উপন্যাস II মুন্সী প্রেমচন্দ II মূল হিন্দী থেকে অনুবাদ: সফিকুন্নবী সামাদী
পণ্ডিতগণ উপন্যাসের অনেক রকম সংজ্ঞা দিয়েছেন। কিন্তু ব্যাপার হলো যে জিনিস যত সরল তার সংজ্ঞা ততই কঠিন। আজ অব্দি কবিতার সংজ্ঞা স্থির হতে পারেন ঔনি। যত পণ্ডিত তত সংজ্ঞা। কোনো দুই পণ্ডিতের মত মেলে না। উপন্যাসের ব্যাপারেও একথাই বলা যেতে পারে। এর এমন কোন সংজ্ঞা নেই যাতে সকলেই একমত হতে পারেন।
আমি উপন্যাস বলতে মানব চরিত্রের চিত্র-মাত্র বুঝি। মানব চরিত্রের ওপর আলোকসম্পাত এবং তার রহস্য উদঘাটন উপন্যাসের মূল কথা।
কোনো দুজন মানুষের চেহারা মেলে না, সেরকম তাদের চরিত্র মেলে না। সকল মানুষের হাত, পা, চোখ, কান, নাক, মুখ থাকে কিন্তু এত মিলের পরও যেমন তাদের মধ্যে পার্থক্য থাকে, এমনি মানুষের চরিত্রের মধ্যে অনেক সাধারণ বৈশিষ্ট্য থাকা সত্বেও থাকে মৌলিক পার্থক্য। এই চরিত্র-সম্পর্কিত সাধারণত্ব ও বিশিষ্টতা এবং অভিন্নতা ও পার্থক্য প্রদর্শনই উপন্যাসের মুখ্য কর্তব্য।
সন্তানের প্রতি প্রেম মানবচরিত্রের এক সর্বত্র-বিস্তৃত বৈশিষ্ট্য। এমন কি কোনো প্রাণী আছে, সন্তানকে যে ভালোবাসে না? কিন্তু এই সন্তান-প্রেমেরও মাত্রা রয়েছে, রয়েছে পার্থক্যও। কেউ তো সন্তানের জন্য মরেও যেতে পারে, তার জন্যে কিছু রেখে যেতে নিজে নানা প্রকার কষ্ট করে, কিন্তু ধর্মভীরুতার কারণে অন্যায় পথে ধন সঞ্চয় করে না। সে ভয় পায়, এর পরিণাম যদি আমার সন্তানের জন্য খারাপ হয়। এমন মানুষও আছে, যে ঔচিত্যের লেশমাত্র বিবেচনা করে না—যে কোনো প্রকারে ধন সঞ্চয় করে যাওয়া নিজের ধ্যান মনে করে, যদি এর জন্যে তাকে অন্যের গলাও কাটতে হয়। এ ধরনের সন্তান-প্রেম নিজের আত্মারও বলিদান করে দেয়। তৃতীয় রকমের সন্তান-প্রেম দেখা যায়, সন্তানের চরিত্র যেখানে প্রধান কারণ, যখন পিতা সন্তানের কুচরিত্র দেখে তার প্রতি বিমুখ হয়ে যায়—তার জন্যে কিছু রেখে যাওয়া বৃথা মনে করে। বিচার করলে এই সন্তান প্রেমের নানান রকম পার্থক্য পাওয়া যাবে। তেমনি মানবীয় গুণেরও নানান মাত্রা ও ভেদ রয়েছে। আমাদের চরিত্রাধ্যায়ন যতটা সূক্ষ্ম হবে, যতটা বিস্তৃত হবে ততটাই সফলতার সঙ্গে আমরা চরিত্র-চিত্রণ করতে পারবো। সন্তান-প্রেমের এমন এক দশাও হতে পারে, যখন পুত্রকে কুমার্গে চলতে দেখে পিতা তার হন্তারক হয়ে যায়। এও সন্তান-প্রেমই, যখন সন্তান পিতার জন্যে ঘিয়ের লাড্ডু হয়ে যায় যার বক্রতা স্বাদ গ্রহণে বাধা সৃষ্টি করে। এমন সন্তান প্রেমও দেখতে পাওয়া যায়, যেখানে মদ্যপ, জুয়াড়ি পিতা পুত্রপ্রেমের বশীভূত হয়ে সকল বদ-অভ্যাস ত্যাগ করে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ঔপন্যাসিক এইসব চরিত্রকে অধ্যয়ন করে পাঠকের সামনে সোজা-সাপটা রেখে দেবেন, নাকি নিজের বুদ্ধিমতো কাটছাঁট কমবেশি করবেন, বা কোনো উদ্দেশ্য পূরণের জন্যে চরিত্রের মধ্যে কোন পরিবর্তনও নিয়ে আসবেন?
