Home » পার্পল হিবিস্কাস (৮ম পর্ব) / চিমামান্ডা নগোজি আদিচে; ভাষান্তর: দিলশাদ চৌধুরী 

পার্পল হিবিস্কাস (৮ম পর্ব) / চিমামান্ডা নগোজি আদিচে; ভাষান্তর: দিলশাদ চৌধুরী 

সে একটা মূর্তি নিয়ে ধীরে ধীরে কাপড় দিয়ে মুছতে লাগলো, দেশলাই কাঠির মত ওটার একটা পা শুন্যে ভাসছিল, তার পরবর্তী কথার আগেই। “যাও, সোনা।”

আমি তখন উপরে গিয়ে আমার পড়ার বইয়ের দিকে তাকিয়ে বসে রইলাম। কালো অক্ষরগুলো আবছা হয়ে গেল, বর্ণগুলো যেন একটা আরেকটার মধ্যে সাঁতার কাটছিল। আর তারপর সেগুলো বদলে গিয়ে উজ্জ্বল লালরঙ ধারণ করলো, তাজা রক্তের মত লাল। রক্তটা পানির মত বয়ে যাচ্ছিল, মায়ের ভেতর থেকে, আমার চোখের ভেতর থেকে। পরে, রাতের খাবারের সময়, বাবা বললো আমরা ষোলটি বিশেষ প্রার্থনাবাণী পড়ব যাতে মায়ের অপরাধ ঈশ্বর ক্ষমা করে দেন। আর রবিবারে, আগমনীর পরের রবিবারে আরকি, আমরা ধর্মসভার পরেও থেকে গেলাম আর বিশেষ প্রার্থনাবাণী পড়া শুরু করলাম। ফাদার বেনেডিক্ট আমাদের গায়ে শুদ্ধিজল ছড়িয়ে দিল। কয়েক ফোঁটা শুদ্ধিজল আমার ঠোঁটের ওপর পড়লো আর আমি প্রার্থনা করতে করতে ওটার পানসে লবনাক্ত স্বাদ অনুভব করলাম। যদি বাবার মনে হয় যে জাজা কিংবা আমি সেন্ট জুডের প্রতি আবেদনমূলক প্রার্থনার তেরো নাম্বারের দিকে গিয়ে একটু ঢিলে মেরে গিয়েছি, তাহলে সে আবার প্রথম থেকে আমাদের শুরু করাবে। তাই আমরা চেষ্টা করছিলাম সবটা একদম ঠিকঠাক করার। আমি ভাবলাম না, এমনকি ভাবার কথাও ভাবলাম না যে মায়ের আসলে কোন দোষের জন্য ক্ষমার দরকার।

যতবার আমি পড়তে শুরু করতাম আমার পড়ার বইয়ের অক্ষরগুলো রক্তে পরিণত হত। এমনকি যখন আমার প্রথম সাময়িক পরীক্ষা এলো, এমনকি যখন আমরা ক্লাস মূল্যায়ন করা শুরু করলাম, তখনো অক্ষরগুলো অর্থহীন রইলো।

প্রথম পরীক্ষার কিছুদিন আগে, আমার ঘরে বসে পড়ছিলাম, একবারে শুধু একটামাত্র শব্দে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করছিলাম যখন দরজার ঘন্টা বাজলো। দেখা গেল এসেছেন ইওয়ান্ডে চোকার, বাবার পত্রিকার সম্পাদকের স্ত্রী। উনি কাঁদছিলেন। আমি শুনতে পাচ্ছিলাম কারণ আমার ঘরটা বসার ঘরের ঠিক উপরে আর আমি জীবনে কোনদিন এত জোরে কাউকে কাঁদতে শুনিনি।

” ওরা তাকে নিয়ে গেছে। ওরা তাকে নিয়ে গেছে।” তিনি হেঁচকি দিতে দিতে বললেন ।

“ইউয়ান্ডে, ইউয়ান্ডে,” বাবা বলল, ওনার চেয়ে বাবার গলা অনেকটাই নিচুতে।

” আমি কি করব, স্যার? আমার তিনটি বাচ্চা! একটা একদম দুধের শিশু! আমি কীভাবে একা এদের মানুষ করব?”

