Home » কাওড়ামঙ্গল (পর্ব ৭) II রোমেল রহমান

কাওড়ামঙ্গল (পর্ব ৭) II রোমেল রহমান

চান্দে চান্দে পাড়ি দেও মাটি
তোমার ছায়া আমার ছায়ায় লাগে কাটাকাটি,
ধান ছড়ায়ে শালিক ছুঁড়ে দেও
তুমি সুতোয় সুতোয় পুতুলবাজি খেলা খেলে নেও।

রাত ঘন হলে মঙ্গল তার পাল নিয়ে নীরবে ব্যস্ত পালায়। আমরা দেখি একদল ছায়া মানুষ একদল ছায়া শুয়োর তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আকাশে চাঁদ। শেষ রাতে পাল তাড়াতে তাড়াতে নদী কিনারায় এসে দাঁড়ায় মঙ্গলের দল। হাঁপাতে থাকে সবাই। নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে মঙ্গল। শুয়োরগুলো জল খেতে থাকে। নদী মরে গেছে।

হরিপদ : এ নদীও মইরে গেইছে? স্রোত নেই, চর খালি।
দিনেশ : কাকা নদী কি এহন পাড়ি দিবা নাকি আলো ফুটলি?
মঙ্গল : আলো ফুটুক।
হরিপদ : ছোটবেলা দেহিছি এই নদীর ঢেউ। এহন শেষ হয়ে গেইছে।
দিনেশ : বড় নদীতে বাঁন দিলি ছোট নদী বাঁচে নাকি?
মঙ্গল : আগে ভাটার সময়ও নৌকো লাগতো এহন জোয়ার ভাটা কিছু নেই। হাইটেই পাড়ি দেয়া যায়।

একটা শুয়োর ঘোঁত ঘোঁত করে অন্য কয়েকটা শূয়রকে গুঁতোতে থাকে। সুবোধ এগিয়ে গিয়ে লাঠি চালিয়ে থামায়।

মঙ্গল : সুবোধ, ঝোলার থে ছাউ গুলোন ছাইড়ে দে। দুধ খাতি লাগুক। নদী পাড়ি দিলি আবার হাঁটা ধরা লাগে কতক্ষণ।

সুবোধ সিমেন্টের প্লাস্টিক বস্তার বাজারের ব্যাগের মধ্যে বয়ে আনা এক/দুইদিন বা কয়েক সপ্তাহ বয়সের বাচ্চাগুলোকে বের করে দিতেই তাদের ধাড়ি মার স্তন চুষতে শুরু করে তারা। যেন দুধ পানের মোচ্ছব লেগে যায়, কিলবিল করতে থাকে একটার উপর দিয়ে আরেকটা।

ভোরের সূর্য যখন ওঠে। মঙ্গল ইশারা দেয় সবাইকে। সুবোধ থলেতে বাচ্চাগুলোকে ভরে ফেলে। দিনেশ মানতের সেই শুয়োর আর আনন্দ ঠাকুরের রেখে যাওয়া মর্দাটাকে প্রথমে নামিয়ে দেয় নদীর জলে। তারপর একে একে পুরো পাল নেমে যায়। পেছনে কয়েকজন কাওড়া আর দুই পাশে কয়েকজন কাওড়া হেঁটে পাড়ি দেয়। সবার শেষে মঙ্গল। একবার মাত্র সে পিছনে ফিরে তাকায়।

নদী পাড়ি দিয়ে কাওড়ারা এগোতে থাকে। একটা ধাড়ি বাচ্চা দেয়। সবাই দাঁড়িয়ে যায়। হরিপদ মজা নেয়,

হরিপদ : বাজি কি ধরবি নিকি দিপেন?
দিপেন : নাহ্‌। ধরলিই হারবানি।

সবাই হাসে। স্বস্তির হাসি। মঙ্গল শুধু নদীর অইপারে তাকায়। তার মনে শঙ্কা আছে এখনো গুণ্ডাদের।
একটা বিল দেখিয়ে মঙ্গল পাল নামিয়ে দিতে বলে। দিপেনকে বলে,
মঙ্গল : নে। পাল নামায় দে এই মাঠে। খাতি লাগুক। দিপেন, ওইপাশেই থাকার কায়দা কর। পালা কইরে ঘুমোলি ঘুময় নে এট্টু। বেলা ফুটলি সময় হবে নানে।
দিপেন : খাবার জল আনা লাগতো কাকা। পুকুর তো দেখতিছি না।
মঙ্গল : পাত্তর হাতে কইরে বইসে থাকলি কি পুকুর হাইটে আস্পে?

