২৩
ইবলার ঘুম ভাঙে পরদিন সকালে। ঘুম ভাঙার পর থেকে একটা ব্যাপার নিয়ে ভাবছে। এপর্যন্ত জীবনে বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে গ্রহণ করা পরামর্শ অনুযায়ী একের পর এক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে পা ফেলার কারণে বর্তমানে তার জীবনে যে এক কঠিন রহস্যময় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাই নিয়ে চিন্তা করছে। এক মুহূর্তের জন্যও তার মনে এমন বিশ্বাস উঁকি মারে না যে জীবনে সে যাই করছে তার জন্য আসলে সে নিজেই দায়ী। বরং ইবলা মনে করে, সব কিছুর জন্য মূলত অন্যরা দায়ী— আশেপাশের মানুষজন দায়ী— দায়ী সৃষ্টিকর্তা। ‘সবই তাঁর ইচ্ছা এবং সবই আমার ভাগ্য, সৃষ্টিকর্তা নিজে আমার জন্য সবকিছু এভাবে ঘটবে বলেই নির্ধারণ করেছেন।’
সকালে নাস্তা করার জন্য ইবলা আশার ঘরে যায়। আশা মাত্রই ঘুম থেকে উঠেছে। তাকে আগের চেয়েও মোটা দেখাচ্ছে আজ।
‘কেমন ছিল লোকটা?’ আশা প্রশ্ন করে। বিয়ের পর প্রথম রাতের কথা জানতে চাইছে আশা।
‘আমি পুরুষদের সম্পর্কে তেমন কিছু জানি না। দু’জন মাত্র পুরুষ দেখেছি আমি এই পর্যন্ত আমার জীবনে। তবে বলতে পারি এই দুজনের ভেতর আউইল বেশি ভালো।’
‘কীভাবে?’
‘তা আমি বলতে পারবো না।’
‘লোকটি তোমাকে ওয়াজি ফুর টাকা দিয়েছে কাল রাতে?’
‘না, তিনি আমার সাথে চালাকি করেছেন।’
‘আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম সে চালাকি করবে।’
‘যাইহোক, সে চালাকি করেছে। এটাই কথা: আমি একটি টাকা ও পাইনি।’
আশা ইবলার কাছ থেকে আর কিছুই শুনতে আগ্রহ বোধ করে না। তার মূল আগ্রহ অর্থের প্রতি; এটা তার রক্তের ভেতর প্রবাহিত স্রোতের মতো মিশে আছে। পরবর্তী কিছুক্ষণের জন্য ইবলা আশাকে ভয়ংকর রকম ক্ষিপ্ত হতে দেখে। বাড়ির একজন ভাড়াটিয়াকে দেখে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠে আশা।
‘আস্তে। বাড়ির দরজাটা ভেঙে ফেলো না দয়া করে। দরজার কব্জা ভেঙে গেছে আগেই। এমন করছো কেন দরজাটাকে নিয়ে?’ একটি ঘরে ভাড়া থাকা বৃদ্ধ মহিলাকে কড়াভাবে ধমকে দেয় আশা। পানি নিয়ে খেলতে থাকা একটি বাচ্চাকে বলে, ‘চারপাশে পানি ছিটাবি না। পানি অপচয় করার খরচ আমি দিতে পারবো না। তোর মা কোথায়?’
‘ওখানে,’ বাচ্চাটি বলে। আশা বাচ্চার মাকে ডেকে ধমকে জানায় তার শিশুটিকে এভাবে পানি নিয়ে খেলা বন্ধ করতে হবে।
ইবলা বুঝতে পারছে না আশা এতো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠার কারণ কী। তার কাছে মনে হয়ে শুধুমাত্র টাকাই নিয়ন্ত্রণ করে আশার স্নায়ুকে। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে কোথাও এতোটুকু সন্তুষ্টি খুঁজে পাওয়া, কিংবা কথা থেকে বিন্দুমাত্র অসহ্য অনুভূতি বোধ করা- এই সবকিছুই আশার জীবনে আবর্তিত হয় টাকাকে কেন্দ্র করে। আগের রাতে মিলন শেষে টিফোর দিয়ে যাওয়া টাকাগুলো থেকে আশাকে কিছু দেওয়ার চিন্তাটি এই মুহূর্তে বাতিল করে দিল ইবলা। তাছাড়া টিফো ওকে টাকাগুলো ওয়াজি ফুর দর্শনী হিসেবে দেয়নি, ইবলাকে দিয়েছে কিছু কাপড় ও খাবার কেনার জন্য।
‘আমি কি চা বানিয়ে আনবো আমাদের দুজনের জন্য?’ রাগে গজগজ করা থামিয়ে আশা একটি টুল নিয়ে পাশে এসে বসলে ইবলা জিজ্ঞাসা করে।
‘হ্যাঁ। ভালো হয় তাহলে।’
‘আর পাশের বাড়ির মহিলার কাছ থেকে কয়েকটি রুটি কিনে আনবো?’