এখান থেকেই উপন্যাসের দু’রকম পার্থক্য হয়ে যায়। এক আদর্শবাদী, অন্যটা বাস্তববাদী।
বাস্তববাদী চরিত্রকে পাঠকের সামনে তার যথার্থ নগ্ন রূপে উপস্থাপন করেন। সচ্চরিত্রতার পরিণাম খারাপ কিংবা অসচ্চরিত্রতার পরিণাম ভালো হচ্ছে কি না সে বিষয়ে তিনি পরোয়া করেন না। তাঁর চরিত্রেরা নিজের দুর্বলতা বা মহত্ব প্রদর্শন করে জীবনলীলা সাঙ্গ করে। পৃথিবীতে সব সময় সৎকর্মের ফল ভাল এবং অসৎকর্মের ফল মন্দ হয় না, বরং তার উল্টো হয়ে থাকে। ভালো মানুষ ধাক্কা খায়, যাতনা সহ্য করে, বিপদে পড়ে, অপমানিত হয়, তার সৎকর্মের ফল উল্টো হয়। আবার মন্দ মানুষ শান্তিতে থাকে, বিখ্যাত হয়, যশ লাভ করে, তার অসৎ-কর্মের ফল উল্টো হয়। (প্রকৃতির নিয়ম বিচিত্র!) বাস্তববাদী অভিজ্ঞতার শেকলে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ, আর যেহেতু পৃথিবীতে খারাপ চরিত্রেরই জয়জয়কার দেখা যায়, এমনকি উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বল চরিত্রেও কিছু না কিছু দাগ থাকে, তাই বাস্তববাদ আমাদের দুর্বলতা, আমাদের অসাম্য এবং আমাদের ক্রুরতার নগ্ন চিত্র হয়ে থাকে। এবং এভাবে বাস্তববাদ আমাদেরকে নৈরাশ্যবাদী করে তোলে, মানব চরিত্র থেকে আমাদের আস্থা উঠে যায়, চারিদিকে আমাদেরকে কেবল মন্দ আর মন্দই দেখায়।
এতে সন্দেহ নেই যে সমাজের কুপ্রথাগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখাবার জন্যে বাস্তববাদ খুবই উপযোগী, কেননা এটা খুবই সম্ভব যে বাস্তববাদ ছাড়া আমরা মন্দকে দেখাতে গিয়ে অত্যুক্তি করে বসি এবং সেই ছবি তার চেয়ে অনেক বেশি কালো করে দেখাই যা বাস্তবে রয়েছে। কিন্তু যখন সেই দুর্বলতাকে দেখাতে গিয়ে শিষ্টতার সীমা অতিক্রম করে যায়, তখনই তা আপত্তিকর হয়ে যায়। তাছাড়া মানবস্বভাবের বিশেষত্ব এই যে সে যে ছলনা, ক্ষুদ্রতা এবং কপটতায় ঘেরা রয়েছে, তার পুনরাবৃত্তি তাকে প্রসন্ন করতে পারে না। সে কিছুক্ষণের জন্য এমন পৃথিবীতে উড়ে চলে যেতে চায়, যেখানে এসকল কুৎসিত ভাব থেকে তার মুক্তি মেলে—সে ভুলে যায় যে সে চিন্তার বন্ধনে ডুবে আছে; যেখানে তার সজ্জন, সহৃদয়, উদার মানুষের দেখা মেলে; যেখানে ছলনা,কপটতাএবং মানসিক বিরোধের প্রাধান্য না হয়। তার মনে খেয়াল আসে যে যদি কিচ্ছা-কাহিনীতেও সেসব লোকেরই প্রসঙ্গ থাকে যাদের সঙ্গে অষ্টপ্রহর বসবাস করতে হয়, তাহলে এসব বই পড়বো কেন?