বেকুব হয়ে দিপেন বেরিয়ে যায় গ্যালন নিয়ে। মঙ্গল বসে পড়ে। একটু আধশোয়া হয়ে জিরোতে লাগে।

২৯

জল আনতে গিয়া তুমি
ডুবলা পানিতে,
পানি থিকা তুইলা তোমায়
ভাসাই জলেতে।

জল নিতে পুকুর পাড়ে আসতেই এক মহিলা দিপেনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পরিচয়,

মহিলা : এই এই কিডা তুমি?
দিপেন : জল নিতি আইলাম খাবার জন্যি।
মহিলা : সেডা তো দেখতিই পাচ্ছি।জিজ্ঞেস করতিছি তোমার নাম কি? কোন বাড়ির?
দিপেন : নাম আমার দিপেন মণ্ডল। বাড়ি এহেনে না।
মহিলা : বাড়ি এহেনে না? তালি এহেনে আসলা কিরাম কইরে?
দিপেন : জি আমরা হচ্ছি কাওড়া। শুয়োরের পাল ন্যে কেবল মাত্তর আইছি আপনাগের গেরামে।
মহিলা : কি কলা? কাওড়া? ছ্যাঁ ছ্যাঁ।সইরে যাও।ওঠো ওঠো জলের কাছ থে ওঠো।

দিপেন থতমত হয়ে উপরে উঠে যায়।
মহিলা : অজাতগের জন্য এই পুকুর না।জল ছোঁবা না খবরদার। তোমাগের জন্যি মুচি পাড়ায় এট্টা পুকুর আছে অইখেনে যাও।
দিপেন বোকার মতন তাকিয়ে থাকে।
মহিলা : তাকায় আছো ক্যান? কান নাই? নাকি ভোঁদাই? হাঁটো হাঁটো!

দিপেন অসহায়ের মতন বেরিয়ে যায়।

৩০

হাটের কেনা,মাঠের কেনা,
কোথায় কখন হাটবাজার;
ঘরের মধ্যি গুঁইসাপ
ঝোপের মধ্যি পোষা নাড়।

রাস্তা দিয়ে ভটভটিতে যাওয়ার সময় দুজন লোক শুয়োর পাল দেখে ভটভটি থামিয়ে নেমে আসে মাঠে।

লোক ১ : পাল কাগের?
মঙ্গল : এই যে বাবু আমার।
লোক ২ : নাম কী দাদার?
মঙ্গল : মঙ্গল
লোক ২ : নিবাস কি মনিরামপুর নাকি ডুমুরে?
মঙ্গল : জানেন তো সবই।ডুমুরে।
লোক ১ : যাচ্ছিলাম হাটে এই জিনিসের দাম করতি তা ভগবান এহেনে মিলেয় দেলো।
মঙ্গল : কপালে থাকলি রাস্তাতেই নামতি হয়।
লোক ১ : তা ভালো কইছ।
লোক ২ : শোন আমাগের এট্টা অনুষ্ঠান আছে।দশ বারোডা মাল লাগবে। এহন দরদাম কও দিনি।
মঙ্গল : পিস হিসেবে না কেজি হিসেবে শোনবেন?
লোক ১ : হাটের চাইতি কম নিলি মাল নেবো নালি না।
মঙ্গল : কম দিতি দিতি তো দাদা আমাগের আর বেশি হল না।
লোক ১ : কথার তো কায়দা ম্যালা তোমার। তা ইদিকে যে শুয়োর নিয়ে ঢুকিছো এরা কিচ্ছু কচ্ছে না? এগেরতো ছোঁয়াছুঁয়ি মেলা।
মঙ্গল : ও।
লোক ১ : আমরা কলাম এই গিরামের না। কিন্তু এগের জাতপাতের আচরণ এহনো আগেরকালের মতন।পেটে ভাত নেই জাতের খাড়া সব। কবে কোন উঁচু জাতের লোক পত্তন দিইলো এই গিরামের সেই গরমে এহনো গরম।সবাই নাকি সেই বাড়ির জ্ঞাতি।
মঙ্গল : অ।তা হলি হবে।আমরা করব কি ? তা দাদা সেই বাড়িডা কুন্ডা? আছে নাকি নোনায় খায়ে গেইছে?
লোক দুটো হেসে ওঠে।

৩১

গোস্বা না করো মা মনসা দোহাই
বেউলার মতো য্যেন স্বামী না হারাই!
নির্বিষ সর্প দিয়া করো ফোঁসফাঁস
সংসার রসে যেন মেটে মোর আশ।

সুবোধের চারপাশে ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়েছে।ঘুম ভেঙে তাকিয়ে দেখে একটা সাপ ফনা তুলে আছে তার দিকে।লাফিয়ে সরে যায় একদিকে। সুবোধের সেই উচ্ছলতা নেই আর।একদিনেই সব উবে গেছে।তাকিয়ে তাকিয়ে সুবোধ দেখে সাপটার চলে যাওয়া।একটা কুকুর ঢোকে আবার বেরিয়ে যায়।সুবোধ পাতার ফাঁক দিয়ে দেখা যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থাকে অঞ্জনার অপেক্ষায়।

৩২

জোয়ারে আসলো কুমির
খাইল সারা দেশ,
হরিলুট হলে পর
কুমিরেই শেষ!

