(পর্ব চার)
‘ক্যামারিনার সাথে
বিবাদে জড়িয়ো না।’ একটি সিসিলিয়ান প্রবাদ
২১
আশার প্রস্তাবে আপত্তি করার কোন কারণ দেখলো না ইবলা। আশার সাথে একমত হলো যে এখন থেকে ওদের দুজনের একসাথে রান্না করা এবং খাওয়া উচিত। তাতে দুজনেরই খরচ কমবে। কিছু কিছু খরচ অবশ্য কমেছে। ইবলা ধীরে ধীরে আশার অতীত সম্পর্কে জানছে। গ্রাম থেকে আসার পর এই পর্যন্ত, ইবলার সামনে আশাই সবচেয়ে আকর্ষণীয় চরিত্র। আওরাল্লা বেশিরভাগ সময় বিছানাতেই পড়ে ছিল। আর বিধবা? বিধবা হচ্ছে বিধবা— এবং প্রতিটি বিধবা মহিলা সাধারণত অনাকর্ষণীয় জীব (তাই তাদের স্বামীরা একঘেয়েমিতে ভুগে তাদের আগে মারা যায়)।
কিন্তু আশা, দাপটের সাথে ঘুরে বেড়ায়, যা জীবনকে আরও রোমাঞ্চকর করে তুলেছে। এই বাড়িতে ছয়টি ঘর আছে, বৃত্তাকার আফ্রিকান কুঁড়েঘরের শৈলীতে নির্মিত হয়েছে বাড়িটি। ছোট দরজা এবং ঘাসের ছাদ, এবং পাশের দিকটা ঢালু। নানা ধরণের ভাড়াটের কাছে ঘর ভাড়া দিয়েছে আশা। একমাত্র খোদাই জানেন কীভাবে সে তাদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করে। হয়তো এই ব্যাপারটিই ব্যাখ্যা করে কেন সে এতোটা ব্যবসায়িক মানসিকতার মানুষ। আর কেন সে এমন জাদরেল স্বরে কথা বলে সবসময়। আশার কনুই দুটি সবসময় দুই পাশে প্রসারিত থাকে আর মুখে লেগে থাকে এক ধূর্ত হাসি। মাথা ঢাকা একটি কালো পোশাক পরে থাকে সব সময়, আবার সে নিজের ইচ্ছে মতো আলগা করে ফেলে সেই কালো পোশাকের ঢাকনা। তখন তার কপালে ধূসর চুলের ঝাঁকড়া দেখা যায়। ইবলা নিজেকে আশার ভক্ত হিসেবে উপস্থাপন করতে পারেনি, কারণ আশাই প্রথম ব্যক্তি যে তাকে নিজের সমান বলে মনে করেছে: ইবলাকে নিজের সম্পর্কে সচেতন করেছে আশা।
এক সপ্তাহ বা তারও বেশি সময় আগে, একদিন জামা এসেছিল। জামা এসে জানালো সে আউইলের কাছ থেকে একটি চিঠি পেয়েছে। আউইল ভালো আছে। জামা আরও জানায় যে চিঠিটি তার সঙ্গেই আছে। কিছুক্ষণ শার্টের পকেটে চিঠিটি খুঁজলো জামা। পকেট থেকে বের হওয়া অনেকগুলো চিঠির মধ্যে থেকে আউইলের চিঠিটি বেছে তুললো। ইবলা হাতে নিলো সেটি। জামা জানায়, চিঠিটি ইবলার জন্য পাঠানো হয়নি, কিন্তু সে দেখতে পারে।
যদিও ইবলা পড়তে জানে না, তবুও সে খামটি খুললো। খামের ভেতর একটি দীর্ঘ চিঠি, যেটিতে শুধুই কালো দাগ, ঢেউ, রেখা, কাটাকুটি লাইন টানা আর ছবি আঁকা, যতদূর ইবলা বুঝতে পারলো এসবই দেখতে পেল চিঠির কাগজে। কিন্তু, খামের ভেতর একটি ছবিও আছে; সেই ছবিতে আউইল এবং অন্য একটি মেয়েকে দেখা যাচ্ছে। মেয়েটির গায়ে একটি সুইমিং স্যুট ছাড়া আর কিছু