[১]
কুত্তামুখো কি মিষ্টি খাবি বলবি তো আগে! খেঁকিয়ে উঠলো মা। এমনভাবে রাগের প্রকাশ ঘটল যাতে দোকানদার এবং খদ্দেররা বুঝতে না পারে, অথচ শাসানোও গেল।
পাপাইয়ের মুখটা ছোট হয়ে গেল। মনে মনে মিষ্টি খাওয়ার ইচ্ছেটা কেমন জানি চলে গেল ওর। প্রথমে ভেবেছিল গড়াগড়ি দেওয়ার কথা। কিন্তু বাড়ির উঠোনে এই কাজটা যতটা সহজ, এই জনবহুল পরিবেশে তা ততটাই কঠিন। পরিণাম ভাল হবে না। তাই এবার আর টেনে হিঁচড়ে পাপাইকে নিয়ে যেতে হয়নি।
প্রথমে কাতর দৃষ্টি মেলে সে তাকাল মায়ের মুখে, তারপর অসহায়ভাবে কাঙ্খিত মিষ্টিগুলিকে শেষবারের মত দেখে নিজেই সরে এল দোকানের সামনে থেকে। ছেলে কিছু টের পাওয়ার আগেই চোখের কোণে উপচে আসা জল আঁচলে মুছে নিল মা। অভাবী মায়েরা এই বাড়তি প্রতিভা নিয়েই জন্মায়। মা পাপাই এর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল বারদুয়েক। ভয় হল হাত ঠেলে সরিয়ে দেবে না ত! নয়তো দাঁত খিঁচিয়ে গাল দিয়ে ফেলবে কিম্বা শেষপর্যন্ত কাঁদতে কাঁদতে গড়াগড়ি যাবে! কী কাণ্ড করে বসবে কে জানে ? ভিড়ভাট্টায় ছেলেকে মারধর করতেও ভাল লাগে না। পথ চলতি লোকেরা হাঁটাচলা থামিয়ে গোল হয়ে বিনে পয়সার রঙ্গতামাসা দেখতে লেগে যাবে।
বাইরে বেরোলেই প্রতিবার এমন হয়ে থাকে। পাপাই মিষ্টি খাওয়ার জন্য ভয়ানক বায়না করে মাকে নাজেহাল করে ছাড়ে। রাস্তাঘাটে বড় অপমানিত হতে হয়। বাসস্ট্যান্ডের এদিকটায় ফলের দোকানগুলোর কাছে টিনের বোর্ডে বড়বড় করে লেখা ‘গৌরিবালা সুইটস’। গতবছর থেকে মোটামুটি পড়তে শিখেছে পাপাই৷ তার আগে থেকেই অবশ্য কাঁচের খাঁচায় বন্দী মিষ্টিগুলো তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকত। ইচ্ছে করত মিষ্টিগুলোকে নাগালে পেতে। যবে থেকে পড়তে শিখেছে, পাপাই বুঝেছে স্বর্গের আরেক নাম ‘গৌরিবালা সুইটস।’
পাপাইকে মিষ্টি খাওয়াতে আপত্তি নেই মায়ের। কিন্তু দু-তিনটে মিষ্টিতে পাপাইয়ের মন ভরে না। ভীষণ খাইখাই করে। তখনই বিড়ম্বনার সৃষ্টি হয়। এমন হয়েছে একবার। পাপাই খেয়ে যাচ্ছে, আর দোকানদার দিয়ে চলেছে। পুরো কুড়িটাকার মিষ্টি খেয়ে ফেলেছিল সেবার। বাসভাড়া কম পড়ে গেছিল বলে মাকে অনেক কথা শুনিয়েছিলো বাসের কন্ডাক্টর, টাকা নেই তো বাসে ওঠো কেন? আবার সিটে বসে যাচ্ছে ! শালা ভিখারির দল…। শেষের অংশটা স্বগতোক্তি হলেও কথাটা কানে এসেছিল পাপাইয়ের। এতটাই খারাপ লেগেছিল যে মায়ের দেখাদেখি সে ও সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল। বাকিপথ সিট ফাঁকা পড়ে থাকলেও আর বসেনি।
