নাদিয়া আঞ্জুমান হেরাউই ২৭ ডিসেম্বর ১৯৮০ সালে উত্তর -পশ্চিম আফগানিস্তানের হেরাত শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পিতামাতার ছয় সন্তানের একজন । ১৯৯৫ সালের সেপ্টেম্বরে তালেবানরা হেরাত দখল করে এবং প্রদেশের তৎকালীন গভর্নর ইসমাইল খানকে ক্ষমতাচ্যুত করে। তালেবান সরকার ক্ষমতায় আসার সাথে সাথে নারীদের স্বাধীনতা ব্যাপকভাবে সংযত ছিল। স্কুলের দশম বছরে একজন মেধাবী ছাত্র, আঞ্জুমান এখন শিক্ষার আশা ছাড়াই ভবিষ্যতের মুখোমুখি তখন, কারণ তালেবানরা মেয়েদের স্কুল বন্ধ করে দিয়েছিল এবং মেয়েদের জন্য ব্যক্তিগত শিক্ষা নিষিদ্ধ ছিল।
১৯৯৬ সালে, আঞ্জুমান অন্যান্য স্থানীয় নারীদের সাথে সমাবেশ করে এবং গোল্ডেন নিডল সেলাই স্কুল নামে একটি শিক্ষা বিষয়ক আন্ডারগ্রাউন্ড সার্কেলে যোগ দিতে শুরু করে, যা তরুণীদের দ্বারা আয়োজিত এবং হেরাত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহাম্মদ আলী রহিয়াবের পরামর্শে পরিচালিত হয়। গোল্ডেন নিডল স্কুলের সদস্যরা সপ্তাহে তিনবার সেলাই শেখার ছদ্মবেশে জড়ো হতেন (তালেবান সরকার কর্তৃক অনুমোদিত একটি অনুশীলন), প্রকৃতপক্ষে সভাগুলি হেরাত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের বক্তৃতা ছিল সাহিত্যের উপর আলোচনা সহ। প্রকল্পটি ছিল বিপজ্জনক; ধরা পড়লে, সম্ভাব্য শাস্তি ছিল কারাদন্ড, নির্যাতন এবং ফাঁসি। নিজেদের সুরক্ষার জন্য, উপস্থিতরা তাদের সন্তানদের ভবনের বাইরে খেলতে এবং নজরদারি হিসাবে ব্যবহার করেছিল। তারা নারীদের ধর্মীয় পুলিশের কাছে আসার ব্যাপারে সতর্ক করতো, সেই সময়ে ছাত্ররা তাদের বই লুকিয়ে রাখতো এবং সেলাইয়ের কাজ করতো। তালেবান শাসনের পুরো সময় ধরে এই কর্মসূচি অব্যাহত ছিল।
অধ্যাপক রহিয়াব লেখালেখি ও সাহিত্যে আঞ্জুমানের একজন পরামর্শদাতা হয়েছিলেন। যখন নারীদের নিজেদের ঘর থেকে বের হওয়ার অনুমতি ছিল না, তখন রহিয়াব ষোল বছর বয়সী আঞ্জুমানকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন এবং তাকে একটি স্বতন্ত্র লেখার কণ্ঠস্বর বিকাশে সহায়তা করেছিলেন। তিনি তাকে অনেক লেখকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন – হাফিজ শিরাজী, বাইদেল দেহলভী, ফরফ ফররখজাদ এবং অন্যান্য কবি যা তার কাজকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে।
২০০১ সালে যখন তালেবান শাসন ক্ষমতাচ্যুত হয় তখন আনজুমানের বয়স ছিল ২১ । আনুষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের জন্য মুক্ত, তাকে সাহিত্য অধ্যয়নের জন্য হেরাত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয় এবং ২০০২ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। সাহিত্যে ডিগ্রি অর্জনের সময়, আঞ্জুমান গুল-ই-দোদি (ধোঁয়ার ফুল) নামে একটি কবিতার বই প্রকাশ করেন যা আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং ইরানে জনপ্রিয় ও নন্দিত হয়।
আঞ্জুমান হেরাত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ফরিদ আহমদ মজিদ নিয়াকে বিয়ে করেন, যিনি সাহিত্যে স্নাতক এবং সেখানকার গ্রন্থাগারের প্রধান। নিয়া এবং তার পরিবার বিশ্বাস করত যে, তিনি একজন নারী হওয়ায় আঞ্জুমানের লেখা তাদের খ্যাতির জন্য অসম্মানজনক, তবুও আঞ্জুমান কবিতা লিখতে থাকেন। ৪ নভেম্বর ২০০৫ সালে ২৫ বছর বয়সে আঞ্জুমানের হত্যার আগে এই দম্পতির এক ছেলে ছিল।
