আবারও ভোরে ফজরের নামাজের জন্য ঘুম থেকে জেগে উঠতে না পেরে শেষমেশ নিজের ব্লাডপ্রেশারের অসুখটার ঘাড়েই দোষ চাপায় সাজিয়া। সবসময়ই বলে সে, ওই হতচ্ছাড়া ওষুধগুলোর জন্যই নাকি তার যত অশান্তি।
অবশ্য ওর মা বলত, “এসব শয়তানের লীলাখেলা। রোজ সকালে শয়তান এসে পা টিপে দেয়, গায়ে কাঁথা জড়িয়ে পিঠ চাপড়ে ঘুম পাড়ায় যেন তুই ফজরের নামাজটা পড়তে না পারিস। ওগুলোকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে সময়মত উঠে নামাজ পড়ার অভ্যেস কর”। ব্যক্তিগত চাকরের মতো শয়তানের পা টিপে দেওয়ার ব্যাপারটা সাজিয়ার কাছে রোমান্টিকই লাগে, সেই ভাবনায় মজা পেয়ে মনের সুখে তাকে পা দিয়ে বেশ দু’ঘা লাগিয়ে দেয়। এরপর থেকে দেরিতে ঘুম থেকে উঠে শয়তানের ঘাড়ে দোষ চাপানোর বেশ ভালো একটা সুযোগ পায় সে।
সেদিনও বেশ বেলা অব্দি ঘুমিয়ে ছিল সে। চোখ মেলে ঠিক কোথায় আছে ঠাহর করতে না পেরে ধাতস্থ হতে একটু সময় নেয়, যদিও আড়মোড়া ভাঙতেই হাতে বরের স্পর্শ পায়। নিজের বালিশে মাথা আর গায়ে জড়ানো নিজের কাঁথাটা দেখে বুঝতে পারে বাড়িতে নিজের ঘরেই আছে সে। চেনাজানা জায়গায় জেগে উঠে মনটাই ভালো হয়ে যায় তার।
অবশ্য খুব বেশি সময় সে সুখ সয় না। বাইরে কেউ কাঁদছে, ধীরে ধীরে উঠে দরজার কাছে গিয়ে ছেলে ফরমানের গলা শুনতে পায়। তাড়াতাড়ি বারান্দায় বেরিয়ে এসে দেখে আলতাফ দাঁড়িয়ে আছে, ভীষণ রাগী দেখাচ্ছে তাকে। ফরমান ওকে শান্ত করার চেষ্টা করে, “দেখ, যা হবার ছিল হয়েছে”, বলে সে, “এতে কারো কোন হাত নেই। চিন্তা করো না, তুমি বাড়ি যাও। আম্মি উঠলেই আমি সবকিছু তোমার বাড়িতে দিয়ে আসব। এখন ঘুম ভাঙানো ঠিক হবে না, ওর শরীরটা ভালো নেই। ডাক্তার ঠিকমতো বিশ্রাম করতে বলেছে”।
“কিন্তু ভাইয়া, জামাত ঠিক করেছে আজ বিকেল পাঁচটাতেই কবর দেওয়া হবে। অপেক্ষা করার মতো আর তো কেউ নেই। তাহলে গোসল, কাফনের কাজ তাড়াতাড়ি সেরে ফেলাই ভালো”, আবারও বলে আলতাফ। এবার মেজাজ ধরে রাখতে না পেরে ফরমান বলে, “দেখ, তুমি তো আর আমার কাছে কাফনের কাপড় দিয়ে রাখোনি। আম্মির হজ্ব থেকে আসাও ছয়-সাত বছর হয়ে গেছে। ইয়াসিন বুয়া এতো বছরেও তার কাপড় আম্মির কাছ থেকে নিয়ে যায়নি কেন? কিংবা হয়ত নিয়ে গিয়ে কোথাও তুলে রেখেছে। বাড়িতে আরেকবার খুঁজে দেখ”।
ছেলের পেছনে এসে দাঁড়িয়ে সবকিছু শুনে প্রচণ্ড ধাক্কা খায় সাজিয়া। “কী হয়েছে?” বলে সে, “ফরমান, তুমি কার সাথে কথা বলছ, বাবা?’ মায়ের দিকে ফিরে তাকায় ফরমান, তার চেহারায় অস্থিরতা ফুটে ওঠে। সে মনে মনে ভাবে, “এই মহিলাদের খেয়েদেয়ে আর কোন কাজ নেই। একটু চুপ থাকতে পারে না। সব ব্যাপারে নাক না গলালে যেন তাদের পেটের ভাত হজম হয় না”। অবশ্য মনের কথা মনেই চেপে রেখে সে বলে, “উঠে এলে কেন? তুমি ঘুমাতে যাও আম্মি। এটা ইয়াসিন বুয়া*র ছেলে আলতাফ, কাফনের কাপড়ের জন্য এসেছে”।
সাজিয়ার মনে হয় যেন ওর ওপর বিনামেঘে বজ্রপাত হয়েছে। ব্যস্ত ভঙ্গিতে সামনে এগিয়ে কমবয়সী ছেলেটার দিকে বেশ রাগের স্বরেই বলে, “সকাল সকাল এসব কী হট্টগোল বাঁধিয়েছ? এখানে কাফন আসবে কোথায় থেকে? কার বাড়িতে কখন যেতে হয় কোন হুঁশ নেই তোমার?”। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে পুরো ব্যাপারটা একেবারেই পছন্দ হচ্ছে না ফরমানের। বিষণ্ন চোখে পেছনের দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় আলতাফ বলে, “চিক্কাম্মা, আজ ভোরেই ফজরের নামাজের সময় আম্মা মারা গেছে। তাই কাফনের কাপড়ের জন্য এসেছি”। খবরটা শুনে ভেতরে একেবারে ভেঙে চুরমার হয়ে যায় সাজিয়া। সামলাতে না পেরে পাশে রাখা চেয়ারটাতে ধপ করে বসে পড়ে সে। কল্পনাতীত, অসম্ভব একটা ঘটনা ঘটে গেছে। কীভাবে এর মুখোমুখি হবে সে? কীভাবে সামাল দিবে? এই সমস্ত ভাবনায় লাগাম দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব না। পুরোপুরি ভেঙে পড়ে সে। হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে, “হায় আল্লাহ, এ কী হলো?”।
না চাইলেও সবকিছু একে একে মনে পড়ে যেতে থাকে সাজিয়ার। সেদিন বাড়িতে বেশ একটা উৎসবের আমেজ ছিল। অনেক আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব এসেছিল। সাজিয়া আর তার স্বামী সোবহান হজ্বে যাচ্ছে। বেশিরভাগ কাছের আত্মীয় আর বন্ধুবান্ধবের সাথে দেখা সাক্ষাত হয়ে গেছে। সবার সাথে কোলাকুলি করে সব রকম ইচ্ছায় অনিচ্ছায় করা ভুলচুকের জন্য মাফ চেয়ে নিয়েছে। আত্মীয়রাও দাওয়াত দিয়ে যার যার সাধ্যমতো ছোটখাট উপহার দিয়ে সাজিয়া আর সোবহানের কাছে কোন ভুলভাল হলে মাফ চেয়ে নিয়েছে। শান্তির ব্যাপার হলো কাছের মানুষজন একে অপরের সবকিছু ভুলে খুশিমনে ওদের বিদায় জানিয়েছে।