নেই, ছবিতে মেয়েটির খোলা পেট দেখা যাচ্ছে। আউইলের একটি হাত মহিলার স্তনের উপর রাখা। জীবনে প্রথমবারের মতো ইবলা নিজের হাতে কোনো ছবি ধরেছে। গ্রামে বিশ্বাস প্রচলিত ছিল, ছবি তুললে মানুষের হায়াৎ কমে যায়: সময়ের আগেই মারা যায় ছবির মানুষ। অবশ্য এই বিশ্বাসে ভীত না হলেও, ইবলা কাউকে ক্যামেরা দিয়ে তার ছবি তুলতে দেখেনি কখনো।
জামা ভেবেছিল চিঠির খাম থেকে সে বন্ধুর ছবিটি আগেই সরিয়ে রেখেছিল। কিন্তু ভুলটুকু বুঝতে পাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই জামা অপ্রস্তুত হয়ে গেল, চমকে চোখ সরিয়ে ফেললো অন্যদিকে।
ঠিক এই সময় দৃশ্যপটে উপস্থিত হলো আশা। আশাকে আসতে দেখে দ্রুত ভাগতে চাইলো জামা ওদের দুজনের সামনে থেকে। দ্রুত সালাম জানিয়ে বলে তক্ষুণি উঠতে যাচ্ছিলো সে। অন্য একসময় আবার দেখা করতে আসবে।
‘এতো শীঘ্র চলে যাচ্ছ? কেন?’ আশা অবাক হয়। জামা আজ এতো তাড়াহুড়ো করছে কেন তা বুঝতে পারছে না।
‘একটু যেতে হবে। পরে আসবো আবার।’
চিঠি আর ছবি ধরা ছিল ইবলার হাতে। ওগুলোকে সে কী করবে বুঝতে পারছিল না। ছবিতে এক শ্বেতাঙ্গ মেয়ের সাথে তার স্বামীর মতো কাউকে দেখতে পাচ্ছে ইবলা, কিন্তু কেউ হয়তো ইবলাকে ব্যাখ্যা করে বোঝাতে পারতো যে ছবির দুজন আসলে অন্যায় কিছু করছে না। কেউ যদি বলতো যে শ্বেতাঙ্গদের দেশে সবকিছু এইভাবেই চলে, তাহলে ইবলা সে কথা বিশ্বাস করতো অবলীলায়। কিন্তু ইবলা রুষ্ট হলো; ভীষণ ক্ষুণ্ণ হয়েছে, আউইলের উপর নয়, শ্বেতাঙ্গ মেয়েটির উপরেও নয়, বরং নিজের উপর। ছবির সমস্ত ব্যাপারটি তার সামনে পরিষ্কার হতে শুরু করেছে, মাথার ভেতর নানারকম চিন্তারা ভিড় করছে, অপ্রমাণিত সব ভাবনা।
‘এটা কী?’ জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায় আশার কণ্ঠ।
‘এটা…’ চিঠিটি আশার দিকে বাড়িয়ে দে ইবলা।
আশা হাতে নিয়ে চিঠির খাম খুললো, খাম থেকে ছবিটি বের করে পরীক্ষা করে দেখলো। বেশ কষ্ট করে, ভেঙে ভেঙে চিঠিটি পড়লো আশা। ইবলাকে বোঝানোর জন্য চিঠির বক্তব্য সোমালি ভাষায় অনুবাদ করে শোনায়।
‘আমার এখন কী করা উচিত?’ ইবলা প্রশ্ন করে। তার কণ্ঠস্বর এতো গুরুগম্ভীর শোনাচ্ছে, যে কেউ বুঝতে পারবে এইমুহূর্তে তার সাহায্য প্রয়োজন।
‘আমি জানি তোমার কী করা উচিত,’ আশা বলে।
‘তাহলে বলে দিন।’
‘তার আগে আমাদের জন্য চা করে আনি চলো। চা খেতে খেতে বলবো তোমাকে এখন কী করতে হবে।’
