Home » গাজায় ইজরায়েলী গণহত্যা: বৃহত্তর ঔপনিবেশিক ফ্যাসিস্ট প্রকল্প // নজরুল আহমেদ জমাদার

গাজায় ইজরায়েলী গণহত্যা: বৃহত্তর ঔপনিবেশিক ফ্যাসিস্ট প্রকল্প // নজরুল আহমেদ জমাদার

না, ফিলিস্তিনে কোন যুদ্ধ চলছে না। চলছে হত্যাযজ্ঞ। চলছে শিশু হত্যা, চলছে নারী হত্যা, প্রাণ প্রকৃতির হত্যা। এবং এটা একপাক্ষিক। বিশ্বের পরাক্রমশালী শক্তি আমেরিকার মদতে ইজরায়েলি বাহিনী কোনরকম বাধা ছাড়াই মানুষ হত্যার খেলায় মেতেছে। লক্ষ্য হলো পুরো একটা জাতিকে শেষ করে দেওয়া। আর গোটা  আরব ভূমিতে আমেরিকার আধিপত্য আরও দৃঢ় করা। গোটা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় উন্মুক্ত বন্দিশিবির এখন গাজা উপত্যকা, যেখানে ২০ লাখের বেশি মানুষ দিনযাপন করছে অবরোধ, খাদ্য সংকট, বিদ্যুৎ ও পানির অভাবে। ২০০৭ সাল থেকে ইজরায়েল গাজাকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে, এবং নিয়মিত বোমাবর্ষণ, হত্যা, কাঠামো ধ্বংস ও শিশু হত্যার ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে।  ২০১২ সালে জাতিসংঘ তার একটা  রিপোর্ট জানিয়েছিল:  “Gaza could become unlivable by 2020 if current trends continue.” অথচ গাজার উপর ইজরায়েলের নিষ্ঠুরতা  আজও চলমান।

 ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে হামাসের হামলার জবাবে ইজরায়েল গাজায় ব্যাপক সামরিক অভিযান শুরু করে, যা দ্রুত গণহত্যার রূপ নেয়। ইজরায়েলি বাহিনী হাসপাতাল, স্কুল, মসজিদ ও বেসামরিক আবাসিক এলাকা লক্ষ্য করে বোমাবর্ষণ করে, যা যুদ্ধাপরাধের শামিল।  চলতি বছরের ১৮ ই মার্চ যুদ্ধ বিরতি লংঘন করে ক্রমাগত গাজাতে আক্রমণ চালাচ্ছে ইজরায়েলি বাহিনী। এপ্রিল মাসে গাজাতে ইজরায়েল যে “কার্পেট বোম্বিং” চালিয়েছে তাতে ক্রমাগতই ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলেছে সমগ্র ফিলিস্তিন। ইজরায়েল এই ঘটনাকে ” হামাস নির্মূলের অভিযান বললেও আসলে এটি দীর্ঘদিনের একটি জাতি নিধনের ( ethnic cleansing) পরিকল্পনা। এই বৃহৎ পরিকল্পনার বর্তমানে অংশ হিসেবে কাজ করছে ডোনাল্ড ট্রাম্প, বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ও নরেন্দ্র মোদির ফ্যাসিস্ট ঐক্য। এই ফ্যাসিস্ট ঐক্যের একটা অন্যতম সাধারণ ভিত্তি হল বিশ্বব্যাপী ” ইসলামোফোবিয়া” সৃষ্টি করা। কিন্তু বিশ্বের বাম, প্রগতিশীল, গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষ শুধু কি বিষয়টাকে ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখবে? ব্যাপারটা ঠিক তেমন না। ফিলিস্তিনের উপর ইজরায়েলের দখলদারি ও সেখান থেকে  একটা জাতিকে নিধনের পরিকল্পনাকে আসলে একটি দীর্ঘ ঐতিহাসিক সাম্রাজ্যবাদী প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা হিসেবেই দেখতে হবে।