দিপেন জলের গ্যালন মাথায় নিয়ে ফেরে বিরক্ত চোখমুখে।

দিপেন : এ দেশে থাহা যাবে না কাকা।
মঙ্গল : ক্যান?
দিপেন : জলের কষ্ট খুব। জল নোনা সব কয়ডা পুকুরের।দুইডে মিষ্টি পানির পুকুর এট্টায় গেলাম সেহেন থে তাড়ায় দেলো।কয় যে, কাওড়াগের জল নেয়া নিষেধ।উঁচু জাতের পুকুর ওডা।তারপর গেলাম মুচিপাড়ার পুকুরে।
মঙ্গল : ভালো যন্ত্রণা তো বাড়া। আমারেও দুইজন কয়ে গেলো। এরা নাকি হাটবাজারেও ঝামেলা করে। দেহি আজেকে থাহি তো। না পোষালি পাল তুইলে ভাইগে। নে জিরোয় নে।

হরিপদ ঘুমাচ্ছে হাঁড়িপাতিলের পাশে। স্বপ্নে দেখতে থাকে বাচ্চা কোলে নিয়ে বসে আছে হরিপদ। তার বউ একটা মাগুর মাছ কুটছে। পাশে লাউ এবং অন্যান্য তরকারি পড়ে আছে। কিন্তু মাছটা কাটতে গিয়ে আঙুল কেটে যায়। হরিপদ আঁতকে ওঠে। ঘুম থেকে ধড়মড় করে জেগে ওঠে। মঙ্গল ফিরে তাকায়, টের পায়; এসব তার চেনা। অনেকদিন কাওড়ারা মাঠে থাকলে এমন হওয়া শুরু হয়।

আচমকা ৫/৬ টা মোটর সাইকেল এসে থামে রাস্তায়। একদল ছেলে মাঠে নেমে আসে। তাদের মধ্যে গতকালের চারজন আছে। এরা নদী পাড়ি দিয়ে চলে এসেছে ধরতে। মাঠে নেমেই এলোপাথাড়ি পিটান শুরু করে কাওড়াদের। মঙ্গলকে প্রথমে পেয়ে পেটায়। অন্য দুজন কাওড়া পালায়। দিপেন পাল্টা এগিয়ে যায় মঙ্গলকে মারার সময়। তাকে পিটিয়ে ফেলে দেয়। দিনেশ, হরিপদ আহত হয় ভালো রকম।