এখন বিকেল প্রায় তিনটা। ইবলা এবং আশা পাশের ঘরে গেল, সেখানে আশা চা বানায় দুজনের জন্য। ইবলার মনে অনেক রকম চিন্তা আসছে, কিন্তু একটা বিষয়ে সে এবার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ: আর পালাবে না কোথাও। পালিয়ে সে গ্রাম থেকে শহরে এসেছিল, সেখান থেকে পালিয়ে মোগাদিসিওতে এসেছে। এখন যদি সে মোগাদিসিও থেকে পালায় তাহলে সে সোজা সমুদ্রে যাবে। ইবলা সমুদ্রে আশ্রয় নেওয়ার জন্য একেবারেই প্রস্তুত নয়। ‘সামনে যাই আসুক না কেন, আমি মোগাদিসিওতেই থাকবো, কেয়ামত পর্যন্ত,’ মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় ইবলা।
আশা ইবলার হাতে চা দিলো। বাড়ির প্রায় সবাই এখন বাইরে আছে। পুরো বাড়ি খুব শান্ত, চুপচাপ।
‘আমার কাছে একটা বুদ্ধি আছে,’ আশা কথা শুরু করে। একবার ঢোক গিললো কথা শেষ করে।
‘আমি শুনতে চাই সেটি।’ ইবলা চায়ে চুমুক দেয়।
‘কিন্তু তুমি কি আমার কথা শুনবে?’ আশা আবার ঢোক গেলে।
‘হ্যাঁ, শুনবো। আপনার মাথায় কী চিন্তা এসেছে সেটি শুনতে উদগ্রীব হয়ে আছি আমি; যা খুশি করতে বলুন আমাকে, শুধু দয়া করে এখান থেকে চলে যেতে বলবেন না। বলবেন না যে আমাকে আবার পালাতে হবে।’ কথা শেষ করে ইবলা মুখ ভরে চা নিল। চায়ের স্বাদ তার কাছে একজন পুরুষের স্বাদ বলে মনে হলো।
‘পালতে হবে না। অন্য একটি পরামর্শ আছে আমার কাছে।’
‘বলুন।’ ইবলা আরেক গাল চা নিল মুখে। এবার চায়ের স্বাদ আগের চেয়ে আরেকটু ভালো লাগলো; একটি মহিলার মতো।
‘কসম কেটে বলো যে তুমি সেটা করবে।’
‘আমি আল্লাহর কসম খাচ্ছি। আপনার পরামর্শ মতো আমি যদি কাজ না করি, তাহলে আল্লাহ যেন আমার ভাইকে মেরে ফেলে।’
কথাটি শেষ করেই ইবলার মনে আরেকটি একটা কথা বেজে উঠলো। ‘আমার দাদার কী হবে?’ যখন গ্রামে ছিল, তখন ইবলা দাদার মৃত্যুর শপথ নিয়েছিল। আজ ঘটনাটি তা হলো না: সে বলেছে ‘আমার ভাই,’ ভাইয়ের কী হতে পারে? আচ্ছা ঠিক আছে, এই চিন্তাটি আগামীকালের জন্য তুলে রাখা যাক। এখন একটি একটি করে সমস্যা নিয়ে চিন্তা করা যাক, ইবলা ভাবে।
‘আমার পরিচিত একজন ধনী লোক আছে। তিনি আমাকে দেখতে কয়েকবার এখানে এসেছেন। সে তোমাকে দেখেছে এবং আমাকে তোমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছে। আমি তাকে বলেছি তোমার কথা, তুমি কে। কিন্তু তাকে বলিনি যে তোমার স্বামী এখন দূরে আছে। তিনি আমাকে বলেছেন তোমার কাছে আমি তার কথা বলতে পারি কিনা।’
‘লোকটি কী চায়?’
‘আমি জানি না, তবে আমার মনে হয় তুমি যা বলবে, সে মেনে নেবে। লোকটি তোমার ব্যাপারে খুব আগ্রহী।’
‘আপনি ইসলাম সম্পর্কে কিছু জানেন?’ ইবলা হঠাৎ করেই প্রশ্নটি করলো, কণ্ঠে বুঝিয়ে দিল যেন আশা ইসলাম সম্পর্কে কিছুই জানে না।
‘খুব অল্প। কেন?’