গাজাতে ইজরায়েল বাহিনী যে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে, এবং ইজরায়েল প্যালেস্টাইনের যে সমস্যা সেটা বুঝতে গেলে ইজরায়েল রাষ্ট্র তৈরীর ইতিহাস এবং তার সঙ্গে যুক্ত উগ্র জাতীয়তাবাদী ধারণা “জায়নবাদকে” বুঝতে হবে।  “প্যালেস্টাইন” অঞ্চলটি ৪০০ বছর ধরে  অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। সেই  সময়ে সেখানে মুসলমান, খ্রিস্টান ও ইহুদি জনগোষ্ঠী একসঙ্গে বসবাস করত। অঞ্চলটি ছিল একাধিক জাতিগোষ্ঠীর মিশ্রিত এবং তুলনামূলক শান্তিপূর্ণ জনপদ।  প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমানরা জার্মানির মিত্র ছিল, এবং তারা পরাজিত হয়। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ বাহিনী জেরুজালেম দখল করে, এবং প্যালেস্টাইন অঞ্চলকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়। এই ৪০০ বছর ধরে তখন গোটা ইউরোপ জুড়ে  ইহুদিরা জাতিগত বিদ্বেষ এবং আক্রান্তের শিকার হন।  ওই বছরই অর্থাৎ ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বেলফোর একটি চিঠিতে ফিলিস্তিনে “ইহুদিদের জন্য একটি জাতীয় বাসস্থান” প্রতিষ্ঠার সমর্থন জানান। এই  ঘোষণার পর থেকেই হাজার হাজার ইউরোপীয় ইহুদি প্যালেস্টাইনে অভিবাসন শুরু করে। তখন থেকেই  স্থানীয় আরবরা তাদের জমি হারাতে শুরু করে। এর প্রতিবাদে ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৯ পর্যন্ত  ফিলিস্তিনিরা বিদ্রোহ করে। কিন্তু প্রতিটি বিদ্রোহই বলপূর্বক দমন করে ব্রিটিশ ও ইজরায়েল বাহিনী। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ একটি পরিকল্পনা  গ্রহণ করে।  যেখানে প্যালেস্টাইনকে দুটি ভাগে ভাগ করার প্রস্তাব দেয়া হয়। এক ভাগে হবে ইহুদি রাষ্ট্র, যারা পাবে ৫৫% ভূখণ্ড। অন্য ভাগে হবে আরব রাষ্ট্র, যারা পাবে ৪৫ % ভূখণ্ড। আর জেরুজালেম থাকবে আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণে। ফিলিস্তিনিরা এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে কারণ তারা তখনো জনসংখ্যায় সংখ্যাগরিষ্ঠ (৬৫%) হওয়া সত্বেও তাদের দেওয়া হচ্ছে কম জমি। তাদের এই যুক্তি ছিল যথার্থ। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের মতামতকে কোনোও গুরুত্ব না দিয়েই প্রায় জোর করে ১৯৪৮ সালের ১৪ মে নতুন ইজরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম হয় প্যালেস্টাইন ভূমিতে। অর্থাৎ ইজরায়েল রাষ্ট্রের জন্মই হলো আরব ভূমি দখলের মাধ্যমে।  তারপরেই  আরব রাষ্ট্রগুলি ইজরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে কিন্তু ইজরায়েল বিজয়ী হয়। ফিলিস্তিনিদের জীবনে মহাবিপর্যয় নেমে আসে যেটাকে আরবি ভাষায় বলে ‘নাকবা ‘ । এই সময় প্রায় ৮ লাখ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়।

