কাহিনির প্রেক্ষাপট: ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এক ক্ষুদ্র রাজ্য মণিপুর। মণিপুর একসময় স্বাধীন রাজ্য ছিল। ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশদের সাথে সংঘটিত এক অসম যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মণিপুর তার স্বাধীনতা হারায়। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতীয় উপমহাদেশ মুক্ত হলে মণিপুরও তার স্বাধীনতা ফিরে পায়। সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচন করে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করে তারা। কিন্তু ১৯৪৯ সালের অক্টোবরে এক অন্যায় চুক্তির মাধ্যমে মণিপুরকে ভারতীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ভারতীয়দের বিরুদ্ধে সেই ক্ষোভ মণিপুরিদের রয়েছে। সে কারণেই ষাটের দশকে মণিপুরে স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীদের বিভিন্ন সংগঠন সশস্ত্র বিপ্লব শুরু করে। ভারত সরকার ১৯৫৮ সালে প্রণয়ন করে ‘আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট (আফস্ফা)’ এবং মণিপুরেও তা কার্যকর করে। এই আইনের আওতায় সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীর লোকেরা সন্দেহভাজন যে কোনো লোককে বিনা ওয়ারেন্টেই অ্যারেস্ট করে নিয়ে যেতে পারে, গুম করতে পারে বা প্রকাশ্যে মেরে ফেলতে পারে; এর জন্য তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনানুগ ব্যবস্থাও নেয়া যাবে না। একদিকে এই আইনের ব্যাপক অপপ্রয়োগ এবং অন্যদিকে স্বাধীনতাকামী বিপ্লবী দলগুলোর নানা দৌরাত্ম্য মণিপুরের সাধারণ জনগণকে অতিষ্ঠ করে তোলে। এই গল্পের নায়ক মালেমঙানবা প্রথম যৌবনে স্বাধীনতাকামী বিপ্লবী দলে নাম লিখিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে নানা পারিবারিক চাপ ও ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে আইনের কাছে আত্মসমর্পণ করে সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। কিন্তু তারপরও জীবন স্বাভাবিক হয় না। দুই পক্ষ থেকেই বিপদের আশঙ্কা থেকে যায় তার। তাই, ভয় ও আতঙ্কে কাটে তার প্রতিদিনকার জীবন। এরকম এক প্রেক্ষাপটেই এই গল্পের কাহিনি নির্মিত। – অনুবাদক
বৈশাখের শূক্লপক্ষের অস্তায়মান চাঁদ এক টুকরো হয়ে পশ্চিম আকাশে এখনও ঝুলে আছে, একথা মালেমঙানবা জানে। ইচ্ছে হয়, দরোজাটা খুলে একটু বাইরে বেরোয়। উঠোনের এক প্রান্তে তার লাগানো বাঁধাকপি, টমেটো, ফরাস গাছগুলোকে চাঁদের এই আবছা আলোয় একবার দেখতে ইচ্ছে করে তার। রাতের পাখি আর নিশাচর প্রাণিদের হাসি সে কখনো দেখেনি। বৈশাখের পড়ন্ত চাঁদের এই আবছা আলোয় তারা মনে হয় কথা বলে নিজেদের মধ্যে, হাসে প্রাণ খুলে। কেন জানি না, আজ মালেমঙানবার ইচ্ছে হয় তারা নিজেরা কথা বলুক প্রাণ ভরে, হাসুক মন খুলে। মুরগীর ছানাগুলোর কথাও মনে পড়ে যায় তার। তাদের সাথে অবশ্য মালেমঙানবার খুব গভীর একটা সম্পর্ক। এদের ‘চেক-চেক’ আওয়াজ শুনলেই সে বুঝে যায় কী বলতে চায় তারা। বৈশাখি চাঁদের এই আবছা আলোয় কি তারা ঘুমিয়ে পড়েছে? তাদের কি কিছু বলার আছে তার কাছে? খুব জানতে ইচ্ছে করে মালেমঙানবার। তার খুব ইচ্ছে হয়, একবার ঘরের বাইরে বেরোয়। ধীরে ধীরে উঠে বসে বিছানায়। ছোট করে কমিয়ে রাখা হারিকেনের আলোয় ঘরটা অন্ধকারই লাগছে। কাছে গিয়ে আলোটা বাড়ায় একটু। দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। কী সব ভাবে। বাইরে কোনো সাড়াশব্দ নেই। কুকুর বেড়ালের ডাক পর্যন্ত নেই। সব চুপচাপ, কেমন নিস্তব্ধ। দরজাটা খুলতে গিয়েও সে খুলে না।
‘এতো রাত্রে আবার কোথায় বেরুচ্ছো?’