[২]
সারাদিনের কাজ জমে আছে। ঘরদোরে ন্যাতা দেওয়া, গরুকে জাব দেওয়া, হাঁস- মুরগি খাওয়ানো, গোয়ালঘর আর হাঁস-মুরগির ঘর সাফ করা, গোবর থেসে ঘুঁটে দেওয়া, পাতা ঝেঁটানো, কাজের পর কাজ। এগুলো সেরে উঠতে পারলে সুপ্রিয়া কিছুটা হালকা হয়। কাজের ফাঁকে প্রায়ই তাকে পাপাইয়ের খোঁজ নিতে হয়। কোথায় যায়, কী করে তা নিয়ে চিন্তার অন্ত নেই। সাঁতার শিখে গেছে এই রক্ষে।
ডাকাডাকি করতে করতেই সে দেখতে পেল নিতাইদের পুকুরের ওপারে পাপাই আপনমনে খেলছে। কাদা তুলে এনে কী সব বানাচ্ছে। কাছে যেতেই নজরে এল ব্যাপারটা। গোল গোল করে ছোট ছোট কাদার তাল পাকিয়ে তার উপর লাল, হলুদ আর সাদা গুঁড়ো মাখিয়ে মিষ্টি বানিয়েছে। মিষ্টিগুলোকে তিনটে নারকেলের খোলায় আলাদা করে রেখে পুকুর থেকে হাতের আঁজলায় জল এনে ঢেলে দিলো প্রতিটা খোলায়। পরের ঘটনায় সুপ্রিয়ার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। তালপাতার চামচে কাদার মিষ্টিগুলো মুখের কাছে তুলে ধরছে পাপাই আর চাকুম চুকুম শব্দ করে খাওয়ার অভিনয় করছে। সুপ্রিয়া আঁচলে চোখ মুছল। পাপাইয়ের কাছে গিয়ে স্নেহভরে ডাকল, কী করতিছিস বাবা ?
লাজুক হেসে জানালো, ‘মিষ্টি বানাইতিছি মা।
এরপর গৌরিবালা সুইটস এর কর্মচারির মত বলতে শুরু করল, এইটেয় রসগল্লা, ওইটেয় লাল মিষ্টি, আর সেইটেয় হলদে মিষ্টি।
সুপ্রিয়া জিজ্ঞেস করল, ‘তুই হলদি গুঁড়ো কথায় পেলি? আর খড়ি ভেঙে রসগল্লা বাইনেছিস?’
পাপাই ভীষণভাবে প্রতিবাদ করে উঠল, না, না, একদোম না। পিঙ্কুর দকানের বাইরে হলদি গুঁড়োর ফাটা প্যাকেট পড়ে ছিল। আর মুই খড়ি ভাঙিনি, এইটে চকের গুঁড়ো। ইস্কুল থেকে চক এনেছিলুন।
আচ্ছা অনেক খেলা হইছে, এইবার চান করে লে বাপ৷
আমি আরও খ্যালবো মা। এখন গা ধুবোনি।
বেলা বয়ে যেচছে, আমাকে তো সব কাজ সেরতে হবে৷ তোকে গা ধুবাবো কখোন? মায়ের স্নেহভরা কথায় পাপাই খুব খুশি হল। তাই কথা না বাড়িয়ে নারকেলের খোলা তিনটে সরিয়ে রেখে বাধ্য ছেলের মতো মায়ের সঙ্গে চলল তালপুকুরের দিকে।
[৩]
পাপাই যেদিকেই তাকায় মিষ্টি দেখে। গাবতলায় মোড়লপাড়ার ছেলেরা মার্বেল খেলে। সেখানে খেলা দেখতে দেখতে মার্বেলগুলো তার রসগোল্লা মনে হয়। নদীর ধারে সারি সারি পিটলি গাছে যেন ঝুলে থাকে অগুনতি মিষ্টি। নিজেকে অসুখী মনে হয়। শুদ্দু আলুভর্তা-ভাত খেয়ে ওকে থাকতে হয়। মা কি রসগোল্লা বানাতে পারে না ? সেটা কি ডাল রাঁধার থেকেও অনেক কঠিন ?