কিন্তু এই ইজরায়েল রাষ্ট্র তৈরীর পেছনে উগ্র জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ জায়েনবাদের একটা বড় ভূমিকা আছে। “জায়ন” শব্দটি এসেছে হিব্রু ভাষা থেকে। এটি মূলত প্রাচীন জেরুজালেম শহরের একটি পাহাড় যেটিকে ইহুদি ধর্মগ্রন্থে  আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক মুক্তির প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। আধ্যাত্মিকভাবে ইহুদিরা বিশ্বাস করে  “জায়ন” মানে ঈশ্বরপ্রদত্ত ভূমি, যেখানে ইহুদি জাতি একদিন ফিরে যাবে এবং ধর্মীয় ও জাতিগত শুদ্ধতা প্রতিষ্ঠা করবে। ধীরে ধীরে “জায়ন” হয়ে ওঠে সারা জেরুজালেম শহরের প্রতীক এবং পরবর্তী কালে পুরো ইজরায়েল জাতির ভূমি ও আত্মপরিচয়ের প্রতীক। উনিশ শতকের শেষ দিকে, ইউরোপে যখন ইহুদি জাতিগোষ্ঠী নিপীড়নের শিকার হচ্ছিল, তখন জায়ন  শব্দটি আধ্যাত্মিক অর্থ ছাড়িয়ে একটি রাজনৈতিক প্রতীক হয়ে ওঠে। এই ভিত্তিতে গড়ে ওঠে জায়নবাদ। যার  রাজনীতিক উদ্দেশ্য ছিল “Return to Zion”।  এটার মর্মকথা হলো “জায়ন”-এ (প্যালেস্টাইন অঞ্চলে) ফিরে গিয়ে একটি স্বতন্ত্র ইহুদি জাতিরাষ্ট্র গঠন করা। সেই ধর্মীয়-রাজনৈতিক চিন্তার আধুনিক, আগ্রাসী এবং উপনিবেশবাদী রূপই আজ আমরা জায়নবাদ হিসাবে দেখছি। এটা বুঝতে হবে যে জায়নবাদের ইতিহাস আসলে আধুনিক ইউরোপের  উপনিবেশ ও জাতিবাদেরই ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত। যেখানে গোটা ইউরোপজুড়ে খ্রিস্টীয় ঘৃণা ও সন্ত্রাসের শিকার ইহুদীরা। খ্রিস্টীয় রাষ্ট্র ও সমাজের অতি সাম্প্রদায়িক নীতি ” রাজার ধর্মই প্রজার ধর্ম ” ইহুদি সম্প্রদায়কে কোণঠাসা করেছিল। অর্থাৎ আধুনিক ইউরোপীয় ইতিহাসেরই অংশ জায়নবাদ। জাতিবাদের পরস্পর বিরোধী প্রবণতা জায়েনবাদকে বেড়ে উঠতে সহযোগিতা করেছে। ইউরোপে ইহুদি নিপীড়ন ও জাতিগত বিদ্বেষ  বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে থিয়োডোর হার্জেল  নামে একজন অস্ট্রিয়ান ইহুদি রাজনৈতিক চিন্তক ১৮৯৭ সালে “জায়নবাদ” মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।  তাঁর মতে,ইহুদি জনগণের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠন করা উচিত, যেখানে তারা নিরাপদে বসবাস করতে পারবে। নানান ভাবনার পর তিনি প্যালেস্টাইনকেই সেই “জাতিরাষ্ট্র” স্থাপনের উপযুক্ত স্থান বলে চিহ্নিত করেন। যদিও পরবর্তীকালে জায়নবাদ  আরো উগ্র জাতিবাদী ধারণায় পরিণত হয়। যেখানে বিশুদ্ধ রক্ত, ও বিশুদ্ধ জাতির ধারণা তৈরি  হয়।

১৯৪৮ সালে ইজরায়েল  নতুন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পরপরই ফিলিস্তিনিদের আরও বেশি জমি দখল করতে থাকে। ১৭৬৭ সালে ইজরায়েল  মাত্র ছয় দিনের যুদ্ধে মিশর, সিরিয়া ও জর্ডানকে পরাজিত করে। দখল করে নেয় ওয়েস্ট ব্যাংক, গাজা , গোলান হাইটস  ও পূর্ব জেরুজালেম।

রাষ্ট্রপুঞ্জ এই সব দখলকৃত অঞ্চল থেকে  সরে যেতে বললেও ইজরায়েল তা মানেনি। এরপর যতবারই ফিলিস্তিনি জনগণ তাদের প্রতিরোধ চালিয়ে যান ততবারই ফিলিস্তিনি জনগণের উপর অত্যাচার নেমে আসে। ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তির মাধ্যমে ইজরায়েল ও পিএলও (ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থা) একে অপরকে স্বীকৃতি দেয়। গাজা ও ওয়েস্ট ব্যাংকে স্বশাসনের কথা বলা হয়, কিন্তু ইজরায়েল নিরাপত্তার অজুহাতে সেনা ও বসতি স্থাপন বজায় রাখে। ২০০৫ সালে গাজা থেকে সেনা  প্রত্যাহার করলেও স্থল, জল ও আকাশপথে সম্পূর্ণ অবরোধ আরোপ করে। ২০০৬ সালে হামাস গাজায় নির্বাচনে জয়লাভ করে। ইজরায়েল ও পশ্চিমারা এটিকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলে বিবেচনা করে।