মালেমঙানবার স্ত্রী জানতে চায়। মনে হয়েছিল সে ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু না, ঘুমোয়নি। মালেমঙানবা ফিরে এসে আবার বিছানায় বসে।
‘মুরগীর ছানাগুলোকে একটু দেখবো ভাবছিলাম। হারিকেনগুলোতে তেল ভরে দিয়েছিলে তো?’
‘হ্যাঁ, ভরেছি।’ স্ত্রী জবাবে বলে।
মালেমঙানবা একটু ধীরকণ্ঠে আবার বলে, ‘খুব বেশি তো রাত হয়নি এখনো।’
‘বেশি রাত হোক বা না হোক, সন্ধ্যার পরে আর এখন কেউ ঘর থেকে বেরোয় না।’
তারপর আর কেউ কোনো কথা বলে না। এই সত্য তো এখন সবাই জানে। নতুন কিছু তো আর নয়। রাত হলেই সবাই ভয়ে ভয়ে থাকে। কখন কী হয়। সে অন্ধকার রাত্রিই হোক বা জ্যোৎস্নালোকিত উজ্জ্বল রাত্রি। সবাই কেমন যেন চুপসে থাকে; প্রাণ খুলে যেমন কেউ হাসে না, তেমনি গলা ছেড়েও কেউ কথা বলে না। কিন্তু মালেমঙানবা অন্তত একবার প্রাণ খুলে হাসতে চায়; শুধু সে নয়, সে চায় তার স্ত্রীও হাসুক। তার মাও। সবাই যেন অন্তত একটিবার হাসে।
‘মুরগীর ছানাগুলো এই সাতদিন হলো ডিম ফুটে বেরিয়েছে। এতোদিনে মনে হয় মা’র সমান বড় হয়ে গেছে।’
মালেমঙানবা তার স্ত্রীর উদ্দেশে কথাগুলো বলে। সে জানে, এটা সত্যি নয়, হালকা রসিকতা। তার এ কথা শুনে যদি তার স্ত্রী একটু হাসে। কিন্তু হাসে না। হাসির কথা বলার পরও কেউ হাসে না, এটাও এক বড় সমস্যা। রসিকতা হিসেবে এটাকি খুব হালকা হয়ে গেলো? নাকি তার স্ত্রী হাসতেই ভুলে গেছে? তার ইচ্ছা, স্ত্রী একবার প্রাণখুলে হাসুক। কিন্তু স্ত্রীকে হাসাবার মতো কোনো ভালো রসিকতার কথা মালেমঙানবার এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। তাই কথা ঘুরিয়ে অন্য কথা বলে।
‘বাঁধাকপিগুলো কাল সব বেচে ফেলি। পোকা পড়তে শুরু করেছে।’
‘কত টাকা বিক্রি হতে পারে?’
‘আর কত? এখন তো সস্তার সময়। বাঁধাকপিতে বাজার সয়লাব। এই ধরো একশ’ টাকার মতো বিক্রি হতে পারে।’
‘একশ’ টাকা হলেও ভালো।’
এরপর আর দুজনের মুখে কোনো কথা নেই। মাত্র দুবছর হলো তাদের বিয়ের বয়স। এর মধ্যেই তার স্ত্রী সুনীতার ওপর সংসারের সমস্ত ভার এসে পড়েছে। বিবাহিত জীবনের কোনো আনন্দ-আহ্লাদই সে উপভোগ করতে পারেনি। বরং তার ওপর সে চাপিয়ে দিয়েছে টানাপড়েনের এক সংসার। মালেমঙানবা এক বিষণœ ভাবনায় ডুবে যায়। কিন্তু সে বেশিক্ষণের জন্য নয়।
মায়ের পাশে নিশ্চিন্তে শুয়ে থাকা তার শিশুপুত্রটির দিকে তাকায় মালেমঙানবা। তার রক্তিম গাল দুটো ধরে একটু আদর করে দেয় সে। এখন তো সে এক পুত্রসন্তানের পিতা। তার কাঁধে অনেক দায়িত্ব। জীবনপ্রবাহের স্বাভাবিক গতির ধারায় দায়িত্বের যে বন্ধন সেই বন্ধনে এখন সেও আবদ্ধ। তার মনে পড়ে, ছোটবেলায় তার বাবা তাকে আদর করে ডাকতো ‘সনাতোম্বা’ (বাবারা সাধারণত ছেলেকে আদর করে ডাকে ‘সনাতোম্বা’; ‘ছোট্ট সোনা’ বলে ডাকার মতো)। স্কুল ছুটির দিনগুলোতে বাবা তাকে লোক্তাক হ্রদে নিয়ে যেতো ঘাস কাটা অথবা