আত্মঘাতী
পাখার স্তব্ধ ত্রিভুজাকার ছাতার নীচে
কেউ দড়ি টানছে,
ছিন্নভিন্ন তাঁবু, হাতের ছলনায় হয়ে উঠছে মুখর
এখানে কোথাও জল নেই
এখানে বিবিধ নিঃশ্বাসের ভিতর ভয়ের নিঃশ্বাস জেগে আছে
সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয় আছে;
আছে একের পর এক শূন্য মেঘ।
আমাদের ক্ষীণ অনুপস্থিতিতে
শব্দের অপচয় ঘটে যায়-
বেঁচে থাকা জরুরি মেনে নিলে
এই মরণশীলতা আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায়।
বুঝে নেওয়া যায় এই আমাদের মৃত্যুদ্বার
বেঁচে থাকার প্রকৃত উদ্দেশ্য হারিয়ে গেলেও
অবারিত শান্তিপ্রিয়তার খেলা চালিয়ে যাই
জীবনের হা-মুখে থাকা ত্রিকোণ সংশয়,
গেলা যায় না-
এপারে-ওপারে আলো-আঁধারের মাঝে বসে
গুনে যাই গোধূলির খুচরো পয়সা…
পথ
পথে হারিয়ে যাওয়া গাছ দেখে ডালপালা খুঁজে ফিরি। কোথাও মৌচাক দেখা যাচ্ছে না। ধুলোবালি আছে। শুধু ছায়ার দিকে তাকিয়ে থাকা সারস- শিকারের রাস্তা চেনে…
আমাদের হাঁটতে থাকা পাহাড়ি পথে পুনরায় গাছটি হারিয়ে যায়। আমরা ছেড়ে যাচ্ছি সমতলভূমি, আশ্চর্য চূড়ার কাছে পৌঁছতে হবে। এই দীর্ঘ আস্ফালন শান্ত হয়ে আসে, ভিতরের তীব্র বৃংহন ধসে যায়। উঁচুতে যাওয়ার পথে সমস্ত শিরা গাছ হতে থাকে, মাথা তুলি। দেখি হাতিটি ঝুলে আছে চলমান বৃক্ষের গায়ে…
তোমার পেছনে দেয়াল
তোমার পিছনে দেয়াল, দেয়ালে চড়ুইয়ের বাসা, অন্ধকারে নারীর আলো। সুখ চলে গেছে ছায়াময় পথে, ঘরের ভিতর জমে থাকা অজস্র দোলনা, স্থির! দেয়ালে স্পষ্ট হয় ছায়াপক্ষী। চড়ুইয়ের আড়ালে আরেকটি চড়ুই- কে কাকে দেখছে বোঝা যায় না। ঘোমটার ভিতর চোখ নামিয়ে রাখে যে নারী, তার ওড়নার জমিতে অরণ্য একে দিই। দেয়াল অদৃশ্য হয়, তোমার পেছনে দৃশ্যত হারিয়ে যায় বনজ অশ্রু…
নিমবৃক্ষ
মাটি চাপা দেওয়া হচ্ছে নিমবৃক্ষে-
ভুলে যাচ্ছ তার বৃক্ষ-উল্লাস?
বিস্মৃত হচ্ছ সেইসব সবুজ চেহারা?