ইজরায়েল আজও রাষ্ট্রপুঞ্জের ১৯৪৭ সালের দ্বি-রাষ্ট্র নীতি কার্যকর করেনি। ওয়েস্ট ব্যাংকে অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপন অব্যাহত রেখেছে। জেরুজালেমকে একক রাজধানী ঘোষণা করেছে, যা আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ। রাষ্ট্রপুঞ্জের বহু প্রস্তাব  অমান্য করেছে। কিন্তু কেন ইজরাইল রাষ্ট্র অবৈধভাবে একটা ভূমি পাওয়ার পরও রাষ্ট্রপুঞ্জের নিয়ম না মেনে  আরো সম্প্রসারণ করছে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আবার ইতিহাসে ফেরত যেতে হবে। রাজনৈতিক জায়নবাদের যাকে স্রষ্টা বলা হয় সেই থিয়োডোর হার্জেল শুধু কি  ফিলিস্তিন ভূমিতে ইহুদিদের জন্য একটা রাষ্ট্র চেয়েছিলেন? তার চাওয়াটা এখানে সীমাবদ্ধ ছিল না। তাঁর কল্পনার ইজরায়েল রাষ্ট্র বর্তমান ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের চাইতেও বিস্তৃত। তিনি  চেয়েছিলেন ইহুদী আবাসভূমি হবে মিশর নদী থেকে ইউফ্রেটিস পর্যন্ত বিস্তৃত। অর্থাৎ সার্বিকভাবে পুরো আরব ভূমিই তিনি চেয়েছিলেন। বর্তমানে তার চিন্তারই  সাম্রাজ্যবাদী রূপ দেখছি  বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর কাছ থেকে। আর এর জন্য প্রয়োজন একটা জাতিকে ধ্বংস করে দেওয়া। যদি পুরো গাজা ভূমির মানুষদের মেরে ফেলা যায় তাহলে পুরো ভূমি ইজরায়ল তাদের দখলে নিতে পারবে। এব্যাপারে ইজরায়েলি ইতিহাসবিদ ইলান পাপে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ The Ethnic Cleansing of Palestine (2006)-এ বলেন, “ইজরায়েলের রাষ্ট্রীয় প্রকল্পটি জন্মই হয়েছিল জাতিগত নিধনের ভিত্তিতে। এটির মূল দর্শন ছিল—‘যদি আমরা এখানে থাকতে চাই, ওদের চলে যেতেই হবে। বহু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ইজরায়েল রাষ্ট্র  তৈরীর ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন ইহুদি পরিবারে জন্মেও তিনি জায়নবাদের মিলিট্যান্ট রূপের বিরোধিতা করেছিলেন। ১৯৪৮ সালে ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠনের পর তিনি ইজরায়েলের প্রথম রাষ্ট্রপতি হতে অনুরোধ পান, কিন্তু তিনি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি ইজরায়েলের  তৎকালীন চরমপন্থী দল ” হিরুট” এর নেতাদের “ফ্যাসিস্ট” বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। যে পদ্ধতিতে ইসরাইল রাষ্ট্র তৈরি হয়েছিল তার বিরোধিতা করেছিলেন মহাত্মা গান্ধীও।  তিনি বলেছিলেন: “Palestine belongs to the Arabs in the same sense that England belongs to the English.” তিনি মনে করতেন, ইহুদিদের সঙ্গে সমবেদনা থাকা সত্ত্বেও, ফিলিস্তিনে তাদের একটি জাতিগত রাষ্ট্র তৈরি নৈতিকভাবে অযৌক্তিক।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেখা যায় পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় উপনিবেশ  শেষ হচ্ছে ও তার ফলে নতুন নতুন দেশ তৈরি হচ্ছে। পশ্চিমারা তাদের ইউরোপীয় উপনিবেশ মানসিকতা ত্যাগ করেনি তার প্রমাণ বর্তমান বিশ্বে ফিলিস্তিনকে নতুন করে উপনিবেশ বানিয়ে রাখা। গাজাকে কেন্দ্র করেই প্রাচ্যের উপর নিয়ন্ত্রণ আসলে উপনিবেশিত ও সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতারই ফল। যেটা ইজরায়েলকে দিয়ে করে চলেছে আমেরিকা। বিশিষ্ট ফিলিস্তিনি -মার্কিন তাত্ত্বিক এডওয়ার্ড সাঈদের  মতে, ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠনের পেছনে প্রধানত ইউরোপীয় উপনিবেশবাদী মানসিকতা কাজ করেছে, এবং সেই রাষ্ট্রে যারা প্রথমদিকে বসতি স্থাপন করেছে তারা ছিল মূলত ইউরোপীয়, সাদা চামড়ার  ইহুদি জনগোষ্ঠী। নতুন ইজরায়েল রাষ্ট্র “মধ্যপ্রাচ্যকে প্রতিনিধিত্ব করে না” বরং এটি “ইউরোপের এক প্রান্তস্থ উপনিবেশ”। সাঈদের স্পষ্ট মত হল, “The Zionist state was created by a settler-colonial movement whose leadership was European, whose language was European, whose culture was European, and whose idea of the Orient was colonial.” ফরাসি দার্শনিক অ্যাঁলা বাদিউ ইজরায়েলকে সাম্রাজ্যবাদের সৈনিক বলে মন্তব্য করেছেন। বাদিউর মতে, ইজরায়েল গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের একটি সামরিক ঘাঁটি, যা মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা কর্পোরেট শক্তির স্বার্থ রক্ষা করে।

