[ গোস্বামী তুলসীদাসের জন্ম ১৪৯৭ খ্রিস্টাব্দে মতান্তরে ১৫৩২ খ্রিস্টাব্দের (১৫৮৯ বিক্রম সম্বৎ) শ্রাবণ মাসে। অনেকের মতে তিনি ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বান্দা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। আবার সর্বাধিক গ্রাহ্য মতানুসারে তিনি উত্তরের কনৌজ রাজ্যের পরাশরগোত্রীয় ব্রাহ্মণ।
মূলত সংস্কৃত ও অওধি ভাষায় তাঁর যাবতীয় রচনা। অসংখ্য উপদেশমূলক দোঁহার পাশাপাশি পার্বতীমঙ্গল, চৌপাই রামায়ণ, কড়কা রামায়ণ, বৈরাগ্য-সন্দিপনীর মতো উচ্চাঙ্গ সাহিত্যও তিনি রচনা করেছেন তবে তাঁর সর্বজনবিদিত তথা মধ্যযুগীয় ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তি হল- ‘রামচরিতমানস’। ১৬২৩ খ্রিস্টাব্দের (১৬৮০ বিক্রম সম্বৎ) এক শ্রাবণ তিথিতে বারাণসীর নিকট অসিঘাটের আশ্রমে তাঁর তিরোধান ঘটে। ]
চম্পায় হ্যায় তিন গুণ-রং-রূপ অউর বাস্।
এক অবগুণ হ্যায় জো ভ্রমর না যাওয়ে পাশ।। ১ ।।
চম্পক ফুল ভরে ওঠে রং, রূপ, সুবাসিত গুণে
অথচ ভ্রমর স্পর্শ করে না তার ত্রুটিপূর্ণ মধু।
এসো অসংখ্য গুণান্বিত মানুষ
চম্পক ফুলের মতো একটি দোষ সরিয়ে রেখে
হয়ে ওঠো সফল আনন্দ-উদ্বাহু…
ধন অউর যৌবনকো গরব কবহু করিয়ে নহি।
দেখ্ তহি মিট্ যৎ হেয় যব ভাদরকে ছাহি।। ২ ।।
অহং সরিয়ে রাখো ধন-যৌবনের
দ্যাখো, যেভাবে অদৃশ্য হয় ভাদ্রের ক্ষণিক মেঘ
ভেসে ভেসে যায় মেঘেদের ছায়া
সেভাবে কালেরও বিনাশ আছে
ধন-যৌবন ডুবে যায় সময়ের বিপুল সমুদ্র মাঝে।
জ্ঞানী মারে জ্ঞান্ সে ব্যাধ মারে তীর।
সদ্’গুরু মারে শব্দ সে শালে সকল্ শরীর।। ৩ ।।
ব্যাধের তীরের ডগায় পাখিদের মৃত্যু লেখা থাকে
জ্ঞানের শলাকা মুখে মালিন্যের ধ্বংস আঁকা থাকে।
যে আচার্য পথ দেখিয়ে চলেন
তার শব্দে শব্দে,
ইন্দ্রিয়লোভ ভেঙে শরীরের উজ্জ্বলতা রাখা থাকে…
অলি পতঙ্গ মৃগ্ মীন্ গজ্ ইয়াকো একই আঁচ।
তুলসী ওয়াকো ক্যা গৎ যাকো পিছো পাঁচ।। ৪ ।।
দ্যাখো ইন্দ্রিয় রসে ডুবে থাকা পতঙ্গ-ভ্রমর
অতল তাদের ডানা-
দ্যাখো হরিণ, মৎস্য কিংবা হাতি
সংগ্রহ করে অসীম কামনা।
নিয়ত যাপন যদি এত বশীভূত হায়
তবে হে তুলসী, জীবনের কাছে মৃত্যুর পরোয়ানা এসে যায়…
দয়া ধরম্ কী মূল হ্যায় নরক মূল অভিমান।
তুলসী মৎ ছোড়িয়ে দয়া যও কণ্ঠাগত্ জান্।। ৫ ।।
প্রতিটি ধর্মের দেহে করুণা জ্বলে
সেরে ওঠে ক্ষত দয়ার প্রলেপে।
নরকসজ্জা আছে অভিমান পথে
শোনো হে তুলসী,
যদি প্রাণ কণ্ঠাগত হয়
তবু জেনো করুণার ধর্ম শ্রেষ্ঠ নিশ্চয়।
বড়া বড়া সব কঈ কর্’তা বড়মে তাল অউর খজুর।
বৈঠনেকো সায়া নহী মিল্’তা ফল্ তো বড়ি দূর।। ৬ ।।
সমস্ত সম্পদ আপন অহং-এ বাঁচে
অথচ তাদের নিজস্ব ছায়া নেই।
তাল ও খেজুরের বিরাট বৃক্ষ জুড়ে আছে সব
শুধু নেই ছায়া মনোরম-
যদি দান নেই জীবনের অনন্ত বাজারে
তবে ফলের আশা কেন শেষ সন্তরণে…
সন্ত বড়ে পরমার্থী শীতল উনকি অঙ্গ্।