অন্ধকার উষ্ণ ঘরে কাজ করতে করতে যখন আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি তখন ইচ্ছে হয় কোনো বাগানে গিয়ে নির্মল স্বচ্ছ বায়ু সেবন করে আনন্দ লাভ করতে। এই শূন্যতাকে আদর্শবাদ পূর্ণ করে। আদর্শবাদ আমাদেরকে এমন চরিত্রের সঙ্গে পরিচিত করায়, যার হৃদয় পবিত্র, স্বার্থ এবং কামনা থেকে মুক্ত, যে আসলে সাধু প্রকৃতির। যদিও এরকম চরিত্র ব্যবহারিক জীবনে খুব বেশি কুশল হয় না, তার সরলতা সাংসারিক বিষয়ে তাকে ধোঁকা দেয়; কিন্তু সংসারের কাঠিন্যে তিক্ত প্রাণে এ ধরনের সরল, ব্যবহারিক জ্ঞানবিহীন চরিত্রের দর্শন এক বিশেষ আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে।
বাস্তববাদ যদি আমাদের চোখ খুলে দেয়, তবে আদর্শবাদ আমাদেরকে উঠিয়ে নিয়ে কোনো এক মনোরম স্থানে পৌঁছে দেয়। আদর্শবাদের এই গুণের সাথে সাথে, একটা বিষয়ে শঙ্কাও রয়েছে, আমরা এই মতবাদের কারণে এমন চরিত্র না অঙ্কন করে বসি যে কেবল আদর্শের পুতুলমাত্র—যার মধ্যে প্রাণ বলতে কিছু নেই। কোনো দেবতাকে কামনা করা মুশকিল নয়, কিন্তু সেই দেবতার মধ্যে প্রাণ-প্রতিষ্ঠা করা মুশকিল।
তাই সেই উপন্যাসকেই উচ্চ শিল্প হিসেবে বিবেচনা করা হয় যার মধ্যে বাস্তব এবং আদর্শের সংমিশ্রণ ঘটে। তাকে আপনি ‘আদর্শোন্মুখ বাস্তববাদ’ বলতে পারেন। আদর্শকে সজীব বানানোর জন্যে বাস্তবের উপযোগ হওয়া প্রয়োজন, আর ভালো উপন্যাসের এটাই বিশেষত্ব। ঔপন্যাসিকের সবচেয়ে বড় গুণ এমন চরিত্র সৃষ্টি করা, যে নিজের সদ্ব্যবহার এবং সদ্বিচার দ্বারা পাঠককে মোহিত করতে পারে। যে উপন্যাসের চরিত্রে এই গুণ নেই, দুই পয়সা মূল্য তার।
চরিত্রকে উৎকৃষ্ট এবং আদর্শ করে তোলার জন্যে তাকে নির্দোষ করে তোলা জরুরী নয়—মহান থেকে মহান পুরুষের মধ্যে কোনো না কোনো দুর্বলতা থাকে। চরিত্রকে সজীব করে তোলার জন্যে তার দুর্বলতা প্রদর্শনের মধ্যে কোনো ক্ষতি নেই। বরং এসব দুর্বলতা এই চরিত্রকে মানুষ করে তোলে। আমাদের ওপর নির্দোষ চরিত্রের কোনো প্রভাব পড়ে না। আমাদের প্রাচীন সাহিত্যের ওপর আদর্শের ছাপ লেগে ছিলো। তা কেবল মনোরঞ্জনের জন্যে ছিলো না। তার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিলো মনোরঞ্জনের সাথে সাথে আত্মশোধন। সাহিত্যিকের কাজ কেবল পাঠকের মনোরঞ্জন নয়। সেটা তো মোসায়েব, মাদারী, বিদূষক, বা ভাড়ের কাজ। সাহিত্যিকের আসন তারচেয়ে অনেক উঁচুতে। তিনি আমাদের পথ-প্রদর্শক, তিনি আমাদের মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তোলেন, আমাদের মধ্যে সদ্ভাবের সঞ্চার করেন, আমাদের দৃষ্টিকে বিস্তৃত করেন। অন্তত তাঁর এই উদ্দেশ্যই হওয়া উচিত। এই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত করবার জন্য তার চরিত্র পজিটিভ হওয়া খুব প্রয়োজন, যে প্রলোভনের সামনে মাথা নত করে না, বরং তাকে পরাস্ত করে; যে বাসনার জালে বন্দি না হয়ে বরং তাকে দমন করে; যে কোনো বিজয়ী সেনাপতির মতো শত্রু-সংহার করে বিজয়-নাদ করতে করতে বের হয়। আমাদের ওপর এ রকম চরিত্রের প্রভাবই সবচেয়ে বেশি পড়ে।