আমি ওনার কথা বলতে গেলে শুনতেই পাচ্ছিলাম না, ওনার কথার চেয়ে ওনার গলায় যেন কিছু আটকে যাবার শব্দটা বেশি পরিষ্কার শোনা গেল। তারপর বাবা বলল, “ইউয়ান্ডে, এভাবে বোলো না। আদের কিচ্ছু হবে না, আমি কথা দিচ্ছি, আদের কিচ্ছু হবে না।” আমি শুনলাম জাজা ওর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। ও এখন নিচে যাবে আর এমন ভাব করবে যেন ও রান্নাঘরে পানি খেতে যাচ্ছিলো, তারপর বসার ঘরের দরজার খুব কাছে দাঁড়িয়ে কথা শুনবে। ও যখন উপরে এলো জানতে পারলাম যে দ্যা স্ট্যান্ডার্ডের সম্পাদক দপ্তর থেকে গাড়ি চালিয়ে বের হওয়ার সময় সৈনিকেরা আদে চোকারকে গ্রেফতার করেছে। ওনার গাড়িটা রাস্তার পাশে পড়েছিল, সামনের দরজা খোলা অবস্থায়। আমি কল্পনা করলাম, আদে চোকারকে তার গাড়ি থেকে টেনে বের করা হচ্ছে, তারপর আরেকটা গাড়িতে ঠেসে ঢোকানো হচ্ছে, হয়ত সেটা সৈনিকে ভরা কোনো কালো স্টেশন ওয়াগন যাদের বন্দুক জানালা দিয়ে বেরিয়ে আছে। আমি আরও দেখলাম ভয়ে কাঁপতে থাকা তার হাত, তার পায়জামায় ছড়িয়ে পড়া ভেজা দাগ। আমি জানতাম তার গ্রেফতারের কারণ গতদিন দ্যা স্ট্যান্ডার্ডে হওয়া শিরোনাম, এমন এক কলাম যেখানে বলা হয়েছে কীভাবে রাষ্ট্রপতি এবং তার স্ত্রী লোকেদের টাকা দিয়েছে বিদেশে হেরোইন পাচারের জন্য, এমন এক কলাম যেটা প্রশ্ন তুলেছে সম্প্রতি হওয়া ওই তিন লোকের মৃত্যুদণ্ড আর কারা মাদক ব্যবসার আসল হোতা সেই ব্যাপারে। জাজা বললো, যখন ও চাবির ফুটা দিয়ে দেখছিল তখন বাবা ইউয়ান্ডের হাত ধরে প্রার্থনা করছিল, তাকে বলছিল সাথে সাথে বলতে, “তাদের কাউকেই সে একা ছাড়বে না যারা তার উপর বিশ্বাস রাখে।”

এই কথাগুলোই আমি পরের সপ্তাহে পরীক্ষায় বসে নিজেকে বলেছিলাম। আর এই কথাগুলোই আমি পুনরায় উচ্চারণ করছিলাম গাড়িতে বসে, আমার ফলাফলের কাগজ বুকে চেপে ধরে, স্কুলের শেষদিনে যখন কেভিন আমায় নিয়ে বাড়ি ফিরছিল। রেভারেন্ড সিস্টারেরা আমাদের মুখখোলা খামে ফলাফল দিয়েছিল। আমি আমার শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছি। এই ব্যাপারটা সংখ্যায় লেখা ছিলো, “২/২৫”। আমার শ্রেণি শিক্ষিকা, সিস্টার ক্লারা, লিখেছেন, ” কাম্বিলি তার বয়সের তুলনায় অনেক বেশি বুদ্ধিমতী। শান্ত এবং দায়িত্বশীল।” অধ্যক্ষ, মাদার লুসি লিখেছেন,” এক মেধাবী, বাধ্য শিক্ষার্থী এবং গর্ব করার মত কন্যা।”

কিন্তু আমি জানতাম বাবার আমাকে নিয়ে গর্ব হবে না। সে আমাকে আর জাজাকে প্রায়ই বলতো যে সে ডটার্স অফ দি ইমাকুলেট হার্ট আর সেন্ট নিকোলাসের পেছনে এত টাকা এজন্য ঢালে না যাতে অন্য লোকের ছেলেমেয়েরা এসে প্রথম হয়ে যেতে পারে। তার পড়ালেখার পেছনে কেউ এত টাকা খরচ করেনি, বিশেষত তার নাস্তিক বাপটা তো নয়ই, আমাদের দাদাজান নুকোউ আরকি, তবুও সে সব সময় প্রথম হতো। আমি বাবাকে গর্বিত করতে চাইতাম, যেমনটা সে করেছে তেমন ফলাফল করতে চাইতাম। আমি চাইতাম সে যেন আমার ঘাড়ের পেছনে হাত দিয়ে আমাকে বলে যে আমি ঈশ্বরের ইচ্ছা পূর্ণ করেছি। আমি চাইতাম সে যেন আমায় জোরে জড়িয়ে ধরে বলে যাকে বেশি দেয়া হয়, তার কাছে সবার চাহিদাও থাকে বেশি। আমি চাইতাম সে যেন আমার দিকে তাকিয়ে হাসে, সেই হাসি যেটা তার মুখ উজ্জ্বল করে দেয় আর আমার ভেতরে এক অদ্ভুত উষ্ণতা ছড়িয়ে দেয়। কিন্তু আমি দ্বিতীয় হয়েছি, ব্যর্থতার দাগ আমার পুরো শরীরে।

