বাবা আমার ফলাফলপত্রের দিকে আরও কিছুক্ষণ দেখল, তারপর বলল, “রাতের খাবারের জন্য নিচে এসো।”
আমি নিচে যাচ্ছিলাম, আমার পায়ে যেন কোনো গিঁট নেই, যেন লম্বা কাঠের ফালি। বাবা একটা নতুন ধরনের বিস্কুটের স্যাম্পল নিয়ে বাড়ি এসেছিল, আর রাতের খাবার শুরু করার আগেই সে সবুজ প্যাকেটটা সবার হাতে হাতে দিল। আমি বিস্কুটে কামড় দিলাম। “খুব ভাল, বাবা।”
বাবা একটা কামড় বসিয়ে চিবুতে চিবুতে জাজার দিকে তাকাল।
” একটা সতেজ স্বাদ,” জাজা বলল।
” খুব মজা,” মা বলল।
” ঈশ্বরের কৃপায় ভালোই বিক্রি হবে এটা,” বাবা বলে, ” আমাদের ওয়েফার বাজারের সেরা, আর এটাও তার সাথে যোগ হবে।”
বাবা যখন কথা বলছিল, আমি তার দিকে তাকালাম না, তাকাতে পারলাম না। সিদ্ধ মিষ্টিআলু আর গোলমরিচ দেয়া সবজি আমার গলা দিয়ে নামতেই চাচ্ছিলো না। ওগুলো আমার মুখে এমনভাবে জড়িয়ে রইলো যেভাবে নার্সারি স্কুলের গেটে শিশুরা তাদের মায়ের হাত জড়িয়ে থাকে। আমি গ্লাসের পর গ্লাস পানি খেলাম খাবারটা নিচে নামাতে, ততক্ষণে বাবা প্রার্থনা শুরু করে দিয়েছে, আমার পেট পানিতে উপচে উঠছিল। প্রার্থনা শেষ করে বাবা বলল, “কাম্বিলি, ওপরে এসো।”
আমি তার পেছন পেছন গেলাম। লাল সিল্কের পায়জামা পরে যখন সে সিঁড়ি বেয়ে উঠছিল, তার পাছা কাঁপছিল আর নড়ছিল আকামু পুডিংয়ের মত, ঠিকঠাকভাবে বানানো আকামু পুডিং, জেলির মত। বাবার শোবার ঘরের ঘি রঙের সাজসজ্জা প্রতিবছর বদল হতো, কিন্তু ঘি রঙেরই অন্যান্য ছায়ায় সামান্য হেরফের করে। পা রাখতেই তলিয়ে যাওয়া দামী তন্তু দিয়ে তৈরি পাপোষটার রঙ একদম ঘি-রঙা ; পর্দাগুলোর কিনারায় শুধু একটু খয়েরি সুতার কাজ রয়েছে ; দুটো ঘি-রঙা চামড়ার চেয়ার পাশাপাশি রাখা যেন দুজন মানুষ কোনো ঘনিষ্ঠ কথোপকথনে মশগুল। সব ঘি-রঙ একসাথে মিশে যেত আর ঘরটাকে বেশ বড়সড় দেখিয়ে তুলতো, যেন ঘরটার কোনো সীমানা নেই, যেন চাইলেও পালানো যাবে না কারণ পালাবার কোনো রাস্তা নেই। ছোটবেলায় যখন আমি স্বর্গের কথা ভাবতাম, মনে হতো স্বর্গ বাবার ঘরের মতন, এমনই নরম, এমনই ঘিয়ের মত, এমনই অসীম। আমি বাবার বাহুর অন্তরালে জায়গা নেব যখন হারমাতান বজ্রঝড় বাইরে ফুসে উঠবে, জানালায় মশার জালের সাথে আমগুলো ধাক্কা খাবে আর ইলেকট্রনিক তারগুলোর একটা আরেকটার সাথে সংঘর্ষ হবে আর উজ্জ্বল কমলা রঙের ফুলকি জ্বলে উঠবে। বাবা আমাকে তার দুই হাঁটুর মধ্যে ঢুকিয়ে নেবে আর জড়িয়ে নেবে ওই ঘি রঙের কম্বলে যাতে রয়েছে নিরাপত্তার ছোঁয়া।