‘তোমার কাছে টাকা আছে?’
‘হ্যাঁ, অল্প কিছু টাকা আছে।’
‘তাহলে নিয়ে এসো,’ কথোপকথন সংক্ষিপ্ত করে বলে আশা।
সকালের নাস্তা শেষ করে উঠতেই জামা এসে ঢুকলো আশার ঘরে। ইবলা এবং আশা তখন একসাথে বসেছিল, কিন্তু কথা বলছিল না। তাদের চা পান করার খালি গ্লাস দুটি ইবলার দিকে রাখা। জামাকে দেখে ইবলা নিজেকে গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে দ্রুত: ঘুম থেকে উঠে এখনো সে মুখ ধোয়নি। আগে ভেবেছিল অন্যরা তার সম্পর্কে কী ভাবছে তা নিয়ে ইবলা মাথা ঘামায় না। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে অন্যদের তুলনায় নিজেকে কেমন দেখাচ্ছে এই মূল্যায়নটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ তার কাছে।
‘গতকাল রাতে যদি টিফোর সাথে আমার একটা ছবি তুলে রাখা যেত, তাহলে আজ জামাকে দেখিয়ে প্রমাণ করে দিতে পারতাম। কিন্তু জামা শুধু একজন বন্ধু, বেচারা বন্ধু। কিছুতেই সে বন্ধুর কৃতকর্মের জন্য দায়ী নয়। আসলে কেউই কারো কর্মের জন্য দায়ী নয়,’ জামাকে দেখে ইবলা মনে মনে ভাবে কথাগুলো।
‘নাবাদ,’ জামা ওদেরকে অভিবাদন জানায়।
‘নাবাদ,’ তারা দুজনেই অভিবাদন ফেরত দেয়।
‘ভাবলাম কাজে যাওয়ার আগে আপনার সাথে দেখা করে যাই। আউইলের কাছ থেকে কিছু এসেছে,’ জামা বলে।
‘আরেকটা ছবি?’ ব্যঙ্গ করে বলে আশা।
‘না।’
‘তাহলে কী?’ জিজ্ঞেস করে ইবলা।
‘টাকা,’ জামা বলে।
‘কতো?’ আশা জানতে চায়।
‘তিনশত সোমালি শিলিং।’
টাকার কথা শুনে আশা উঠে দাঁড়ায় খুব জলদি করে এবং জামার কাঁধে একটি হাত রাখে। এই কাজটি করতে গিয়ে সে জামার বুক পকেটে হাত ছোঁয়ায়। মনে হচ্ছে যেন জামার পকেটে হাত দিয়ে টাকা বের করার চেষ্টা করছে।
‘তুমি হলে গিয়ে আরেক চামচা, নবী কিদারের এজেন্ট। কথাটা আমার কাছ থেকে জেনে নাও ছোড়া,’ আশা বলে বিদ্রুপের স্বরে।
‘আমি কি টাকাগুলো দেব আপনাকে?’ জামা প্রশ্ন করে সোজাসুজি।
‘হ্যাঁ,’ আশা বলে। ‘আমাকে দাও। টাকাগুলো আমাকে দাও।’ জামা একবার ইবলার দিকে তাকায়। ইবলা মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে সামান্য হাসে।
আশা টাকা নেওয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছে লম্বা করে। উজ্জ্বল এক হাসিতে ভরে উঠেছে তার সমস্ত মুখ।
জামা জানায় আউইল আগের নির্ধারিত সময়ের চেয়ে একটু আগেই বাড়ি ফিরে আসবে। আর আউইলের কাছ থেকে নতুন কোনো খবর পেলে সে অবশ্যই তাদেরকে জানানোর চেষ্টা করবে, কথাটি বলে চলে গেল জামা।
ঘুরেফিরে আউইলের কথা মনে করিয়ে দেয় এমন সবকিছু ইবলা তার চারপাশ থেকে মুছে ফেলতে চেষ্টা করছে। দাদা এবং ছোট ভাইয়ের কথা মনে পড়ে ইবলার। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, আউইলের সাথে পবিত্র সম্পর্ক ভেঙে দেয়ার জন্য তার মনে কোনো অনুশোচনা নেই: কারণ আউইল নিজেও ইবলার সাথে একই কাজ করেছে। নিজের সাথে কয়েক মিনিট যুক্তিতর্ক করে ইবলা। আউইল শুরু করেছে প্রথমে: ‘নাকের বদলে নাক, কানের বদলে কান, কোরান তাই বলে,’ নিজেকে কথাটা আবার মনে করিয়ে দেয় ইবলা।
