Home » জারুল ফুলের জন্মদিন ।। জাকারিয়া প্রীণন

জারুল ফুলের জন্মদিন ।। জাকারিয়া প্রীণন

ঘুমের জগতে একটি হরিণ দৌড়ে যায়—সঘন বনের অন্তরালে। অবসন্ন বিকেল যখন মাথা নিচু করে দিয়েছে দিগন্তের লালিমায়। আমার মনে পড়ে জোনাকি গ্রামের কথা। ঘন বন জঙ্গল পেরিয়ে ততদিনে মানুষ পৌঁছে গেছে সভ্যতার অনেক উঁচুতে। গতরাতে একটি জোনাকের সাথে আমার বন্ধুত্ব হলো; সারারাত জোছনা দেখতে দেখতে বুঝতে পারলাম আমরা দুজনই নিঃসঙ্গ। আমরা দুজনেই জীবনের কাছে পরাস্ত নাবিক। যেখানেই ভাবি একটি নদী আছে—সেখানেই বালুচর। যেন আমরা পথ হারিয়ে চক্কর দিচ্ছি মরুভূমি সাহারায়। জীবনের দিকে তাকালে অধিকাংশে নিজেকে বেদুঈন বলে মনে হয়। অনেকটা কাঠের দরোজায় ঠিকানা লিখে রাখার মতো অন্ধকার—
হরিণের ঘ্রাণ—কুয়াশার গ্রাম। তোমার চলে যাওয়া আলধরে নিবিড় হয়ে যায় ফিরে আসার বাসনা। বৃষ্টি শেষে মেঘশিরিষের পাতায় কিছু জল জমে থাকে ঝরে পড়বে বলে। যেন কোথাও নেই আমাদের কাঙ্ক্ষিত আবহাওয়া। মেঘের ঘূর্ণিতে বিলুপ্তির জলসাঘর কেঁপে কেঁপে ওঠে—ভোরবেলার নিপুণতা যাদের ছিল কেউ আর বেঁচে নেই পৃথিবীতে। জোনাকিরা কোনো কিছুই দেখে না কল্পনা করতে ভালোবাসে। কখনো কখনো তার কল্পনায় বাঁশপাতা হয়ে যাই কিংবা কোনো বংশীবাদক। যা কিছু মনে মনে ভাবে সেকথা বলে না কখনও—যেন একটি মৌন আতাফল রাখা আছে বিকেলের প্রার্থনায়। আমি জানি ইহা তার অভিমান ছাড়া আর কিছু নয়। কিছু কিছু অভিমান আছে যা একটা সময়ে এসে বিচ্ছিন্নতার গল্প হয়ে যায়। আর ভুলে থাকাটা হয়ে উঠে অমোঘ অভিশাপের লালিত হাহাকার।

একটি ঝরা পাতার কাছে জীবনের গল্প বলো না সে জীবনের অর্থ জানে। পৃথিবীর যাবতীয় সৌন্দর্য মনোরমা সবুজ পালকিতে চড়ে পরিসমাপ্তির দিকে ধাবমান—এই জীবনের গতিময় আহার। বাষ্প হয়ে জল গুলো বাতাসে ঘুরে ঘুরে মেঘ হয়ে যায়—মেঘ গুলো বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে মাটি, নদী, খাল-বিল ও পুকুরে। মানুষের বিবর্তনও এভাবে হয় দীর্ঘ যাপনের ভিতর দিয়ে অনেক কিছু বদলে যায়। যেমন ফুল ফুটে থাকতে থাকতে ঝরে যায় এক সময়। দূরত্ব ও যোগাযোগহীনতা অনেক কিছুই কেড়ে নেয় আমাদের। অথচ পৌষের সন্ধ্যায় পরস্পর পরস্পরকে জড়িয়ে ধরা মন্দ নয়। আজকাল মানুষ ভালোবাসাকে ঘৃণা করতে শুরু করেছে। উপান্তে ফুটে থাকা অনুরাগ আমাদের আর আলোড়িত করে না। মানুষ আকাশ পাতাল হয়ে বাঁচতে পারে না কেউ মাটি হয়ে গেলে নিজে ধুলি হয়ে যেতে হয়—অথবা ঘাস হয়ে মাটিকে আঁকড়ে ধরতে হয় যেন ঝুমবৃষ্টিতে মাটি কেটে না পড়ে। যেকোনো সম্পর্ক ঘাস আর মাটির মতো হওয়া চাই। তখন মাটিবিদ্ধ শিকড় গুলোকে নিজের বলে মনে হয়। কিন্তু মানুষ অধিকাংশে হয়ে পড়ে রক্তপিপাসু—রক্তের দাম ভালোবাসা।

আমার জ্বলতে থাকা সূর্যে এখন অমাবস্যার সন্ধ্যা নেমে এসেছে। পায়ের প্রার্থনায় পথ গুলো ভিজছে আষাঢ়ের জোছনায়। এখন পৃথিবীতে আছে অসংখ্য জোনাকি। জোনাকিরা চা পান করতে জানে না কিন্তু তীব্র অপেক্ষায় আশা ধরে রাখতে জানে। জোনাকির কাছে আমি শিখতে পেরেছি তীব্র অপেক্ষা। আমিও এখন ক্লান্তিহীন অপেক্ষা করে যেতে পারি। বাঁশপাতার বাঁশি দিয়ে এলোমেলো করে দিতে পারি পরিপাটি বাতাসের মন। শান্ত সেসব গানে বাজাতে জানি জোছনার ভায়োলিন। রোজ রোজ অন্ধকারে জোনাকির দেখা পাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। মূলত অন্ধকার তাদের ধর্মশালা। প্রেমিকের চেয়ে বড় কোনো ধার্মিক আমি দেখিনি আজও—একই নারীর কাছে ধীমান ধার্মিকের মতো পড়ে থাকে সারাটা জীবন। কিন্তু যে নারী উপেক্ষা করে যায় হৃদয়ের পথ—তখন নিজেকে আমার কাফের বলে মনে হয়। শোনো—আমি তোমাকে আমার বন্ধুর কথা বলছি তার মাথভর্তি রূপকথার বেণী। বন্ধুত্বের খোলস ছেড়ে সে এখন মাধবীলতার লাল বেদনা।

পৃথিবীতে যে কয়টি জোনাকি আমি দেখেছি তারা অন্ধকারকে অলংকৃত করেছে আজীবন প্রীতিপ্রদ উল্লাসে। আমি বহুবার অন্ধকার হয়ে গেছি কেবল একটি জোনাকির উড়াল দেখবো বলে। কী তার নাচের আকাঙ্খা?—নিশ্চয়ই দোলনচাঁপার মতোই সুন্দর। আমি বহুবার জোনাক হয়ে থেকেছি একটু অন্ধকার পাবার জন্যে। জানি আজ বাইরে তুমুল অন্ধকার কিন্তু এখন আর জোনাকি হতে ইচ্ছে করে না। এখন কল্পনা করতে পছন্দ করি মাঝে মধ্যে আকাশ ভেঙে যেই রোদ আসে তার মধ্যে শুকিয়ে রাখি বসন্তের ফুল। যেমন এখন দেখছি জন্মদিনের পাখি গুলো নির্বাণ লাভের অপেক্ষা করছে। সমস্ত ঘর জুড়ে হয়তো এখন আনন্দ শিহরণ—হয়তো ১৬ বছরের কোনো কিশোরীর মতো ডানা মেলে তার ভিতর দিয়েই আরেকবার দেখে নিচ্ছ পৃথিবীর মুখ—কী তার অসুখ। আমি দেখছি একটি মুক্ত পাখির ডানা—উড়ছে—লোবান আকাশের তীরে এখন বিদগ্ধ শাদা মেঘের আরশোলা। দেখছি তার ডানা দুঃখে ভার—অসংখ্য ফুল ফুটিয়ে রেখেও যেমন নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে গাছের জীবন। আমিও তো একাই হাঁটি আপন ছায়ার আঙুল ধরে—আর ভাবি কবে তোমার কণ্ঠের গ্রীবা থেকে উড়ে আসবে হলুদ মৌমাছি। আমাদের সকল দিনরাত্রি বিষাদের কারখানায় পালিত শাপদ।