আমি ওইরকম একটা কম্বলের ওপরেই বসে আছি, বিছানার কিনারায়। আমি আমার স্লিপার খুলে ফেললাম আর পায়ের পাতা পাপোষে ডুবিয়ে দিলাম আর সিদ্ধান্ত নিলাম ওগুলোকে এভাবেই ডুবিয়ে রাখার যাতে আমার পা নিজেকে আচ্ছাদিত মনে করে আর আমার একটা অংশ নিজেকে সুরক্ষিত অনুভব করে।
“কাম্বিলি,” ঘন একটা নিশ্বাস নিয়ে বাবা বললো, “এই সাময়িকে তুমি তোমার সর্বোচ্চটা দাওনি। তুমি দ্বিতীয় হয়েছ কারণ তুমি নিজেই এটা বেছে নিয়েছ।” তার চোখগুলো ছিলো দুঃখী, গভীরভাবে দুঃখী।
আমি তার মুখমণ্ডল স্পর্শ করতে চাইছিলাম, তার রাবারের মত গালে আমার হাত ছড়িয়ে দিতে চাইছিলাম। তার চোখে গল্প ছিল, যেগুলো আমি হয়ত কোনোদিন জানতে পারবো না।
তখনই ফোন বাজলো; আদে চোকার গ্রেফতার হবার পর থেকে প্রায়ই এটা বাজতে থাকে। বাবা ফোনটা তুললো আর নিচু গলায় কথা বলতে লাগলো। আমি তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম যতক্ষণ না সে মুখ তুললো আর হাত নেড়ে আমায় চলে যেতে বলল।
বাবা আমাকে তার পরেরদিন ডাকলো না, তার পরের দিনও না, কথাবার্তা বলতে আমার ফলাফলপত্রের ব্যাপারে, কিভাবে আমাকে শাস্তি দেয়া হবে সে ব্যাপারে। আমি ভাবতে লাগলাম যে, আদে চোকারের ব্যাপারটা নিয়ে বাবা একটু বেশিই ব্যস্ত কিনা, কিন্তু এক সপ্তাহ পরে আদে চোকারকে জেল থেকে বের করার পরও বাবা আমার ফলাফলপত্র নিয়ে কিছুই বললো না। এমনকি সে আদে চোকারকে জেল থেকে বের করার ব্যাপারেও কিছু বলল না; আমরা শুধু আদে চোকারের সম্পাদকীয় দ্যা স্ট্যান্ডার্ডে ফিরে আসতে দেখলাম যেখানে তিনি লিখেছেন স্বাধীনতার গুরুত্ব সম্পর্কে, লিখেছেন যে কিভাবে তার কলম কখনোই সত্য লিখতে পিছপা হয়নি, হবে না, হতে পারে না। কিন্তু তিনি একবারও উল্লেখ করলেন না যে, তাকে কোথায় নেয়া হয়েছিল বা কারা গ্রেফতার করেছিল বা তার সাথে কি ঘটেছে। ওখানে একটা ইটালিক অক্ষরের পুনশ্চ ছিল যেটায় তিনি তার প্রকাশককে ধন্যবাদ জানিয়েছেনঃ “একজন বিশুদ্ধ মানুষ, আমার দেখা সবচেয়ে সাহসী মানুষ।”
আমি মায়ের পাশে সোফায় বসেছিলাম, পারিবারিক সময়ে, আর আমি ওই লাইনটা বারবার পড়লাম আর তারপর চোখ বন্ধ করে ফেললাম, নিজের মধ্যে একটা ঢেউ বয়ে যেতে অনুভব করলাম, সেই অনুভূতি যেটা আমার হতো যখন ফাদার বেনেডিক্ট ধর্মসভায় বাবার ব্যাপারে বলত, সেই অনুভূতি যেটা আমার হতো হাঁচি দেবার পর; একটা পরিস্কার স্থিরকম্প অনুভব।