‘আমি যেদিন গ্রাম থেকে চলে এলাম সেদিন দাদার কী অবস্থা হতে পারে?’ ইবলা অনুমান করতে পারে না সত্যি বুড়োর অবস্থা কী হতে পারে।
চারপাশে তাকিয়ে দেখলো আশা নেই। চলে গেছে। ক্লান্ত কুকুরের মতো নিঃসাড় অনুভূত হচ্ছে ইবলার সমস্ত দেহ। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না, মস্তিস্ক চিন্তাহীন শূন্য, কিছুই ভাবতে পারছে না। শ্রান্ত শরীর অবসন্ন, নড়াচড়া করতে পারছে না। সবকিছুর উপর বীতরাগ, কিছুই করতে ইচ্ছে করছে না। অনীহা যেন সবকিছুতেই।
ইবলার মনে হলো কারো পায়ের শব্দ শুনেছে। কী ঘটছে দেখার জন্য মাথা তুলে চাইলো একবার। কিন্তু পরক্ষণেই চোখ বন্ধ করে ফেললো পরম ক্লান্তিতে। এক সেকেন্ডের জন্য তার মনে হলো পুরো বিশ্ব— জন্তু, মানুষ, প্রাণী এবং সাগর মহাসাগর, মানুষের তৈরী ভবন— সবকিছু ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছে, সবকিছু এখন তাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। এই মুহূর্তে এক সেকেন্ডের জন্য হলেও, একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ তার কেইসটিকে বিপজ্জনক বলে মনে করতে পারে। ইবলা সাতটি সমুদ্র এবং সাতটি পাহাড় আর আটটি স্বর্গের মধ্যখানে কোথাও দোদুল্যমান হয়ে ঝুলছে বুঝি।
ইবলার মাথা ঘুরছে। তবুও সে মাথা নাড়ে। মাথার ভেতর সে যা অনুভব করছে তা হচ্ছে একটি কল্পনাপ্রসূত ভয়, একটি দিবাস্বপ্ন যেখানে সে এখনও জেগে আছে, মোগাদিসিওতে কোথাও বসে আছে। তার গায়ের উপর দিয়ে কয়েকটি উট হেঁটে যাচ্ছে, ইবলার শরীরের উপর দিয়ে আর তার ভাইয়ের শরীরের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে উটগুলো পেরেক বসানো শক্ত পা ফেলে ফেলে। দাদার কথা চিন্তায় আসেনি, কারণ দাদার মতো একজন বৃদ্ধের মৃত্যু হতে পারে যেকোনো মুহূর্তে। এবং সেটাই স্বাভাবিক।
ঝাপসা স্বপ্নের ঘোরে ইবলা লক্ষ্য করে অন্যান্য দিনের মতোই সে ঘরের ভেতর বসে আছে। সকালের নাস্তা হিসেবে তারা সবাই দুধ খেয়েছে। ছোট বাচ্চারা আশেপাশে খুশিতে লাফাতে আরম্ভ করেছে। উট-পালক সবগুলো উটকে একে একে নাম ধরে ডাকছে। উটগুলো কোনো উত্তর দিলো না যতক্ষণ না একজন উট-পালক ছাউনির ভেতরে ঢুকে লাঠি দিয়ে উটগুলোকে আঘাত করতে আরম্ভ করলো। উট-পালকটি একটি ছোট ছেলে, ঠিক ইবলার ভাইয়ের মতোই রোগা পাতলা। উটগুলো এবার ছাউনি থেকে বেরিয়ে এসেছে। খুব ভোরে দাদা ওকে বলেছিল বিছানা থেকে উঠে দুধের পাত্রগুলো পরিষ্কার করতে। সেইদিনই দাদা বুড়োর হাতে ইবলার হাত তুলে দিবে বলে কথা দিয়েছিল। আর ইবলা, দাদার কথায় বিছানা থেকে নামতে অস্বীকার করে। বলে সে খুব অসুস্থ, ভীষণ পেট-ব্যথা করছে।
‘কিন্তু এক্ষুণি যা। ঘুম থেকে উঠ, সব ঠিক হয়ে যাবে,’ দাদা আদেশ করে।
‘পারবো না। আমি অসুস্থ।’
ইবলা ভীষণ বিরক্ত হয়েছে দাদার কথায় এবং সিদ্ধান্তে। গ্রামের সবার জন্য যে মানুষটি নিয়োজিত ও সহজলভ্য, সেই লোককে কীভাবে বিয়ে করবে ইবলা। বিয়ের কথা মনে করে একবার নিজের অস্তিত্বকেই ঘৃণা লেগেছে তার নিজের কাছে। দাদা ভীষণ করে অনুরোধ করছে ইবলাকে বিছানা থেকে উঠে দুধের পাত্রগুলো পরিষ্কার করতে যেতে, কিন্তু ইবলা দাদার কথা শুনবে না। ‘তাহলে তুই মরে যা,’ খুব রেগে গিয়ে দাদা বলেন।