‘তাহলে, আপনি চিন্তা করুন, আমার কাজিন এমন একজনের হাতে আমাকে তুলে দিতে চেয়েছিল যাকে আমি কখনো দেখিনি। কাজিন বলেছিল, শেখ নাকি আমার বাগদানের কথা ঘোষণা করেছে সেখানে। তাই আমি আউইলের সাথে পালিয়ে এসেছি মোগাদিসিওতে। কিন্তু আউইলের সাথে আমার বিয়ে সম্পর্কে ইসলাম কী বলে? এটা কি বৈধ?’
‘আমার মনে হয়. . . আমি জানি না,’ ইতস্তত করে জবাব দিল আশা।
‘আপনার ধনী বন্ধুটি কি বিবাহিত?’ ইবলার কথা শুনে মনে হলো লোকটি বিবাহিত কিনা তা নিয়ে বিশেষ মাথা ব্যথা নেই তার।
‘হ্যাঁ, বিবাহিত। সঙ্গে বিয়ের বয়সী দুইটি মেয়ে ও দুইটি ছেলে আছে। বাইদোয়া থেকে এখানে আসে।’
‘তার নাম কী?’
‘টিফো।’
‘কী বিশ্রী নাম। কেমন দেখতে? তিনি কি খুব বুড়ো?’ ইবলা লোকটার জীবন-ইতিহাস সম্পর্কে জানতে চাইলো এখন।
‘খুব বুড়ো না, কিন্তু সে অনেক পয়সাওয়ালা।’
‘আপনার মনে হয় তিনি আমাকে বিয়ে করতে রাজি হবেন? আমি যেকোনো সময় উনাকে বিয়ে করতে আগ্রহী আছি— যেটি আদম এবং হাওয়া শুরু করেছিল, কিন্তু তারা বিয়ে করেনি, তাই না?’
‘আদম হওয়ার বিয়ে সম্পর্কে আমার কোন ধারণা নেই। তবে শুনেছি, প্রথমে ভাই বোনদের ভেতর বিয়ে হওয়ার প্রচলন ছিল, যতদিন পর্যন্ত না বোন ছাড়াও বিয়ে করার মতো যথেষ্ট পরিমানে মেয়ের সংখ্যা উৎপন্ন হয়েছিল পরিবারের বাইরে। সৃষ্টির শুরুতে পুরুষরা সবসময়ই আমাদের চেয়ে সংখ্যায় বেশি ছিল।’
‘আপনার পয়সাওয়ালা বন্ধুটি কখন আসবেন?’
‘আজ রাতে। তিনি এলে আমি তাকে বলবো তোমার সাথে এসে কথা বলতে। আর আমি একজন কাজী ও দুইজন সাক্ষীকেও প্রস্তুত থাকতে বলবো, অবশ্য যদি তিনি তোমাকে বিয়ে করতে রাজি হন। আজ শুক্রবার। বেশ কিছু মুসুল্লি আজ আমার বাড়িতে কোরআন তেলাওয়াত করতে আসবে।’
‘আপনার কাছে মনে হয় এই বিয়ে পরে আমার জন্য কোন সমস্যা তৈরি করবে?’