গাজা ভূমিতে ইজরায়েলের মাধ্যমে আমেরিকার যে নিয়ন্ত্রণ এটা শুধু যে সামরিক শক্তির মাধ্যমে হচ্ছে তা কিন্তু না। আন্তর্জাতিক  মিডিয়াগুলোর মাধ্যমে  প্রবলভাবে সাংস্কৃতিক আধিপত্য কায়েম রাখা হয়েছে। সাঈদ দেখিয়েছেন, পশ্চিমা উপনিবেশবাদ কেবল রাজনৈতিক বা সামরিক নয়, সাংস্কৃতিক আধিপত্যের মাধ্যমেও চলে। একদিকে  ফিলিস্তিনিদের ‘আতঙ্কবাদী’ হিসেবে দেখায় ও অন্যদিকে ইজরায়েলকে ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র’ হিসেবে তুলে ধরে এই আধিপত্যে তৈরি করা হয়।  গাজার উপর  বোমা হামলাকে ‘প্রতিরক্ষামূলক’ বলা এবং প্রতিরোধকে ‘সন্ত্রাস’ বলা সেই ইজরায়েলি প্রোপাগান্ডার অংশ।

এ ব্যাপারে ইতালিও মার্কসীয় চিন্তক অ্যান্টোনিও গ্রামসি দেখিয়েছেন, কীভাবে রাষ্ট্র কেবল বল প্রয়োগের মাধ্যমে নয়, বরং সাংস্কৃতিক আধিপত্যের মাধ্যমে জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করে। ইজরায়েলি প্রোপাগান্ডা, পশ্চিমা মিডিয়ার নিরবতা, এবং ভারতীয় মিডিয়ার ফিলিস্তিনবিরোধী প্রচার—সবই এই  আধিপত্যের নিদর্শন। ভারতীয়সহ পশ্চিমা মিডিয়া গাজাতে ইজরাইলের আক্রমণের জন্য মূলত হামাসকে দায়ী করে। হামাসকে সন্ত্রাসবাদী সংস্থা হিসেবে তুলে ধরে। তারা এটা বলে না যে হামাস জনগণের দ্বারা নির্বাচিত। হামাসের মাধ্যমে ফিলিস্তিনের জনগণ যে একটা প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে এটাকে গুরুত্ব দেয় না পশ্চিমা মিডিয়া। এ ব্যাপারে বিশিষ্ট ফরাসি চিন্তক ফ্রানজ ফ্যানন মনে করেন, উপনিবেশিতদের প্রতিরোধও এক ধরনের মুক্তির ভাষা। 