পাঁচুর বাবা পরশুদিন কাজ থেকে ফিরেছে। ফেরার সময় মিষ্টি এনেছিল৷ সন্ধ্যাবেলা খেলা শেষে শিবুদার সঙ্গে ঘরে ফেরার সময় পাচুদের ঘরের পাশ দিয়েই আসছিল। গন্ধটা তখনই পেয়েছিল পাপাই। উঠোনে শিবুদা তাকে ছেড়ে দিতেই সে ঘুরপথে দৌড় লাগাল। পা টিপে টিপে ও বাড়ির কাঁদালে ঢুকে উঁকি মারার চেষ্টা চালাল। জানালাটা বড্ড উঁচু। দু পায়ের বুড়ো আঙুলে ভর দিয়ে দাঁড়াতে ভিতরটায় এক মুহূর্তের জন্য চোখ পড়ল। ঘরের মাঝখানে পাঁচু আর তার ছোট বোন। সামনে খোলা মিষ্টির প্যাকেট। তিন চার রকমের তো হবেই। কী আনন্দ করে খাচ্ছে দুজনে ! দেখেই মনটা খারাপ করল পাপাইয়ের।
রাতে ভাল করে খাবার গেল না পেটে। ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখতে লাগল। কী বড় মিষ্টির দোকান! কাঁচের ঘেরাটোপে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হরেকরকম মিষ্টি। টেবিলে নক্সা করা বাটিতে তার পছন্দের সব মিষ্টি। দোকানের কাকুটা ডাকছে, ‘আয়, ভিতরে আয় খোকা। যত খুশি মিষ্টি খা, পেট ভরে খা, কোনও টাকাপয়সা লাগবে না।’
পাপাই মিষ্টির কথা ভাবছে, জিভে জল এসেছে। কিন্তু মায়ের মুখটা ভেসে উঠছে তার মনে। ভিতরে যাবে কি যাবে না সেটা বহু চিন্তা করেও ঠিক করতে পারছে না।
পরদিন ভোর হতেই চুপি চুপি দরজা খুলে সে বেরিয়ে পড়ল। পাঁচুদের বাড়ির পিছনে আসতেই চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল । খালি প্যাকেটখানা পড়ে আছে পুকুরপাড়ে। পাপাই প্যাকেটটা তুলে উলটে দেখল। যা ভেবেছিল তাই। মিহিদানা। দু’চারদানা অবশিষ্ট আছে প্যাকেটে লেগে। আর গোটা কয়েক ঝরা বাঁশপাতার উপর পড়ে আছে। খুঁটে খুঁটে তুলে গুনে দেখল সে। মোট ন’খানা। ঠাকুরের প্রসাদ মনে করে তিন আঙুলে চেপে এবার পেটে চালান করে দিল।
[৪]