‘সমস্যা হলে তা হবে পুরুষদের জন্য। তারা একে অপরের গলা কামড়াতে ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিন্তু দুজনের একজন কেউ তোমাকে স্পর্শ করার সাহস পাবে না।’
‘টিফোকে বলবেন, আমি তাকে গোপনে বিয়ে করতে রাজি আছি। হয়তো তিনিও চাইবেন ব্যাপারটি গোপন থাকুক। আর আউইল যদি ফিরে আসে এবং আমার সাথে থাকতে না চায়, তবে আমি টিফোর সাথেই থাকবো। আমার এই মূল্যবান জীবনকে আমি খুব ভালোবাসি। কারো স্ত্রী হয়ে থাকতে ভালোবাসি। কার স্ত্রী হলাম, তা নিয়ে মাথা ঘামাই না।’
‘হ্যাঁ, আমি বলবো টিফোকে,’ আশা আশ্বস্ত করে ইবলাকে।
চা পান শেষ করে এবার তারা নিজেদের এই বৈঠকটি মুলতবি করলো। ইবলা সঙ্গে সঙ্গেই বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়েছে। কিছুক্ষণের ভেতর স্বপ্নে দেখে তার ভাই এসেছে। ইবলা স্বপ্নে এটাও দেখলো যে তার দাদা মারা গেছেন।
যখন ঘুম ভাঙলো, তখন সন্ধ্যা সাতটা প্রায়। ‘টিফো এসেছে,’ আশা এসে জানিয়ে গিয়েছে। ইবলা ঠান্ডা পানি দিয়ে মুখ ধুলো। মুখে সাবান ব্যবহার করলো না, এখনও সে শরীরে সাবান লাগাতে অপছন্দ করে। তারপর একটি নতুন পোশাক পরে ইবলা, যে পোশাকটি আশা তার এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে ধার করে এনেছে আজকের অনুষ্ঠানের জন্য।
২২
নিজের কাছে বারবার উচ্চারণ করেছে ইবলা, জীবনকে সে ভালোবাসে। যদিও সে সত্যিই বুঝতে পারে না জীবন আসলে কী: জীবন সম্পর্কে একটি ভুল ব্যাখ্যা ধারণ করেছিল সে নিজের মনে। যদি তার লালন করে রাখা ব্যাখ্যাটি সঠিক হয়, তাহলে সবার ব্যাখ্যাই সঠিক। ইবলার কাছে জীবন মানে হচ্ছে স্বাধীনতা, সব রকমের স্বাধীনতা।‘একজন মানুষের তাই করা উচিত যা তার করতে ইচ্ছে হয়— এরই নাম জীবন। আমি এটাকেই ভালোবাসি।’ স্বাধীনতা— ইবলা যার উপাসনা করে। যে কোন পুরুষের সাথে শুয়ে পড়ার স্বাধীনতা নয়, সকল পুরুষ শয্যা সঙ্গী হবার যোগ্য নয়, সকল পুরুষ ভালো স্বামী হয় না। ইবলা নানা রকমের অবস্থা সম্পর্কে নিজস্ব ধারণা তৈরী করতে অনন্য। তার কাছে বিয়ে হচ্ছে একটি নিরাপদ আশ্রয়। আশা করি আমার কথায় কেউ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে না, মনে মনে বলে ইবলা। ভয় লাগছিল, হয়তো নিজেকে চরম হতাশ করতে হতে পারে ইবলার এবার। যেহেতু টিফোকে সে আগে দেখেনি, আশংকা করছে লোকটি হয়তো ভূতের মতো এক প্রাণী হবে। আর যদি তাই হয় তাহলে সে তখন কী করবে? পালিয়ে যাবে। কিন্তু কোথায়? না। সে আর পালাবে না— অন্তত আরেকটি পুরুষের খোঁজে তো নয়ই। যদি কোন পুরুষ তার প্রতি আগ্রহী হয়, তবেই সে তার কাছে নিজেকে উপস্থাপন করবে।‘কিন্তু সেটা হবে পতিতাবৃত্তি। না, তা হবে না। আমি আমার জীবনকে ভালোবাসি। এবং বিবাহের মধ্যে জীবন আছে। এবং দুজন বিপরীত লিঙ্গের মানুষের মাধ্যমে জন্মগ্রহণ করে বিবাহ নামের সম্পর্কটি।’ (তার সামান্যতম ধারণা ছিল না যে সমকামীদের মতো মানুষ থাকতে পারে পৃথিবীতে।)
ইবলা গায়ের পোশাকটি একপাশে একটু গুঁজে দিল। মনে মনে পোষাকটির প্রশংসা করলো। যেহেতু তার ঘরে কোন বড়ো আয়না নেই, সে ঘাড় ঘুরিয়ে শরীরের পিছন দিকটা দেখার চেষ্টা করলো। কিছুক্ষণ এভাবে থাকায় তার মাথায় ঝিমুনি ধরে। আশা এসে ঘরে ঢোকায় ইবলা স্বাভাবিক হলো। জানতে চায় ভদ্রলোক তার প্রস্তাব গ্রহণ করেছে কিনা।
‘হ্যাঁ।’
‘আর কাজী এবং সাক্ষীরা?’