জাল দিয়ে, ফাঁদ পেতে বা বড়শি দিয়ে মাছ ধরার কাজে সাহায্য করার জন্য। তার বাবার জীবনের অধিকাংশ সময়ই কেটেছে এই লোক্তাক লেকে। এই লোক্তাকই তাদের পরিবারের খাদ্য জুগিয়েছে, তার পড়াশোনার ব্যবস্থা করেছে। তখন সে কখনও বাবার কথা এভাবে ভাবেনি। কিন্তু বাবার হাত ধরেই লোক্তাকের সাথে তার পরিচয়। তার বাড়ি থেকে মাত্র কয়েকটি বাড়ির পরেই লোক্তাক, এক বিশাল প্রাকৃতিক লেক, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের স্বাদু পানির সবচেয়ে বড় লেক। এর পাড়ে তারা বন্ধুরা মিলে ভরা জোছনায় কত রাত কত সময় কাটিয়েছে ‘তৌদ্রি’ (বাঁশের তৈরি এক ধরনের বাঁশি) বাজিয়ে। এভাবেই লোক্তাকের প্রেমে পড়েছিল সে। পরবর্তী জীবনে কতবার সে আশ্রয় নিয়েছে এই লোক্তাকের কাছেই। অথচ এখন সে লোক্তাকের দিকে পা’ই বাড়ায় না। বরং লোক্তাক থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে সে। তার কানে মাঝে মাঝে এখনও বাজে বাবার সেই মিষ্টি ডাক ‘সনাতোম্বা’। ইচ্ছে হয় সেও ছেলেকে ‘সনাতোম্বা’ বলে ডাকে।
‘ঐ লোকটা নাকি বিয়ে করেছিল। সন্তানও ছিল তাদের।’
স্ত্রীর কথায় মালেমঙানবা কল্পনার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে আসে। একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কে? কার কথা বলছো?’
‘ঐ যে, মারা গেলো যে লোকটা। সেও নাকি সব ছেড়ে-ছুঁড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছিল। তার স্ত্রীর কী অবস্থা, কে জানে!’
‘সেও’ কথাটার অন্তর্গত অর্থ বুঝেছে মালেমঙানবা। এ নিয়ে আর কথা বাড়াতে চায় না সে। এর পরিবর্তে বরং সে মজার কোনো বিষয় নিয়ে আলাপ করতে চায়। একটু আনন্দ দেবে এমন কোনো বিষয়। একটু হাসি আনবে তাদের মুখে এমন কিছু। কিন্তু তার স্ত্রী আবার আগের কথার সূত্র ধরে বলে, ‘কী একটা বিষয় নিয়ে আলাপ করবে বলে আর্মি তাকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গেছিল। সকালে তার মৃতদেহটা পাওয়া গেছে ঘরের বাইরে। বলেছে, ক্রসফায়ারিং-এ মারা গেছে। একটি পিস্তল আর গ্রেনেডও নাকি পাওয়া গেছে তার কাছে।’
এসব খবর আর নতুন কিছু নয়। এরকম ঘটেই চলেছে। এ-জাতীয় কোনো খবর নয়, মালেমঙানবা এখন নতুন কিছু শুনতে চায়। আনন্দের, খুশির। তারপরও মালেমঙানবা ফিসফিসিয়ে বলে, ‘মাকে বলতে যেয়ো না। মা যেন না জানে।’
‘তাই কী হয়! বাজার থেকে ফেরার সময় মা নিজেই দেখে এসেছে বলে আমাকে আগেই বলেছে, নারীরা প্রতিবাদে আন্দোলন শুরু করে দিয়েছে। আর এর ফলে ‘খ্বাইরমবন্দ ইমা কৈথেল’ (নারীদের বাজার) নাকি সেই বিকেলেই ভেঙে গেছে।’