প্রখর রোদে শাখাগুলো মাথা নাড়ল
আমি আবার সবকিছু চেয়ে নিচ্ছি
এই অপার সম্পদ ভুলে যেতে যেতে
অঙ্কুরিত হয় আমার মৃত্যুবীজ-
মৃত্যুকে হ্যাঁ বলি, গ্রহণ করবো বলে প্রস্তুত হই-
অথচ জীবন ফিরিয়ে দেবে বলে তুমি দাঁড়িয়ে আছ;
আমি তোমার দু-হাতে
জীবনের জাফরি কেটে রাখব বলে অপেক্ষা করি
দূর থেকে দেখি,
নিমফুলে ঢেকে যাচ্ছে তোমার শরীর
নিমফলের মতো আমাদের চোখ
ঢুকে যাচ্ছে একই গহ্বরে-
প্রতীক্ষা অনন্ত হতে থাকে
একটি গাছের গা-বেয়ে উল্লাস ও বিষাদ ওঠানামা করে।
দরোজা ও চৌকাঠ
তার দরজার পাল্লা জুড়ে ঝিমঝিম শব্দ। বিচিত্র হলুদ ফুল দিয়ে আঁকা নকশা। সেগুলির পাতা চিহ্নিত করবে বলে, এক মহাবৃদ্ধ এসে বসে সন্ধ্যার অন্ধকারে। মুহূর্ত জুড়ে জোনাকি-জোয়ার, বৃদ্ধের খৈনি ডলা শেষ হয় নীরবে। ঘোলা কাঁধ, এক হাতে জ্বলন্ত হুকো আঁকড়ে অজন্ম ফুল গোনে।
সহসা দরোজা খুলে গেলে, গহীন তমিস্রা তাকে বেঁধে দেয়, ধীরে ধীরে নিদ্রা এসে পেট ভরে- কত কত দিন আর রাত্রি বয়ে যায়, এমনকী বিষণ্ণ গোধূলিও। সেই মহাবৃদ্ধ চৌকাঠ জড়িয়ে থাকে, তার ভাঙা ডালপালা ঝলমল করে নিসর্গ বস্তির দিকে দিকে…
রং
গোধূলির রং দেখে উদাস হয়ে আসে চোখ
অনাবৃত হাত কল্পনা করে নেয় গন্ধর্ব বুক-
কার চেতনার কাছে কে ডুবে আছে
জানা যায় না…
মলিন জলের উপর চাঁদের ছায়া,
আকাশের আলো, জলের আঁধার মুখোমুখি হলে
পৃথিবীর তামাম আলো নিভে আসে
ছুরি ও তরমুজের মতো চিদ্ ও চেতনা-
ওঠে আর নামে…
রংহীন স্তনের কাছে পানীয়ের জন্য দাঁড়াই
অনন্ত ঘুমের পর চোখ খুলি,
সমস্ত স্থিরকৃত রঙিন ভিড়ের মাঝে
সাদাকালো সম্ভাবনারা একাকী এগিয়ে যায়…
—————————————————————————————————————–
ভালচন্দ্র ভানাজি নেমাড়ে -এর জন্ম ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে মহারাষ্ট্রের ইয়াল (Yawal) শহরে। ভারতীয় মরাঠি ভাষার একজন জনপ্রিয় লেখক, কবি, সমালোচক এবং ভাষাবিজ্ঞানী হিসেবেও তিনি সুপরিচিত। ইংরেজি ভাষার অধ্যাপক ভালচন্দ্র নেমাড়ে লন্ডনের ‘School of Oriental and African Studies’ -এ মরাঠি সাহিত্যে অধ্যাপনা করেছেন একবছরের কিছু বেশি সময়। পরবর্তী কালে তিনি অওরঙ্গাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় এবং গোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত হন।
তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘কোসলা’ [ ১৯৬২ ] মরাঠি সাহিত্য জগতের ভাষা, আঙ্গিক তথা বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। ২০১৪ সালে, নেমাড়ে তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘হিন্দু’-র জন্য জ্ঞানপীঠ পুরস্কারে ভূষিত হন- যা ভারতীয় সাহিত্য জগতের সর্বোচ্চ পুরস্কার। উপন্যাসের পাশাপাশি তাঁর কবিতাও অসাধারণত্বের দাবি রাখে। ‘দেখণী’ কাব্যগ্রন্থে তাঁর কবি প্রতিভার যথার্থ বিচ্ছুরণ ঘটেছে। মরাঠি কবিতার সংকেতধর্মিতাকে এমন এক উচ্চ পর্যায়ে তিনি নিয়ে গিয়েছেন যেখানে সময়ের আয়াম [ Time Dimension ] মুহুর্মুহু পরিবর্তিত হতে থাকে। শূন্যতা ও অনুভূতি পরস্পরকে কেন্দ্র করে বুনে চলে এক আশ্চর্য মায়াজাল। তাঁর নিজের ভাষায়, “An emotionless journey towards nothing is the initial source of feeling.”
২০১৩ সালে তিনি ‘পদ্মশ্রী’ লাভ করেন।