Home » পার্পল হিবিস্কাস (দশম পর্ব) // চিমামান্ডা নগোজি আদিচে, ভাষান্তর: দিলশাদ চৌধুরী 

পার্পল হিবিস্কাস (দশম পর্ব) // চিমামান্ডা নগোজি আদিচে, ভাষান্তর: দিলশাদ চৌধুরী 

আমরা দোকানিদের থেকে গা ঝাড়া দিয়ে এগিয়ে চললাম যারা আমাদের “আপনাদের যা দরকার আমার কাছে আছে” অথবা “আমার সাথে আসুন, এদিকে” বলতে বলতে অন্ধকার পথগুলোর দিকে টেনে নিচ্ছিল, যদিও তাদের কেউই জানতো না যে আমরা কি চাই। রক্তমাখা তাজা মাংস আর স্যাতলা শুটকি মাছের গন্ধে আমরা নাক কুঁচকে ফেললাম আর মাথা নিচু করে ফেললাম মধু বিক্রেতার চালার ওপরে ঘন হয়ে ভোঁ ভোঁ করতে থাকা মেঘের মত মৌমাছির ঝাঁকের থেকে। যেইনা আমরা আমাদের জুতো আর মায়ের কেনা কিছু কাপড় নিয়ে বাজার থেকে বের হলাম, আমরা রাস্তার পাশের যে সবজির দোকানগুলোকে একটু আগে অতিক্রম করে এসেছি, সেদিকে একটা ছোট্ট ভিড় দেখতে পেলাম। সৈনিকেরা ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছিল। বাজারের মহিলারা চিৎকার করছিলো আর অনেকেই দুই হাত মাথায় দিয়ে বসেছিল যেমনটা মানুষ করে হতাশ হয়ে কিংবা বড় কোনো আঘাত পেয়ে। এক মহিলা ধুলোয় পড়ে তার ছোট্ট আফ্রো চুল ছিড়ছিলো। তার ঘাঘরা খুলে এসেছিলো আর তার সাদা জাঙিয়া দেখা যাচ্ছিল।

” জলদি চলো,” মা আমার আর জাজার দিকে  ঘেষে বললো, মনে হলো যেন মা আমাদের সৈনিক আর ওই মহিলাকে দেখা থেকে রক্ষা করতে চাইছে। আমরা তাড়াতাড়ি চলতে চলতে এক মহিলাকে দেখলাম এক সৈনিকের দিকে থুথু ছুড়ে দিতে। দেখলাম সৈন্যটি একটা চাবুক বাতাসে ছুড়ে দিল, চাবুকটা লম্বা ছিলো, বাতাসে কুন্ডলী পাকিয়ে ওটা মহিলার কাঁধের ওপর পড়লো। আরেক সৈন্য লাথি মেরে ফেলে দিচ্ছিল ফলের ডালা, পাঁকা পেঁপে বুট দিয়ে পিষে অট্টহাসি হাসছিল।

গাড়িতে উঠতেই কেভিন মাকে বললো যে সৈন্যদের আদেশ দেয়া হয়েছে সবজির দোকানগুলো অবৈধ স্থাপনা, ওগুলোকে ভেঙে দিতে। মা কিছুই বললো না, জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো, যেন সে শেষবারের মত ওই মহিলাগুলোর মুখ দেখে নিতে চাইছিল।

বাড়ি ফিরতে ফিরতে আমি ধুলোয় পড়ে থাকা ওই মহিলার কথা ভাবতে লাগলাম। আমি তার মুখ দেখিনি, কিন্তু মনে হচ্ছিল যেন আমি তাকে চিনি, সবসময়ই চিনে এসেছি। ইচ্ছা করছিল ফিরে যেতে, গিয়ে তাকে সাহায্য করতে, তার ঘাঘরায় লেগে থাকা লাল মাটি পরিস্কার করে দিতে।

আমি তার কথা ভাবলাম, সোমবারেও, যখন বাবা আমায় স্কুলে ছাড়তে গেলো। ওগুই রোডে সে গাড়ি ধীরে করলো রাস্তার পাশে হামাগুড়ি দেয়া এক ভিখারীকে কিছু চকচকে নায়রার নোট ছুড়ে দিতে, কাছেই বাচ্চারা খোসা ছাড়ানো কমলা ফেরি করছিল। ভিখারীটি নোটের দিকে তাকিয়ে রইলো, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে হাত নাড়তে লাগলো, তারপর লাফিয়ে লাফিয়ে হাততালি দিতে লাগলো। আমি ভেবেছিলাম লোকটি পঙ্গু। আমি গাড়ির আয়নায় তাকে দেখতে থাকলাম, আমার চোখ তার ওপর স্থির রইলো যতক্ষণ না সে দৃষ্টির বাইরে চলে যাচ্ছে। তাকে দেখে আমার বাজারের ধুলোয় লুটিয়ে থাকা মহিলার কথা মনে পড়লো। ওই মহিলার দুর্দশা আর এই লোকটির আনন্দের মধ্যে যে অসহায়ত্ব লুকিয়ে আছে, তার চেহারা একই।

ডটার্স অফ দি ইমাকুলেট হার্ট মাধ্যমিক স্কুলকে যে দেয়াল ঘিরে রেখেছে, সেটি বেশ উঁচু, আমাদের বাড়ি ঘেরা দেয়ালের মতই, কিন্তু কুন্ডলীত ইলেক্ট্রিক তারের বদলে সেগুলো সুরক্ষিত ছিলো সবুজ কাঁচের ভাঙা টুকরো দিয়ে যেগুলোর বাইরের অংশ বেশ সূচালো। বাবা বললো আমি প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করতেই বাবার সিদ্ধান্তে মাধ্যমিক স্কুলের দেয়ালে বদল আনা হয়েছে। শৃঙ্খলা জরুরি, বাবা বলে। তরুণ প্রজন্মকে তো আর দেয়াল টপকে শহরে গিয়ে জংলি হয়ে যেতে দেয়া যায় না, যেমনটা ওরা ফেডারেল সরকারের কলেজগুলোতে করে।