হজ্ব যাত্রার আর মাত্র সপ্তাহখানেক বাকি, তখনও আত্মীয়স্বজন অনেকের সাথে দেখা করা হয়নি। স্বামী-স্ত্রী মিলে দূরের আত্মীয়দের সাথে দেখা করে এসেছে। সোবহানের বড়সড় ব্যবসা আর সাজিয়ার ঘরসংসার সামলানোর পর আলাদা করে সবার সাথে গিয়ে দেখা করা সম্ভব না। তাই বাড়িতেই সবার জন্য দাওয়াতের আয়োজন করা হয় যাতে সেখানেই সবার কাছে মাফ চেয়ে নেওয়া যায়।
দাওয়াত না পেলেও সরল মনেই সেই অনুষ্ঠানে এসে হাজির হয় ইয়াসিন বুয়া। বিয়ের মাত্র তিন বছরের মাথায় দুই সন্তান রেখে গত হয়েছে তার স্বামী। পাইকারি বাজারে মজুরের কাজ করতো মানুষটা, একদিন সেখানেই হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেল। স্বামী মারা যাবার পর ইদ্দত পালনের সুযোগটাও হয়নি। কমবয়সী মেয়েটা মাথায় ওড়না জড়িয়ে এর ওর বাড়িতে বাসনকোসন ধোয়ামোছার কাজ নেয়, বিয়ে জন্মদিন কিংবা নানা উৎসবের বাড়িতে নীরবে কাজ করে যায় ছেলেমেয়েদের মুখে দু’মুঠো খাবার তুলে দেওয়ার জন্য। ইদ্দতের এই বাধ্যতামূলক শোকের সময়টুকুতে বাড়িতে বসে স্বামীর রুহের জন্য দোয়া করার সুযোগটুকুও কপালে জোটে না তার। তাতে অনেকেই দু’কথা শুনিয়ে দেয়। কিন্তু সেসব কাদা ছোঁড়াছুঁড়ির চেয়ে ছেলেমেয়েদের মুখে খাবার জোটানোটা তার কাছে বেশি দরকারি ছিল। মায়ের এই কঠোর পরিশ্রমের মধ্যে দিয়েই বড় হয় ছেলেমেয়েরা। ছোট মেয়েদের কুরআন পড়া শিখিয়ে বেশ দু’পয়সা আয় করতে শুরু করে মেয়েটা। সেই টাকার সাথে নিজের যতটুকু সঞ্চয় তা দিয়ে মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে এখন অটোরিক্সা ড্রাইভার ছেলের সাথে থাকে ইয়াসিন বুয়া। গায়ের জোর আরো কমে আসলে অন্যের বাড়িতে কাজে ইস্তফা দেয় সে।
খুব শখ ছিল ছেলের বিয়ে দিবে। তবে আরো বেশি একটা ইচ্ছে ছিল তার মন, হৃদয় আর শরীর জুড়ে। দিনরাত কেবল সেই ইচ্ছের চারপাশে ঘুরপাক খেতো সে ভোকাট্টা ঘুড়ির মতো। কিপ্টেমি না করলেও টাকাপয়সা জমানোটা তার এমন স্বভাবে পরিণত হয় যে, ছেলের বিয়ের জন্য জমানো টাকা থেকে নিজের জন্য একটা ওড়না কিনলেও মনে হয় যেন কারো কাছ থেকে চুরি করছে। মনের খচখচানিতে এমন অস্থির হয়ে থাকে যে তিনদিন ধরে টাকাটা আঁচলের খুটেই বেঁধে রাখে। তারপরও মনের সেই গোপন ইচ্ছেকে হার মানাতে পারেনি মায়ের সহজাত মন। ইয়াসিন বুয়ার জেদ যেন হঠাৎ করেই বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়। টাকাগুলোকে শক্ত করে মুঠোর ভেতর ধরে দ্রুত পায়ে হেঁটে যায় সাজিয়ার বাড়ির দিকে। সেখানে তখন অনেক মানুষজন, উৎসবের আয়োজন …
কেউ তাকে দাওয়াত দেয়নি। কেউ এসে বলে না, “আরে, তুমি এসেছ!”। এমনকি একটু খাতির করে খেতে বসতে বলার মতোও কেউ নেই। জীবনে কখনও তেমন আদরযত্ন কপালে জোটেনি তার। অবশ্য অপমানও হয়নি। শুধু পরিশ্রম করে গেছে। পোর্সেলিনের বাসনকোসন ধুতে ধুতে হাত দু’টো ধরে এসেছে। বিরিয়ানীর তেল-চর্বি কি আর অত সহজে ওঠে আজকাল? সবার খাওয়া শেষ হলে উঠোনের পাকা দাওয়ায় বসে কয়েক লোকমা মুখে দেয়। যদিও সব মনোযোগ সাজিয়ার দিকে। “কী কপাল!”, বিড়বিড় করে আপন মনেই বলে। কখন হাতের কাজ শেষ হবে আর মনের ইচ্ছেটা তাকে বলতে পারবে সেই অপেক্ষায় দূর থেকে সাজিয়ার কাজকর্ম দেখতে থাকে।
কখন যে সাজিয়ার একটু অবসর হবে? অসংখ্য আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে শুভকামনা আর উপহার পেতে পেতে সে ক্লান্ত। অনেকেই বিদায়ের সময় কোলাকুলি করে নিজেদের নানান সমস্যা নিয়ে হজ্বে গিয়ে দোয়া করতে বলে। “সাজিয়া আপা, আমার ছোট মেয়েটার জন্য ভালো কোন পাত্র পাচ্ছি না। ওর জন্য একটু দোয়া করবে” বলে একজন। আরেকজন বলে, “আমার ভাবীর ক্যান্সার। দোয়া করো ও যেন ভালো হয়ে যায়”। “আমার ছেলেটার চাকরি হচ্ছে না। খুব কষ্ট পাচ্ছে ছেলেটা। ওর জন্য একটু দোয়া করবে”। দোয়া চাওয়ার এই তালিকা ক্রমেই লম্বা হতে থাকে। সাজিয়া হাসিমুখে সবাইকে জবাব দিতে থাকে, “ইনশাল্লাহ। ওদের জন্য দোয়া করব”। নিজে ক্লান্ত হলেও সেটা বুঝতে না দিয়ে একে একে সবাইকে বিদায় দিতে থাকে। যদিও দুপুরের খাবারের দাওয়াত ছিল, তারপরও সন্ধ্যে অব্দি মানুষজন আসতেই থাকে। বাসনকোসন ধোয়ামোছা করতে করতে নিজের সুযোগের অপেক্ষা করতে থাকে ইয়াসিন বুয়া।
অবশেষে রাত প্রায় এগারোটার দিকে নরম কার্পেটে পা ছড়িয়ে সোফায় বসার একটু অবসর পায় সাজিয়া, তখনই বসার ঘরের দরজার কাছে ইয়াসিন বুয়ার ছায়া দেখতে পায় সে। অস্থির হয়ে পড়ে ইয়াসিন বুয়া, সাজিয়ার জন্য খারাপ লাগে, “আহ রে, মানুষটা একেবারে হয়রান হয়ে গেছে”। শাড়ির আঁচলে হাত মুখে পা টিপে টিপে ওর দিকে এগিয়ে যায়, যেন ওর ময়লা ফাটা গোড়ালির পা ওই দামী কার্পেটে না পড়ে। “তুমি কখন এলে বুয়া?” আলগোছে জিজ্ঞাসা করে সাজিয়া।