দিন ফুরিয়ে যায়—ডানা ভরা নিঃসঙ্গতা আর গোপন কিছু বেদনা নিয়ে ফিরে যাবে বাড়ি হয়তো তখন সন্ধ্যা বৃষ্টি হচ্ছে অথবা হচ্ছে না। চাঁদ উঠলো কি আকাশে? সমস্ত বেদনায় নদী হতে চাওয়া আমি একটি বালুচর বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি। প্রতিটি দুপুর এখনো তোমার কান্নার কথা মনে করে বিষণ্ণ হয়। যেন তাদের সমস্ত জীবন ধরে একটি কাটাচিহ্ন পড়ে আছে নিথর। এখন যেকোনো দুপুরে মানে মন খারাপের জানালা—চোখ রাখলে কেবল তোমাকেই মনে পড়ে। গোলাপের কলির মতো প্রস্ফুটিত নই আমি—আমাদের বন্ধুত্ব মৃত ফড়িংয়ের নাচ অথবা নষ্ট কলির সুনিশ্চিত পতন। অথচ তোমার বিষণ্ণতার সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেছে আমার। তাকে পাখি বানাই তারপর ছেড়ে দিই। সে উড়ে উড়ে গান করে—এডালে ওডালে চোখ রাখে বসবে বলে। গ্রামের চঞ্চল তরুণীর মতো ঝড়ের মধ্যে আম কুড়োতে যায় মূহুর্তের প্রজাপতি। আকাশ ভরে রাখি মেঘের হারমোনিয়ামে তার বৃষ্টি ভালো লাগে বলে। আমি বরং এখন তাকে জোনাকি বলেই ডাকি। জোনাকির জন্মদিনে তার জন্যে অনেক গুলো অন্ধকার সাজিয়ে রেখে ঘুমিয়ে পড়েছি। একটি প্রশ্ন চিহ্ন ছাড়া আমার কোনো অস্তিত্ব নেই কোথাও। হয়তো আমি তার ঘৃণার ভাষা—অথবা উপেক্ষার স্বরলিপিতে লেখা কোনো নাম। আজ তার জন্যে একটি চিঠি লিখেছি মনে মনে; যার ভাষাটা এমন—