” এই লোকগুলো গাড়িও চালাতে পারে না,” স্কুলের ফটকে এসে পৌঁছাবার পর বাবা বিড়বিড় করে বললো, যেখানে চালকরা গাড়িগুলো একটা আরেকটার দিকে তাক করে হর্ণ দিচ্ছিলো ক্রমাগত। “স্কুলের আঙিনায় কে আগে ঢুকতে পারে তার ওপর কোনো পুরস্কার তো আর দেয়া হয় না!”

ফেরিওয়ালি মেয়েরা, আমার চেয়েও বয়সে ছোট, স্কুল ফটকের পাহারাদারের চোখ ফাঁকি দিয়ে আস্তে আস্তে গাড়িগুলোর দিকে যাচ্ছিলো খোসা ছাড়ানো কমলা, কলা আর চিনেবাদাম ফেরি করতে। ওদের পোকায় কাটা ফতুয়া কাধ বেয়ে পড়ে যাচ্ছিল।

বাবা শেষ অব্দি গাড়িটাকে প্রশস্ত স্কুল আঙিনায় ঢোকাতে সক্ষম হলো, ঘাস ছাটা লম্বা মাঠ ছাড়িয়ে  ভলিবল কোর্টের কাছে গাড়িটাকে রাখলো সে। “তোমার শ্রেণীকক্ষ কোথায়?” তারপর জিজ্ঞেস করলো।

আমি আঙুল তুলে একসারি আমগাছের পাশে দাঁড়ানো একটা ভবন দেখিয়ে দিলাম। বাবা আমার সাথে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো আর আমি ভাবতে লাগলাম যে সে কি করতে চায়। বাবা কেন এসেছে, কেন সে আমাকে স্কুলে নিয়ে এসেছে আর কেভিনকে বলেছে জাজাকে স্কুলে নিতে।

ক্লাসে যাওয়ার পথে সিস্টার মার্গারেট বাবাকে দেখে একরাশ শিক্ষার্থী আর অভিভাবকদের মধ্য থেকে খুশিমুখে হাত নাড়লো, তারপর চটপট আমাদের কাছে এলো। তার কথাগুলো তার মুখ থেকে নম্রভাবে বেরিয়ে আসছিলোঃ বাবা কেমন আছে, সে ডটার্স অফ দি ইমাকুলেট হার্টে আমার উন্নতি নিয়ে খুশি কিনা, সামনের সপ্তাহে বিশপের অভ্যর্থনায় সে থাকছে কিনা।

কথা বলার সময় বাবা তার উচ্চারণ পরিবর্তন করে ফেললো, তাকে শোনাচ্ছিল ব্রিটিশদের মত, যেমনটা সে করে ফাদার বেনেডিক্টের সাথে কথা বলার সময়। তার বলার কায়দা ছিলো অমায়িক, যেমন ‘খুশি করতে উদ্বেল’ ভাব সে ধর্মীয় লোকদের সাথে দেখায়, বিশেষত সাদা চামড়ার ধর্মীয় লোকদের সাথে। ততটাই অমায়িক যতটা অমায়িক সে থাকে ডটার্স অফ দি ইমাকুলেট হার্টের লাইব্রেরির উন্নয়নের জন্য চেক দেবার সময়। বাবা বললো যে সে কেবল আমার ক্লাস দেখার জন্যই এসেছে আর সিস্টার মার্গারেট তাকে বললো কিছু প্রয়োজন হলে অবশ্যই জানাতে।

“চিনউই জিদেজে কোথায়?” ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে বাবা জিজ্ঞেস করলো।

একদল মেয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো। আমি চারিদিকে তাকালাম, কপালের কাছটায় ভার ভার অনুভব করছিলাম। বাবা কি করবে? চিনউইর হালকা রঙের মুখ দলের একদম মাঝখানে দেখা যাচ্ছিল, বরাবরের মতই।

” মাঝখানের মেয়েটা,” আমি বললাম। বাবা কি ওর সাথে কথা বলবে? ওকে কানমলা দেবে প্রথম হবার জন্য? আমি চাইছিলাম ধরণী দ্বিধা হয়ে যেন পুরো স্কুলটাকেই নিজের মধ্যে সেধিয়ে নেয়।

” দেখো ওর দিকে,” বাবা বললো। “ক’টা মাথা ওর?”

“একটা।” আমার এটা বলতে যদিও ওর দিকে তাকানোর প্রয়োজন ছিলোনা, তবুও তাকিয়েই বললাম।

বাবা একটা ছোট আয়না পকেট থেকে বের করলো, কমপ্যাক্ট পাউডারের আয়নার মত। “আয়নায় দেখো।”

আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

” আয়নায় দেখো।”

আমি আয়নাটা নিয়ে তাতে নিজেকে দেখলাম।

” তোমার কয়টা মাথা, মা?” বাবা জিজ্ঞেস করলো, ইগবুতে, প্রথমবারের মত।

” একটা।”

” ওই মেয়েটারও একটাই মাথা, দুটো নয়। তাহলে তুমি কিভাবে ওকে প্রথম হতে দিলে?”

” এমনটা আর হবে না বাবা।”

(চলবে…)

Ajit Dash

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ভাষা
Scroll to Top