পাঁচুর সঙ্গে খেলা করায় মায়ের বারণ নেই। কিন্তু তার হাতের কাঠিগজার ভাগ চাওয়ায় ভয়ানক আপত্তি মায়ের। পাঁচু বেশ ভালো। একবার লুকিয়ে বট পাতায় মুড়ে তাকে দানাদার এনে ধরিয়েছিল। আনোয়ারদের বাড়ির পাশে করঞ্জাতলায় বসে চুপি চুপি সাবাড় করে দিয়েছিল পাপাই।
ঘুঁটে বেচার কিছু টাকা পেয়েছে সুপ্রিয়া। তা দিয়ে এক পো দুধ আনিয়েছে। ছানা কাটিয়ে চিনি দিয়ে পাপাইকে দেবে। মাঝেমধ্যে নারকেলের নাড়ু করে দেয়৷ কিন্তু তাতেও মন ভরে না পাপাইয়ের। ডিম বেচে সংসারে দুটো পয়সা আসে। এছাড়া হাঁস মুরগি বেচলেও কিছু লক্ষ্মীলাভ হয়। নিজের জন্য শাড়ি-চুড়ি কিছুই কেনেনি বহুকাল।
বিকাশের বউ বাসন্তী সেবার বলছিল রাঁধুনির কাজের কথা৷ কলকাতায় বালিগঞ্জে গিয়ে থাকতে হবে বাবুদের বাড়িতে। থাকা-খাওয়া সব ফ্রি। মাইনে দেবে, বাচ্চার পড়ার ব্যবস্থা করে দেবে। তার কোন ননদ কাজ করে। প্রস্তাব শুনে সুপ্রিয়া যে একবারও যে ভাবেনি তা নয়৷ কিন্তু ভিটেমাটির মায়া, মাথার উপর খড়ের চাল ছেড়ে যাওয়ার মতো শক্ত হৃদয় তার নেই৷ সম্পত্তির ভাগাভাগি হয়নি। সুপ্রিয়া এটাও জানে শ্বশুরবাড়ির যেটুকু সামান্য জমি, ভিটেমাটিটুকু ছাড়া আর কিছুই পাবে না। ভাসুর-জা তাকে বঞ্চিত করবে। তবু স্বামীর শেষ স্মৃতিচিহ্ন ছেড়ে যেতে পারে না৷ চোখের সামনে এমন ধানভরা জমি, পুকুর, আম, জাম, তাল, বট, ক্ষীরিশ, পিটলি গাছ- যেখানে তার কোনো অধিকারের প্রশ্নই নেই; তবুও সেসব ছেড়ে যাওয়ার কথা সে ভাবতেও পারে না।
[৫]
ঘোষেদের জামাই এসেছে। ওদের জামাই এলেই মিষ্টি নিয়ে আসে। বাটিতে করে দুটো মিষ্টি দিয়ে গেছে মিনতির মা। একটা রসগোল্লা আরেকটা পান্তোয়া। সুপ্রিয়া তুলে রাখল পাপাইয়ের জন্য। বিকেল গড়িয়ে গেল। উঠোনে পায়ের আওয়াজ কানে আসতেই সুপ্রিয়া ডেকে উঠল, ‘পাপাই ঘরকে এলি বাপ?’
কী মা?
এই দ্যাখ কী আছে তোর জন্যে?