কেভিন গাড়িবারান্দায় গাড়ি থামানোর আগেই মা দরজা খুলে দিল। মা সব সময় স্কুলের শেষদিনে সদর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করত,ইগবুতে প্রশংসাসূচক গান গেয়ে আমাকে আর জাজাকে জড়িয়ে ধরে আমাদের ফলাফলের কাগজ হাতে নিয়ে দেখার জন্য। এটাই একমাত্র দিন ছিল যেদিন সে গলা ছেড়ে গান ধরতো। “ও মে ময়া, চিনেকে, ও মে ময়া…”

মা গান শুরু করলো আর আমি তাকে অভিবাদন জানানোর পর চুপ হয়ে গেলো। “শুভ বিকেল, মা।”

” সোনা, সব ঠিকঠাক হয়েছে তো? তোমার মুখ মলিন লাগছে।” সে একপাশে সরে আমাকে ভেতরে ঢুকতে দিল।

” আমি দ্বিতীয় হয়েছি।”

মা যেন চুপসে গেলো। “এসে খেয়ে নাও। সিসি নারকেল ভাত করেছে।”

আমি আমার পড়ার টেবিলে বসেছিলাম যখন বাবা বাড়ি ফিরল। সে প্রায় লাফিয়ে উপরে উঠল, তার এক একটা ভারী পদক্ষেপের শব্দ আমার মাথায় গন্ডগোল করে দিচ্ছিল। বাবা জাজার ঘরে গেল। ও প্রথম হয়েছে, প্রতিবারের মতই, তাই বাবা ওকে নিয়ে গর্বিত হবে, ওকে জড়িয়ে ধরবে, তার হাত জাজার কাধের ওপর রাখবে। যদিও সে অনেকক্ষণ জাজার ঘরে কাটাচ্ছিল, আমি জানতাম সে প্রত্যেকটা বিষয়ের আলাদা করে নাম্বার দেখছিল, দেখছিল যে কোনোটায় আবার গত পরীক্ষার চেয়ে এক দুই মার্ক কম এসেছে কিনা। কিছু একটা যেন আমার ব্লাডারে তরল ঢুকিয়ে দিল, আমি বাথরুমে ছুটলাম। বেরোনোর পর দেখলাম বাবা আমার ঘরে। “শুভসন্ধ্যা, প্রিয় বাবা।”

” স্কুলে সব ঠিকঠাক?”

আমি চাইছিলাম বাবাকে বলে দিতে যে আমি দ্বিতীয় হয়েছি, যাতে বাবা দ্রুত ব্যাপারটা জেনে যায়, যাতে আমি আমার ব্যর্থতা স্বীকার করতে পারি। কিন্তু তার বদলে আমি বললাম, “হ্যা” আর তাকে ফলাফলপত্রটা দিলাম। সে যেন পুরো এক যুগ লাগিয়ে খামটা খুললো আর তার চেয়েও বেশি সময় নিয়ে ফলাফলপত্রটা পড়ল। আমি আমার নিঃশ্বাস শান্ত রেখে অপেক্ষা করার চেষ্টা করলাম, পুরোটা সময় এটা জেনেই যে আমার চেষ্টা বিফলে যাচ্ছে।

” প্রথম কে হয়েছে?” বাবা জিজ্ঞেস করল শেষমেশ।

“চিনউই জিদেজে।”

” জিদেজে? যে মেয়েটা গত পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয়েছিল?”

” হ্যা,” আমি বললাম। আমার পেটের মধ্যে শব্দ হচ্ছিলো, ফাঁপা কাঁপা শব্দ যেটা একটু বেশিই জোরালো শোনাচ্ছিল। যেটা আমি পেট ভেতরের দিকে টেনে নেয়ার পরও বন্ধ হচ্ছিল না।

(চলবে…)

Ajit Dash

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ভাষা
Scroll to Top