গাজার উপর ইজরায়েলের নির্মম আক্রমণকে ফ্যাসিবাদের একটি নতুন রূপ হিসেবেই ধরতে হবে। সমস্ত ফিলিস্তিনিদের গণহত্যা করে একটা বিশুদ্ধ ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের পথে নেমেছে নেতানিয়াহু। এটাকে উগ্র ফ্যাসিবাদ ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। একই পথে হেঁটে ছিলেন হিটলারও। সবসময় একজনকে শত্রু হিসেবে দেখিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনে ভীতি তৈরি করা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রনায়কদের চরিত্র। ফিলিস্তিনি জনগণকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ আখ্যা দিয়ে বিশ্বজনমতকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে ইজরায়েল। মার্কসবাদী চিন্তক স্লাভোজ জিজেক ইসরাইলি রাষ্ট্রের  চরিত্রকে”ডেমোক্রেটিক ফ্যাসিজম” বলে বর্ণনা করেছেন কারণ তিনি মনে করেন এই রাষ্ট্র ইহুদি আধিপত্যবাদকে (Jewish Supremacy) সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়। এক্ষেত্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প,  বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ও নরেন্দ্র মোদির ফ্যাসিস্ট ঐক্য আলোচনা করা জরুরী। ফ্যাসিস্ট ঐক্যের একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো বিশ্বব্যাপী  মুসলিম ঘৃণা ও ইসলামোফোবিয়া তৈরি করা। ট্রাম্পের “America First” নীতি আসলে  খ্রিস্টীয় শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদেরই একটা রূপ। ২০১৫ সালে ট্রাম্প একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং রাজনৈতিক মন্তব্য করেছিলেন যেটি হলো,  ” I think Islam hates us” । তার এই মন্তব্য থেকে পরিষ্কার যে ইসলামকে শত্রু হিসেবে দেখিয়ে বৃহৎ সংখ্যক মানুষের জনসমর্থন আদায় করা ছিল তার লক্ষ্য। ভারতবর্ষে প্রায় একই নীতি আরও উগ্রভাবে প্রয়োগ করে নরেন্দ্র মোদি। ট্রাম্প মনে করে আমেরিকার সাদা চামড়ায় খ্রিস্টানরাই শ্রেষ্ঠ, নেতানিয়াহু মনে করে ইহুদীরাই শ্রেষ্ঠ, মোদি মনে করে ব্রাহ্মণরা শ্রেষ্ঠ। তিনজনের মধ্যে ফ্যাসিবাদের রাজনীতির মিল আছে। বাবরি মসজিদ ভেঙে রাম মন্দির নির্মাণ, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিল, নাগরিকত্ব আইন পাস করা, ওয়াকফ বিল পাস করার মতো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়ে ভারতে মুসলমানদের কার্যত এক ঘরে করে রাখা হয়েছে। আমেরিকার মতোই ইজরায়লকে সমর্থন করে চলেছে নরেন্দ্র মোদি সরকারও। যেটা চিরাচরিত ভারতের বিদেশ নীতির পরিপন্থী। ভারত ধারাবাহিকভাবেই ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি ভারতের সেই চিরাচরিত বিদেশনীতি থেকে বেরিয়ে এসে ইজরায়েলকে সমর্থন করছে। গাজা ভূমিতে আক্রমণ চালাতে ইজরায়েলকে বিভিন্নভাবে সামরিক অস্ত্র দিয়ে ভারত সাহায্য করেছে বলে আল জাজিরার এক রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে। আমেরিকা আরও সরাসরি ইজরায়েলকে সমর্থন করছে। রাষ্ট্রপুঞ্জকে অগ্রাহ্য করেই ২০১৭ সালে ট্রাম্প প্রশাসন  জেরুজালেমকে ইজরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। মার্কিন বৈদেশিক নীতির সমালোচনা করে বিশিষ্ট মার্কিন তাত্ত্বিক নোয়াম চমস্কি বলেছিলেন, ইজরায়েল একটি স্যাটেলাইট স্টেট, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করে। তিনি উল্লেখ করেন যে, ইজরায়েলি সামরিক বাহিনীর ৯০% অস্ত্র ও অর্থায়ন আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। 