অবশেষে সাজিয়ার দেখা পেয়ে অসম্ভব খুশিতে জবাব দেয়, “অনেকক্ষণ আগেই এসেছি”।
“ওহ! তাই নাকি? সারা বিকেল তোমাকে তো কোথাও দেখলাম না”, বলে সাজিয়া। তারপর নরম গলায় জিজ্ঞাসা করে, “খেয়েছ?”।
“হ্যাঁ, আম্মা। আপনার বাড়ির দানা খেয়েই তো বেঁচে আছি। আপনার হাতে যেন সোনা ফলে। এই সংসার ভরে উঠুক”।
তৃপ্তি বোধ করে সাজিয়া “অনেক দেরি হয়ে গেছে বুয়া। তুমি বাড়ি যাবে কীভাবে?”।
ওর জন্য চিন্তা করতে দেখে বলে, “আলতাফ বলেছে, ওর অটোতে করে বাড়ি নিয়ে যাবে। ও আসলেই চলে যাব”।
সাজিয়া জানে ইয়াসিন বুয়া সারাদিন নানা রকম কাজ করে গেছে। তাই সে উঠে নিজের ঘর থেকে কিছু টাকা নিয়ে আসে। “এটা রাখো, বুয়া। তুমি খরচ করো। তিনদিন পরেই আমরা হজ্বের জন্য রওনা হবো, ফিরতে পয়ঁতাল্লিশ দিন লাগবে। দোয়া করো, আল্লাহ যেন আমাদের হজ্ব কবুল করে”।
নিজের হাতের মুঠোয় বুয়ার দুই হাত চেপে ধরে টাকাগুলো গুঁজে দেয় সে। ইয়াসিন বুয়া বিহ্বল হয়ে পড়ে। তার মতো ফকির-মিসকিনকে এমন মায়া করতে দেখে চোখ ভিজে ওঠে। সাজিয়ার কাছ থেকে টাকাগুলো নেয় না সে। বরং নিজের আঁচলের খুট থেকে আরো কয়েকটা কুঁচকানো নোট বের করে সাজিয়ার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে মিনতি করে, “আম্মা, এখানে ৬ হাজার রুপি আছে। আপনি তো হজ্বে যাচ্ছেন। ওখান থেকে আমার জন্য জমজমের পানিতে ভিজিয়ে একটা কাফনের কাপড় আনবেন। অন্তত: ওই কাপড়টুকুর জন্য যদি বেহেশতে যেতে পারি”।
এক মুহূর্তের জন্য সাজিয়া ভেবে পায় না কী বলবে। কাজটা খুব একটা কঠিন না। “আরে, একটা কাফনেরই তো কাপড়। আরো কিছু টাকা দিয়ে হলেও আনা যাবে”, ওই সময়ের ভাবনায় এমনটাই মনে হয়েছিল। তাই দ্বিতীয়বার আর না ভেবেই রাজি হয়ে যায়।
টাকাগুলো বুয়ার হাত থেকে নিতে নিতেই ব্যাপারটা বুঝতে পারে সাজিয়া। গরিবদের টাকাগুলোও তাদের মতোই মলিন, ভাঙাচোরা, কুঁচকানো আর বিবর্ণ। মাঝে মাঝে তার মনে হয়, গরিবদের কাছে চকচকে টাকা দিলেও খুব শিগগিরই সেগুলো বিচ্ছিরি হয়ে যাবে, আজ সেটা প্রমাণ হয়ে গেল। “ঠিক আছে বুয়া, এখন তাহলে যাও” বলে ওকে বিদায় দিয়েই দ্রুত নিজের ঘরের লাগোয়া বাথরুমে ঢুকে টাকাগুলো বেসিনের ওপরে রেখে সাবান দিয়ে ডলে ডলে ভালো করে হাতদুটো ধুয়ে নেয়।
সেই টাকা আর বেসিন থেকে তুলেছিল কিনা সেকথা আর সাজিয়ার মনে নেই। হজ্ব কাফেলার বিমানে চড়ে সবাই মিলে মদিনায় গিয়ে পৌঁছায়। নতুন পরিবেশে নানান পবিত্র জায়গায় যাওয়া, আটদিন ধরে চল্লিশ রাকাত নামাজ পড়তে পড়তে সময় যে কীভাবে পার হয়ে যায় টের পায় না সে। সুবহান ওকে কেনাকাটা করতে মানা করেছিল। কিন্তু সে কি আর মানা শুনবে? মানা তো করাই হয় না শোনার জন্য, অতএব নিজের ইচ্ছে মতোই কাজ করে। এখানেও ব্যতিক্রম হয় না।
এবার নিয়তের কথা মনে করিয়ে দেয় সুবহান। হজ্বের পথে রওয়ানা দেওয়ার আগে এই যাত্রায় তাদের নিয়ত ছিল শুধুই ইবাদত। তাই হজ্ব শেষ হওয়ার পরই দরকারি কেনাকাটা করার তাগিদ দেয় সে, সেই সাথে বুঝায় এসব কাজ হজ্বের নিয়তকে মাটি করে দিতে পারে। মদিনা থেকে মক্কার পথে যাত্রাও সাজিয়ার জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা। এই সবকিছুর মাঝে নিজের গ্রাম কিংবা বাড়ির কথা আর মনে থাকে না কারো। মক্কায় থাকার সময়টা কখনও ভোলার মতো না। ইন্ডিয়ার হজ্ব কমিটি অনেকগুলো বাড়ি ভাড়া করে রেখেছিল। প্রতি দুইটা রুমের জন্য একটা করে বাথরুম আর সাথে একটা ছোট্ট রান্নাঘর, অবশ্য সেখানে গ্যাস সিলিন্ডার, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিনসহ সব ধরণের গেরস্তালি সুযোগ সুবিধাই ছিল। সাজিয়ার মায়ের দিকের চারজন আত্মীয় একসাথে এসেছে তাই ওদেরকে একটা বড় রুম দেওয়া হয়। যথারীতি রান্নার দিকটা মহিলারাই দেখভাল করে। তাদের বেশিরভাগ সময় কেটে যায় নামাজ, ক্বাবাঘরের তাওয়াফ, দোয়াদরুদ আর নানা রকম ইবাদতে। যেখানে প্রথম রাসুলের কাছে কুরআনের বাণী নাজিল হয় সেই হেরাগুহাসহ আরো সব পবিত্র জায়গা ঘুরে দেখা আর সময় ধরে ধরে নামাজ পড়ায় ব্যস্ত থাকতে হয়। সৌদি সরকারসহ অন্য বড় ব্যবসায়ীরা বিশাল সব ট্রাকে করে করে হজ্বযাত্রীদের মাঝে পানি, জুস আর খাবারের প্যাকেট বিতরণ করতে থাকে। হজ্বযাত্রীরা আল্লাহর মেহমান তাই তাদের খেদমত করলে আল্লাহ্ খুশি হবেন এই বিশ্বাস থেকেই সবাই যেন আদর আপ্যায়নে জীবন দিয়ে দেয়।