এই ডাক পাপাইয়ের চেনা। কিছু পাওয়ার সম্ভাবনায় তার মনে জাগল চাপা রোমাঞ্চ। হাত-পা না ধুয়েই সে এক লাফে দরজা ডিঙিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ল। সুপ্রিয়া সবে বাটিটা হাতে ধরেছে, ঝড়ের মতো উপস্থিত হয়ে বাটিটা ছিনিয়ে নিয়েই নেচে উঠল আনন্দে। ‘রসগল্লা’ বলে চেঁচিয়ে উঠে গপ করে গিলে নিল সেটা। বাটির তলায় লেগে থাকা রসটুকু সশব্দে টেনে নিয়ে নামিয়ে রাখল বাটিটা। পান্তোয়াটা একেবারে খেল না। দুই আঙুলে চেপে চুষে অনেকক্ষণ ধরে খেতে লাগল।
‘আর কই?’ প্রশ্ন করল পাপাই। ঠিক এই ভয়টাই পাচ্ছিল সুপ্রিয়া। ‘আর কথায় পাবো বাবা? মিনতিদের জামাই আসছিলো তাই মিষ্টি দিয়ে গেসলো।’ সাফাই দেওয়ার চেষ্টা করল সে।
পাপাইয়ের বিশ্বাস হল না প্রথমটায়। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে মায়ের মুখ লক্ষ্য করে শেষ পর্যন্ত যখন সে বুঝল মায়ের কথাই ঠিক; তার জন্য বরাদ্দ মাত্র দুটিই, তখন সে আর স্থির থাকতে পারল না।
‘আমি কিচ্ছু জানিনি। আমার আরও মিষ্টি লাগবে’ বলেই অন্যায় আবদার জুড়ল। তার ভাবগতিক ভাল লাগল না সুপ্রিয়ার। প্রবল বিক্ষোভে কান্নায় ফেটে পড়ল পাপাই। এক ছুটে উঠোনে বেরিয়ে এল। কিছু বলার আগেই সুপ্রিয়া দেখতে পেল পাগলের মতো মাটিতে গড়াগড়ি যাচ্ছে পাপাই। খালি গা, ঘামে ভরা। সর্বাঙ্গে লেপে যাচ্ছে গোবর আর ধুলো।
‘উঠ পাপাই। অমন করিসনি, বলছি তো কিনে দুবো মিষ্টি।’
পাপাই গড়াগড়ি যেতে যেতে অভিযোগ করল ‘মিষ্টি কিনে দিবে বলে তুমি দাউ না।’
‘এবারে দুবখন, উঠে পড় বাপ।’
পাপাই এই প্রতিশ্রুতি আগেও পেয়েছে। কাজের কাজ কিছু হয়নি। আরও ক্ষেপে উঠল সে।
‘মিষ্টি চাই আমার, এখখুনি দাউ’ গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে লাগল। সুপ্রিয়া তাকে টেনে তুলতে যেতেই রাগে অন্ধ হয়ে সে বিশ্রী গালি দিয়ে ফেলল।
ততক্ষণে লোকজন জড়ো হয়েছে৷ পাড়াশুদ্ধ লোকের সামনে ছেলের এমন অবাধ্যতা, লুটোপুটিতে সুপ্রিয়ার লজ্জায় মাথা কাটা গেল। ঘোষেদের জামাইটাও ছুটে এসেছে। সুপ্রিয়ার ভীষণ রাগ চড়ে গেল। সামনে উঠোনে একটা মোটা বাঁশের কঞ্চি পড়ে ছিল। দেখতে পেয়েই সেটা হাতে তুলে নিল। নিষ্ঠুরভাবে পাপাইকে পেটাতে লাগলো।
‘ওলাউঠা তোকে আজ মেরেই ফেলবো। তোর জেদ বাড়তেছে দিনে দিনে। কথা শুনা যায় না…।’
[৬]
