ও আমার কথামালা, তুমি অত্যন্ত উদাসীন নয়তো খুব আলগাভাবে বোনা।
তুমি সভ্য-ভব্য প্রবঞ্চকের হাতে ডিগবাজি খাওয়া বাজিকরের-হাড়। আমি তোমাকে প্রকাশ করি!
আমি জন্মেছিলাম পাথরের মতো আমার নিজস্ব ক্ষয় সঙ্গে নিয়ে।
আমার কুসংস্কারাচ্ছন্ন যৌবনের কোনো নিরাময় হয়নি। আমার অনাবিল দৃঢ়তা আজ নিঃশেষিত। আমি প্রবেশ করেছি ভেঙ্গে পড়ার কালে।
বিশ্বের যে বর্তমান অবস্থার মাঝে, যে বাস্তবতার মাঝে আমরা প্রসারিত হচ্ছি
তা অদূষিত রক্তের একটি মোমবাতি। আর আমরা ঘুমাই নিদ্রার বাইরে।
স্রষ্টা দুঃখবাদী। সৃষ্টি উচ্চাভিলাষী। আর তাই আশাবাদী।
কিন্তু সৃজিতের আবর্তন তাদের উল্টো বিধান গ্রহণ করে।
তীরের সমর্থন ছাড়া, বাতাসে ভরসা ছাড়া সমুদ্রে নির্ভর করো না।
জন্ম থেকেই আমার শ্বাস-প্রশ্বাস ছিল আগ্রাসী।
তার আধবোজা চোখের ছায়াকে আমাদের অভিবাদন জানানো উচিৎ।
না ছিড়েই সে ফল বাগানের ফল তুলে নেয়।
যন্ত্রণাভোগ, সে তো স্বজ্ঞার বেদনা থেকে আসে।
কবিতায় নিমগ্ন আমাদের রাত খুব দ্রুত শেষ হয়ে যায়। উদ্ভাসিত হয় জাগরণ। আমরা যেমন ক্ষত-বিক্ষত, তদ্রুপ আমাদের হাতে কবিতাও ক্ষত-বিক্ষত হয় যখন সে ছেড়ে যেতে চায়। তাকে বাঁধার শিকল যত দীর্ঘই হোক না কেন।
কখনো কখনো আমাদের হৃদয়কে মনে হয় সে আমাদের দেহ থেকে বেরিয়ে যেতে চায়।
আর দেহকে তখন মনে হয় মৃতবৎ।
আমরা কখনোই অসম্ভবকে পাই না। কিন্তু অসম্ভব আমাদের আলোর মতো পথ দেখায়। আমরা মৌমাছি এবং সাপ এড়িয়ে চলি। আমরা দূরে থাকি বিষ এবং মধু থেকে।
আমার প্রথম অক্ষর ছিলো একটি ফুল ফোটানো কাঁটাগাছ।
পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্ণা আমাকে বললো,
আরাম-বিরামে থাকা অপরাধ।
প্রশান্ত হও। মৃত্যুর মাঝ দিয়ে তুমি ফিরিয়ে দেবে তোমার সব ঋণ, সকল প্রিয়, সব ভালবাসা। এমন কি জ্যান্ত মরাও বার বার উৎপাদিত হবে।
যৌবনের দুঃখ সবশেষ অমৃত ফল।
মৃত্যুর বিশাল মিত্রবাহিনী হল স্মৃতি। যেখানে সে তার অসংখ্য সৈনিকের মাঝে লুকানো। স্মৃতি আমাদের পরিভ্রমণে পীড়নকারী। তার আয়ুষ্কাল একটি সন্ধ্যা থেকে আগামিকালের সীমায়।
মানুষ যে বাতাসকে তার ভেতরে টেনে নেয়, একদিন সেই বাতাস তাকে টেনে নেবে; অবশেষটুকু নেবে ভূমা।
হত্যা আমাকে নিরস্ত্র করেছে চিরতরে
তুমি আমার নিরস্ত্রকারী চিরতরে
আমরা কোনটা বুঝবো?
ধ্বংসস্তূপের মাঝে ফিসফিস করে বলতে কে পরোয়া করে যে, আমরা যা ধ্বংস করেছি তা আমাদের দেখা স্বপ্ন এবং অবিরাম রূপ পাল্টানোর চাইতে শতবার বেশি মূল্যবান ছিল?