“ঈশ্বরকে ধন্যবাদ আদে এখন সুরক্ষিত,” মা বলল পত্রিকার ওপর হাত চালাতে চালাতে।
“ওরা ওর পিঠে সিগারেটের ছ্যাকা দিয়েছে,” মাথা নাড়তে নাড়তে বাবা বলল। “ওরা ওর পিঠে এত এত সিগারেটের ছ্যাঁকা দিয়েছে।”
“ওরা ওদের কর্মফল পাবে, কিন্তু এই দুনিয়ায় নয় প্রিয়,” মা বলল। যদিও বাবা তার দিকে তাকিয়ে হাসলো না — বাবাকে দেখে মনে হচ্ছিলো মুচকি হাসার পক্ষেও অনেক বেশি দুঃখী। আমি যে কেন মায়ের আগে কথাটা বলার কথা ভাবলাম না। আমি জানি বাবা মায়ের কথাটা পছন্দ করেছে।
“আমরা এখন থেকে আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকা প্রকাশ করব,” বাবা বলল। “আমার লোকেদের পক্ষে এখন আর এটা সুরক্ষিত নয়।”
আমি জানতাম আন্ডারগ্রাউন্ড প্রকাশ মানে হলো পত্রিকা এখন থেকে বের হবে একটা গোপন জায়গা থেকে। তারপরও আমি কল্পনা করলাম আদে চোকারসহ অন্যান্য কর্মচারীরা সব মাটির নিচের একটা অফিসে বসে আছে, একটা ফ্লুরোসেন্ট বাতি ঘরটাকে আলোয় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, লোকেরা ডেস্কের ওপর ঝুঁকে লিখছে, সত্য প্রকাশ করছে।
ওই রাতে, যখন বাবা প্রার্থনা করছিল, সে আরও দীর্ঘ কথাবার্তা যোগ করলো ঈশ্বরকে তাড়না করে যাতে সে আমাদের দেশকে শাসন করতে থাকা অধার্মিক লোকগুলোর ধ্বংস ডেকে আনে। আর সে গলা তুললো বারবার করে, “আমাদের নাইজেরিয়ার মানুষের ঢাল হয়ে থাকা দেবী, আমাদের জন্য প্রার্থনা করো।”
স্কুলের ছুটি অল্পদিনের ছিল, মাত্র দুই সপ্তাহ, আর স্কুল খোলার ঠিক আগের শনিবারে মা আমাকে আর জাজাকে বাজারে নিয়ে গেল নতুন জুতো আর ব্যাগ কিনতে। আমাদের ওগুলোর প্রয়োজন ছিল না; আমাদের ব্যাগ আর খয়েরি চামড়ার জুতো এখনো একদম নতুনের মত, শুধু এক সাময়িকী পুরনো। কিন্তু এটা একটা নিয়ম ছিলো শুধুমাত্র আমাদের জন্য, প্রতি সাময়িকীর শুরুতে বাজারে যাওয়া, বাবার অনুমতি ছাড়াই জানালার কাচ নামানো যখন কেভিন আমাদের গাড়ি চালিয়ে সেখানে নিয়ে যায়। বাজারের উপকণ্ঠে আমরা আমাদের চক্ষু চালিয়ে দেই ময়লার ভাগাড়ের পাশের অর্ধনগ্ন পাগল লোকদের ওপর, সে সব লোকেদের ওপর যারা সাধারণভাবেই দাঁড়িয়ে যায় প্যান্টের চেইন খুলে কোণাগুলোয় প্রস্রাব করতে, সেই মহিলার ওপর যাকে কিনা কাচা সবজির ঢিপির সাথে চিৎকার করে দরদাম করতে দেখা যায় যতক্ষণ না পেছন থেকে ব্যাপারীদের সর্দার বেরিয়ে আসে।
(চলবে….)