রাতে ভাত খেল না পাপাই। গা ধুয়ে মুছে দিতেই সে বিছানায় উপুড় হয়ে পড়েছিল। সুপ্রিয়ার আদর ভালবাসা কোনও কিছুকেই পাত্তা দিল না। এমনকি কোনও কথার উত্তরও দিল না। রান্না হয়ে যেতেই সুপ্রিয়া ঘুমন্ত পাপাইকে জাগিয়ে তুলল, মুখে ভাত গোঁজার চেষ্টাও করল; কিন্তু ছেলের মন গললো না। হাল ছেড়ে সে দোরগোড়ায় বসে রইল অনেকক্ষণ। শেষে দু গ্রাস নিজে খেয়ে শুয়ে যাবে মনস্থির করল। সেই দুপুরে ভাত খাওয়া। থালা হাতে তুলতেই তার মনে হল সে বড় স্বার্থপর। ছেলে না জানি পেটে কত খিদে নিয়ে ঘুমিয়েছে আর সে একা খেয়ে নিচ্ছে! থালা ঢাকা দিয়ে দরজায় খিল এঁটে দিল। শোয়ার আগে লণ্ঠনটা হাতে নিয়ে বিছানার দিকে এগিয়ে আসতেই তার চোখ জলে ভরে এল। পাপাইয়ের সারা শরীরে কালশিটের দাগ। এ কী করল সে? মা হয়ে ছেলেকে এমন করে মারল! শ্যামলীর মা এসে না ছাড়ালে আরও মার খেত পাপাই।
গায়ে হাত বোলাতে গিয়ে দেখল পাপাইয়ের গা গরম। মনেহল যেন জ্বর এসেছে। পাপাইকে টেনে তোলার সময় সে কাঁপছিল।
সকালে ঘুম ভাঙতেই সুপ্রিয়া পাপাইয়ের মাথায় হাত রাখল। গা গরম। নিশ্চিতভাবেই জ্বর এসেছে।
ডাক্তার এল। এমাসের জমানো কুড়ি টাকা ডাক্তারের হাতে ধরিয়ে দিতে হল। ভিজিট আর ওষুধপাতি মিলিয়ে খরচ পঞ্চাশের উপরে। পরিস্থিতি ঠাওর করে জয় ডাক্তার কোনও জোরাজুরি করল না। যাবার সময় বলে গেল চান করা, ভাত খাওয়া বন্ধ রাখতে হবে।
[৭]
রাতে জ্বরের ঘোরে স্বপ্ন দেখল পাপাই। অনেক দূর থেকে কে যেন তাকে ডাকছে, ‘আয়, চলে আয়।’ পাপাই বুঝতে পারছে সেখানে শুধুই মিষ্টি। নানা রকমের গাছ আর গাছে ফলের মতো ঝুলে আছে কত মিষ্টি। লাল, সবুজ, সাদা, হলুদ…কত না জানা রঙ। জায়গাটা অনেক অনেক উপরে, মেঘেদের পেরিয়ে যেতে হবে। রাস্তাও তার চেনা। সে হাঁটা শুরু করল। তাদের পাড়া ফেলে বাঁধ। বাঁধ থেকে নেমে ধান জমি। সরু মেঠো রাস্তা। পথ শেষ হয়েছে নদীর কাছে। পাড়ে কয়েকটা ভাঙা কলসি পড়ে। সে চমকে উঠল। কোথায় এল তবে? বাবাকে এখানেই পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। পাপাই ভাবল, তার মা কীভাবে তাকে ছাড়া বাঁচবে। মিষ্টি না মা, ভাবতে ভাবতেই যেন কে তাকে টেনে নিচ্ছে অন্য এক পৃথিবীর দিকে। সে প্রাণপণে চেঁচিয়ে ডেকে উঠল ‘মা।’
সুপ্রিয়ার তন্দ্রা ছুটে গেল। অন্ধকারে পাপাই ভয়ার্ত গলায় ডাক শুনে চমকে পাপাইয়ের মুখের উপর ঝুঁকে পড়ল।
কী রে বাপ? কী হইছে?
জল খাবো মা।
-আচ্ছা দিচ্ছি!
জলের গ্লাস নামিয়ে শান্ত ভাবে প্রশ্ন করল পাপাই, ‘মা, অসুখ কি সারবেনি?’
সুপ্রিয়া তার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, ‘সারবে বাপ, সারবে।’
পাপাই খুশি হল না। আবার জিজ্ঞেস করল, ‘সত্তি সারবে তো?’