সাহিত্যের সবচেয়ে উঁচু আদর্শ তার রচনা কেবল শিল্প সৃষ্টির জন্য করা। ‘শিল্পের জন্যে শিল্প’ মতবাদের প্রতি কারো আপত্তি থাকতে পারে না। সেই সাহিত্যই চিরকালীন হয়ে উঠতে পারে যা মানুষের মৌলিক প্রবৃত্তিকে অবলম্বন করেছে; ঈর্ষা এবং ভালোবাসা, ক্রোধ এবং লোভ, ভক্তি এবং বিরাগ, দুঃখ এবং লজ্জা—এর সকলই আমাদের মৌলিক প্রবৃত্তি এদের আলো দেখানোই সাহিত্যের পরম উদ্দেশ্য আর উদ্দেশ্য ছাড়া তো কোনো রচনা হতেই পারে না।
সাহিত্য-রচনা যখন কোনো সামাজিক, রাজনৈতিক বা ধর্মীয় মতবাদ প্রচারের জন্যে করা হয় তখন তা উচ্চ পদ থেকে পতিত হয়—এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আজকাল পরিস্থিতি এত তীব্র গতিতে বদলে যাচ্ছে, এত নতুন নতুন মতবাদ সৃষ্টি হচ্ছে যে কোনো লেখকের পক্ষে সাহিত্যের আদর্শকে মনে রাখা মুশকিল হয়ে পড়ছে। এটা প্রায় অসম্ভব যে লেখকের ওপর এই পরিস্থিতির প্রভাব না পড়ে, তিনি তার দ্বারা আন্দোলিত না হন। একারণেই আজকাল কেবল ভারতবর্ষেই নয় ইউরোপের বড় বড় বিদ্বান লেখকও নিজের রচনায় কোনো না কোনো ‘বাদ’ প্রচার করছেন। তারা এই কথার পরোয়া করেন না, এতে তাদের রচনা জীবিত থাকবে কিনা; নিজের মতকে পুষ্ট করায় তাদের ধ্যান, এ ছাড়া তাঁদের আর কোনো ইচ্ছে নেই। কিন্তু এ কথা কি করে মানা যায়, যে উপন্যাস কোনো মতবাদ প্রচারের জন্যে লেখা হয়, তার মহত্ত ক্ষণিকের? ভিক্টর হুগোর ‘লা মিজারেবল’, টলস্টয়ের অনেক গ্রন্থ, ডিকেন্সের কত রচনা মতবাদ-প্রধান হয়েও উচ্চকোটির সাহিত্যকৃতি এবং এখন অব্দি তাদের আকর্ষণ কমে যায়নি। আজও শ’, ওয়েলস প্রমূখ বড় বড় লেখকের গ্রন্থ প্রচারের উদ্দেশ্যেই লিখিত হচ্ছে।
আমাদের প্রশ্ন হলো, কুশল সাহিত্যিক মতবাদ-প্রধান রচনাকে কেন সুন্দর করে সৃজন করতে পারবেন না যেখানে মানুষের মৌলিক প্রবৃত্তির সংঘর্ষ অঙ্কন করা যায়? ‘শিল্পের জন্য শিল্প’-এর সময় তখন যখন দেশ সম্পন্ন এবং সুখী থাকে। আমরা যখন দেখছি যে আমরা নানা রকম রাজনৈতিক এবং সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ। যেখানেই বৃষ্টি ফেলি সেখানেই দুঃখ এবং দারিদ্র্যের ভীষণ দৃশ্য চোখে পড়ে, বিপত্তির করুণ ক্রন্দন শোনা যায়, এরূপ অবস্থায় বিবেচনাশীল মানুষের হৃদয় কম্পিত না হয়ে পারে কী করে।
হ্যাঁ, ঔপন্যাসিকের এই চেষ্টা অবশ্যই করা উচিত তাঁর মতবাদ যেন পরোক্ষভাবে প্রকাশিত হয়, এই মতবাদের কারণে উপন্যাসের স্বাভাবিকতায় যেন কোনো বিঘ্ন না ঘটে। নইলে উপন্যাস অবশ্যই নীরস হয়ে পড়বে।
দিকেন্স ইংল্যান্ডের অনেক বিখ্যাত ঔপন্যাসিক হয়ে উঠেছেন। ‘পিকউইক পেপার্স’ তার অমর হাস্যরসপ্রধান রচনা। ‘পিকউইক’ নাম এক শিকরম(একপ্রকার ঘোড়ার গাড়ি) গাড়ির যাত্রীর মুখ থেকে ডিকেন্সের কানে এসেছিল। ব্যাস, নামের অনুরূপ চরিত্র, আকার, বেশভূষা—সব রচিত হয়ে গেল। ‘সাইলাস মার্নার’ও ইংরেজি সাহিত্যের এক প্রসিদ্ধ উপন্যাস। এর রচয়িতা জর্জ এলিয়ট লিখেছেন যে নিজের শৈশবে তিনি এক ফেরিওয়ালা তাঁতীকে পিঠের ওপর কাপড়ের থানসহ অনেকবার দেখেছেন। সেই ছবি তার মনের মধ্যে আঁকা হয়ে গিয়েছিল আর তা সময়মতো উপন্যাস রূপে প্রকাশিত হয়। ‘স্কারলেট লেটার’ও হথর্নের সুন্দর মর্মস্পর্শী রচনা। এই