মালেমঙানবা চুপ হয়ে যায়। ভাবে, এর জন্যেই বোধহয় মা আজ কথাটথা বেশি না বলে একটু আগেভাগেই বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়েছে। ভাতও তেমন খায়নি। এখন কী করছে মা? ঘুমিয়ে পড়েছে কি? ইচ্ছে হয়, একবার মায়ের কাছে গিয়ে মাকে দেখে আসে। কিন্তু না, বিছানা ছেড়ে আর ওঠে না মালেমঙানবা। ছেলের পাশে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে সে। তাকিয়ে থাকে ঘরের চালের দিকে। ঘরের ছাউনির শণগুলো প্রায় পঁচে গেছে। জায়গায় জায়গায় ছিদ্র হয়ে গেছে। সেই ছিদ্রপথ দিয়ে অবলীলায় ঢুকে পড়ছে অস্তায়মান চাঁদের ম্লান আলো।
বাবাকেও মনে পড়ে তার। তার জন্য বাবাকে যে কত কষ্ট করতে হয়েছে। আর্মির হাতে বেতের বাড়িও খেয়েছেন কয়েকবার। লোক্তাকে মাছ ধরতে আসা বাবার সাথে কখনো কখনো হঠাৎ দেখা হয়ে যেতো তার। এক গভীর দুঃখবোধ থেকে শুধু বলতেন, ‘মালেমঙানবা নামে আমার কোনো পুত্র নেই, একজন ছিল সনাতোম্বা নামে। আমি মালেমঙানবাকে চিনি না।’ এই বলে নৌকা ঘুরিয়ে চুপচাপ চলে যেতেন, ফিরেও তাকাতেন না। এরপর আর বেশিদিন বাঁচেননি বাবা। সুস্থ সবল মানুষটা একদিন সামান্য জ্বরে হঠাৎ করেই মারা গেলেন। মালেমঙানবার চোখ জলে ভরে ওঠে। পরনের গামছার খুঁট দিয়ে গোপনে মুছে ফেলে চোখের জল। এরকম পুরোনো স্মৃতির বায়োস্কোপ দেখার চেয়ে তার বরং দেখতে ইচ্ছে করে বৈশাখের বৃষ্টিজল পেয়ে সবুজ হয়ে ওঠা বৃক্ষলতা, ফুটে ওঠা নানা রঙের বিভিন্ন ফুল, লোক্তাকের জলে ভাসমান নানা শাক-সবজি ও পানাগাছের সবুজ সম্ভার। তারা কি প্রাণ খুলে হাসছে সবাই? মালেমঙানবা চায়, সবাই হাসুক, প্রাণ খুলে হাসুক।
‘কিসের শব্দ হলো ওটা?’
সুনীতা শোয়া থেকে লাফিয়ে উঠে বসে। মালেমঙানবাও স্ত্রীর কথায় কান খাড়া করে কিছু শোনার চেষ্টা করে। বুঝতে পারে, তেমন কিছু নয়, মেঘের শব্দ, বাতাসও একটু জোরেই বইছে। এর একটু পরেই বজ্র-বিদ্যুৎসহ শুরু হয় বেশ প্রবল এক বর্ষণ। ঘন ঘন বিদ্যুৎঝিলিকের আলো নানা ফাঁক ফোকড় দিয়ে ঘরের ভেতরেও প্রবেশ করছে। এই একটু আগেই তো চাঁদের আলো ছিল, কিন্তু সামান্য সময়ের ব্যবধানে এমন প্রবল বর্ষণ শুরু হবে, মালেমঙানবা ভাবতেও পারেনি। বৈশাখের ঝড়-বৃষ্টিগুলো এরকমই হয়, মালেমঙানবা জানে। কিন্তু এখন আর এরকম বজ্র-বিদ্যুৎ আর ভারি বৃষ্টি সে চায় না। এর মধ্যে শুরু হয়ে গেছে শিলাবৃষ্টিও। একটু আগে চাঁদের আলো গলিয়ে পড়া ছাদের ছিদ্রপথ দিয়ে শিলার দু-এক টুকরোও এসে পড়েছে ঘরের ভেতর।
মুরগির ছানাগুলোর জন্য ভাবনা হয় মালেমঙানবার। কী জানি এই বাতাসে তাদের ছাউনিটা উড়ে গেছে কি-না। এই শিলাবৃষ্টিতে তারা কীভাবে আছে, কে জানে? ভালো আছে তো তারা? শাক-সবজির গাছগুলোর নিশ্চয়ই ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে এই শিলাবৃষ্টিতে।
‘পুলিশ বা আর্মিরা একজন ‘লৈশাবী’কেও (অবিবাহিতা যুবতী) নাকি আটক করেছে বিপ্লবী দলের সাথে যোগাযোগ আছে সন্দেহে’, সুনীতার উদ্বিগ্ন কণ্ঠ আবার শোনা যায়।
আবার এসব গল্প কোত্থেকে এলো? সে ভাবছে তার মুরগী ছানাগুলোর, বাগানের শাক-সবজি গাছগুলোর কথা। কিন্তু তার স্ত্রী এসব নিয়ে ভাবতে পারছে না কেন?