– সেরি যাবে রে। অমুন দামী ওষুধ। না সেরি যাবি কুথায়।
পাপাই দেখল মায়ের চোখ যেন ভেজা ভেজা। তার মনেহল মায়ের কান্নার কারণ সে নিজেই। দুহাতে মায়ের গলা জড়িয়ে সে আস্তে আস্তে বলল, ‘তুমি আর কেঁদোনি মা। আমি আর মিষ্টি খেতে চাইবোনি।’
‘চুপ কর বাপ’ বলেই ছেলের মাথা বুকে টেনে নিয়ে সুপ্রিয়া বলল, ‘ঠাকুরের দয়ায় আগে ভাল হয়ে যা। তারপর কত মিষ্টি খাবি তুই আমি খাওয়াবোখুন।’
দুপুরে ছেলেকে চিঁড়ে সেদ্ধ খাওয়ালো। সারাদিন প্রায় না খেয়েই কাটলো সুপ্রিয়ার। সব কাজ ফেলে ছেলের কাছে শুয়েই ছিল। বিকেলের দিকে কাপড়ের পোঁটলায় থালা বেঁধে ভাত দিয়ে গেল মনির মা৷ পাপাইকে ডাকতেই সে অসম্মতি জানাল। জড়ানো গলায় বলল, ‘খাবনি।’
‘একটুকুন খেয়ে লে বাপ। না খেলে গায়ে জোর পাবিনি।’ জোর করে তার মুখে ভাত গুঁজে দিল সুপ্রিয়া। দু’তিনবার আধচেবানো ভাত গিলেই পাপাই অনিচ্ছা দেখিয়ে আবার গড়িয়ে পড়ল বিছানায়। হাতের চেটোয় জল ঢেলে সুপ্রিয়া পাপাইয়ের ঠোঁটে বুলিয়ে দিল দুবার।
(৮)
‘ছেলে কেমুন আছে রে?’ মনির মা প্রশ্ন করল।
-ভালো নাই গো দিদি। গা এখুনো গরম। ছেলে আমার খুব কষ্টে আছে।
সুপ্রিয়ার শুকনো মুখ দেখে মায়া লাগল মনির মায়ের। ‘সেকি রে? অমুন দামী ট্যাবলেট কেপসুল খেচছে তাও কমেনি জ্বর?’
নিম গাছে গরুর খুঁটো-দড়ি বেড় দিয়ে সে উঠে এল চৌকাঠে। আঁচলে হাত মুছে পাপাইয়ের কপালে রেখেই বলে উঠল, ‘ওঃ, গা পুড়ে যেচ্ছে রে জ্বরে।’
আবার ডাক্তার এল। কানে শোনার যন্ত্র দিয়ে পাপাইয়ের বুকের গতি মাপল। জিভ দেখল। তারপর মিটার দেখতে দেখতে গম্ভীর হয়ে বলল ‘জ্বর বেড়েছে।’
‘ও ডাক্তারকাকু, ছেলের আমার জ্বর কমতিছে না কেন?’ সুপ্রিয়া উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল।
কমবে, কমবে একটু সময় তো দিতে হবে।
তিনদিন হয়ে গেল, আর কত দিন লাগবে সারতে?
কথাটা ভালো লাগল না জয় ডাক্তারের। কিছুটা বিরক্ত হল সে। ব্যাগ থেকে লাল রঙের একপাতা ট্যাবলেট বের করে কাঁচি দিয়ে কেটে চারখানা রাখল সুপ্রিয়ার হাতের কাছে। বলল, ‘নতুন ওষুধ দিলুম, সেরে যাবে’।
ডাক্তার চলে যেতে সুপ্রিয়া গামলায় জল আনলো। তারপর গামছা এনে পাপাইয়ের মাথা ধুইয়ে দিল। দুপুরে খাইয়ে দিয়ে পাপাইকে আদর করে ডাকল সুপ্রিয়া। ‘পাপাই সোনা, এই দ্যাখ কী? মায়ের হাতের তালুতে একবার তাকিয়ে দেখল পাপাই। সুপ্রিয়া তাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে আশ্বস্ত করে বলল, ‘এই তোর ওষুধ, এইটে খেলেই মেজিকের মতো জ্বর চলে যাবে।’
