সাহিত্যের বর্তমান যুগকে মনোবিজ্ঞানের যুগ বলা যেতে পারে। সাহিত্য এখন কেবল মনোরঞ্জনের সামগ্রী নয়। মনোরঞ্জন ছাড়া এর আরো কিছু উদ্দেশ্য রয়েছে। সাহিত্য এখন কেবল বিরহ এবং মিলনের রাগ আলাপ করে না। এই শিল্প জীবনের সমস্যাবলী বিচার করে, এদের সমালোচনা করে, এদের সমাধান করতে চেষ্টা করে।
নীতিশাস্ত্র এবং সাহিত্যের কার্যক্ষেত্র এক, কেবল এদের রচনাবিধানে পার্থক্য । নীতিশাস্ত্রও জীবনের বিকাশ এবং পরিছন্নতা চায়, সাহিত্যও তাই চায়। নীতিশাস্ত্রের মাধ্যম তর্ক এবং উপদেশ। এই শাস্ত্র যুক্তি এবং প্রমাণের মাধ্যমে বুদ্ধি এবং বিচারকে প্রভাবিত করতে চেষ্টা করে। সাহিত্য নিজের জন্য নির্বাচন করেছে মনোভাবনার ক্ষেত্র। সাহিত্য সেইসব তত্ত্বকেই রাগাত্মক ব্যঞ্জনার দ্বারা আমাদের অন্তস্থল পর্যন্ত পৌঁছায়। এর কাজ আমাদের সুন্দর ভাবনাকে জাগিয়ে তুলে তার মধ্যে ক্রিয়াত্মক প্রেরণা সৃষ্টি করা। নীতিশাস্ত্রবিদ অনেক প্রকার প্রমাণ দিয়ে আমাদেরকে বলেন, এরকম করো, নইলে তোমাকে পস্তাতে হবে। শিল্পী সেই প্রসঙ্গকেই এমনভাবে আমাদের সামনে উপস্থিত করেন তাতে তা আমাদের নিজস্ব হয়ে যায়, আর তা আমাদের আনন্দের বিষয় হয়ে যায়।
সাহিত্যের অনেক পরিভাষা করা হয়েছে। কিন্তু আমার বিবেচনায় সবচেয়ে সুন্দর পরিভাষা, ‘জীবনের সমালোচনা’। আমরা যে রোমান্টিসিজমের যুগের মধ্য দিয়ে পার হয়েছি, জীবনের সাথে তার কোনো সম্পর্ক ছিল না। সাহিত্যিকদের মধ্যে একদল তো বৈরাগ্যের দোহাই দিত, অপর দল শৃঙ্গাররসে ডুবে ছিল। পতন কালে প্রায় সকল সাহিত্যের এই অবস্থা ছিল। বিবেচনার শিথিলতাই পতনের সবচেয়ে খারাপ লক্ষণ। যখন সমাজের মস্তিষ্ক অর্থাৎ শিক্ষিত শাসক ভাগাভাগি আর বিষয় ভোগে লিপ্ত হয়ে যায় তখন বিবেচনার অগ্রগতি রুদ্ধ হয়ে যায় আর অকর্মণ্যতার আড্ডা জমতে থাকে। এমনিতে তো ইতিহাসের উজ্জ্বল যুগেও ভোগ বিলাসের কোনো কমতি ছিলনা; কিন্তু পার্থক্য এটুকুই যে এক অবস্থায় ভোগ আমাদেরকে কর্মের জন্য উত্তেজিত করতে থাকে, অন্য অবস্থা এটি আমাদেরকে ভীরু এবং বিচারশূন্য করে ফেলে। সমাজ ইন্দ্রিয়সুখে এতটা ডুবে যায় যে তার আর কোনো বিষয়ের চিন্তা থাকে না। তার অবস্থা হয় সেই মদ্যপের মতো যার মধ্যে থাকে কেবল মদ্যপানের চেতনা। তার আত্মা এতটা দুর্বল হয়ে যায় যে সে মদ্যপানের আনন্দও উপভোগ করতে পারে না। সে পান করে কেবল পান করবার জন্য, আনন্দের জন্য নয়। যখন শিক্ষিত সমাজ এই অবস্থায় উপনীত হয় তখন সাহিত্যের ওপর এর প্রভাব না পড়ে পারে কী করে? যখন কিছু মানুষ ভোগে ডোবে, তখন কিছু মানুষ বৈরাগ্যতেও ডুববে। ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া তো থাকেই। বেশ্যালয় এবং মঠ একে অন্যের জবাব। মঠ না হলে বেশ্যালয়ও হত না। এমন যুগে রোমান্সই সাহিত্যশিল্পের আধার ছিল। কিন্তু এখন অবস্থা অতি দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। আজকের সাহিত্যিক জীবনের প্রশ্ন থেকে পালাতে পারেন না। যদি তিনি সামাজিক সমস্যাবলীর দ্বারা প্রভাবিত না হন, যদি তিনি আমাদের সৌন্দর্যবোধ জাগাতে না পারেন, যদি তিনি আমাদের মধ্যে