উট-পালক একটি উটের পাঁজরে খোঁচা মারে। উটটি ছুটে বেরিয়ে আসে ছাউনির কুটির থেকে, তারপর লাফিয়ে লাফিয়ে পা দিয়ে বাতাসে লাথি মারতে থাকে। অন্য উটগুলো এই উটটিকে অনুসরণ করে। উট-পালক তাদেরকে সামলাতে চেষ্টা করলো প্রাণপণ, কিন্তু বৃথা চেষ্টা। উটগুলো প্রথমে ঘুরতে লাগলো, তারপর তারা কুঁড়েঘরের দিকে ছুটে গেল। ইবলা এখনো মেঝেতে শুয়ে আছে, যেখানে তার দাদা তাকে রেখে গিয়েছিল, আর যখন সে দুধের পাত্র পরিষ্কার করতে অস্বীকার করেছিল।
একটি উট ঘরের ভেতর দৌড়ে ঢুকলো, আর উটটি ইবলার পুরোটা শরীরের উপর দিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করে।
‘সাহায্য করো। আমাকে কেউ সাহায্য করো,’ ইবলা চিৎকার করে উঠে।
কিন্তু কেউ তার কথা শুনছে না।
ইবলা তখন মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। যখন উট-পালক দুটি কুঁড়েঘরের ভেতরে প্রবেশ করেছে, এবং ওর দাদাকে জীবনের শেষবারের মতো কালেমা পড়তে বলা হচ্ছে, যেহেতু সবাই ভাবছে তিনি এখন মারা যাবেন, কিন্তু ইবলার দাদা কালেমা পড়তে রাজি হচ্ছেন না।
খোদাকে ধন্যবাদ, এতক্ষণ এর সবই স্বপ্ন ছিল মাত্র।
যখন একটি পরিচিত কন্ঠস্বর কানে এসে লাগলো, তখন ইবলা বিস্মৃতি থেকে বেরিয়ে উঠে বসেছে কেবল। ইবলা নামে কেউ এই বাড়িতে থাকে কিনা, জানতে চাইছে পরিচিত কন্ঠস্বরটি। ভয়ানক ঘুম ও দিবাস্বপ্ন থেকে লাফ দিয়ে জেগে উঠে ইবলা উত্তর দেয়, ‘হ্যাঁ। আমি এখানে আছি।’
দেখা গেল বিধবা এসেছে এবং সাথে ইবলার ছোট ভাইটাকে নিয়ে এসেছে। ভাইয়ের সাথে দেখা হবার সাথে সাথে ইবলা কেমন আহত এবং প্রতারিত অনুভব করে নিজের কাছে।
এতদিন পর এই বাড়িতে ভাইকে কীভাবে অভ্যর্থনা জানাবে, বা কী কথা বলবে বুঝে উঠতে পারছে না কিছুতেই। ‘ওরা সবাই মিলে আমাকে হত্যা করেছে,’ ইবলার অবচেতন মন বলে এই কথা ইবলাকে। ‘কিন্তু দোষ আমার ভাইয়ের ছিল না। দোষী হচ্ছেন আমার দাদা, আর সেই বয়স্ক উট-পালক।’
ইবলা এবং তার ভাই একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর তাদেরকে নিজের ঘরের দিকে নিয়ে যাবার আগে ইবলা প্রথমে বিধবার সাথে কথা বলতে আরম্ভ করে।
২৪
ভাই এবং বিধবার এই হঠাৎ আগমন ইবলার কাছে বিরক্ত লাগে। কেন এসেছে এরা? আর একসাথে কেন? ভাইকে জিজ্ঞাসা করেনি, দাদা কেমন আছে— কিংবা, অন্তত, গ্রাম থেকে চলে আসার পর দাদা কেমন ছিলেন। ইবলা কিছুক্ষণ ইতস্তত করে। ‘আমরা যখন একা থাকবো হয়তো তখন ভাইকে এগুলো জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে,’ ইবলা ভাবে। ‘অথবা ভাই হয়তো বিধবার সাথে এসব কথা আলাপ করে করে ফেলেছে ইতোমধ্যে— আলাপ করার সম্ভাবনাই বেশি।’
আউইলের জামাকাপড় সব এখনো আশার কাছেই আছে। কিন্তু বিধবা স্বগোক্তির মতো করে প্রশ্ন করে, ‘আউইল কি তার সব কাপড় সাথে করে নিয়ে গেছে?’ ইবলার কাছে মনে হলো বিধবা হয়তো কিছু জানার চেষ্টা করছে?
