Home » জুলফিকার রবিনের একগুচ্ছ কবিতা

জুলফিকার রবিনের একগুচ্ছ কবিতা

ব্যথার নুপুর

চমকে উঠেছি প্রিয় ভাঁজখোলা ঘ্রাণ
সরলা স্নেহের কোলে শূন্য উঠান
ভাঙনবর্তী বুকে শাশ্বত পাখি
খোলা চুলে ডেকে যায় বিষাদ ভোরে।

আঁচলের গাটে বাঁধা সকাল দুপুর
অবলা মেয়ের পায়ে ব্যথার নুপুর
পরাতে পারেনি কেউ স্মৃতির রাখি
প্রিয়চোখ বুজে আছে মোহের ঘোরে।

চুরি হয়ে গেছে নাকি সাঁঝের জোনাক
যেই সুর বেধেছিলো ঝিঁঝিঁপোকা  ডাক
আকুল করবে কবে রাতের হাওয়া
বুকের অভাবে কত হৃদয় পোড়ে।

দর্শন

ঘুম এ জন্য আমার প্রিয় নয় যে
তাতে এই দেহ সুস্থিত হয়
বরং তুমি স্বপ্নে আসো বলেই তো
এইসব ঘুমের অভিনয়।

জনৈক আমি

আমার অজানাতে আছে কিছু সূক্ষ্ম বেদনার হিসেব
কৌতূহলে আছে এমন হাজারো অজানা
আমাকে ভালোবাসতে পারো প্রিয়
অজানাকে ভালোবেসো না।
দৃশ্যত আমি তোমাদেরই যেন
অগোচরে বড় অচিন, বেগানা
আমাকে কাছে টানতে পারো প্রিয়
ভুলে অচেনাকে টেনো না।

দেয়াল

ভাবনাতে এলে পরে তড়িৎ চমকে যায়
বুক জুড়ে ওঠে সেই নামের বজ্রধ্বনি
জনশ্রুতি হলো এই বেহায়াপনার কথা
জানা গেল শুধু তাঁর কানেই তা পৌঁছেনি।

যদি হৃদয় পাতো কানে

তোমার দেহে যে আবহমান রূপের সম্মেলন
তার প্রতিটি ভাঁজেই আমি খুঁজে পাই ইবাদতের ভাষা
আমি যে তোমায় এত ডাকি এত যে জপি তোমার নাম
লোকে তার প্রতিবাদ করেছিলো
অথচ তারা জানে না-
ও দেহের ভাষা জানলে যেকোন কাফেরও মত্ত হবে কঠোর উপাসনায়
মুশরিকেরা সব বসে যাবে অনির্দিষ্টকালের ইতেকাফে
তুমি বরং তোমার হৃদয়ের সাথে একটা কান জুড়ে দাও
অথবা কানের সাথে একটা হৃদয়
তাহলেই শুনতে পাবে-
কতটা মর্মস্পর্শী আমার এই একাগ্রতার আজান।

কুটুমপক্ষী ডাকতে ডাকতে তুমি নাই

শুক্রবার নিকটে বলেই আমি বৃহঃবারকে ভালোবাসি
তুমি নিকটে বলেই ভালোবাসি বেদনাকে
অথচ শুক্রবার আর তুমি থাকোনা অনন্ত সময়জুড়ে
যেন কুটুমপক্ষী ডাকতে ডাকতে তুমি নাই
আমি হাসতে হাসতে অশ্রুসিক্ত হয়ে যাই।

মন মহাজন

প্রবল প্রেমের সুখ দেহের গহীনে
ব্যথার মহিমা দিয়ে ঢাকা সযতনে
মোহের দরিয়া মাঝে জলের ডাকাতি
শীতল স্নেহের খোঁজে প্রাণের আকুতি।

দেহের নগরে ডাকে সুরেলা আজান
দ্বিধার দরজা খোলে কাতর পরাণ
নয়নে নয়ন প’লে বেপরায়া মতি
পিয়াস মেটায় যেন রূপময় জ্যোতি।

প্রেমের বাজারে সদা চলে বেচাকেনা
চুমুর আড়ালে কে যে শোধ করে দেনা
ঠোঁটের শিরনী পেলে ক্ষুধিত প্রেমিক
ভুলে যায় লোকেদের শত কোটি ধিক্।

মরুভুমে ঘেরা এই তৃষিত জীবনে
রসের ভাবনা কাটে সতত স্মরণে
ভাবুকের ধ্যানে যদি থাকে মহাজন
ভবের যাবত জ্বালা হয় নিবারণ।

নিয়তি

আমাদের কৈশোরিক সংলাপের পর
পুনর্জন্ম হয়েছে যে বিরহী প্রেমের
তার কপালে পরাও উপেক্ষার কালোটিপ।
হৃদয় যদি চিরকাল বঞ্চিত স্বভাবসুলভ
প্রকৃত আর অপ্রকৃতের সংজ্ঞায়,
কোন সূত্রে তবে গড়ে তোলো মায়াজাল?