সাজিয়া আর দলের সবাই হজ্বের বাকি কাজগুলো শেষ করার দিকে মন দেয়। একদিন বিকেলে ক্বাবাশরীফ থেকে নামাজ পড়ে ফিরে সে। তীব্র গরমে দুপুরের খাবারের পর ক্লান্তিতে চোখ বুঁজে আসে। একটুখানি ভাতঘুম দিয়ে উঠে শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগে। এখুনি আসরের নামাজের জন্য মসজিদ-আল-হারামে যেতে হবে সবাইকে। বাথরুমে ওজু করতে গিয়ে একটা কিছু দেখে থমকে যায় সে, পাশের রুমের জয়নব একটা দশ লিটারের বালতিতে পানি ভরছে। “আরে জয়নব, তুমি কী করছ এখানে?”, অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে সাজিয়া।
আশেপাশে তাকিয়ে জয়নাব জবাব দেয়, “আমাকে কাফন ধুতে হবে”।
“কী বললে?” বিরক্ত হয়ে আবারও জিজ্ঞাসা করে সাজিয়া। “তুমি পানি চুরি করছ। এটা কি ঠিক? হজ্বে এসেও তোমার এসব ছোটলোকি স্বভাব গেল না?”। সে চিৎকার শুরু করলে তাড়াতাড়ি বালতিটা নিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে দড়াম করে দরজা লাগিয়ে দেয় জয়নাব। সাজিয়া বুঝতে পারে ঘটনাটা। হজ্ব যাত্রীদের পানি দেওয়ার দায়িত্ব ছিল সৌদি সরকারের। অথচ কোম্পানিগুলো বড় বড় বালতিতে করে পানি আনেনি। তার বদলে ওরা ক্বাবা শরীফের ভেতর থেকে ট্যাংকারে করে জমজমের পানি এনে দুই রুমের জন্য ভাগাভাগি করে ডিসপেন্সারে দিয়ে যায়। এতে দশ থেকে পনের লিটার ধরে, সেটা দুপুর তিনটার দিকে আবার ভরে দেওয়া হয়। সাজিয়া খুব কমই এখানে পানি পায়। বেশিরভাগ সময় রাতে নামাজ থেকে ফেরার পথে সুবহান একটা করে পাঁচ লিটারের পানির বোতল কিনে নিয়ে আসে।
খুব রাগ হয় সাজিয়ার। জয়নাবের এমন দজবাবে যেন গায়ে জ্বালা ধরে যায়। ওর দুঃসাহস দেখে ভাবে, এই চুরি করা পানিতে কতগুলো কাপড় ডোবাবে সে? হায় খোদা! ওকি বাড়ির সবাইকে জমজমে ধোয়া কাফন বলে মিথ্যে কথা বুঝাবে? সবকিছু চোখের সামনে পরিষ্কার হয়ে যায় সাজিয়ার, এদিকে স্ত্রীর গলার আওয়াজ শুনে রুম থেকে দৌড়ে এসে সুবহান ওকে হাসিতে ফেটে পড়তে দেখে। কী নিয়ে এমন চিৎকার করছিল বুঝতে না পেরে সে জিজ্ঞাসা করে, “কী হয়েছে সাজিয়া? এমন করে হাসছ কেন?”। হাসতে হাসতেই পুরো ঘটনাটা বলে সে, “দেখ। এরা হজ্বের মর্ম বুঝেই না। এখানে এসেও এমন ছোটখাট জিনিস নিয়েও মানুষকে ঠকায়”। সুবহান অল্প হেসে বলে, “তুমি এসব আজ জানলে? আমি তো এখানে এসেই এসব খেয়াল করেছি। তবে তোমার মতো হৈচৈ করিনি। এজন্যই তো নিজেদের জন্য পানি কেনা শুরু করেছি। এসব নিয়ে ঝগড়াঝাটির কোন দরকার নেই”।
হঠাৎই বুয়ার কাফনের কথা মনে পড়ে সাজিয়ার, “আরে! আমাদেরকে ইয়াসিন বুয়ার জন্য কাফনের কাপড় কিনতে হবে। রাতে নামাজ থেকে ফেরার পথে নিব”, নিজের প্রতিশ্রুতির কথা মনে করে সে। মাথা ঝাঁকিয়ে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নেয় সুবহান, এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। ঠিক যা ভেবেছিল তাই হয়েছে, ওরা যখন পৌঁছায় ততক্ষণে আল-হারাম একেবারে ভর্তি হয়ে গেছে। যথারীতি নারী আর পুরুষরা আলাদা জায়গায় জমা হয়েছে। মসজিদের পিলার বরাবর কাতারে কাতারে দাঁড়ান মানুষ, গভীর নিবেদনে হাত জড়ো করা, মাথা অবনত। দেরি হয়ে গেছে বলে সাজিয়া আর সুবহান মসজিদের একেবারে বাইরের দিকের চত্বরে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পড়ে। খুব শিগগিরই এই জায়গাটাও দেরিতে আসা লোকজনে ভরে যায়। মাথার ওপর কড়া রোদ পড়তেই বিশাল আকারের ছাতাগুলো আপনমনেই পাখা মেলে ছায়া জোগায়। আবার রোদ কমতেই ছাতাগুলো আপনমনে ভাঁজ হয়ে পিলারের মতো দাঁড়িয়ে থাকে – এই দৃশ্যটা সাজিয়ার খুব ভালো লাগে।
এশার নামাজ পড়ে ক্বাবা শরীফ থেকে হেঁটে ফিরে ওরা। রাস্তা আর ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে চলা লক্ষ লক্ষ মানুষের মাঝে কোথায় থেকে যে ইয়াসিন বুয়ার জন্য কাফনের কাপড় কিনবে সাজিয়া সেটা ভেবে পায় না সুবহান। এত মানুষের মাঝে যেন হারিয়ে না যায় তাই শক্ত করে স্ত্রীর হাত ধরে হাঁটতে থাকে সে। কোনরকম লজ্জা কিংবা দ্বিধা ছাড়াই ওর হাত ধরে কিংবা কোমর জড়িয়ে রাখার অভ্যেস করে নিয়েছে সে। স্ত্রীর আলগোছে হাঁটার সাথে তাল মেলাতে নিজের গতি কমাতে হয় তার। ভেতরে ঢোকার আগে বাইরে থেকেই ভালো করে দেখে নেয় সেই দোকানে আদৌ কাফনের কাপড় বিক্রি করে কীনা। যাই হোক, কাফনের কাপড় খুঁজতে গিয়ে একটা কার্পেটের দোকানে চোখ যায় সাজিয়ার। ওগুলোর রং, ডিজাইন আর কারুকাজ খুবই সুন্দর লাগে ওর কাছে। বরের কোনরকম অনুমতির তোয়াক্কা না করেই দরদাম করতে শুরু করে দেয় সে, কেনাকাটা বন্ধ করতে সুবহানের সব চেষ্টা বিফলে যায়। নিয়তের বরখেলাপ হবে কিংবা উদ্দেশ্য বিফলে যাবে এসব কোন বাহানাই আর কাজে দেয় না। এমনকি হজ্বের পরে কেনাকাটা করার প্রতিজ্ঞাও বেমালুম ভুলে বসে সে। দোকান থেকে ওকে বের করে আনার সবরকমের চেষ্টাই জলে যায়।