‘না। না, তা করেনি। আমি তার কাপড় অন্য একটি জায়গায় রাখি,’ ইবলা ব্যাখ্যা করে বলে, বুঝলো একটা ভুল করে ফেলছে না জেনেই।
‘কোথায়?’
‘বাড়িওয়ালীর ঘরে।’
‘কেন? এই ঘরে যথেষ্ট জায়গা আছে। একরকম খালিই পড়ে আছে ঘরটি,’ বিধবা বলে।
‘আমাকে কাপড় কিনে দেওয়ার মতো টাকা ছিল না আউইলের কাছে। তিনি চলে যাওয়ার সময় ভীষণ ভেঙে পড়েছিলেন,’ প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে ইবলা বলে। ইবলার ভাই চুপচাপ বিছানায় বসে আছে। সে এখন যত দ্রুত সম্ভব গ্রামে ফিরে যেতে চায়। পরে ইবলাকে বলেছে এই কথা।
বিধবা প্রসঙ্গ পরিবর্তনের ব্যাপারটি লক্ষ্য করলো না— এক প্রসঙ্গ থেকে আরেকটি প্রসঙ্গ আসে। ইবলার ভাই চুপ করে আছে; সে সবসময়ই চুপ করে থাকে, যেন ছেলেটি মায়ের গর্ভে থাকার সময়েই সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছে, শুধু প্রশ্ন করা হলেই কথা বলবে। ভাইয়ের জন্য চিন্তা হয় ইবলার।
‘দাদার কী অবস্থা— নাকি তুমি আমার সাথে দাদার ব্যাপারে কোন কথা বলতে চাও না?’ বিধবা গোসল করতে যেতেই ইবলা প্রশ্ন করে ছোট ভাইকে।
‘তিনি মারা গেছেন।’
‘দাদা। মারা গেছেন? কবে?’ দাদার মৃত্যু হওয়া আর বেঁচে থাকা নিয়ে বিশেষ চিন্তিত না হয়েই প্রশ্নটি করে ইবলা।
‘আপনি যেদিন গ্রাম থেকে চলে এসেছেন, সেদিন।’
‘কীভাবে?’
‘মরে গেছেন, ব্যাস।’
‘উটের পায়ের নিচে পড়ে মরেছেন?’
‘না।’
‘তাহলে কীভাবে?’
‘কষ্টের আঘাতে।’
‘কিন্তু তা কেন হবে? তার কাছে আমি অতো মূল্যবান কিছু ছিলাম না। নইলে তিনি ওরকম একটা লোকের হাতে আমার হাত তুলে দিতে চাইতেন না।’
‘ওই লোকটার কী দোষ ছিল?’
‘কোন লোকের কথা বলছো?’
‘যার সাথে দাদা আপনার বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন?’
‘আমি তাকে বিয়ে করতে চাইনি।’
‘তাহলে আপনি যখন বেলেত ওয়েনে এলেন, তখন কী হয়েছিল?’
‘আমাদের কাজিনও আমার সাথে একই কাজ করতে চেয়েছিল। তার সুবিধা মতো একজন বাজে লোকের সাথে আমাকে বিয়ে দিতে চেয়েছিল।’
‘আর তারপর?’