আমার দুচোখ চিরে দেখো প্রিয়
তুমি ব্যতীত কোথাও কোন মিথ্যে নেই
অথবা কোন স্থায়ী বসতির চিহ্নমাত্র
আমাকে কাঙাল করো ডাকাতিয়া ঠোঁট
রূপান্তর ছাড়া সকল গন্তব্যই অনিশ্চিত প্রায়।

প্রবঞ্চনা

সেসব দুঃখ কেউ দেখে না
অবিশ্বাস্য অথচ চোখের এতটা কাছে
পবিত্র কৈশোর কিনে নিলো প্রতারক সময়
লোভেরা উজাড় করে ঢেলে দিলো প্রাপ্য বিষ।
এখন আমাদের বুকভরা হাসপাতাল
হাতভরা ওষুধের ঘ্রাণ
প্রতিটি শরীরে দগদগে ঘা, সদ্য সেলাইয়ের টান।
এখন শহরগুলোতে লাশের জীবন
গ্রামগুলো শহরের অবৈধ সন্তান
প্রতিটি বসতবাড়ি যেন নীরব কবরখানা
ভেতরে সাত দোজখের মিলিত তুফান।
অথচ এই লোকালয়ে ছিলো ভরপুর স্নিগ্ধতা
হাওয়ার তালে নাচতে থাকা প্রিয়তমা ফসল
ছিলো মিষ্টি রোদের সাথে ভোরের তীব্র প্রণয়
কোরান আর কীর্তনের সুরে গাঁথা অভিন্ন হৃদয়।
আমাদের কতটুকু বাকী আর কতটুকু শেষ
শুধু মগজ বিক্রির দামে পাওয়া যেটুকু সংকট
নাকি জিহ্বায় ঝুলে থাকা অস্পষ্ট মুক্তির বাণী।
প্রেম আর মানবতার সংজ্ঞা বদল করে
কারা যেন যুদ্ধে নেমেছে
আরও ভীষণ কোন যুদ্ধের ফন্দিতে
প্রভু, কী নির্লজ্জ প্রবঞ্চক তোমার শ্রেষ্ঠ তৈয়ার
মানুষকে হত্যা করে তারা পৃথিবী বাঁচাতে চায়।

বাতিল মাল

তুমি কেবল পরীক্ষা করে দেখো
কতটা সস্তায় বিকিয়ে যায় বাতিল মাল
আমাকে গভীর থেকে টেনে তুলে আনো
যেখানে কোনদিন পড়েনি কারো চোখ
যেন আমি কাঙ্ক্ষিত আর দুর্লভ।

আমি ঝুলে থাকি গাছের সবথেকে অবহেলিত ডালে
যাকে ঢেকে রাখে দুর্ভাগ্যের একগোছা পাতা
তুমি খুব সাবধানে বৃন্তচ্যুত করো
পরখ করো  বুকের গভীরে টেনে
কখনো বসাও দাঁত, কখনো নখের আঁচড়
আঘাতে পুলক জাগে মৃত্যুর মতন।

যে সুনিপুণ অভিনয়ে বেড়েছিলো সাময়িক উপযোগ
তাতে কেবল স্পষ্ট হয়েছে জন্মের অভিশাপ
সেই যে কবে নেড়েচেড়ে রেখে গেছো প্রিয়
তারপর কেমন অবিক্রীতই রয়ে গেলাম চিরটাকাল।

 বিষন্নতা  তোমার স্মরণ

যে বিষন্নতা তোমার স্মরণ নিয়ে আসে
তাকে যত্ন করে বসাই নির্জনতার খাটে
তার পায়ে চুমু খেয়ে প্রার্থনা করি
উন্মাদনা যেন আমাদের মাঝে দেয়াল না হয়ে যায়
কোলাহলের মাঝেও আমাদের যে দৃষ্টিবিনিময়
তার রেশ থেকে যায় পুরোটা প্রতীক্ষা জুড়ে
সেই অনুভবকে বুকে জড়িয়ে রেখে যন্ত্রণাকে বলি-
তুমি বরং আমার অভ্যাস হয়ে যাও।

 মানুষ যেমন

মানুষের খুব কাছে গেলে দেখতে পাবে
কপালের ভাঁজে ভাঁজে ইতিহাস দর্শন
চোখের মণিতে রাজনীতির ছলাকলা
আর বুকের ভেতর কবিতার পাণ্ডুলিপি
যার দেহে মিশে আছে মহাবিশ্বের আলপনা
তাকে কসমোলজির মত বুঝতে যেওনা
ভুলেও যদি মানুষকে বুঝতে চাও
আগে ধরে নিও এক সুনিশ্চিত ব্যর্থতা।

 রূবাঈ

১.

চোখের দেখায় মন পুড়ে যায় দোজাহানে যারে চাই
এমন বাসনা পুষবো তেমন সাধনা কিছুই নাই
হৃদয়ের দাম আকাশ ছুঁয়েছে আর আমি মুসাফির
দ্বারে দ্বারে ঘুরে জমেছে কেবল জীবন পোড়ানো ছাই।

২.

পান মুখে কেউ দিচ্ছে বয়ান নেশার দ্রব্য ঘোর হারাম
দুই পেগ গিলে বলছে মাতাল ভূতের মুখেই রামের নাম
আমরা সবাই ব্যস্ত কেবল পারস্পরিক ভুল খোঁজায়
নিজের জীবন ঘাটলে পেতাম হাজার ভুলের স্বর্গধাম।

আমরা দুজন

একটি অচেনা পাখির সাথে গন্তব্যহীন উড়ে চলি
আমারই মত যার হৃদয় নিয়ে গেছে চতুর সওদাগর।
আমাদের নিচে যে পৃথিবী আর মানুষের হাট,
সেখানে প্রেমের নামে পাওয়া যায় নিখাদ অস্থিরতা।
প্রেমিক মূলত এমন ফুল যাতে তৈরি হতে পারে কলঙ্কমালা
বুকে যাদের তীব্র হাহাকার তারা এক অভিন্ন গাছের ডালপালা।

Ajit Dash

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ভাষা
Scroll to Top