সবকিছু ভুলে ওই টার্কিশ কার্পেটে যেন সে হারিয়ে যায়। হাল ছেড়ে দিয়ে ফিসফিস করে দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করে সুবহান, “এখানে কি কাফনের কাপড় পাওয়া যাবে?”। ছেলেটা তখুনি প্লাস্টিকে মোড়ানো লাশের মতোই ভারী একটা কাপড়ের থান বের করে নিয়ে আসে। সাজিয়ার মনোযোগ কাড়ার চেষ্টা করে সুবহান, কিন্তু সে কার্পেট নিয়েই ব্যস্ত। এক হাতে কাফনের কাপড়টা সরিয়ে দিতে দিতে বলে, “আরে, এটা কী ভারী! এটা আমরা কীভাবে নিয়ে যাব?”। এক মুহূর্তে পুরো ব্যাপারটা নাকচ করে নিয়ে আবারও কার্পেটের দিকে মন দেয় সাজিয়া।
অবশেষে কেনাকাটা শেষ হয়। পকেট থেকে টাকা গুণে দিয়ে কার্পেটের প্যাকেটটা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে আসে সুবহান। রাস্তায় কোন রিক্সা কিংবা কুলির দেখা নেই বলে অগত্যা নিজেই সেটা কাঁধে বয়ে নিয়ে চলে। মনে মনে আশা করে চেনা পরিচিত কারো সাথে যেন দেখা না হয়। মাঝপথে সাজিয়ার একটু খারাপ লাগলে আস্তে করে জিজ্ঞাসা করে, “খুব কি ভারী?” কোন জবাব দেয় না সুবহান। সাজিয়ার এমন ছেলেমানুষি কাজে খুব রাগ হয়েছে, তাই হতচ্ছাড়া কার্পেটটাকে ঘরের এক কোণে নামিয়ে রেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। অন্যকোন সময় হলে নির্ঘাত রাগ করত, হয়তো সাজিয়াকে বকাঝকাও করত। যেহেতু হজ্বে এসেছে, আর আশেপাশের রুমে সবাই আত্মীয়স্বজন, তাই ব্যাপারটা নিজের মধ্যেই হজম করে সুবহান।
অবশেষে হজ্ব শেষ হলো। বেশকিছু ভুলভাল হলেও মোটের উপর সন্তুষ্ট দু’জনেই। মিনা থেকে ফেরার পর নানারকম দুশ্চিন্তায় শরীর খারাপ হয়ে যায় সাজিয়ার। ব্লাড প্রেশার খুব বেড়ে যাওয়ার কারণে হাসপাতালে থাকতে হয় দুই দিন। প্রেশার কমানোর জন্য আরো একদিন রেস্টে থাকতে হবে। এত কিছুর মধ্যে কেনাকাটার সময় চলে যাচ্ছে বলে খুবই বিরক্ত সে। সুবহানকে বারবার বুঝায় শরীর ভালোই আছে, আরো ঠিক হয়ে যাবে। এদিকে কেনাকাটা বন্ধ করার সবরকমের চেষ্টাই করে সুবহান। টাকাপয়সা নিয়ে চিন্তা করছে না সে, তবে অতিরিক্ত লাগেজের জন্য ফ্লাইটে কোনো ঝামেলায় পড়তে চায় না। সাজিয়ার মন খারাপ হোক সেটাও চায় না, এতে না আবার ব্লাড প্রেশার বেড়ে যায়। অতএব সাজিয়ার ইচ্ছেরই জয় হয়।
কেনাকাটায় মত্ত হয়ে থাকলেও ইয়াসিন বুয়ার কাফনের কাপড়ের ব্যাপারটা বেশ কয়েকবার মনে আসে, তবে এই আসা যাওয়ার মাঝখানেই একসময় সেটা বেমালুম ভুলে বসে সাজিয়া। এমন একটা দারুণ জায়গায় … হায় খোদা … কেউ কি কাফনের মতো এমন মন খারাপ করা জিনিসের খোঁজ করে? ওটা কি ইন্ডিয়াতে পাওয়া যায় না? আমাদের গ্রামেই তো পাওয়া যায়। বলতে পারি, মক্কায় খুঁজে পাইনি। হায়! হজ্ব থেকে ফিরেই মিথ্যা বলব? “তওবা, তওবা”, হালকা করে নিজের গালে চড় মেরে বলে সে। মিথ্যে বলা যাবে না। কিন্তু ইয়াসিন বুয়ার ইচ্ছে পূরণ তার জন্য এমন ঝামেলার ব্যাপার হয়ে উঠবে কে জানত।
এই মুহূর্তে ইয়াসিন বুয়ার মৃত্যুর খবর শুনে তার অসমাপ্ত ইচ্ছের কথা ভেবে সাজিয়ার মাথা খারাপের জোগাড়। ইস্, আগে যদি জানত, যত ঝামেলাই হোক নিজের কথা রাখত।
আসার সময় জিনিসপত্র এত বেশি হয়ে গিয়েছিল যে অনেক কিছু অন্যদের ব্যাগে দিতে হয়। এসব জোগাড়যন্ত্র করতে গিয়ে বিপাকে পড়ে সুবহান। তার ওপর সবাইকে দেওয়ার জন্য জন্য জমজমের পানির পাঁচ লিটারের ক্যান, কয়েক কেজি খেজুর সেগুলোর ওজনও কি কম? সাজিয়া শুধু বোরকা পরে নিজের হাতব্যাগটা নিয়ে সুবহানের কাছে দৌড়াদৌড়ি করতে থাকে প্রতিটা ছোটখাট জিনিসের জন্য। এতে সে আরো বিরক্ত হয়। অবশেষে বহু ঝক্কি ঝামেলার পর সব জিনিসপত্র গুছিয়ে ফ্লাইট ধরতে পারে।
হজ্ব থেকে ফেরার এক মাস পরেও সব জিনিস বিলিয়ে শেষ করতে পারেনি সাজিয়া। আসার পর তো প্রথম তিনদিন বিছানা ছেড়েই উঠতে পারেনি জেটল্যাগের জন্য। তারপর শুরু হয় ব্যাগবোচকা খোলা। আগে স্বর্ণের জিনিসগুলো একেবারে কাছের মানুষদেরকে পাঠানোর বন্দোবস্ত করে। চমৎকার কার্পেটটা বিছিয়েই মন ভালো হয়ে যায় তার। সুবহান শুধু বিরক্ত মুখে হেঁটে যায়, ওর এই উদাসীনতাও নজরে পড়ে না সাজিয়ার। এরপর সে যার যার জন্য আনা কাপড়চোপড় আর খেলনাগুলো দিয়ে দেয়। কয়েকজন বান্ধবী আর আত্মীয়স্বজন বোরকা আনতে বলেছিল, সেগুলো হতে হবে নির্দিষ্ট ডিজাইন আর রঙের, সাথে কসৌটির কাজ করা। কেউ কেউ টাকাও দিয়ে দিয়েছিল। অন্যদের জন্য উপহার হিসেবে বোরকা পাঠিয়ে দেয় সে। বাকি সবার জন্য একটা করে জায়নামাজ, তসবীহ, একমুঠো খেজুর আর এক বোতল জমজমের পানি। এসব নিজের হাতে না করলেও সবকিছু দেখভাল করতে হয় তাকে, সেটাও কম পরিশ্রমের নয়। এভাবে সব শেষ করতে করতেই এক মাস পেরিয়ে যায়।