এই ‘আর তারপর’ শব্দ দুটি ইবলার কানে লাগলো খট করে। শব্দ দুটিকে খুব অবান্তর আর বেশি বলে মনে হলো ইবলার কাছে। ভাইকে সে প্রায় বলেই ফেলেছিল যে আউইল তার কাছে থেকে চলে গেছে, সাদাদের দেশে গিয়ে একটি সাদা মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব করেছে। আর ইবলাও আউইলের সাথে একই কাজ করেছে। কিন্তু ছোট ভাইকে এসব কথা বলা উচিত নয়। নাকি উচিত? তাকে কি ইবলা সবকিছু জানাবে, প্রতিটি ঘটনা শুরু থেকে, প্রতিটি দুর্ঘটনার সকল বৃত্তান্ত? ভাইকে কি তার বলা উচিত যে টিফোর সাথে সে বিছানায় গিয়েছে, গতরাতে সে টিফোকে বিয়ে করেছে এবং আজ সন্ধ্যায় টিফো নামের লোকটি আবার আসতে পারে তার সাথে বিছানায় যাওয়ার জন্য— কারণ সে তার স্ত্রী? ভাইকে কি তার প্রতিটি গোপন কথা বলা উচিত? তা যদি না হয়, তবে সে এসব কথা আর কাকে বলবে? যদিও ভাই বয়সে তার চেয়ে অনেক ছোট, কিন্তু সে একটি ছেলে এবং তাই একজন মহিলার মতো ধারণ ক্ষমতা তার চরিত্রে নেই। যদিও ভাইয়ের বয়স কম, কিন্তু সে নিশ্চয় অন্যান্য পুরুষদের চেয়ে ভালো হবে এবং মানসিক চিন্তায় অধিক শক্তিশালী এবং আকর্ষণীয় ধারণা পোষণ করবে নিজের চরিত্রে। ‘চিন্তায় এবং দূরদর্শিতার যদি খুব ভালো নাও হয়, তবুও সেগুলো আমার মতো একজন মহিলার চেয়ে ভালো হবে অন্তত,’ ইবলা ভাবে।
‘আর তারপর কী হলো?’
‘কখন কী হলো?’
‘মোগাদিসিওতে আসার পর কী হলো।’
‘বেশি কিছু না,’ ইবলা উত্তর দেয় বিরসভাবে।
আশ্চর্যজনকভাবে, এইমুহূর্তে ইবলা নিজেকে প্ররোচিত করলো, ভাইকে সে আর ভয় পাবে না। কেন সে তাকে ভয় পাবে? ইবলা জানে গ্রামে একটি মেয়ের কথার চেয়ে ছেলের কথার মূল্য বেশি, মেয়েটি বয়সে তার চেয়ে বড়ো হলেও। কিন্তু এখন অবস্থা তেমন নেই। তারা এখন ভিন্ন জায়গায় আছে। ইবলার মনে হলো, গ্রামে থাকলে এই পরিস্থিতিতে যা হতো এখন ঠিক তার বিপরীত পরিস্থিতি হয়েছে।
‘তুমি পশুগুলোকে রেখে চলে এসেছো কেন?’ ইবলা ভাইকে উল্টো প্রশ্ন করে।
‘আপনিও তাই করেছেন, তাই না?’
‘কারণ আমি একজন নারী।’
‘আর আমি একজন পুরুষ।’
‘আমাকে তোমার সে কথা মনে করিয়ে দিতে হবে না।’ ইবলা ভাবে, ‘ইঁচড়ে পাকা ছেলে!’
‘আমাকেও পশুদের কথা মনে করিয়ে দেবার কোনো কারণ নেই আপনার,’ ভাই বলে।
‘তুমি কি গ্রামে চলে যাবে?’ কথাটি শব্দ করে বলে ইবলা মনে মনে বললো, ‘এক্ষুণি ভাগো এখান থেকে, বাছা!’
‘হ্যাঁ।’
‘কখন?’
‘যত তাড়াতাড়ি আপনি আমাকে ফেরত পাঠাতে পারেন, ততই মঙ্গল আমার জন্য।’
‘এই জায়গাটি তোমার তেমন পছন্দ হয়নি, সে কারণে কি চলে যেতে চাইছ?’ কথাটি বলে ইবলা খুব আশা করলো ভাইয়ের মুখের জবাবটি যেন তাই হয়।
আমি ঘৃণা করি এই জায়গা। এখানে অর্ধনগ্ন নারী, পাগল পুরুষলোক, ভীষণ কোলাহলপূর্ণ স্থান, নারী-পুরুষ হাত ধরাধরি করে চলছে। উফ সব মানুষ পাগল এখানে। এদেরকে গুলি করা উচিত— সবগুলোকে, এমনকি আপনাকেও।’
‘কেন?’