সৌদি আরব ও তুরস্কের মতো দেশ আমেরিকার চাপে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে যেতে পারছে না। কিন্তু ইরান পুরোপুরি  ফিলিস্তিনের জনগণের স্বাধীনতাকে সমর্থন জানিয়ে যাচ্ছে। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন দিচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকার মত দেশগুলিও। লড়াই অসম হলেও স্বাধীনতার পক্ষে লড়ে যাচ্ছে ফিলিস্তিনের জনগণ। রাষ্ট্রশক্তিগুলি ইজরায়েলের পক্ষে থাকলেও বিশ্বের মানবতাবাদী গণতন্ত্রপ্রেমী  জনগণ ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে আওয়াজ তুলছে। গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ বুঝতে পারছে বিশ্বজুড়ে যেভাবে একনায়ক এবং ফ্যাসিস্ট নেতারা যৌথভাবে কাজ করছে তাতে বিশ্বের গণতন্ত্র ধ্বংস হতে পারে। ইতিহাসবিদ টিমোথি স্নাইডার তাঁর On Tyranny বইতে উল্লেখ করেছেন, “The alliance of authoritarian leaders across the globe is a threat to democratic values.” তাই বিশ্বের  গণতন্ত্রপ্রিয় জনগণ ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়িয়ে আসলে বিশ্বগণতন্ত্রের পক্ষেই দাঁড়াচ্ছে।

তথ্যসূত্র:

Badiou, A. ( 2006). Polemics.

Gandhi, M ( 1948). Harijan

Gramsci, Antonio (1971).  Selections from the prison notebook.

Fanon, Frantz ( 1961). The Wretched of the Earth.

Herzl, Theodor.( 1897). The Jewish State.

Pappe, Ilan( 2006). The Ethnic Cleansing of Palestine.

Said, Edward.( 1979). The Question of Palestine

Said, Edward.( 1978). Orientalism.

Said Edward. (1993). Cultural Imperialism.

The New York Times, Dec, 4, 1948.

তুষার, সরোয়ার.(২০২৫ ) জায়নবাদ: ইতিহাস ও মতাদর্শ. প্রতিপক্ষ

Zizek, Slavoj (2007). Violence.

Mazhar Ziban

সম্পাদক, লেখালেখির উঠান । কলেজ জীবন থেকে রূপান্তরবাদী রাজনীতির সাথে জড়িত। সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী। একটি বামপন্থি ছাত্র সংগঠনের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ছিলেন। অনূদিত কবিতার বই আমিরি বারাকা'র কেউ আমেরিকা উড়িয়ে দিয়েছে। সহলেখক: • বাংলাদেশের দলিত সম্প্রদায়: বৈষম্য, বঞ্চনা ও অস্পৃশ্যতা মাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞান শিক্ষা বরেন্দ্রী আদিবাসীদের চালচিত্র Colonialism Casteism and Development: South South Cooperation as a 'New' Development paradigm জন্ম ১৫ এপ্রিল, ১৯৬৫। নবদ্বীপের বাসিন্দা। পেশায় ইংরেজির শিক্ষক। উপনিবেশবিরোধী চর্চায় ব্যস্ত থেকে উপনিবেশের তৈরি নানা মিথ ভাঙতে। সতত সচেষ্ট। স্রোতের উল্টোদিকে সাতার কেটেই তার আনন্দ। ছাত্রপাঠ্য ইতিহাসের আড়ালে চলে যাওয়া ব্যক্তিবর্গ ও ঘটনাকে উপযুক্ত সম্মান জানিয়ে পাদপ্রদীপের আলোয় তলে। আনার চেষ্টা করেন। উনিশ ও বিশ শতকে বাংলার শিক্ষা, সমাজ ও সংস্কৃতির নানা পরিবর্তনের হালহদিশ খুঁজে বের করে দীর্ঘদিনের 'আইকন'-দের নির্মোহ কাটাছেড়ায় আগ্রহী। কলকাতার একটি প্রতিষ্ঠিত। দৈনিকে আমন্ত্রিত লেখক হিসেবে। সমকালীন সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে অনিয়মিতভাবে ফিচার লেখেন। এটিই তার প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। অপ্রচলিত বইপত্তর পড়া ও টকটাক লেখালেখি ছাড়া তার অন্যতম শখ। ভারতীয় ডাকটিকিট ও মুদ্রা সংগ্রহ। প্রচ্ছদ: জ্যোতির্ময় পাল

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ভাষা
Scroll to Top