কোনো মানুষ, যদি না সে বেঁচে থাকার মাঝে মৃত হয়, এই জীবন মাঝে সে নোঙ্গর অনুভব করতে পারে না।
মানুষের ইতিহাস হলো একই শব্দের জন্য প্রতিশব্দ লেখার দীর্ঘ উত্তরাধিকার। একে চ্যালেঞ্জ করা একটি কর্তব্য।
যা ছিল তা আর নেই। যা নেই তা অবশ্যই হবে। তার পূর্ণ আবেগ মথিত দু’টো হাত, বিভ্রান্তির জটাজাল থেকে মুক্ত করকমলে বসন্ত নিয়ে আসে। অহমের বাসনার জন্য যা ক্রোধকে প্ররোচিত করে তা নৃশংসতা নাকি রক্তিম নিয়তি?
শেষ কিভাবে তার অর্থের ন্যায্যতা প্রতিপাদন করে? শেষ বলে কিছু নেই। আছে কেবল মাত্র অর্থ এবং তা আরো বেশি ভেবে নেয়া।
‘আমি বিদ্রোহ করি, সুতরাং আমি তা ছড়িয়ে দেই’। যেখানে বাধ্যবাধকতা লোকের বিদ্রোহের উত্থান ঘটায় সেখানে এভাবেই মানুষের কথা বলা উচিৎ।
সূর্য যখন পথ প্রদর্শক, একটু হলেও আগে বাড়ো।
তোমাকে যা দেয়া হয়েছে তা যদি গ্রহণ না করো, একদিন তুমি ভিখারি হবে; আরো অনেক বেশি প্রত্যাখ্যাত ভিখারি।
দেবতাদের ব্যাপারে আমরা ঈর্ষান্বিত নই। তাদের ভয় পাই না বা তাদের সেবাও করি না। কিন্তু আমরা আমাদের জীবনের সংকটের মাঝে তাদের বহু রকমের অস্তিত্ব স্বীকার করি। আর আমরা অগ্রসর হই তাদের দুঃসাহসিক সন্তানদের সাথে একাত্ম হতে। যারা সেই দেবতাদের আর মনে রাখে না।
বাতিল করা মুখে মারা’র চাইতে বেশি কিছু নয়। আমাদের মাঝে হয়ে ওঠার দ্বারাই কেবল দেবতারা মারা যায়।
স্বাধীনতার মদ খুব দ্রুত আধা-মাতালে পরিণত করে। যদি না তাকে মূল আধারে পাঠানো হয়।
———————————–
[রেনে শার (René Char, 1907-1988)। বিশ শতকের গুরুত্বপূর্ণ আধুনিক ফরাসী কবিদের মাঝে অন্যতম। হেইডেগার সহ বহু গুণীজন তাঁর কাব্যিক দার্শনিকতার গুণমুগ্ধ ছিলেন। রেনে শার ছিলেন ফরাসী প্রতিরোধ পর্বের (French Resistance) একজন অগ্রগন্য ব্যক্তি। তিনি ১৯৬০ এর দশকে পারমানবিক অস্ত্র বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় মিলিট্যান্ট হন। তাঁর অনেক ঘনিষ্ঠ চিত্রকর বন্ধু, উল্লেখযোগ্যভাবে পাবলো পিকাসো, বারুক ও জিয়াকোমেত্তি’র সঙ্গে একত্রে কয়েক বছর পরাবাস্তববাদী (Surrealism) আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। রেনে শার এর কবিতা বিশ শতকের নৈতিক, রাজনৈতিক এবং শিল্পের প্রধান ক্ষেত্রসমূহের মুখোমুখি হয়েছিল। তাঁর সর্বাধিক পরিচিত কাজের মধ্যে রয়েছে ‘Leaves of Hypons’, ‘The Brittle age and Returning Upland’, ‘Stone lyer’, ‘Hammer with No Master’, ‘This smoke that carried us’ প্রভৃতি। বর্তমান ভাষান্তরখানি প্রস্তুত করা হয়েছে গুস্তাফ সোবিনকৃত ‘দ্য ব্রিটল এইজ অ্যান্ড রিটার্নিং আপল্যান্ড’এর প্রথম ভাগের নির্বাচিত অংশ থেকে।]