ধরেই নেওয়া হয় যে হজ্ব থেকে ফিরলে তার মধ্যে পবিত্রতা আর ঈমান জোরদার হবে। সেই ঈমানের শক্তি যেন বিফলে না যায় তাই বেশি বেশি করে আল্লাহর ইবাদত করা দরকার, সেজন্য হজ্ব ফেরত মুসুল্লিরা পরের চল্লিশ দিন বাড়ির বাইরে না গিয়ে ইবাদত চালিয়ে যায়। সাজিয়াও সেটাই করে। যথারীতি ইয়াসিন বুয়া বেশ কয়েকবার এ বাড়িতে আসলেও চুপচাপ ফিরে গেছে। প্রতিবারই বলা হয় সাজিয়া বিশ্রাম করছে, নয়তো নামাজ পড়ছে কিংবা ঘুমাচ্ছে অথবা অন্যকোন কাজে ব্যস্ত আছে, যেটা শুনে ইয়সিন বুয়ার চোখ ভিজে ওঠে। একদিকে সে নিজের কাফনের কাপড় দেখার জন্য মনে মনে অস্থির হয়ে, অন্যদিকে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে হজ্ব ফেরত সাজিয়ার হাত দু’টো নিজের হাতে নিয়ে ছুঁয়ে দেখার জন্য। হয়তো সাজিয়া ওর জন্য কোন উপহার এনেছে, সেই পথ চেয়ে থাকে কেবল।
বুয়ার দুঃসহ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে একদিন দেখা মেলে সাজিয়ার। সবেমাত্র গোসল করে এসেছে সে, চুলগুলো তখনও ভেজা ভেজা। দারুণ একটা আকাশি নীল রঙের জামা আর কাসৌটির কাজ করা ওড়না মাথায় দিয়ে ওকে বেরিয়ে আসতে দেখে খুশিতে চোখ ঝলমল করে ওঠে বুয়ার। দৌড়ে গিয়ে সাজিয়ার হাত দুটো নিয়ে নিজের চোখে ঠেকায়। হাজ্বি সাহেবার হাত দুটো ছুঁয়ে নিজেকেও সেই পবিত্রতার অংশ মনে করে শিহরিত হয়ে ওঠে সে। “কেমন আছো বুয়া?”, হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ছোট করে বলে সাজিয়া। তাড়াতাড়ি ঘরের ভেতর থেকে একটা জায়নামাজ আর তসবীহ নিয়ে এসে বলে, “এই নাও, এগুলো তোমার জন্য”। ইয়াসিন বুয়ার তৃষিত চোখ যা দেখতে চায় সেটা নেই এখানে। আল্লাহর কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য বহু সাধের জমজমের পানিতে ভেজানো কাফনের কাপড় হাতে পাওয়ার এই তো চরম মুহূর্ত। উপহারগুলো নেওয়ার জন্য হাত না বাড়িয়েই গভীর অবিশ্বাসে সাজিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে সে, হতাশায় মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে যেন। অবশেষে সাহস জুটিয়ে পরিষ্কার গলায় সাজিয়াকে বলে সে, “এগুলো চাই না। আমার কাফনের কাপড় দিন”। এমন কিছু আশা করেনি সাজিয়া, তাই রাগে ফেটে পড়ে সে। কোনরকম রাখঢাক না করেই বুয়ার উপর চিৎকার করে, “ছিঃ! জায়নামাজ কেউ ফিরিয়ে দেয়?” এক ইঞ্চিও নড়ে না বুয়া, নিজের জায়গায় স্থির সে। “আপনার শ্বাশুড়ির দেওয়া জায়নামাজ এখনও আমার কাছে আছে, খুব সুন্দর সেটা। এত জায়নামাজ নিয়ে আমি করব কী? আর কয়দিনই বা বাঁচব? দিন ঘনিয়ে এসেছে। আমার এখন দরকার কাফনের কাপড়”।
ইয়াসিন বুয়ার এই রূপ আগে কখনও দেখেনি সাজিয়া। গভীর সম্মানে ওর সামনে সবসময় মাথা নুয়ে চলত, মিনিটে মিনিটে আকাশের দিকে ইশারা করে সাজিয়ার জন্য দোয়া করত, আঙুল ফুটিয়ে বলত সংসারের সব বালামুসিবত যেন দূর হয়ে যায়, খোদা যেন ওকে লম্বা হায়াত দেয়, আর পরকালে বেহেশত। সবসময় দোয়া করা সেই বুয়া কোথায়? সামনে গোঁয়ারের মতো দাঁড়িয়ে থাকা এই মানুষটা কে?
রাগে ফেটে পড়ে সাজিয়া। মাত্রই হজ্ব থেকে ফিরেছে সেকথা ভুলে যায়। “কোন কাফনের কথা বলছ? মরার পর গায়ে দেওয়ার জন্য? সেই কাফন তো অন্যরা তোমাকে পরাবে। সেটা নিয়ে এত হৈ-হল্লা করছ কেন? তোমার কী হয়েছে, বুয়া? মাথা খারাপ হয়ে গেছে? কত টাকা দিয়েছিলে আমাকে? তার চেয়ে দশগুণ তোমার মুখের ওপর ছুঁড়ে দিতে পারি। থাম, এরপর আর কখনও আমাকে মুখ দেখাবে না”। রাগে চিৎকার করতে করতে নিজের ঘরে যায় সে। কিন্তু হাতে পাঁচশ টাকার একটা নোট নিয়ে বেরিয়ে এসে কোথাও আর ইয়াসিন বুয়াকে দেখতে পায় না। এত সহজে বুয়াকে যেতে দেওয়া যাবে না। দৌড়ে একবার রান্না ঘরে যায়, আরেকবার পেছনের উঠোনে।
রাস্তায় উঁকি দিয়ে দেখে, কোথাও বুয়ার দেখা নেই। “জাহান্নামে যাক!” ভাবতে ভাবতে টাকাটা তেপায়ার ওপর রেখেই সোফায় শুয়ে পড়ে। সাজিয়ার কথা মত ইয়াসিন বুয়া আর কখনও এ বাড়িতে আসেনি। উটকো ঝামেলা বিদেয় হয়েছে ভেবে সে বরং শান্তি পায়। বুয়া এমন কাজ করতে পারে কীভাবে? সেকথা ভেবে মাঝেমাঝেই মেজাজ চড়ে যায়। আর বুয়া না আসলে তারই বা কী করার আছে? চুলোয় যাক। হয়তো রোজার ঈদ কিংবা কোরবানী ঈদে কিছু চাইতে আসবে। কোন এক রমজানে নতজানু হয়ে বুয়া আসবে সেই অপেক্ষাতেই থাকে সাজিয়া। যদিও বুয়ার আত্মসম্মানকে ছোট করে দেখার কোন কারণ নাই। নতুন বউয়ের রঙিন আলোয়ানের মতো করেই কাফনের কাপড়টাকে ছুঁয়ে দেখার অপেক্ষায় ছিল সে। অথচ দামী কাপড় আর গয়নার মাঝে ডুবে যাওয়া সাজিয়ার অপমান তার হৃদয়ে গভীর ক্ষত করে দিয়ে গেছে।