২০০৫ সালের নভেম্বর মাসে আঞ্জুমান এবং তার স্বামীর মধ্যে ঝগড়া হয়। নেয়ার মতে, আঞ্জুমান বাইরে গিয়ে পরিবার ও বন্ধুদের সাথে দেখা করতে চেয়েছিলেন, ঈদুল ফিতরের একটি সাধারণ অভ্যাস। নিয়া বলেছিল যে সে তাকে তার বোনের সাথে দেখা করতে দেবে না। আঞ্জুমান প্রতিবাদ করে, এবং তারা দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। সেই রাতে, নিয়া অঞ্জুমানকে মারধর করে এবং তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন, তার মাথা কেটে যায়। আঞ্জুমান অজ্ঞান হয়ে পড়লে, নিয়া তাকে রিকশায় করে হাসপাতালে নিয়ে যায়; পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানায়, আঞ্জুমান ইতিমধ্যেই মারা গিয়েছেন। একজন উর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা, নিসার আহমদ পাইকার জানান যে, তার স্বামী তাকে মারধর করার কথা স্বীকার করেছেন, কিন্তু তাকে হত্যা করেননি; পরিবর্তে, নিয়া অভিযোগ করেন যে আঞ্জুমান বিষ খেয়েছিলেন এবং মৃত্যুর আগে তা করার কথা স্বীকার করেছিলেন।
বলা হয়, আঞ্জুমান জ্ঞান হারানোর পর রক্তবমি করেছিলেন, যা পরে ডাক্তাররা বিশ্বাস করেছিলেন মৃত্যুর সবচেয়ে সম্ভাব্য কারণ। নিয়া দাবি করেন যে আঞ্জুমান বিষ খেয়েছিলেন এবং সবাইকে বলতে চেয়েছিলেন যে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। নিয়া এবং তার পরিবার ডাক্তারদের ময়নাতদন্ত করতে বাধা দেয়, তাই মৃত্যুর প্রকৃত কারণ সম্পর্কে কোন নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আঞ্জুমানের সম্ভাব্য হত্যার জন্য নিয়া এবং তার মা দুজনকেই গ্রেফতার করা হয়েছিল।
এরপরই জাতিসংঘ এই হত্যার নিন্দা জানায়। তাদের মুখপাত্র অ্যাড্রিয়ান এডওয়ার্ডস বলেছিলেন যে, ” নাদিয়া আঞ্জুমানের মৃত্যু, যেমনটি জানা গেছে, তা সত্যিই দুঃখজনক এবং আফগানিস্তানের জন্য একটি বড় ক্ষতি …. এটি তদন্ত করা প্রয়োজন এবং যে কেউ দায়ী হলে তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত” ।
নিয়া আঞ্জুমানকে হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিল, যার জন্য তিনি তখন কারাগারে ছিলেন। হেরাতের আদিবাসী প্রবীণরা আঞ্জুমানের অসুস্থ বাবাকে নিয়াকে তার মৃত্যুর জন্য ক্ষমা করার জন্য চাপ দিতে শুরু করে, যাতে নিয়াকে জেল খাটানো যায়। নিয়া পাঁচ বছর কারাগারে থাকবে এই প্রতিশ্রুতি দিলে, আঞ্জুমানের বাবা অনুতপ্ত হন, আনজুমানের মৃত্যুকে আফগান আদালত আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মহত্যা বলে গণ্য করে এবং মাত্র এক মাস পরেই নিয়াকে মুক্তি দেওয়া হয়। আঞ্জুমান তার ছয় মাসের ছেলেকে রেখে গেছেন, যিনি এখন নিয়ার হেফাজতে আছেন।
তার গোল দৌদি এবং ইয়েক সাবাদ দিলহোরে দুটোই প্রথম আফগানিস্তানে প্রকাশিত হয়েছিল। গোল দৌদি আফগানিস্তানে তিনবার পুনর্মুদ্রিত হয়েছে।
একটি করুণ শোকগাঁথা
আমাদের হৃদয়ে আসীন হয়ে আছে দুঃখ নামক একটি গৃহ
যার গল্পের পাতা জুড়ে নেমে আসে
কয়েকটি শোকার্ত চোখ, হলুদাভ গাল
তোমার উপস্থিতি শোকের শাখা প্রশাখা মেলে
নিশিদিন ছড়াচ্ছে মহাকাব্যিক শোকগাঁথা।
কতশত ঝর্ণার জল গড়িয়ে পড়ে শরৎ আসে, শরৎ যায়
নির্মল হৃদয়মাঝে ঝরে পড়ে আহত মুকুল
কতশত অবরুদ্ধ পথ মাড়িয়ে চলে যায় কাফেলার দল
ফেরাউন মরে, নমরুদের গল্প শেষ হয়-
তবুও তুমি সবুজ সতেজ বাগানের নিরেট পরাগ থেকে
জেগে থাকো আমাদের অন্তরে।
ওহে দাউদাউ দুঃখ পরান
আমাদের হৃদয় ছেড়ে পালাও
আর কতো পোড়াবে এই কোমল হৃদয়
আজ একটু অন্য ময়দানে যাও।
ওগো দাউদাউ দুঃখগাঁথা
তোমার সঙ্গ হয়তো সাময়িক বিনোদিত করে আামদের
তোমার উপস্থিতিতে আমরা কবিতার রসদ খুঁজে পাই
কিন্তু আর কত?