তপন বুঝাও ত অউরোকে ধরাও ত আপনা রঙ্গ্।। ৭ ।।
প্রতি স্থিতধীর বুকে পরমার্থ জেগে থাকে
স্নিগ্ধ জৌলুস থাকে শান্ত শরীরে।
নেই উত্তাপ, নেই ক্রোধ-
এসো সমর্পিত হও তাপসালোকে
দ্যাখো সকল রঙের মাঝে পরমার্থ জাগে…
চিদানন্দ ঘটমে বসে বুঝত্ তঁহা নিবাস্।
স্ব মৃগমদ্ মৃগনাভি মে চরত্ ফিরত্ সুবাস্।। ৮ ।।
হরিণের নাভির ভিতর সঞ্চিত কস্তুরী
অমল বাতাসে তার গন্ধ ঝরে যায়,
উন্মাদ অন্বেষণে মৃগসম ছুটে চলা-
যেভাবে ঈশ্বরগন্ধে মানুষের হৃদাসন ভরে যায়
তবু দিকে দিকে তাঁর মূর্খ সন্ধান
মানব দেহের মাঝে রেখে যায় হরিণের যাওয়া-আসা…
টীকা:
১. দোঁহাটির রচনাকাল ও শ্রুতিপ্রকাশ- ১৬২৩ বিক্রম সম্বৎ*/ ১৫৬৬ খ্রিস্টাব্দ, গোরক্ষপুর আশ্রমে ভক্তবৃন্দের সম্মুখে।
২. রচনা ও শ্রুতিপ্রকাশ- ১৬২৪ বিক্রম সম্বৎ/১৫৬৭ খ্রি:, গোরক্ষপুর আশ্রমে ভক্তবৃন্দের সম্মুখে।
৩. রচনা ও শ্রুতিপ্রকাশ- ১৫৬১ খ্রি:/ ১৬১৮ বিক্রম সম্বৎ, গুরু সনাতনদাসের নিকট পাঠ সমাপ্ত করার পরবর্তী দিবসে।
৪. রচনা ও প্রকাশ- ১৬২৮ বিক্রম সম্বৎ/ ১৫৭১ খ্রি:, গ্রন্থ- ‘বৈরাগ্য সন্দিপনী’-র অন্তর্ভুক্ত।
৫. দোঁহাটির রচনা ও প্রকাশ- ১৬৩০ বিক্রম সম্বৎ/ ১৫৭৩ খ্রি:, চিত্রকূট পর্বতে তপস্যারত অবস্থায় এক অতি দরিদ্র শূদ্রকে নিজের ভিক্ষান্নের সবটুকু বিলিয়ে দেওয়ার সময় এই দোঁহার শ্রুতিপ্রকাশ করেন।
৬. রচনা ও প্রকাশ- ১৫৭৮ খ্রি:/ ১৬৩৫ বিক্রম সম্বৎ, গ্রন্থ- ‘গীতাবলি’-র অন্তর্গত। আশ্রমে শিষ্যবৃন্দের সম্মুখে।
৭. রচনা ও প্রকাশকাল- ১৬৩৯ বিক্রম সম্বৎ/ ১৫৮২ খ্রি:, কথিত আছে ভবানী মিশ্র নামক এক ব্যক্তি ব্রহ্মহত্যার পাপে অনুতপ্ত হয়ে বৃন্দাবনের আশ্রমে তুলসীদাসের আশ্রয়ে এলে তিনি ভবানী মিশ্রকে উক্ত দোঁহা দ্বারা অভয় দান করেন।
৮. গ্রন্থ- ‘বৈরাগ্য সন্দিপনী’-র অন্তর্ভুক্ত, রচনা ও প্রকাশকাল- ১৬৩১ বিক্রম সম্বৎ/ ১৫৭৪ খ্রিস্টাব্দ, মথুরায় এক ধর্মসভা সম্মেলনে শ্রোতাবৃন্দের সম্মুখে।
* মূল রচনাকাল হিসেবে বিক্রম সম্বৎ -এর ব্যবহার করা হয়েছে কারণ তৎকালীন উত্তর ও মধ্যদেশীয় সনাতন ভারতীয়দের ভিতরে সাল গণনার ক্ষেত্রে তখনও উজ্জয়িনীর সম্রাট বিক্রমাদিত্য প্রবর্তিত (৫৭ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে/ ১ বিক্রম সম্বৎ) গণনা পদ্ধতির কমবেশি প্রচলন ছিল।
রূপায়ণ ঘোষের জন্ম অগস্ট ১৯৯৩ সালে, ভারতের বীরভূম জেলায়। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘প্রাচীন ভারতের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও প্রত্নবিদ্যা’ বিষয়ে স্নাতকোত্তর। অনুবাদের পাশাপাশি রূপায়ণ মৌলিক কবিতা ও প্রবন্ধচর্চাও করে থাকেন। তাঁর এ যাবৎ প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে দু’টি কবিতার বই ও একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। বর্তমানে হিন্দি, মরাঠি, ও রোমানিয়ান সাহিত্যের অনুবাদক হিসেবেও তিনি কাজ করছেন।