কারণ এদের কারোর ভেতর আত্মসম্মানবোধ নেই। আপনি জানেন, এই জায়গাটি আপনার মতো লোকে ভরা, এরা সবাই কোথাও না কোথাও থেকে বহিষ্কৃত হওয়া মানুষ। নিজের গ্রামের লোকজনের সাথে যারা ভালোভাবে চলতে পারেনি, তারা সবাই এখানে এসে ভিড়েছে।’
‘তবে এটা ভালো যে এখানে তারা সবাই একসাথে ভালোভাবে চলতে পারছে নিজের ইচ্ছে মতো। জীবন কাটাতে পারছে স্বাধীনভাবে।’
‘ “পাখি তার নিজের জাতের পাখির সাথেই উড়ে”, সোমালিরা বলে। এখানে তারা সবাই একই জাতের পাখি: বেমানান, নোংরা এবং খারাপ।’
ইবলা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। ব্যাপারটি সে আবারো ভাবলো। সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে, চলে যাওয়ার কথা বলার সাথে সাথেই ভাইকে সে গ্রামে পাঠিয়ে দেবে।
‘আগামীকাল সকালে চলে যেতে চাই আমি,’ ইবলার ভাই বলে।
‘ঠিক আছে। আমি তোমাকে কাল সকালে গ্রামে পাঠিয়ে দিবো।’
‘ধন্যবাদ,’ ভাই বলে।
বিধবা ঘরে আসে। সে একটি চমৎকার গোসল নিয়েছে। জানতে চায় তারা ভাই বোন কী সিদ্ধান্ত নিয়েছে শেষপর্যন্ত।
‘আমার ভাই আগামীকাল গ্রামে ফিরে যাবে,’ ইবলা বলে।
‘তাই নাকি? আমি ওকে তোমার সাথে মোগাদিসিওতে থাকতে বলেছি। আর এখানে স্কুলে ভর্তি হতে বলেছি।’
‘আমি এখানে থাকি আর এরা আমাকে ধরে বিধর্মী বানাক, তাই না?’ মুখ ঝাঁঝিয়ে বলে ইবলার ভাই। ‘না! আমি এখানে থেকে কালো অবিশ্বাসী হতে চাই না।’
‘চুপ থাকো। বড়োরা যখন কথা বলে, ছোটরা তখন তাদের মুখ বন্ধ রাখে। ভদ্রভাবে আচরণ করো। একটুখানি নম্রতা শেখো,’ ইবলা রেগে বলে তার ভাইকে। মনে হচ্ছে ভাইটি যদি এখানে কখনো না আসতো তাহলেই ভালো হতো।
‘তাহলে তোমার ভাই কিছুই জানতে পারতো না?’ বিধবা বলে। ‘আমি ওকে বলেছি যে তোমার মতো বোন থাকায় সে অনেক ভাগ্যবান। ছেলেটি এখানে তোমার কাছে থেকে প্রাথমিক শিক্ষার ক্লাসে ভর্তি হয়ে যেতে পারতো,’ (ইবলা নিজেও এসব জানতো না) ‘এবং আউইলের মতো শিক্ষক হতে পারতো ভবিষ্যতে। আউইল আমার কাছে যখন এসেছিল তখন তার বয়স ছিল চৌদ্দ। তখন মাত্র সে স্কুলে যাওয়া আরম্ভ করেছে। আর এখন সে একজন শিক্ষক। সাদাদের চেয়েও ভালো ইতালিয়ান ভাষা বলতে পারে। যাইহোক, তোমার ভাই যদি আগামীকালই ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে, তাহলে আমি তাকে আগামীকাল আমার সাথে নিয়ে যাব। শুধু, কালকে যাওয়াটা আমার জন্য খুব কষ্টের হবে। একটি দিন বিশ্রাম নিতে পারলে ভালো হতো আমার জন্য।’
‘আগামীকাল সকাল বেলা। আমি আগামীকালই চলে যেতে চাই এখন থেকে।’ইবলার ভাই দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করে।
তারা তিনজন সন্ধ্যার ভেতর রাতের খাবার খেয়ে নেয়। তারপর ঘুমাতে যায়। আশা একটি বিছানা এবং একটি গদি ধার দিয়েছে একরাতের জন্য। ইবলা এবং তার ভাই শুয়েছে এক বিছানায়, ঘরের দরজার কাছে। বিধবা শুয়েছে দেয়ালের কাছে খাটে।