সাজিয়া কখনও স্বপ্নেও ভাবেনি বুয়ার মৃত্যু ওকে এভাবে তাড়া করে ফিরবে। হঠাৎ নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণায় ভেঙে পড়ে সে। কী করা উচিত এখন? কী করা উচিত না? বুয়া চাইলে এক লাখ টাকা দামের কাফনও দিতে পারে সে, কিন্তু জমজমের পানিতে ভেজাতে মক্কা থেকে আনা কাফন? হায় খোদা, কোথায় পাবে সে? এই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত কীভাবে করব? কীভাবে? নিজের মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উপরের একটা খালি ঘরের এক কোণে আশ্রয় নেয়। শরীরের তাপ বাড়ছে, নাকি কাঁপুনি দিচ্ছে? এমন করে ঘেমে নেয়ে উঠছে কেন? কী কপাল। যদি শেষ বিচারের দিনে এই গরিব নারী আঁচল পেতে আল্লাহর কাছে ন্যয়বিচার চায়, নিজের সব পূণ্য দিয়েও আমি বাঁধা থাকব, ভেবে শিউরে ওঠে সাজিয়া। বুয়ার থেকে কতখানি দীনহীন, কত অভাগা সে।
মৃত মানুষটার শেষ ইচ্ছে ছিল ওই কাফন। নাহলে কেনই বা ওর ছেলেটা আসবে? কেন সে মৃত মায়ের হয়ে ওটা চাইবে? যদিও নরম স্বরে কথা বলছিল ছেলেটা, তবু বোঝাই যায় মায়ের শেষ ইচ্ছে পূরণে স্থির সে। এর থেকে কীভাবে মুক্তি পাবে সাজিয়া? মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায় তার। ছেলেটা অন্য কাফন নিতে না চাইলে আজ আর দাফন হবে না। জামাত হয়তো ওর স্বামী আর ছেলেকে মসজিদে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসা করবে। ওদেরকে ভাঁজ করা হাত আর নতমুখে সেখানে পাঠানোর ভয় গ্রাস করে তাকে। ফরমান নিশ্চয়ই মাকে ছেড়ে কথা বলবে না। যতখানি ভালোবাসতে পারে, ততোটাই অপমান করবে নিশ্চয়। ভোকাট্টা ঘুড়ির মতো নানান চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকে মাথার ভেতর। বসে বসে কেবল কাঁদতে থাকে সাজিয়া, দম ফুরিয়ে আসা কান্নার সাথে মনে হয় বুকটা ফেটে যাবে। কেঁদে কি মনটা একটা হালকা হলো? না। গভীর যন্ত্রণা গলার কাছে দলা পাকিয়ে থাকে। কোন শত্রুকেও যেন খোদা এমন শাস্তি না দেন। নিঃশ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হয়।
প্রায় ঘন্টা দুয়েক ওভাবে বসে কাঁদার পর একটু আশার আলো দেখা যায়। নিচতলা থেকে সুবহানের গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। জোরে জোরে ডাকছে সে, “সাজিয়া, সাজিয়া? আমার জামাকাপড় কোথায়? পেন কোথায়? নাস্তা রেডি হয়েছে?” স্বামীর কথা শুনতে পেলেও জবাব দেওয়ার কোন শক্তি নেই ওর কন্ঠে। অবশ্য সাবা জবাব দেয়, ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলে, “আম্মি বাড়িতে নাই, আব্বা। খুব সকালে কারো মারা যাওয়ার খবর এসেছে। হয়তো সেখানেই গেছে”।
“কী? কে মারা গেছে? তোমাকে কে বলল?” জানতে চায় সুবহান।
“ফরমান বলল, নাস্তা না করেই বেরিয়ে গেছে। আম্মিও নিশ্চয় ওর সাথে গেছে”, বলে সে। সাবার কথাগুলো শুনে স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সাজিয়া। ছেলের বৌ হিসেবে সাবা যত খারাপই হোক না কেন এই মুহূর্তে ওর জন্য মনের ভেতর একটুখানি মায়া হয়। বাবুর্চির বানানো রুটি আর সব্জি ডাইনিং টেবিলে সুবহানকে বেড়ে দিচ্ছিল সে। একটু পরেই গেটের ওপাশে সুবহানের গাড়ির আওয়াজ পাওয়া যায়। আর কেঁদে লাভ নেই। এবার একটা কিছু করতে হবে, ভাবে সাজিয়া।
কারো মৃত্যুতে এর আগে এতো কাঁদেনি, এমনকি নিজের বাবার মৃত্যুতেও না। তারপরও সেখানে কত মানুষ ছিল ওকে একটু পানি খাইয়ে দেওয়ার জন্য, গোলাপজলে ভেজানো তুলায় চোখ মুছিয়ে দেওয়ার, পিঠে হাত বুলিয়ে কিংবা বুকে জড়িয়ে সান্তনা দেওয়ার। আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব কে কার আগে কাজে হাত বাড়িয়ে দিবে সেটা নিয়ে কাড়াকাড়ি। ওদের মাঝে শোক সামলে নেওয়া সম্ভব ছিল। আজ এভাবে এতিমের মতো নির্জনে নিজেকে বন্দি করাটা – যদিও নিজেই বেছে নিয়েছে। এর থেকে বের হতে হবে তাকে। মন স্থির করে নিয়ে দ্রুত নিজের আত্মীয় আর বন্ধুবান্ধবদের কল করতে শুরু করে সে।
“জমজমের পানিতে ভেজানো কাফনের কাপড় দরকার আমার …” প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই ওপাশ থেকে জবাব আসে, “আরে … সাজিয়া নাকি? না, বাড়িতে তো তেমন কোন কাফনের কাপড় নেই। মা হজ্বে গিয়ে একটা নিয়ে এসেছিল, সেটা কাকে যেন দিয়ে দেওয়া হয়েছে”। আরেকজন বলে, “মানে, তুমি কাফন কী করবে?”, কেউ কেউ হাসে, “আমরা কি বাড়িতে কাফনের কাপড় রাখি নাকি? আমরা কাউকে এমন কথা দিয়ে বসি না। এসব খুবই ঝামেলার কাজ”। আরেকজন বলে, “ওখানকার কাফন দিয়ে কী হবে? এখানকার হলে কী সমস্যা? পরকালে শুধু আমাদের কাজেরই হিসেব হবে, তাই না?”
