ধর্মসভার পরে আমরা গির্জার প্রবেশপথের বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম যতক্ষণ না বাবাকে ঘিরে ভিড় করে থাকা লোকজনদের শুভেচ্ছা জানিয়ে বাবা বাইরে আসে। ” শুভ সকাল, ঈশ্বরের জয় হোক”, সে বলতে লাগলো। তারপর পুরুষদের সাথে করমর্দন, নারীদের আলিঙ্গন, কিশোরদের পিঠ চাপড়ে আর শিশুদের গাল টিপে আদর করে দিলো। কিছু লোক বাবার কানে ফিসফিস করে কিছু বললো, বাবাও তাদের ফিসফিস করে কি যেন বললো, তারপর তারা ফিরে গেলো বাবাকে ধন্যবাদ জানিয়ে, তাদের দুই হাত দিয়ে বাবার হাত ধরে করমর্দন করতে করতে। শেষমেশ বাবা সবার সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় শেষ করতে পারলো আর এখন যেহেতু গির্জার প্রাঙ্গনটা মোটামুটি ভিড়মুক্ত গাড়িগুলো থেকে যেগুলো পুরো জায়গাটাকে মুখের ভেতর যেমন দাঁত ঠিক তেমনিভাবে বিশৃঙ্খল করে রেখেছিলো, আমরা আমাদের গাড়ির দিকে চললাম৷
” ওই চ্যাংড়া যাজক, এমনভাবে ধর্মসভায় গান গাইতে শুরু করলো যেন ব্যাঙের ছাতার মত সবখানে গজিয়ে ওঠা পেন্টেকোস্টাল গির্জার কোনো ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধাহীন এক ফাজিল। এদের মত লোকেরাই গির্জার জন্য সমস্যা বয়ে আনে। আমাদের অবশ্যই এই লোকের সুবুদ্ধির জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে হবে,” মার্সিডিজের দরজা খুলে ধর্মগ্রন্থ আর গির্জাবার্তা সিটের ওপর রেখে গির্জাপল্লীর বাড়িগুলোর দিকে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়ানোর আগে বাবা কথাগুলো বললো। আমরা প্রতিবার ধর্মসভার পর ফাদার বেনেডিক্টের বাড়ি গিয়ে দেখা করি।
“আমি গাড়িতে বসেই অপেক্ষা করি বরং,” মা ক্লান্তভাবে মার্সিডিজে হেলান দিয়ে বললো, “আমার বমি বমি পাচ্ছে।”
বাবা ঘুরে দাঁড়ালো মায়ের দিকে তাকাতে। আমি নিশ্বাস নিতেও ভুলে গেলাম। মনে হচ্ছিলো যেন দীর্ঘ একটা সময়, কিন্তু হয়ত কয়েক সেকেন্ড মাত্র। ” সত্যিই তুমি গাড়িতে থাকতে চাও?” বাবা জিজ্ঞেস করলো।
মা নিচের দিকে তাকিয়েছিল, তার হাত তার পেটের ওপর রাখা ছিলো, হয়তো তার চাদরটা ধরে রাখতে যাতে সেটা পড়ে না যায় অথবা তার রুটি চায়ের সকালের নাস্তা আটকে রাখতে। “আমার শরীরটা ভালো লাগছে না,” সে আমতা আমতা করে বললো।
” আমি জিজ্ঞেস করেছি তুমি আসলেই গাড়িতেই থাকতে চাও কিনা?”
মা ওপরের দিকে তাকালো। “আমি সাথে যাবো। অতটাও খারাপ লাগছে না।”
বাবার মুখের একটি পেশিও নড়লো না। সে অপেক্ষা করতে লাগলো মায়ের তার দিকে আসা অব্দি তারপর মুখ ঘুরিয়ে নিলো। তারা হাঁটতে শুরু করলো ধর্মযাজকের বাড়ির উদ্দেশ্যে, আমি আর জাজা পেছন পেছন চললাম।
আমি হাঁটতে হাঁটতে মাকে দেখলাম। তখন অব্দি আমি খেয়াল করিনি যে কতটা অন্যরকম লাগছে মাকে। মায়ের ত্বক, যেটা সাধারণত মিহি চিনাবাদাম বাটার মত বাদামি হয়ে থাকে, ধূসর হয়ে গিয়েছে। যেন কেউ তার সম্পূর্ণ রস শুষে নিয়ে তাকে ধূসর করে ফেলেছে ফাটল ধরা হারমাতান মাটির রঙের মত। জাজা চোখে চোখে আমার সাথে কথা বললোঃ যদি মা বমি করে? আমি আমার জামার দু’প্রান্ত তুলে ধরব যাতে মা তাতে বমি করতে পারে আর ফাদার বেনেডিক্টের বাড়িতে কোনো ঝামেলা না হয়।
বাড়িটা দেখে মনে হচ্ছিলো যে নির্মাণকারী বেশ দেরীতেই বুঝতে পেরেছিলো যে সে বাসভবন তৈরি করছে, গির্জা নয়। খাবার ঘরে ঢোকার খিলানটা দেখে মনে হচ্ছিলো কোনো বেদিতে ওঠার দরজা। তাকের ওপর রাখা ঘিরঙা টেলিফোনটা দেখে মনে হচ্ছিলো কোনো পবিত্র ধর্মবার্তা গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত। বসার ঘরের সাথে লাগোয়া ছোট্ট পড়ার ঘরটা পবিত্র গ্রন্থসমূহ, ধর্মসভার জিনিসপত্র আর অতিরিক্ত মদের পেয়ালায় ঠাসা গির্জার প্রস্তুতিকক্ষ হতে পারত। “ইউজিন ভাই!” ফাদার বেনেডিক্ট বললেন। বাবাকে দেখে তার ফ্যাকাশে মুখটায় একটা ডুবতে থাকা চাঁদের মত হাসি ফুটে উঠলো। তিনি খাবার টেবিলে বসে খাচ্ছিলেন। টেবিলে দুপুরের খাবারের মতো সেদ্ধ আলুর টুকরো দেখা যাচ্ছিলো, আবার সকালের নাস্তার মত ভাজা ডিমের প্লেটও দেখা যাচ্ছিলো। তিনি আমাদের তার সাথে যোগ দিতে বললেন।
বাবা আমাদের পক্ষ থেকে না বললো আর তারপর টেবিলের দিকে গেলো ফাদারের সাথে প্রায় নিঃশব্দ কথাবার্তা সারতে। ” কেমন আছ, বিয়েট্রেস?” ফাদার বেনেডিক্ট গলা তুলে জিজ্ঞেস করলেন যাতে মা বসার ঘর থেকে শুনতে পায়। ” তোমাকে দেখে খুব একটা সুস্থ মনে হচ্ছে না।”
” আমি ঠিক আছি ফাদার। শুধু আমার একটু এলার্জি দেখা দিয়েছে আবহাওয়ার কারণে, জানেনই তো, শুষ্ক বাতাসের সাথে বর্ষাকাল যোগ হয়ে বিশ্রী অবস্থা।”
” কাম্বিলি আর জাজা, ধর্মসভা ভালো লেগেছে তো?”