বিছানায় শুয়ে বিধবা কোরানের প্রথম সূরাটি পাঠ করে। প্রতিদিন ঘুমাতে যাওয়ার আগে একবার করে সূরাটি পড়া তার অভ্যাস, বিধবা জানায়। কিন্তু ইবলা মনে করতে পারলো না তারা যখন বেলেট ওয়েনে ছিল তখন তাদের এমন কোন অভ্যাস ছিল কিনা। যাই হোক, বিছানায় শুতেই ইবলা ঘুমিয়ে গেল।
আরো পরে, রাত আরো গভীর হবার পর, জানালায় একটি টোকা শোনা যায়; তারপর একটু বিরতি, তারপর আরেকটি টোকা; তারপর একটু বিরতি, তারপর আরেকটি টোকা, এবং আরও একটু বিরতি।
বিধবার ঘুম ভেঙে যায় টোকার শব্দে। প্রথমে ভাবলো তার হ্যালুসিনেশন হচ্ছে বা নতুন জায়গায় আসার ফলে হওয়া নতুন কোনো অনুভূতি।
‘ইবলা,’ বিধবা একটি পুরুষ কণ্ঠের ডাক শুনতে পায় বাড়ির বাইরে। তারপর আবারও একই ঘটনা ঘটতে থাকে। এবার ইবলার ঘুম ভাঙে, বিছানায় উঠে বসেছে সে, আর টোকার উত্তরে বলে, ‘হ্যাঁ। কী চান? কে আপনি?’
‘টিফো,’ জানালার ওপাশ থেকে লোকটি জবাব দেয়। ‘আমি তোমার সাথে একটু কথা বলতে চাই। জানালার কাছে এসো।’ বিধবা ঘুমের ভান করে পড়ে রইলো। কিন্তু ইবলা টিফোর সাথে কথা বলা আরম্ভ করতেই বিধবা কান পেতে থাকে ওদের কথা শোনার জন্য। অস্পষ্টভাবে শুনতে পায়, ‘. . . আমার স্ত্রী . . . সে এসেছিল. . . আশা। কাল সকালে ওকে জানিয়ো. . আমি সমস্যায় আছি. . একটি চিঠি পাঠাবো পরে. . যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।’ তারপর কণ্ঠটি বিদায় জানালো এবং টিফো চলে যায়। ইবলার নাম ধরে পুরুষ কণ্ঠকে ডাকতে শুনে বিধবার মনে যে চিন্তা এসেছিল একটু আগেও, সেগুলোকে সে বাতিল করে দিয়েছে এইমুহূর্তে জানালার ওপাশে পুরুষ কণ্ঠের চলে যাওয়ার শব্দ শুনে।
বিছানায় ফিরে ইবলা অন্ধকারে নিজের মনে হাসে। ‘হে আমার বেহেস্তের খোদা দয়াময়, এটা খুব ভালো কাজ হয়েছে। টিফো লোকটা আর আমার কাছে আসবে না। তার কথা যদি সত্যি হয় আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তিনি যদি আমাকে বিবাহবিচ্ছেদের চিঠি পাঠান, তাহলে কিছু সমস্যা আমার পক্ষ থেকে সমাধান করার প্রয়োজন হবে না। কিন্তু আউইল যদি একটি সাদা মহিলাকে নিয়ে বাড়ি আসে, তবে আত্মমর্যাদা রক্ষার জন্য আমাকে অবশ্যই কিছু করতে হবে। সে নিজে অধর্ম করতে পারে, কিন্তু আমাকে ব্যবহার করে নয়।’ আপন মনে এইসব কথা বলতে বলতে পরের কয়েক মিনিটের মধ্যে ইবলা আবার ঘুমিয়ে পড়ে।
আর পাশে শুয়ে বিধবা তখনও ভাবছিল রাতের এই ঘটনার ব্যাখ্যা সে সঠিকভাবে করতে পেরেছে কিনা। কিন্তু পরের দিন সকালে তিনি ঠিকই ইবলার ভাইকে সাথে করে বেলেত ওয়েনের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যান।
(চলবে)
বাঁকা পাঁজরের মেয়ে (পর্ব তের ) // নুরুদ্দিন ফারাহ, অনুবাদ: লুনা রাহনুমা