সেদিনটা কেটে গেল। অবস্থার উন্নতি হল না। নিজের ভাগ্যকেই দুষতে থাকলো সুপ্রিয়া৷ বাবা-মায়ের অমতে বিয়ে করে একবার সে বাপের বাড়ির চক্ষুশূল হয়েছে, দ্বিতীয়বার হয়েছে পুনরায় বিয়ে না করার জন্য৷ দ্বিতীয় বিয়ে করলে হয়ত তার জীবন কিছুটা সুখের হত, কিন্তু অকালে চলে যাওয়া ভালোবাসার মানুষটার স্মৃতি আর পাপাইয়ের কথা ভেবে বিয়েতে রাজি হয়নি। বিধবার কাছে ছেলেই সব। দু-তিনবার ভাই লুকিয়ে দেখা করতে এসেছিল। তা নিয়ে মা-বাবার সঙ্গে অশান্তি হওয়ায় সে’ও আসা ছেড়ে দিয়েছে।
পরেরদিনও খাওয়া দাওয়া ফেলে জল পট্টি দিয়ে গেল পাপাইয়ের কপালে। জ্বরে প্রায় অচেতন হয়ে পড়ে থাকল পাপাই।
সন্ধে নেমে এল। শাঁখ বাজিয়ে তুলসি মঞ্চে ঠাকুর প্রনাম করবার সময় সুপ্রিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলে চলল, ‘ছেলেটাকে ভাল করে দাও গো ঠাকুর; মুখ তুলে চাও একবার।’
মায়ের গলা শুনে জ্বরের ঘোর কাটিয়ে অন্ধকারে চোখ মেলে একবার পাপাই জিজ্ঞাসা করল, ‘মা, আমার ওষুধ এসছে?’
সুপ্রিয়া লন্ঠন মুছে কেরোসিন ঢাললো। আগুন ধরাল পলতেয়। দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখতেই কার ডাকে সে চমকে উঠল। তক্ষুনি লন্ঠন পেড়ে নিয়ে দরজার বাইরে আসতেই অতিথির মুখে আলো পড়ল। আশ্চর্য হয়ে গেল সুপ্রিয়া। বিমল এসেছে!
‘এসছিস ভাই!’ কেবল এটুকুই বলতে পারল। আনন্দে তার মুখে আর কোনও কথাই বেরল না।
প্রায় বছর হয়ে গেল ভাইবোনে দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। বিমল কীভাবে কথা শুরু করবে ঠিক করে উঠতে পারছিল না। সে দিদির মুখে চোখে এমন খুশি দেখে অবাক হয়ে গেল।
‘কেমন আছিস দিদি?’
আমরা ভাল নেই ভাই।
কেন? কী হইছে?
‘পাপাইয়ের জ্বর। আজ চার দিন হল। অসুখ সারছেনি। ওষুধে কুনো কাজ হছছেনি।’ কাঁদো কাঁদো গলায় সুপ্রিয়া বলে উঠল।
বিমল উদ্বিগ্ন মনে ঘরে ঢুকল। ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘সে কি! তাহলে সকাল হলেই পাপাইকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।’
ঘরে কথাবার্তা শুনে পাপাই টের পেল কেউ এসেছে। পিটপিট করে চাইল। কিন্তু অতিথিকে চিনতে পারল না। লোকটার হাতে একটা ঝোলা। সে মাথার কাছে বসল। তারপর তার কপালে হাত রাখল। একটা সুগন্ধ ভেসে পাপাইয়ের নাকে প্রবেশ করতেই তার ঝিমুনি ভাব কেটে গেল। সে আরেকবার চাইল। ভালো করে দৃষ্টি ফেলতেই দেখল ঝোলার ভেতর থেকে উঁকি মারছে একটা প্যাকেট। লন্ঠনের নিভু নিভু আলোয় পাপাইয়ের দৃষ্টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে বুঝতে পারল তার ওষুধ এসেছে! প্যাকেটের গায়ে বড়বড় করে লেখা – ‘গৌরিবালা সুইটস।’