সাহিত্যে সমালোচনার গুরুত্ব বর্ণনা করা নিষ্প্রয়োজন। সৎ সাহিত্য গড়ে ওঠে গুরুতর সমালোচনাকে আশ্রয় করেই। ইউরোপে বর্তমান যুগকে সমালোচনার যুগ বলা হয়ে থাকে। সেখানে প্রতিবছর কেবল সমালোচনা বিষয়ক গ্রন্থ প্রকাশিত হয় শত শত। এমন কি এসকল গ্রন্থের প্রচার, প্রভাব এবং স্থান সৃজনশীল রচনা থেকে কোনো অংশে কম নয়। কত পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত রূপে সমালোচনা বের হয়; কিন্তু হিন্দীতে হয় সমালোচনা হয়-ই না অথবা হলেও ঈর্ষা কিংবা মিথ্যা প্রশংসায় ভরপুর অথবা গভীরতাহীন এবং বহির্মুখী। এমন সমালোচক অনেক কম যিনি রচনার গভীরে প্রবেশ করে এর তাত্ত্বিক, মনোবৈজ্ঞানিক বিচার করতে পারেন। হ্যাঁ, কখনো কখনো প্রাচীন গ্রন্থের সমালোচনা চোখে পড়ে যাকে সত্যিকার অর্থে সমালোচনা বলা যায়। কিন্তু আমি একে সাহিত্যিক মুর্দা-পূজনই বলব। প্রাচীন কবি সাহিত্যিকদের যশসঙ্গীত আমাদের ধর্ম। কিন্তু যে প্রাণী কেবল অতীতে বসবাস করে, পুরনো সম্পদের স্বপ্ন দেখতে থাকে আর নিজের সামনে আসা বিষয় দেখে চোখ বন্ধ করে নেয়, সে যে কখনো নিজের পায়ের ওপর দাঁড়াতে পারবে – এ বিষয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে। পুরনোরা যা কিছু লিখেছেন, ভেবেছেন এবং করেছেন সেসব পুরনো অবস্থা এবং পরিস্থিতিতে করেছেন। নতুরেরা যা কিছু লেখেন, ভাবেন এবং করেন সেসব বর্তমান পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল। তাঁদের রচনায় সেইসব ভাবনা এবং আকাঙ্ক্ষা বিদ্যমান যাতে বর্তমান যুগ আন্দোলিত হচ্ছে। যদি আমরা প্রাচীন বিশাল পোড়োবাড়ীর পুজো করতে থাকি প্রতিমার মতো এবং নিজেদের নতুন ঝুপড়ির বিষয়ে কোনোরকম চিন্তা না করি তবে আমাদের দশা কী হবে তা আমরা অনুমান করতে পারি।
চলুন, দেখতে চেষ্টা করি এই অভাবের কারণ কী? ঈশ্বরের কৃপায় হিন্দী সাহিত্যে এমন লেখকের অভাব নেই যিনি বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত, সাহিত্যের মর্মজ্ঞ, সাহিত্যের তত্ত্ব বোঝেন। সাহিত্যের পথ-প্রদর্শন তাঁরই কর্তব্য। কিন্তু হয় তিনি হিন্দী পুস্তকের সমালোচনা করা নিজের গৌরববিরোধী মনে করেন অথবা হিন্দী সাহিত্যে তিনি আলোচনার যোগ্য কিছু খুঁজে পান না কিংবা নিজের গভীর বোধ প্রকাশ করবার জন্য হিন্দী ভাষাকে তাঁর যথেষ্ট বলে মনে হয় না। এই তিন কারণের মাঝেই কিছু না কিছু সত্য রয়েছে, কিন্তু হিন্দী সাহিত্যের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে কি এর চিকিৎসা করা যাবে? চোখ বন্ধ করে বসে থাকলেই কি সমস্ত বাধা-বিপত্তি দূর হয়ে যাবে? আমাদেরকে সাহিত্যসৃষ্টি করতে হবে, হিন্দীকে ভারতের প্রধান ভাষা বানাতে হবে, হিন্দীর মাধ্যমে জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি মজবুত করতে হবে। এভাবে উদাসীন হয়ে বসে থাকলে কি এই উদ্দেশ্য সফল হবে? ইউরোপীয় ভাষাসমূহের উন্নতি এইজন্য হচ্ছে যে সেখানে বুদ্ধিমান এবং হৃদয়বান ব্যক্তিগণ এ বিষয়ে আগ্রহী। বড় বড় পদস্থ কর্মকর্তা, নেতা, অধ্যাপক এবং ধর্মাচার্যগণ সাহিত্যের অগ্রগতির সঙ্গে পরিচিত থাকা নিজের কর্তব্য বলে মনে করেন। শুধু তাই নয়, বরং নিজের সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা তাঁর জীবনের একটি অংশ, ঠিক তেমনি যেমন নিজের দেশের নগর এবং প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী ঘুরে বেড়ানো। কিন্তু আমাদের দেশে উচ্চকোটির মানুষ দেশীয় সাহিত্যের প্রতি তাকানো নিজেকে হেয় প্রতিপন্ন করা বলে মনে করেন। কতজন তো অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে বলেন, হিন্দীতে আছেই বা কী? যদি হাতে গোনা কিছু মানুষ থাকেনও, তাঁরা মনে করেন, এই ক্ষেত্রে এসে আমরা দয়া করেছি। তাঁরা এই আশা করেন যে হিন্দী-জগৎ তাদের সকল কথা চোখ বন্ধ করে মেনে নেবে, ব্রহ্মবাক্য মনে করবে। সম্ভবত তাঁরা মনে করেন, মৌলিকতা ডিগ্রী অর্জন করে পাওয়া যায়। তাঁরা একথা ভুলে যান যে কোনো ডিগ্রীধারীর মৌলিক হওয়া বিরল। ডিগ্রী জানা এবং পড়া বিষয় প্রদর্শন এবং পরিবর্তনের মাধ্যমে পাওয়া যায়। মৌলিকতা এর বাইরে অন্য কিছু। যদি কোনো ‘ডক্টর’ কিংবা ‘প্রফেসর’ লেখেন তবে সম্ভবত উচ্চ মস্তিষ্কধারীগণের গোত্র তাকে স্বাগত জানাবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত হিন্দীর অধিকাংশ লেখক না ‘ডক্টর’ না ‘ফিলোসোফার’। তবে তাদের রচনা কেমন করে সম্মান পাবে এবং এদেরকে সমালোচনার যোগ্য মনে করা হবে? কোনো বস্তুর প্রশংসা তো ভিন্ন কথা, কখনো কখনো নিন্দাও কিছু না কিছু মর্যাদা বাড়ায়। অন্তত নিন্দার যোগ্য মনে করা হয়েছে বলে। আমাদের এই বুদ্ধিমানগণের গোত্র কোনো রচনার প্রশংসা করতে পারেনই না; কেননা এতে তাঁদের সম্মানহানি ঘটে। দুনিয়া বলবে, ইনি তো শ(বার্নার্ড শ), শেলী (পি বি শেলী) এবং শিলার বিষয়ে কথা বলে থাকেন, সেই আকাশ থেকে এত নিচে কিভাবে পতিত হলেন? হিন্দিতেও এমন কিছু হতে পারে, যার দিকে তিনি চোখ তুলে তাকাতে পারেন, এটাতো তাঁর শিক্ষা এবং গৌরবের জন্য লজ্জাজনক। বেচারা তিন বছর প্যারিস এবং লন্ডনে ঘুরে মরেছেন এই জন্য যে হিন্দী সাহিত্যের সমালোচনা করবেন? ফারসী পড়েও তেল বেচবেন! আমি এমন অনেক ভদ্রলোককে চিনি যিনি ‘ডক্টর’ বা ‘ডি. লিট.’ হবার আগে হিন্দীতে লিখতেন; কিন্তু যখন ডক্টরেট ডিগ্রী পেলেন, তিনি ঘুড়ির মতো আকাশে উড়তে শুরু করলেন। তাঁর দ্বারা সমালোচনা সাহিত্য সমৃদ্ধ হতে পারে। কারণ সৃজনশীল রচনার জন্য বিশেষ শিক্ষার প্রয়োজন না হলেও সমালোচনার জন্য বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হওয়া জরুরী। আমার কাছে অনেক অনেক তরুণ লেখকের লেখা আসে, প্রকাশিত হবার পূর্বে সম্মতির জন্য। লেখকের হৃদয়ে ভাব আছে, মস্তিষ্কে বুদ্ধি আছে, খানিকটা প্রতিভা আছে, খানিকটা অধ্যবসায়, আছে কিছুটা অলঙ্করণবোধ – তাঁর কেবল প্রয়োজন একজন ভাল পরামর্শদাতা। এটুকু সহযোগিতা পেলে তিনি কোথা থেকে কোথায় চলে যেতে