কাল যদি নতুন হৃদয়ে বাসা না বাঁধ
তবে জেনে রেখো, হুশিয়ার করছি তোমায়
কাল আমাদের হয়তো পোড়াবার জন্য ধ্বংসস্তূপের কাছে পাবে
কাল থেকে কার হৃদয়ে ঠাঁই নেবে তুমি
কাল থেকে তুমি অভাগা পাখির মতো
সময়ের সীমানায় হৃদয়চ্যুত হবে
তারপর নিছক দুঃখীর মতো চুপচাপ পড়ে থাকবে।
প্রকৃতির কাছে নিবেদন
ও আকাশ এই দহিত পৃথিবীকে শান্ত করো
একফোঁটা বৃষ্টির জন্য সে উন্মুখ হয়ে আছে
তাঁর ঠোঁট শুকিয়ে গেছে, হৃদয়ের অন্তরালে জ্বলছে
দাবানল দাউদাউ, যেন পায়ের কাছে মৃত্যু কুর্নিশ করছে।
ও মেঘ এই মাংস পোড়া ঝলসানো মাটির দিকে ধাবিত হও
কত সহস্র কৃষক তোমার পানে চেয়ে আছে
এসো এই শোকে মোড়া পাহাড়ের দেশে
যুগ যুগ ধরে যার মাথায় বাঁধা শোকের কাপড়।
ওগো জলধারা এসো , একবার এসো এই রিক্ত পৃথিবীতে
ভেঙে যাওয়া ফুলের কোমল হৃদয় তোমার পানে চেয়ে আছে
পুষ্পউদ্যান নির্জীব পাখির মতো পড়ে আছে
তার ঠোঁট থেকে নির্বাসিত হয়েছে হাসি।
হে দয়াময়, কৃষকদের হারিয়ে যেতে দেবেন না সময়ের চুল্লিতে
তারা কেন তৃষ্ণার্তের মতো পড়ে রইবে
তাদের দূর্বল হাতে আবার উঠুক সবল কাস্তে
আবারও তারা গড়ুক পৃথিবীর উদ্যান।
হে ঈশ্বর অসহায় যাযাবরদের প্রতি সদয় হোন
হে প্রভু, তাদের সমুদ্রের মতো কষ্টার্ত হৃদয়ের প্রতি সদয় হোন
হে প্রভু, বসন্তের জ্বলন্ত ঠোঁট গড়িয়ে
বর্ষিত করুণ শান্তির বারিধারা
এই পোড়া মরুভূমির তৃষিত হৃদয় শান্ত হোক।
আমরা তোমার একান্ত অনুগত দূর্বল দাস
আমরা অন্ধকারের সাগরে নিমজ্জিত
আমাদের এই যন্ত্রণামুখর পথ আমরাই তৈরি করেছি
আমাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে চলে যান
কিন্তু আমাদের হাতগুলোকে সবল করে দিন
আমাদের উপর বর্ষণ করুন শান্তির বারিধারা
আমরা ডুবে আছি অশান্তির আগুনে
নতুবা ঝর্ণার শুষ্ক চোখ গড়িয়ে পড়ুক খানিক জলধারা
আমরাতো তোমারই অনুগত হে প্রভু
এই বিশৃঙ্খল পৃথিবীতে আবারও শান্তি ফিরে আসুক।
বসন্ত কন্যার সংস্পর্শে
বসন্ত কন্যার সুললিত বৃষ্টির গান
আমাকে বিমোহিত করে নিয়ে এসেছে তোমার কাছে
তুমি অপলক দৃষ্টিতে দেখছিলে আমায়
আমার হৃদয় বাগানে যেন তুমি তুলেছিলে আনন্দ হল্লা
আমার স্বপ্নগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল তোমার সংস্পর্শে
তুমি কী কাঁপছো? তোমার সংস্পর্শে নেচে নেচে উঠছে কচি পাতা
তোমার প্রেমময় ছোঁয়ার ফুটছে ফুলকুঁড়ি
নির্মল বাতাসেরা আমারই অলক্ষে নির্জনে বইছে
আর ভাসিয়ে আনছে হিমেল স্নিগ্ধতা
কী এক নিবিড় মাদকতা তার ভেতর খেলা করছে।
এই শুভ্র পায়রার সাথে তোমার কী হৃদ্যতা?
তোমার আগমনে সেও যেন চুপিচুপি গেয়ে ওঠে গান
চুপিচুপি তোমার কানে কী বলে সে?
ওগো দুরন্ত পথিক, আমি তোমাকে চিনি
গান গেয়ে গেয়ে কপোত কী বাণী শোনায়?
আমার কবিতায় বিমোহিত হয়ে তার মতো
তুমিও কী মেতে থাকো কাব্যিক বন্দনায়,
যদি আমার কবিতাকে ভালোবাসো
তবে আমায় ডেকো সাইপ্রাস গাছের নিবিড় ছায়াতলে
আমাকে আবদ্ধ করো মখমল কম্বলের লোমশ আবরণে
অথবা আমাকে অর্ঘ্যায়িত করো একগুচ্ছ মিষ্টি তুলসি দিয়ে।