” জ্বি ফাদার,” জাজা আর আমি একইসঙ্গে বলে উঠলাম।
আমরা তারপর তাড়াতাড়িই বেরিয়ে গেলাম, ফাদার বেনেডিক্টের বাড়িতে সাধারণত আমরা যতটা সময় কাটাই তার চেয়ে আজকে অনেক কম সময় থাকলাম। বাবা গাড়িতে বসে কিছুই বললো না, তার চোয়াল এমনভাবে নড়ছিলো যেন সে দাঁত দিয়ে দাঁত ঘষছে। আমরা সবাই চুপ করে রইলাম আর ক্যাসেট প্লেয়ারে “এভ মারিয়া” শুনতে লাগলাম।
যখন বাড়ি ফিরলাম, সিসি ছোট্ট কারুকাজ করা হাতলযুক্ত চিনামাটির চায়ের পাত্রে বাবার চা গুছিয়ে দিলো। বাবা তার বুলেটিন আর ধর্মগ্রন্থ খাবার টেবিলে রেখে নিচে বসলো।
মা তার আশেপাশে ঘোরাঘুরি করতে লাগলো। “আমি তোমাকে চা ঢেলে দিচ্ছি,” মা বললো, যদিও সে কখনোই বাবাকে চা ঢেলে দেয় না। বাবা তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চা ঢেলে নিলো আর তারপর জাজা আর আমাকে চুমুক দিতে বললো। জাজা এক চুমুক দিয়ে কাপটা পিরিচের ওপর রাখলো। বাবা ওটা তুলে আমার হাতে দিল। আমি ওটাকে দু’হাতে ধরলাম, চুমুক দিয়ে দুধ চিনি দেয়া লিপটন চায়ের স্বাদ নিলাম, আর তারপর ওটাকে আবার পিরিচের ওপর রেখে দিলাম।
” ধন্যবাদ বাবা,” ভালোবাসায় পুড়ে যাওয়া জিভের অনুভূতি নিয়ে আমি বললাম।
আমরা পোশাক বদলাতে ওপরে চললাম, জাজা মা আর আমি। সিঁড়িতে আমাদের পদক্ষেপগুলো ছিলো আমাদের রবিবারগুলোর মতই মাপা, নিঃশব্দ। অপেক্ষার নৈঃশব্দ, যতক্ষণ না বাবার দুপুরের ঘুম শেষ হয় আর আমরা দুপুরের খাবার খেতে পারি; চিন্তার সময়ের নৈঃশব্দ, যখন বাবা আমাদের ধর্মগ্রন্থের কোনো অনুচ্ছেদ কিংবা গির্জার প্রথমদিকের কোনো ফাদারের রচিত কোনো বই দিত আর বলতো পড়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে; সন্ধ্যার প্রার্থনার নৈঃশব্দ; তারপর আশীর্বাদ নিতে গাড়ি চালিয়ে গির্জায় যাবার নৈঃশব্দ। এমনকি আমাদের রবিবারের পারিবারিক সময়টাও ছিলো নিস্তব্ধ, দাবা খেলা বা পত্রিকার খবর নিয়ে আলোচনা ছাড়া দিনটা ছিলো এককথায় বিশ্রামের দিন। ” আজকের রান্নাটা সিসি একাই করতে পারবে,” বাঁকানো সিঁড়িটার একদম ওপরের ধাপে উঠে জাজা বলে। ” দুপুরের খাবারের আগে তোমার একটু বিশ্রাম নেয়া উচিত।”
মা কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলো, তার হাত যেন উড়ে গিয়ে তার মুখ চাপা দিলো আর সে দৌড়ে তার ঘরে ঢুকে গেলো। আমি নিজের ঘরে যাবার আগে দাঁড়িয়ে গেলাম তার গলার ভেতর থেকে উঠে আসা বমির তীব্র কাতর শব্দ শুনতে।
(চলবে…)