প্রিয়, জোনাকি শুভ জন্মদিন। তোমার ঈশ্বরের করুণায় নিশ্চয়ই তুমি ভালো আছো। আমিও আছি ভালোই। আজকে মেঘলা দিন কেমন ভেজা ভেজা বাতাস বইছে হয়তো বৃষ্টি হবে রাতে। বৃষ্টি নিয়ে আমার একটি কবিতা ছিল, সেটি আমি আমার কোনো বইতে রাখবো না বলে ঠিক করেছি। আজকাল সারাদিন ব্যস্ত থাক খুব? হয়তো তাই। থাকা না থাকায় আমার কোনো অসুবিধে নেই। এখন বন্ধু—যেন ভুল শব্দের অগোছালো বাক্যে লেখা কোনো গৌণ কবিতা। নাকি অবসন্ন প্রজাতির অভিমান ভরা গল্পের খাতা? শোনো—প্রতিদিন দুপুর হলে যেই ঘুঘুটি সুপারিগাছের মাথায় বসে ডাকাডাকি করতো রোজ—সে আর আসে না এখন। যেন আজ পাথরের ভাষা তার মন। সেই ঘুঘু পাখির সাথে আমার একটা মিল আছে কোথাও মাঝে মধ্যে মনে হয় আমিই সেই ঘুঘু কিংবা সেই আমার নিয়তি। তুমিও তো শুনেছ তার ডাক— কখনো কী বুঝতে পেরেছো ভাষার আঁকুতি? আমি জানি ঠাণ্ডা আপেলের মতো সেও কিছু বলতে চেয়েছে আমাকে। সকাল বেলায় এখন আর দোয়েল পাখিও ডাকে না—তোমার এখানে সেই দোয়েল পাখিটি আসে? আমি যাকে গানেশ্বর বলে ডেকেছিলাম। এসব মনে হয়তো পড়ে না তোমার আমার এমন সামান্য বিষয় গুলোই মনে থাকে। মনে পড়ে আমরা হয়তো অল্প কিছুদিন ভালো বন্ধু ছিলাম। নয়তো সামান্য পরিচিত কেউ। যদি কখনো ভুলে দেখা হয়ে যায় চিনতে পারবো না—আমি মনে রেখেছি শুধু তোমার গলারস্বর। ভালো আছো কী? সে কথাও আর জিগ্যেস করতে ভালো লাগে না। তুমি যেন কি কি খুঁজে পাও এমন প্রশ্নে মনে হয় মুদ্রার উলটো পিঠেই তোমার সকল আগ্রহ। প্রিয় জোনাকি! তোমার সাথে কোনোদিন দেখা হবে না আমার। ইচ্ছে ছিল একটা সময়ে এখন নেই—কিছুটা ইচ্ছে হয়তো তোমারও ছিল। ইচ্ছেরা মরে যায় কিংবা ফুরিয়ে যায়। প্রিয় জোনাকি! আমার ভাষা আজ ফুরিয়ে গেছে। বাকি কিছু কথা আছে যা আর এখানে লিখছি না। কিছু কথা মনের মধ্যে থাকুক। কিছু কথা লিখে রেখেছি কবিতায়। কিছু কথা লিখে রেখেছি গদ্যে। সে কথা শুধু আমি জানি কিছু কথা হয়তো তুমিও জানো। আশা করছি ভুলতে পেরেছো আমাকে অথবা ভুলে যাবে। যদি তাই হয় তবে পৃথিবীতে আরও একটি ফুলের জন্ম সার্থক হবে।

অন্ধকার কেটে গেলে জোনাকির কষ্ট বাড়ে—অনিশ্চয়তার কাটা বিঁধে থাকে মনে তবুও অপেক্ষার প্রত্যাশা শেষ হয় না। আমার বুকে অনেক অনেক অন্ধকার তারা চাইলেই ডানা মেলে দিতে পারে। সুদীর্ঘ বাতাসের রুমাল নাড়িয়ে বহুদিন পর আমার জানালায় দোয়েল এসেছে তাকে আমি মধুচন্দ্রিমা বলে ডাকি। আমি তার সাথে উড়ে যেতে চেয়েছি—তার দুঃখে পুড়ে যেতে চেয়েছি। সে আমার হৃদয় পোড়া নদী—স্রোতে স্রোতে ভেসে যাওয়া তুমুল নিঃসঙ্গতার গান। আমি জানি তোমার চোখে এখনো মলিন হয় রাত—ঠিক এই রকম যেন কেমন করে বদলে গেল জীবন। আমিও ঘরের চাবি হারিয়ে উদ্বাস্ত—নিয়তির হাত ধরে ভেসে ভেসে দেখতে চাই আর কত দূর চলে যাওয়া যায়। তুমি হয়তো চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ভাবছো বিকেল একটি বিশ্বাসের যাদু মাত্র। আমি বৃষ্টিদগ্ধ জারুল নিয়ে ঘরে ফিরছি—আজ আসলে আমার জারুল ফুলের জন্মদিন। আজ তার জন্যে বিশাল একটি আকাশ বানিয়েছি, মৃদু মৃদু বাতাস এঁকেছি, এঁকেছি একটি পাখিও যার সাথে তার বন্ধুত্ব হবে তারপর তারা পাখি হয়ে উড়ে যাবে আকাশে আকাশে।

জাকারিয়া প্রীণন

জন্ম ১৫ জুলাই, ময়মনসিংহ।

ই-মেইল : jakariaprinon@gmail.com

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ভাষা
Scroll to Top