পুস্তকের অঙ্কুর তিনি পেয়েছিলেন এক পুরানো মোকদ্দমার নথি থেকে। ভারতবর্ষে এখনো ঔপন্যাসিকদের জীবন-চরিত্র রচিত হয়নি, তাই ভারতীয় উপন্যাস-সাহিত্য থেকে উদাহরণ দেয়া কঠিন। ‘রঙ্গভূমি’ উপন্যাসের অঙ্কুর আমি পেয়েছিলাম এক অন্ধ ভিখারির কাছ থেকে যে আমাদের গ্রামেই থাকত। সামান্য ইশারা, সামান্য বীজ লেখকের মস্তিষ্কে পৌঁছে এত বিশাল বৃক্ষ হয়ে ওঠে যে মানুষ তাকে দেখে আশ্চর্য হয়ে যায়। ‘ম্যাক এ্যান্ড্রুজ হিম’ রুডইয়ার্ড কিপলিংয়ের এক উৎকৃষ্ট কাব্যরচনা। কিপলিং সাহেব নিজের এক নোটে লিখেছেন, একদিন এক ইঞ্জিনিয়ার তাকে নিজের জীবন-কাহিনী শুনিয়েছিল। তাই ওই কাব্যের আধার। আরেকজন প্রসিদ্ধ ঔপন্যাসিকের বক্তব্য, নিজের উপন্যাসের চরিত্রগুলো তিনি পেয়েছেন প্রতিবেশীদের ভেতর থেকে। তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা জানালার ধারে বসে মানুষের আসা-যাওয়া সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখতেন এবং তাদের কথাবার্তা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। উপন্যাস-প্রেমিকেরা নিশ্চয়ই ‘জেন আয়ার’ পড়েছেন। দুজন ঔপন্যাসিকের মধ্যে এ বিষয়ে কথা হচ্ছিল যে, উপন্যাসের নায়িকার রূপবতী হওয়া প্রয়োজন কিনা। ‘জেন আয়ার’-এর রচয়িতা বললেন, ‘আমি এমন উপন্যাস লিখব যার নায়িকা রূপবতী না হয়েও আকর্ষণীয় হবে।’ তার ফল ‘জেন আয়ার’।
কোনো পুস্তক থেকে অনেক লেখক তার রচনা অংকুর পেয়ে যান। হাল কেনের নাম পাঠক শুনেছেন। তাঁর এক উত্তম রচনার হিন্দী অনুবাদ সম্প্রতি ‘অমরপুরী’নামে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বলেন, আমি প্লট পাই বাইবেল থেকে। মেটারলিঙ্ক বেলজিয়ামের জগৎখ্যাত নাট্যকার। তাঁকে বেলজিয়ামের শেকসপীয়র বলা হয়ে থাকে। তাঁর ‘মোমাবোন’ নাটক ব্রাউনিংয়ের একটি কবিতা দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং ‘মেরী ম্যাগডালীন’ একটি জার্মান নাটক দ্বারা। শেক্সপিয়ারের নাটকের মূল খুঁজে কত বিদ্বান ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছেন। বর্তমানের কত ঔপন্যাসিক এবং নাট্যকার শেকশপীয়রের সহায়তা নিয়েছেন তার খোঁজ করলেও ডক্টরেট ডিগ্রি পাওয়া যেতে পারে। ‘তিলিস্ম হোশরুবা’ ফারসি ভাষার এক বৃহৎ পুথি যার রচয়িতা কে আকবরের দরবারের ফৌজি বলে বর্ণনা করা হয়, যদিও এ বিষয়ে আমাদের সন্দেহ রয়েছে। এই পুঁথির উর্দু অনুবাদ হয়ে গেছে। স্বর্গীয় বাবু দেবকীনন্দন ক্ষত্রী তাঁর ‘চন্দ্রকান্তা’ এবং ‘চন্দ্রকান্তা সন্ততি’-এর বীজ ‘তিলিস্ম হোশরুবা’ থেকে গ্রহণ করেছেন বলে অনুমান করি।
সংসার-সাহিত্যে এমন কিছু কাহিনী আছে, যাদের অবলম্বন করে লেখকগণ হাজার বছর ধরে আখ্যায়িকা লিখে আসছেন। হয়তো হাজার বছর ধরে লিখে যাবেন। আমাদের পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বন করে কতনা নাটক এবং আখ্যান রচিত হয়েছে। ইউরোপীয় গ্রিসের পৌরাণিক গাঁথা কবি কল্পনার জন্যে অশেষ আধার। ‘দুই ভাইয়ের গল্প’, যার খোঁজ প্রথমে মিশরের তিন হাজার বছর পুরানো লেখা থেকে পাওয়া গেছে, ফ্রান্স থেকে শুরু করে ভারতবর্ষ পর্যন্ত ডজন খানেকেরও অধিক প্রসিদ্ধ ভাষার সাহিত্যে সন্নিবিষ্ট হয়ে গেছে। এমনকি বাইবেলেও সেই কাহিনীর একটি ঘটনা হুবহু পাওয়া যায়।