সুনীতা আবার যোগ করে, ‘অবশ্য মেয়েটাকে পরের দিনই নির্দোষ বলে ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু মেয়েটি ঐদিনই নাকি গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে।’
এরপর আর কেউ কথা বলে না। সব চুপচাপ। বৃষ্টি মনে হয় কিছুটা কমে এসেছে। কিন্তু বিদ্যুতের ঝলকানি আছে। বাতাসের তোড়ে মনে হয় ভেসে গেছে মেঘের দল। অবশ্য দূর থেকে এখনও মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে। মালেমঙানবা ভাবে, এই অস্বস্তিকর বিষয় নিয়ে তার স্ত্রী বোধ হয় আর কথা বাড়াবে না। কিন্তু, নৈঃশব্দ্য ভেঙে তার স্ত্রী আবার বলে ওঠে, ‘কিন্তু মেয়েটা গলায় দড়ি দিল কেন?’
মালেমঙানবাও একটু বিরক্তির সুরে বলে, ‘তুমিই বা এ কথা জিজ্ঞেস করছো কেন? তুমিই বলো, কেন মরেছে সে?’ উল্টে বরং মালেমঙানবাই প্রশ্ন করে তার স্ত্রীকে।
এই গল্পে মেয়েটার গলায় দড়ি দেওয়ার সম্ভাব্য কারণ একটাই। মালেমঙানবা বুঝে, এটা তার স্ত্রীও জানে। হারিকেনের মৃদু আলোয় স্ত্রীর দিকে তাকায় সে। দেখে, তার স্ত্রীও অশ্রুসজল চোখে তাকিয়ে আছে তারই দিকে। তার মনে হয়, স্ত্রীর মুখটা যেন সদ্য ফোটা উজ্জ্বল কোনো সুগন্ধি ফুলের মতো।
স্বামী মালেমঙানবার দিকে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে থেকে ঘুমন্ত ছেলের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে সুনীতা আবার ধীরকণ্ঠে বলে, ‘আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে না আসলে কি আমু দাদা এভাবে মরতেন?’
কোত্থেকে আবার আমুর প্রসঙ্গ এলো? ‘এ প্রসঙ্গ আবার কোথা থেকে এলো?’
‘ঘরের ভেতরে তার স্ত্রীর সামনেই নাকি তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। আমু দাদা নাকি পরিচিত বন্ধুবান্ধব মনে করে বিশ্বাস করেই দরজা খুলেছিল।’
‘ঠিক আছে, এখন ঘুমাও তো। সব আজেবাজে ভাবনা, ছাড়ো তো।’ মালেমঙানবা স্ত্রীকে বুঝানোর চেষ্টা করে।
বৃষ্টি থেমে গেছে। কিন্তু চাঁদের আলো আর নেই। মালেমঙানবার মনে আবার তার মুরগীর ছানাগুলো আর শাক-সবজির কথা চলে আসে। বিছানা থেকে নামে। হারিকেনটা হাতে নিয়ে দরজা খুলতে যাবে এমন সময় পাড়ার কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করে ঘরের আনাচে-কানাচে ছোটাছুটি করছে, এরকম শব্দ শুনতে পায় সে। হারিকেনের আলো কমিয়ে দিয়ে বিছানায় এসে আবার শুয়ে পড়ে। স্ত্রী মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। মালেমঙানবা মনে মনে ভাবে, তার মাও যদি কুকুরের এই ঘেউ ঘেউ ডাক না শুনে ঘুমিয়ে থাকে তাহলে ভালোই হয়। ভয় আর আতঙ্কে তাকে চুপসে যেতে হবে না। হাত বাড়িয়ে স্ত্রী এবং পুত্রকে একসাথে জড়িয়ে ধরে সে। এরকম মুহূর্তে তার স্ত্রীর কাছ থেকে মজার কোনো গল্প শুনতে ইচ্ছে করে তার, যাতে তারা দুজনই প্রাণ খুলে হাসতে পারে।