ভাব এবং বিচারের জাগরণ ঘটাতে না পারেন, তবে তাঁকে এই উচ্চপদের যোগ্য মনে করা হয় না। পুরানো জমানায় ধর্মসম্প্রদায়ের হাতে সমাজের নিয়ন্ত্রণ ছিল। আমাদের মানসিক এবং নৈতিক সংস্কার ধর্মের আদেশের অনুগামী ছিল। এখন সেই দায়িত্ব সাহিত্য নিজের কাঁধে নিয়েছে। ধর্ম ভয় অথবা লোভের মাধ্যমে কাজ করত। স্বর্গ এবং নরক, পাপ এবং পুণ্য ছিল তার যন্ত্র। সাহিত্য আমাদের সৌন্দর্যবোধকে সজাগ করতে চেষ্টা করে। মনুষ্যমাত্রের ভেতরেই ভাবনা থাকে। যাঁর মাঝে এই ভাবনা প্রবল আর তার সাথে একে প্রকাশ করবার সামর্থ্যও রয়েছে তিনি সাহিত্যের উপাসক হয়ে যান। এই ভাবনা তাঁর মধ্যে এতটাই তীব্র হয়ে যায় যে মানুষের মধ্যে, সমাজের মধ্যে, প্রকৃতির মধ্যে যা কিছু অসুন্দর, অসৌম্য, অসত্য রয়েছে সেই সব কিছু তাঁর জন্য অসহ্য হয়ে যায় আর তিনি তাঁর সৌন্দর্যবোধের মাধ্যমে ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে সুরুচিপূর্ণ জাগৃতি নিয়ে আসতে ব্যাকুল হয়ে পড়েন। বলা যেতে পারে,তিনি মানবতার, প্রগতির, সততার উকিল। যে দলিত, পীড়িত, আহত – হোক ব্যক্তি বা সমাজ – তার পক্ষপাতিত্ব এবং ওকালতি সাহিত্যিকের ধর্ম হয়ে যায়। তাঁর আদালত সমাজ। এই আদালতের সামনে তিনি তাঁর নালিশ পেশ করেন এবং আদালতের ন্যায়বুদ্ধি ও সৌন্দর্যবোধকে প্রভাবিত করেই তিনি সন্তোষ লাভ করেন। কিন্তু সাধারণ উকিলের মতো তিনি সত্যমিথ্যা সব দাবী পেশ করেন না, কিছু বাড়িয়ে বলেন না, কিছু কমিয়ে বলেন না, সাক্ষীকে শিখিয়ে-পড়িয়ে নিয়ে আসেন না। তিনি জানেন, এসকল চাতুর্যের মাধ্যমে সমাজের আদালতে জয়ী হওয়া যায় না। এই আদালতে তখনই শুনানি হবে, যখন আপনি সত্য থেকে এক বিন্দু সরে না যাবেন। কেবল তখন আদালত বিপক্ষে রায় শোনাবে না। আর এই আদালতের সামনে তিনি তখনই মক্কেলের সত্যরূপ দেখাতে পারবেন যখন মনোবিজ্ঞানের সহায়তা নেবেন। যদি তিনি সেই দলিত সমাজের অংশ হন তখন তাঁর কাজ কিছুটা সহজ হয়ে যায়। কারণ, তিনি নিজের মনোভাবের বিশ্লেষণ করে নিজের সমাজের ওকালতি করতে পারেন। কিন্তু অধিকাংশ সময় তিনি নিজের মক্কেলের অন্তর্গত প্রেরণার সঙ্গে, তার মনোগত ভাবের সঙ্গে অপরিচিত থাকেন। এমন অবস্থায় তাঁর পথপ্রদর্শক মনোবিজ্ঞান ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। এজন্যই সাহিত্যের বর্তমান যুগকে আমরা মনোবিজ্ঞানের যুগ বলেছি। মানববুদ্ধির বিভিন্নতাকে মেনেও আমাদের ভাবনা সাধারণত একরকম হয়। পার্থক্য হয়ে থাকে কেবল বিকাশের ক্ষেত্রে। কিছু কিছু মানুষের মধ্যে বুদ্ধির বিকাশ এতটা প্রখর হয় যে তা ক্রিয়ার আকারে প্রকট হয়ে ওঠে। তাছাড়া অন্য সকলের বুদ্ধি সুপ্ত অবস্থায় পড়ে থাকে। সাহিত্য এসকল ভাবনাকে সুপ্ত অবস্থা থেকে জাগ্রত অবস্থায় নিয়ে আসতে চেষ্টা করে। কিন্তু এই সত্যকে সাহিত্য কখনো ভুলতে পারেনা যে মানুষের মধ্যে যে মানবতা এবং সৌন্দর্যবোধ লুকিয়ে থাকে তাই তার লক্ষ্য হওয়া উচিত। উপদেশ আর শিক্ষার দরোজা তার জন্য বন্ধ। হ্যাঁ, তার উদ্দেশ্য যদি সত্যিকার ভাবাবেগে ডোবা শব্দাবলীতে সাধিত হয় তবে সে এসবের ব্যবহার করতে পারে।