গুন্ডা ১ : খানকির বাচ্চারা পলায় আইছিস?
গুন্ডা ২ : নদী পাড়ি দিলিই কি মনে করিছিস আমাগের সীমানা শেষ?
গুন্ডা ৩ : শুয়োরের বাচ্চা সাহস কি তোর।
গুন্ডা ৪ : পুরো দেশ আমাগের হাতের মুঠোয় আর এই বাইঞ্চদেরা ভাবিছে পলাপুলি খেল্লি বাইচে যাবে।
মঙ্গলের চুলের ঝুঁটি মুঠ করে ধরে ঝাঁকায়।
দিপেন মাটি থেকে উঠে এগিয়ে যায়।
গুন্ডা ১ : হেঁই ধর দিনি এই এইডেরে আগে।
মঙ্গল চিৎকার দিয়ে বলে,
মঙ্গল : ওরে ছাড়েন ওরে ছাড়েন বাবু। আমার ছেইলে ও।আমারে মারেন। সর্দার আমি। দোষ আমি করিছি। আমারে মারেন।
শুয়োর পালের মধ্যে হল্লা শুরু হয়ে যায়।একটা দাঁতাল এসে কামড়ে দেয় গুণ্ডাদের একজনের পাছায়!
গুন্ডা ৪ : হেঁই হেঁই একি। উড়ে উড়ে উড়ে। কামড়ায় দেলো।
গুন্ডা ১ : বান মারিছে মনে হয়। কইলাম না ইরা মানুষ না পিচেস।
গুন্ডা ২ : হেঁই। আর মারামারি করা লাগবে না। কয়ডা শুয়োর নিবি নে। ভটভটি আনতি কইছি আমি। তুইলে ন্যে যাবো। আর ওরে হাস্পাতালে ন্যে যা, ভয় নেই কিছু হবে নানে।
মঙ্গল : বাবুরা আমারে মাফ করেন। আমার ছেইলে গুলোরে আর মাইরেন না। দুডো শুয়োর নিতি চাইলেন নিয়ে যান।
গুন্ডা ২ : তোমার আর ঢপ দিতি হবে নানে খানকির ছাবাল। এহন দেহো কয়ডা নিই। দুইডে চাইলাম দিলে না এহন আর দশটা নিয়ে হাটে বেইচে টাকা নেবো।
রাস্তায় একটা ভটভটি এসে দাঁড়ায়। শুয়োর তুলে নিতে এসেছে। কিন্তু শূকর তুলতে গিয়ে হিমশিম খায় গুণ্ডারা। সমস্ত পালের শূকরের এলোপাথাড়ি দৌড়াদৌড়ি করতে থাকে।কামড় খাওয়া লোকটা আতঙ্কে দিনেশের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। দলের মধ্যে আরেকজনের হাত কামড়ে দেয় এক মাদী শুয়োর! বাচ্চা ধরে টানাটানি করায় ক্ষেপে যায় মাদী। শেষমেশ দুটো শুয়োর তুলতে সক্ষম হয়। ভটভটি ছুটিয়ে তারা হাজির হয় ক্লাব ঘরের সামনে! সেখানে গল্পে মশগুল স্থানীয় নেতারা! ঘাড়ে গর্দান টাইপ একদম নেতাকে দেখান হয় শুয়োর।একটা শুয়োর তাদের সাম্নেই বলি দেয়া হয়। হাত তালি ওঠে চারদিকে। গান ছাড়া হয়। সেই তালে নাচ শুরু হয়। মধু হিজড়েকে আনা হয়েছে নাচাতে! তাকে খেমটা দিতে দেখা যায়। গানের ফাঁকে ফাঁকে নেতাদের উল্লাস চলে। গানের পংতি গুলো ভয়াবহ,

আমার খাজা কাঁটাল লুটে খেলো ডাকাতের দল
থানায় গিয়ে দেখে এলাম মামলাবাজির কল।

দুনিয়াদারী লুটনেওয়ালীর চাবুকেরই ঘা
খাবি তো খা বিচি ফেলে খা
হজমি ছাড়া হজম হবে বিচি খুলে খা

যার কাছে যাই তারই তো চাই
ভাগের মোরব্বা
ঘুঘুবাজির জোড়া নাচে মেরেছি ছাপ্পা

কে যে আসল কে যে নকল
দুই চোখেতে টানলে কাজল
যাবে দেখা ঘোলা ঘোলা
টাকায় টাকায় জামা খোলা

যাচ্ছে খেলে পয়সা ঢেলে
বাপের ঘোড়া ডিঙিয়ে ছেলে
লুটে লুটে চেটেপুটে
সবটুকু ভাগ খাচ্ছে খুঁটে

৩৩

মাঠের মধ্যে তুমি একা,
সাক্ষী ছায়া গাছ,
ভাগ্য তোমার পিতামহ
কপালের লেখা!

সন্ধ্যায় ঝিঁঝিঁর ডাকের মধ্যে ঢুলে পরা অন্ধকার। কাওড়ারা সবাই চুপ মেরে আছে।ভীষণ অপমানে সবাই বিদ্ধস্ত। দিপেনকে একটা চাদর গায়ে শুয়িয়ে রাখা হয়েছে। মঙ্গল থালায় খাবার নিয়ে দিপেনকে খায়িয়ে দিচ্ছে।

মঙ্গল : নে খায়ে নে বাবা।
দিপেন : কয়ডা শুয়োর ন্যে গেছে কাকা?
মঙ্গল : ও দ্যে তোর কাজ নেই। আগে সুস্থ হ।
দিনেশ : কিচ্ছু করতি পারলাম না কাকা আমরা।
মঙ্গল : যাকগে, যা হচ্ছে হোক। এবার কপালে খারাপ লাগিছে। এরাম কইরেই এগোবে।
হরিপদ : থানায় যাবা কাকা?
দিনেশ : প্যাঁচ মারবেনে উল্টো। যেমন রাজা তেমন তার চড়নদার।
হরিপদ : মহাজনরে কবা কি?
মঙ্গল : কবো, সব শেষ। আমারে মারেন, কাটেন; সব দোষ আমার।
দিপেনের চোখ বেয়ে পানি ঝরতে থাকে।
মঙ্গল : তুই কান্দিস ক্যান বলদ?

অন্ধকারের মধ্যে চোখগুলো ভিজে ওঠে। পরস্পর টের পায় কিন্তু আড়াল করে সবাই সবার ব্যথা।

Ajit Dash

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ভাষা
Scroll to Top