পারেন; কিন্তু সে সহযোগিতা তিনি পান না। না এমন কোনো ব্যক্তি আছে, না সংগঠন, না সংস্থা। কেবল পুস্তক প্রকাশকদের পছন্দের ওপর ভরসা: প্রকাশক স্বীকৃতি দিলে ভাল, নইলে সমস্ত পরিশ্রম জলে যায়। প্রেরণাদায়ক শক্তির মধ্যে যশাকাঙ্ক্ষা সম্ভবত সবচেয়ে বলবান। যখন এই আকাঙ্ক্ষাও পূর্ণ হয় না তখন লেখক হাল ছেড়ে দেন আর এভাবে না জানি কত অস্থানের রত্ন লুকানোই থেকে যায়। অথবা প্রকাশক মহাদয়ের আদেশ অনুসারে লিখতে শুরু করেন। আর এভাবে কোনো নিয়ন্ত্রন না থাকার কারণে সাহিত্যে কুরুচি বেড়ে চলে। এদিকে জৈনেন্দ্রকুমারজীর পরখ(জৈনেন্দ্র কুমারের উপন্যাস পরখ), প্রসাদজীর কঙ্কাল (জয়শঙ্কর প্রসাদের উপন্যাস কঙ্কাল), নিরালাজীর অপ্সরা (সূর্যকান্ত ত্রিপাঠী নিরালার উপন্যাস অপ্সরা), বৃন্দাবনলালজীর গঢ়কুণ্ডার(বৃন্দাবন লাল বর্মার উপন্যাস গঢ়কুণ্ডার) ইত্যাদি বেশ কয়েকটি অতি সুন্দর রচনা প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এদের একটিরও গভীর, ব্যাপক, তাত্ত্বিক সমালোচনা প্রকাশিত হয়নি। যেসকল মহানুভবের এই ধরনের সমালোচনার সামর্থ্য রয়েছে তাঁদের কাছে সম্ভবত এই গ্রন্থ সমূহের সংবাদ পৌঁছেনি। তাঁরা অনেক নিম্নমানের গ্রন্থ ইংরেজিতে প্রকাশ করতে থাকেন এবং উচ্চকোটির সজ্জনেরা সেগুলো আনন্দের সঙ্গে সংগ্রহ এবং পাঠ করেন। কিন্তু এ সকল রত্নের (হিন্দী গ্রন্থসমূহ) প্রতি কারো মনোযোগ আকৃষ্ট হয় নি। প্রশংসা না করতেন, ত্রুটিগুলো যদি দেখিয়ে দিতেন, যাতে এদের লেখকগণ ভবিষ্যতের জন্য সচেতন হয়ে যান। কিন্তু সম্ভবত তাঁরা একেও নিজের জন্য লজ্জার বিষয় বলে মনে করেন। ইংল্যান্ডের রামসে ম্যাকডোনাল্ড, ব্যায়নর ল ইংরেজী সাহিত্যের ওপর আলোক ফেলবার মতো ব্যাখ্যা দিতে পারেন; কিন্তু আমাদের নেতাগণ খদ্দর পরে ইংরেজী লিখে এবং বলে গৌরব বোধ করেন, হিন্দী সাহিত্যের ক-খও জানেন না। এই উদাসীনতার পরিনাম হলো এই যে ‘বিজয়ী বিশ্ব তিরঙ্গা পেয়ারা'(বিজয়ী বিশ্ব তিরঙ্গা প্রিয়)-র মত ভাবশূন্য গান আমাদের জাতীয় জীবনে এতটা প্রচার পাচ্ছে। ‘বন্দেমাতরম’কে যদি ‘বিজয়ী বিশ্ব’-এর সামনে রেখে দেখেন তাহলে আপনি বুঝবেন, আপনার বেপরোয়া ভাব হিন্দী সাহিত্যকে আদর্শ থেকে কত নিচে নামিয়ে নিয়ে গেছে। যেখানে ভালো জিনিসের কদর করবার কিংবা পরখ করবার কেউ নেই সেখানে নকল, নিম্নমানের জিনিস বাজারে এলে তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। বাস্তবে আমাদের দেশে সাহিত্যিক জীবনের কোনো খবর নেই। নিচে থেকে ওপর পর্যন্ত মৃত্যুছায়া ছড়িয়ে আছে। এর প্রধান কারণ এই যে হিন্দী লেখকদের মধ্যে এমন অনেক লোক চলে এসেছে, যাদের স্থান ছিল অন্য কোথাও। আর যতক্ষণ পর্যন্ত শিক্ষিত সম্প্রদায় নিজের সাহিত্যিক কর্তব্যকে এমনি অবহেলা করতে থাকবেন, এই দশাই বিরাজ করবে। যেখানে সাহিত্য সম্মেলনের মতো সর্বজনীন সংস্থার সদস্যের মোট সংখ্যা দুশ’র বেশী নয় সেখানকার সাহিত্য গড়ে উঠতে এখনো অনেক দিন লাগবে।