কিন্তু একথা ভাবা ভুল হবে যে লেখক আলস্যের কারণে কিংবা কল্পনাশক্তির অভাবে প্রাচীন কাহিনী ব্যবহার করে থাকেন। আসল ব্যাপার হলো, নতুন কাহিনীতে সেই রস, সেই আকর্ষণ থাকে না যা পুরানো কাহিনীতে পাওয়া যায়। হ্যাঁ, তার কলেবর অবশ্যই নবীন হওয়া চাই। ‘শকুন্তলা’ বিষয়ে যদি কোন উপন্যাস লেখা হয়, তাহলে তা কতটা মর্মস্পর্শী হবে, সে কথা বলার প্রয়োজনই নেই।
রচনাশক্তি কম বেশি সবার মধ্যেই থাকে। যে এতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, তার কোনো অস্বস্তি হয় না—কলম তুললেই লেখা শুরু হয়ে যায়। কিন্তু নতুন লেখকদের প্রথমে কিছু লিখতে এতটাই অস্বস্তি হয়, যেন সে সমুদ্রে ঝাঁপ দিচ্ছে। অনেক সময় কোনো তুচ্ছ ঘটনা তার মস্তিষ্কে প্রেরণাদায়ক হিসেবে কাজ করে। কারো নাম শুনে, কোনো স্বপ্ন দেখে, কোনো ছবি দেখে তাদের কল্পনাশক্তি জেগে ওঠে। কোন ব্যক্তির ওপর কোন প্রেরণা কাজ করবে তা সেই ব্যক্তির ওপর নির্ভর করে। কারো কল্পনা দৃশ্যমান বিষয়াদি জাগিয়ে তোলে, কারোটা কোনো গন্ধ, কারোটা বা শ্রবণ। নতুন সুন্দর স্থানে ভ্রমণ করে কেউ এ বিষয়ে যথেষ্ট সহায়তা পায়। নদীতীরে একাকি ভ্রমণে অনেক সময়ই নতুন কল্পনা জাগ্রত হয়।
ঈশ্বরপ্রদত্ত শক্তি মুখ্য বিষয়। যতক্ষণ এই শক্তি না হবে উপদেশ, শিক্ষা, চর্চা সবই ব্যর্থ হবে। কিন্তু কার মধ্যে এই শক্তি আছে কার মধ্যে নেই এই কথা প্রকাশিত হবে কীভাবে? কখনো এর প্রমাণ পেতে পেতে অনেক বছর চলে যায় এবং অনেক শ্রম নষ্ট হয়। আমেরিকার এক পত্রিকার সম্পাদক এর পরীক্ষা করবার এক নতুন কৌশল বের করেছেন। দলে দলে যুবকের মধ্যে কে রত্ন আর কে পাথর? তিনি একটা কাগজের টুকরায় কোনো প্রসিদ্ধ ব্যক্তির নাম লিখে দেন এবং প্রার্থীকে সেই টুকরা দিয়ে নামটি সম্পর্কে দাঁতভাঙ্গা প্রশ্ন করতে শুরু করেন—তাঁর চুলের রঙ কেমন? তাঁর কাপড় কেমন? কোথায় থাকেন তিনি? তাঁর পিতা কী কাজ করেন? জীবনে তার প্রধান আকাঙ্ক্ষা কী? ইত্যাদি ইত্যাদি। যদি যুবক এসব প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দিতে না পারে তাহলে তাকে অযোগ্য মনে করে বিদায় করে দেয়া হয়। যার নিরীক্ষণশক্তি এত শিথিল, সে তাঁর বিবেচনায় উপন্যাস লেখক হতে পারে না। এই পরীক্ষায় নতুনত্ব অবশ্যই আছে কিন্তু ভ্রান্তির মাত্রাও কম নেই।
লেখকের জন্যে একটা নোটবুক রাখা খুব জরুরি। যদিও এই শ্রেণীর লেখক কোনোদিন নোটবুক রাখেন নি; কিন্তু এর প্রয়োজনকে তাঁরা স্বীকার করেন। কোনো নতুন জিনিস, কোনো অনন্য রূপ, কোনো মনোরম দৃশ্য দেখে নোটবুকে লিখে রাখলে বড় কাজে আসে। ইউরোপে লেখকের কাছে সেই সময় পর্যন্ত নোটবুক অবশ্যই থাকে সকল প্রকার জিনিসকে আলাদা আলাদা জায়গায় সামলে রাখার যোগ্যতা মস্তিষ্ক যতক্ষণ অর্জন করতে পারে না। অনেক বছরের চর্চায় এই যোগ্যতা অর্জিত হয়, এতে সন্দেহ নেই; কিন্তু শুরুর সময় তো নোটবুক রাখা অত্যাবশ্যক। যদি লেখক চান যে তার দৃশ্য সজীব হোক, তার বর্ণনা না স্বাভাবিক হোক, তাহলে অনিবার্যভাবেই এর (নোটবুক) সাহায্য নিতে হবে। একজন ঔপন্যাসিক এর নোটবুক এর নমুনা দেখুন:
‘আগস্ট ২১, দিনের বারোটা, একটা নৌকায় একজন মানুষ, শ্যাম বর্ণ, সাদা চুল, চোখ বাঁকা, চোখের পাতা ভারী, উপরে ওঠা ঠোঁট মোটা, পাকানো গোঁফ।’
‘ডিসেম্বর ১, সমুদ্রের দৃশ্য, মেঘ নীল এবং সাদা, জলে সূর্যের প্রতিবিম্ব কালো, সবুজ, চমকদার, ঢেউ সফেন, তার উপরিভাগ স্বচ্ছ। ঢেউয়ের শব্দ, ঢেউয়ের ছিটা থেকে ফেনা উড়ছে।’
এই মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করা হয় ‘আপনি গল্পের প্লট কোথায় পান?’ তিনি উত্তর দেন, ‘চারিদিকে।’ যদি লেখক তার চোখ খোলা রাখেন তাহলে হাওয়া থেকেও তিনি গল্প পেতে পারেন। রেলগাড়িতে, নৌকায়, খবরের কাগজে, মানুষের কথাবার্তায় এবং আরো হাজারো জায়গা থেকে সুন্দর গল্প বানানো যায়। বৎসর বৎসর সাধনার পর এই দেখাটা স্বাভাবিক হয়ে যায়, দৃষ্টি নিজে নিজেই প্রয়োজনের অংশটুকুন কাটছাঁট করে নেয়। বছর দুয়েক আগে আমি এক বন্ধুর সাথে বেড়াতে গিয়েছিলাম। কথায় কথায় এ প্রসঙ্গ এসে যায় যে যদি দুজনকে বাদ দিয়ে পৃথিবীর অন্য সকল মানুষ মেরে ফেলা হয় তবে কী হবে? এই অংকুর থেকে আমি বেশ কয়েকটি সুন্দর গল্প ভেবে বের করেছি।
এ বিষয়ে তো উপন্যাস শিল্পের সকল বিশারদই একমত হয়েছেন যে উপন্যাসের মসলা কেতাব থেকে না নিয়ে জীবন থেকে নেয়া উচিত। ওয়াল্টার বেসেন্ট তাঁর ‘উপন্যাস-শিল্প’ গ্রন্থে বলেন:
‘উপন্যাসকে নিজের সামগ্রী, তাকে রাখা বই থেকে নয়, সেই মানুষের জীবন থেকে নেয়া উচিত যাদের প্রতিদিন চারদিকে দেখতে পাওয়া যায়। আমি পুরোপুরি বিশ্বাস করি যে অধিকাংশ মানুষ নিজের চোখকে কাজে লাগায়। কিছু মানুষের এই শঙ্কাও হয় যে মানুষের মধ্যে যতগুলো ভালো নমুনা ছিল, তাদের সম্পর্কে তো পূর্বজ লেখকেরা লিখে ফেলেছেন, আমাদের জন্য আর কি বাকি রয়েছে? এ কথা সত্য। কিন্তু কেউ যদি আগে কোনো মন্দ, কৃপণ, অপচয়ী যুবক, জুয়াড়ি, মদ্যপ, রঙীন যুবতী ইত্যাদির চরিত্র অঙ্কন করে থাকেন,তবে কি এখন সেই শ্রেণীর অন্য চরিত্র পাওয়া যাবে না? কেতাবে নতুন চরিত্র নাও মিলতে পারে, কিন্তু জীবনে নবীনতার অভাব কখনোই ছিল না।’
হেনরি জেমস এ বিষয়ে যে মত প্রকাশ করেছেন তা শোনা যাক:
‘যদি কোনো লেখকের বুদ্ধি কল্পনা-কুশল হয়, তবে তিনি সূক্ষ্মভাবে জীবনকে ব্যক্ত করেন, বায়ুর স্পন্দনকেও তা জীবন দান করতে পারে। কিন্তু কল্পনার জন্যে কোনো একটা আধার চাই। যে তরুণী লেখিকা কোনোদিন সেনাছাউনি দেখেননি, তাঁকে এ কথা বলা অনুচিত হবে না, আপনি সৈনিক-জীবনে হাত দেবেন না। আমি এক ইংরেজ ঔপন্যাসিককে জানি, যিনি তাঁর এক গল্পে ফ্রান্সের প্রোটেস্ট্যান্ট যুবকদের জীবনের খুব ভালো চিত্র এঁকেছিলেন। সাহিত্যিক দুনিয়ায় এই বিষয়ে খুব আলোচনা হয়েছে। তাঁকে অনেকে জিজ্ঞাসা করেছে—আপনি ঐ সমাজের এমন নিরীক্ষণ করার সুযোগ কিভাবে পেলেন? (ফ্রান্স রোমান ক্যাথলিক দেশ এবং সাধারণত সেখানে প্রটেষ্টান্টদের দেখা যায় না।) জানা যায় যে তিনি একবার, কেবল একবার প্রটেস্টান্ট যুবকদের বসে গল্প করতে দেখেছিলেন। ব্যাস, ওই একবার দেখাই তার জন্য পরশ পাথর হয়ে গেছে। তিনি পেয়ে গেছেন সেই আধার যেখানে কল্পনা তার বিশাল ভবন নির্মাণ করতে পারে। তার মধ্যে ঈশ্বর প্রদত্ত শক্তি ছিল যা এক ইঞ্চি থেকে এক যোজনের খবর বের করে আনতে পারে আর সেটাই শিল্পীর জন্যে অত্যন্ত মহৎ বস্তু।’