পাড়ার কুকুরগুলো তাদের উঠানে, ঘরের আশেপাশে ছোটাছুটি করে ঘেউ ঘেউ ডাকছে। মালেমঙানবা উৎকর্ণ হয়। মনে হয়, সে যেন বুট জুতার এগিয়ে আসার ভারি শব্দ শুনছে। স্ত্রী ও পুত্রকে আরো জোরে জড়িয়ে ধরে সে। আর স্ত্রীর উদ্দেশে সে কেবল মনে মনে বলে, ‘আমি এখন অপরাধমুক্ত এক মানুষ। আইনের কাছে আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক শান্তিপূর্ণ জীবনে ফিরে এসেছি। আমার কিচ্ছু হবে না দেখো। আমি বরং একটু আগে দেখা তোমার প্রস্ফুটিত ফুলের মতো উজ্জ্বল রূপটুকু নিয়েই ভাবছি।’
লেখক পরিচিতি: কৈশাম প্রিয়োকুমার-এর জন্ম ১৯৪৯ সালে মণিপুরের রাজধানী শহর ইম্ফালে। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার কৈশাম প্রিয়োকুমার মণিপুর সরকারের সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বিভাগের চাকুরি থেকে এখন অবসর নিয়েছেন। প্রধানত গল্প লেখক। তাঁর প্রকাশিত গল্পগ্রন্থের সংখ্য ৫টি। ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘নোংদি তারকখিদরে’ (বৃষ্টি আর হলো না)-এর জন্য ভারতের সম্মানজনক সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার পান। এছাড়া তিনি ‘মণিপুর স্টেট কলা একাডেমি অ্যাওয়ার্ড’সহ সম্মানজনক অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। অনূদিত গল্পটি ২০১৩ সালে প্রকাশিত তাঁর পঞ্চম গল্পগ্রন্থ ‘নোংখোঙ তম্না’ (দিগন্তের অভিমুখে)-এর

এ কে শেরাম
জন্ম ১৯৫৩ সালে হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলায়। পিতা নবকিশাের সিংহ ও মাতা থাম্বাল দেবী। বাণিজ্য ও আইনে স্নাতক। ব্যাংকিং পেশা থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। ফেলো, বাংলা একাডেমি।
প্রকাশিত গ্রন্থ: বাংলাদেশের মণিপুরী: ত্রয়ী সংস্কুতির ত্রিবেণীসংগমে, মণিপুরী ভাষা ও সাহিত্য, কবিতা, এক প্রগলভা প্রেমিকা আমার, কৃষ্ণপক্ষের কবিতা, মিং প্রভুতি।
যুক্ত আছেন বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগােষ্ঠী, সিলেট জেলা সংসদ; মণিপুরী ভাষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা, সিলেট; জাতীয় কবিতা পরিষদ, সিলেট; প্রথম দিনের সূর্য, সিলেট ও প্রগতি লেখক সংঘ, সিলেট প্রভৃতির সাথে । আরো যুক্ত আছেন বাংলাদেশ মণিপুরী সাহিত্য সংসদ, সিলেট; ইন্টিগ্রেটেড মণিপুরী এসােসিয়েশন (ইমা) বাংলাদেশ; সিলেট জেলা শিল্পকলা একাডেমী; সােনালী ব্যাংক অফিসার্স ওয়েলফেয়ার এসােসিয়েশন, সিলেট; স্বজন, সিলেট ইত্যাদির সাথে।
সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য প্রাপ্ত এওয়ার্ড ও সম্মাননা হলাে- ‘সােনামনি মেমােরিয়েল এওয়ার্ড' (সিলেট-১৯৯৪); “শেকড়ের সন্ধানে এওয়ার্ড’ (সিলেট-১৯৯৯); ‘য়েংখােম কমল মেমােরিয়েল এওয়ার্ড’ (শিলচর,ভারত-২০০৩); ‘সাহিত্যভূষণ’ (আসাম মণিপুরী সাহিত্য পরিষদ-২০০৮); ‘প্লাটিনাম জুবিলী বিশেষ সম্মান’ (মণিপুরী সাহিত্য পরিষদ ইম্ফাল,মণিপুর-২০১০); ‘থিয়াম লৈরিকমচা ইন্টারন্যাশনাল এওয়ার্ড (ইম্ফাল,মণিপুর-২০১১); ‘হিজম ইরাবত মেমােরিয়েল ইন্টারন্যাশনাল এওয়ার্ড (ইম্ফাল, মণিপুর২০১১); ধানসিঁড়ি সম্মাননা-২০১২ (ঢাকা-২০১২)।