোনিবেশ করে। সেই সময় থেকেই তোমার বাবা পাখিদের চিকিৎসা করে আসছেন।

Ajit Dash

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ভাষা
Scroll to Top