সবার কাছে না শোনার পর, মন না চাইলেও অবশেষে সাবা’র মাকে কল করে সে। হ্যালো .. হ্যালো এসব ভদ্রতা শেষ হলে আত্মসম্মানের মাথা খেয়ে আসল কথায় আসে। “আপনি কি মক্কা থেকে কোন কাফনের কাপড় এনেছিলেন?”। সাবার মা সাজিয়াকে খুব একটা পছন্দ করে না। সাবার রোজকার সমাচার অনুসারে তার কাছে সাজিয়া এক জলজ্যান্ত রাক্ষুসী, এই নির্মম মহিলা যে কীনা ছেলের বৌয়ের ওপর কড়া নজরদারি করে, এই ডাইনী ওকে যন্ত্রণা দেয়, ওর সুখের পথের কাঁটা, কালনাগিনী। এই সমস্ত কারণে, সাবার মা যেকোন মূল্যে একটা কাফন জোগাড় করতে রাজি – অবশ্য সেটা যদি সাজিয়ার নিজের জন্য হয়। সে জিজ্ঞাসা করে, “আপনার লাগবে?” তারপর ব্যাপারটা জমে ওঠার জন্য কয়েক সেকেন্ড দম নিয়ে বলে, “কিন্তু কেন?”। খোঁচাটা এত পরিষ্কার যে আর কোন কথা না বলে কল কেটে দেয় সাজিয়া। নিজের মায়ের বাড়ি থেকে শুরু করে সব আত্মীয় বন্ধবান্ধবকে ফোন করা হয়। এত অসহায় আগে কখনও বোধ করেনি সে, আবারও দু’চোখ বেয়ে জল নেমে আসে।
কেঁদে কোন লাভ নেই বুঝতে পেরে ঘর থেকে বেরিয়ে কিছু খেয়ে ওষুধগুলো খাবে বলে ঠিক করে সে। অবশ্য কোন কিছুতেই কিছু হয় না। আর কোন পথ না পেয়ে ভাবে এখান থেকেই একটা কাফনের কাপড় কিনে সেটা জমজমের পানিতে ভিজিয়ে যদি পাঠিয়ে দেবে। তাহলে সেটা তো আর মক্কার কাফন হবে না। এমন অতল গহ্বরে পড়ে নিজেকেই অভিশাপ দেয় সে, “ছিঃ সাজিয়া, ধিক্ তোর জীবনে”। ওই মুহূর্তের বেদনা, যন্ত্রণা, অপমান আর অসহায় অবস্থা বর্ণনা করা সম্ভব না।
বিকেল তিনটার দিকে বাড়ি আসে ফরমান। ডাইনিং টেবিলের কাছে গিয়ে সাবাকে জিজ্ঞাসা করে, “আম্মি কোথায়?”। শ্বাশুড়ির মন মেজাজ ভালো নেই সেটা বুঝতে পেরে কোন কথা না বলে চোখ দিয়ে তার ঘরের দিকে ইশারা করে। এক দৌড়ে ভেতরে ঢুকে ফারমান, মা কোন কথা না বললেও চেহারার দিকে তাকিয়েই সবটা বুঝতে পারে। কাছে গিয়ে পাশে বসে বলে, “আম্মি”, ওর হাত ধরে কাঁদার জন্য একটা কাঁধ পায় সাজিয়া। ফরমান সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করলেও সে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। আমার শ্বাশুড়ির মনে এত মায়া যে কাজের মেয়ের মৃত্যুতে এমনভাবে কাঁদছে? ভেবে অবাক হয় সাবা। দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল সে, ফরমান ওকে হাতের ইশারায় চলে যেতে বলে।
সকাল থেকেই সাজিয়ার ওপর বিরক্ত ছিল ফরমান। “ওর রাজি হওয়া ঠিক হয়নি … আর রাজি হলে কথাটা রাখা উচিত ছিল, তাই না? একটা কাফনের কাপড় আনা কী এমন বড় ব্যাপার? সেটাও ওই গরিব বুড়িটার জন্য”। খুব খারাপ লাগে তার। “গত বছর আমি আর সাবা যখন ওমরাহ করতে গেলাম, অন্ততঃ তখন তো আমাদেরকে বলতে পারত আম্মি”। কাফনের কাপড় আনাটা কীভাবে এত বড় একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল সেটা নিয়েই মাকে দু’কথা শুনিয়ে দেওয়ার জন্য এসেছিল সে, তবু কীভাবে যেন নিজেকে সামলে নেয়। সাজিয়ার কষ্ট দেখে খারাপ লাগে তার, সে বলে, “এসব বাদ দাও আম্মি। এরকম অনেক কিছু হয়। মনের ভুলে কিংবা কপালের দোষে। এরকম হতেই পারে। এসব তুমি মনে রেখ না। আমি সকালের আলতাফের বাড়িতে গিয়েছিলাম, দাফনের সব জোগাড়যন্ত্র করে দিয়ে এসেছি। কাফনের কাপড়, আগরবাতি, আতর সবকিছু নিয়ে গিয়েছিলাম। ওর পছন্দমতো জায়গাতেই কবর খোঁড়ার ব্যবস্থা করেছি। গোসলের ব্যবস্থাও করে দিয়েছি। ভেবেছিলাম খাবার খেয়ে তোমাকে নিয়ে যাব। জানি ওখানে না গেলে তুমি শান্তি পাবে না। এসো, আমার সাথে খাবে। তারপর দু’জনে মিলে শেষ বারের মতো ইয়াসিন বুয়াকে দেখতে যাব”।
সাজিয়ার বুকের ভেতরের কষ্টটা আবারও ফুলে ফেঁপে উঠে। ওর সামনে খাবারের প্লেট রাখে ফরমান। কয়েক দানা খাবার মুখে দিয়েই সাবাকে বলে, “তোমার যাওয়ার দরকার নেই। শুধু আম্মি গেলেই হবে”। মা’কে সাথে নিয়ে বেরিয়ে যায়। সে জানে ওখানে গেলে কী হবে। ইয়াসিন বুয়ার মুখের দিকে তাকিয়েই কান্নায় ভেঙে পড়বে আম্মি। সম্ভবত বুয়ার ছেলে আর মেয়ের চেয়েও বেশি কেঁদেছে সাজিয়া। তবু নিজেকে ক্ষমা করতে পারে না। ফরমান বুঝতে পারে এই বিলাপের কোন শেষ নেই।
ওখানে পৌঁছানো পর যেমনটা ভেবেছিল সবকিছু ঠিক সেই রকমই হয়। সাজিয়ার দুঃখের কোন সীমা নেই, কান্নার যেন কোন শেষ নেই। ওর লাল চোখ আর ফুলে ওঠা ঠোঁট দেখে সবাই অবাক হয়ে যায়। এমন বনেদি পরিবারের কাউকে কাজের মহিলার মৃত্যুতে এভাবে কাঁদতে আগে কখনও দেখেনি তারা, অনেকেই ওকে সান্তনা দেয়। ওরা ভাবে, একমাত্র খোদাই জানে এই দু’জনের মধ্যেকার সম্পর্কটা কেমন ছিল। আসল সত্যিটা জানে শুধু সাজিয়া, এখানে শুধু ইয়াসিন বুয়ার দাফন হচ্ছে না, হচ্ছে তার নিজেরও।
দীপা ভাসতি অনূদিত The Shroud গল্পের অনুবাদ। * ভারতীয় অনেক ভাষায় ফুপু বা খালাকে বুয়া ডাকা হয়

আসাদুল লতিফ
লেখক ও অনুবাদক।
প্রকাশিত অনূদিত উপন্যাস: হান ক্যাং-এর “দ্য হোয়াইট বুক” (২০২৫); আব্দুলরাজাক গুরনাহ’র “মেমোরি অব ডিপারচার” (২০২৪); সাতোশি ইয়াগিসাওয়া’র “মোর ডেইজ অ্যাট দ্য মরিসাকি বুকশপ” (২০২৪)। ছোটগল্প: হারুকি মুরাকামি’র “শেহেরজানের অসমাপ্ত গল্প” (২০২৩); বিভিন্ন লেখকের “কিছু বিষাদ উপাখ্যান” (২০২১)। কবিতা: “আরাধ্য সময়” (২০২০)। জন্ম ১৯৭৯ রাজশাহীতে। ঢাকায় কাজ করছেন বেসরকারি ব্যাংকে।