মিস্টার জি. কে. চেস্টারটন গোয়েন্দা কাহিনীর লেখক হিসেবে অনেক পুরানো। তিনি এসব কাহিনী লেখার যে নিয়ম বলেছেন তা অত্যন্ত শিক্ষণীয়। আমরা তার বক্তব্য জানাচ্ছি:
‘গল্পে যে রহস্য থাকে তাকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা উচিত। প্রথমে ছোট বিষয় প্রকাশ করা, তারপর তার চেয়ে একটু বড় এবং সবশেষে মূল রহস্য খোলাসা করা। কিন্তু প্রত্যেক ভাগেই কিছু না কিছু রহস্য উদঘাটন হওয়া দরকার যাতে সব কিছু জানার জন্য পাঠকের ইচ্ছা শক্তিশালী হতে থাকে। এ ধরনের গল্পে একথা খেয়াল রাখা অত্যাবশ্যক যে কাহিনীর শেষে রহস্য উদঘাটনের জন্য নতুন কোনো চরিত্র যেন না আনতে হয়। গোয়েন্দা কাহিনীর এটাই সবচেয়ে বড় দোষ। রহস্য উদঘাটনে মজা তখনই হয় যখন এমন চরিত্র অপরাধী প্রমাণিত হয় যাকে কেউ ভুলেও সন্দেহ করেনি।’
উপন্যাস শিল্পে একথা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে লেখক কী লেখেন আর কি বাদ দেন। পাঠক কল্পনাপ্রবণ, তাই সে এমন বিষয় পড়তে পছন্দ করে না যা সে সহজেই কল্পনা করতে পারে। সে চায় না, লেখক নিজেই সবকিছু বলে দিক, পাঠকের কল্পনার জন্যে কিছু বাকি না রাখুক। সে কাহিনীর একটা স্কেচ চায়, তাতে নিজের অভিরুচি মতো রঙ লাগিয়ে নেয়। কুশল লেখক তিনিই যিনি বুঝতে পারেন কোন কথা পাঠক নিজে ভেবে নেবে আর কোন কথা তাঁকে স্পষ্ট করে দিতে হবে। গল্প বা উপন্যাসে পাঠকের কল্পনার জন্যে যতটা বেশি ছাড়া যায় গল্প ততটাই স্বাদু হয়ে ওঠে। যদি লেখক আবশ্যকতা থেকে কম বলেন তবে তা অর্থহীন হয়ে যায়, যদি বেশি বলেন তবে সেই গল্পে আর মজা থাকে না। কোনো চরিত্রের রূপরেখা বা কোনো দৃশ্যকে চিত্রিত করতে হুবহু নকল করার কোন প্রয়োজন নেই। দুচার বাক্যে মুখ্য কথাগুলো বলে দেয়া ভালো। কোনো দৃশ্য দেখে তাকে তৎক্ষণাৎ বর্ণনা করতে গেলে অনেক অনাবশ্যক কথা চলে আসার আশঙ্কা থাকে। কিছুদিন পর অনাবশ্যক কথা আপনা আপনি মস্তিষ্ক থেকে বেরিয়ে যায়; কেবল গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলোই স্মৃতিতে অঙ্কিত থাকে। তখন ওই দৃশ্য বর্ণনা করলে অনাবশ্যক কথাগুলো থাকবে না। আবশ্যক এবং অনাবশ্যক কথনের একটা উদাহরণ দিয়ে আমরা আমাদের বক্তব্য আরো স্পষ্ট করতে চাই:
সন্ধ্যার সময় দুই বন্ধুর দেখা হয়। সুবিধার জন্য আমরা একজনকে রাম আরেকজনকে শ্যাম হিসেবে চিহ্নিত করছি।
রাম: গুড ইভিনিং শ্যাম, বলো আনন্দেই তো আছো?
শ্যাম: হ্যালো রাম, তুমি আজ ভুল করে এদিকে নাকি?
রাম: বলো কী হালচাল। তুমি তো দেখছি ঈদের চাঁদ হয়ে গেছ।
শ্যাম: আমি তো ঈদের চাঁদ নই, হ্যাঁ, তুমি অবশ্য ডুমুরের ফুল হয়ে উঠেছ।
রাম: চলো, যাবে নাকি সঙ্গীতভবনের দিকে?
শ্যাম: হ্যাঁ, চলো।
লেখক যদি বাচ্চাদের জন্যে গল্প লিখতে না বসেন, যাদেরকে অভিবাদনের বড় বড় কথা শেখানো তার উদ্দেশ্য, তাহলে কেবল এটুকুই লিখবেন:
‘অভিবাদনের পর দুই বন্ধু সঙ্গীতভবনের পথ ধরে।’