‘কাজী কিছুক্ষণের মধ্যেই তোমার সাথে দেখা করতে আসবেন।’
বিয়ের সমস্ত প্রক্রিয়াটি আউইলের সাথে যেভাবে হয়েছিল, এখনো ঠিক সেভাবেই হলো, শুধু এই লোকটি দেখতে কেমন সে সম্পর্কে ইবলার কোন ধারণা নেই। কাজী সাহেব এসে নিয়মমাফিক প্রশ্নগুলো করলেন। ‘আপনার নাম কী? আপনার বাবার নাম? আর আপনি কি টিফোকে বিয়ে করতে রাজি আছেন?’ ইবলা সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিলো। আশা এবং কাজীর উপর ইবলা সম্পূর্ণ আস্থা রেখেছে।
কিছুক্ষণ পর টিফো এলো, একা। লোকটি উচ্চতায় অনেক খাটো। গায়ের রং বাদামী। এবং মোটা। ইবলা টিফোর নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পায়, তার কাছে মনে হলো লোকটির শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। টিফো ঘরের ভেতর প্রবেশ করে। ইবলা যে বিছানায় শুয়েছিল সেটি বাদ দিলে সমস্ত ঘর ফাঁকা পড়ে আছে। সন্ধ্যার আগে, ইবলা যখন গোসল করছিল, তখন আশা এই ঘরে ছিটিয়ে থাকা আউইলের সমস্ত কাপড় সরিয়ে ফেলেছে।
এখন ইবলা বিছানায় শুয়ে আছে। একটি চাদরে মুখ ঢেকে রেখেছে। আশা বলে দিয়েছে, যতক্ষণ পর্যন্ত না টিফো তাকে “ওয়াজি ফুর” টাকা না দিচ্ছে ততক্ষণ মুখ খুলতে না। টিফো বিছানায় বসে কাপড়ে ঢেকে রাখা ইবলার অবয়বের দিকে তাকায়। ইবলার পায়ের তলায় সুড়সুড়ি দিলো কয়েকবার। আর ইবলা সুড়সুড়ি খেয়ে হাসি লুকানোর চেষ্টা করে।
‘তোমার মুখ দেখাও,’ পুরুষালি কণ্ঠে বলে টিফো।
টিফোর গলার আওয়াজ শুনে ইবলা ভয় পেয়ে গেল। একবার মনে হলো মুখ দেখাবে। কিন্তু সে নিজেকে সামলে নিলো।
‘ওয়াজি ফুর টাকা?’
‘কতো চাও?’ টিফো জিজ্ঞেস করে।
‘একশত সোমালি শিলিং,’ আশা যে পরিমাণ টাকার কথা বলে দিয়েছিল তাই বললো ইবলা। ‘কিন্তু এ তো অনেক টাকা,’ নিজের মনে বলে ইবলা।‘এই যে নাও একশত সোমালি শিলিং’ কথাটি টিফো যদি না বলতো তাহলে ইবলা অর্থের পরিমাণ অনেক কমিয়ে দিতো।
‘এখন তোমার মুখ খুলো; এখানে টাকা আছে,’ টিফো বলে।
ইবলা ভুলে গিয়েছে যে আশার শিখিয়ে দেওয়া কথা। আশা বলেছিল প্রথমে মুখের কাপড় একটুখানি সরিয়ে দেখে নিতে লোকটি সত্যি টাকা দিয়েছে কিনা। ভুল করে ইবলা মুখের কাপড় পুরোপুরি খুলে ফেলেছে এবং টিফো তার কাপড়ের টুকরোটা ধরে নিজের দিকে টেনে নিল। আশ্চর্যজনকভাবে লোকটি হাসছে, হাসছে আর হাসছে। এরপর লোকটি ইবলার পোশাক ধরে টানতে শুরু করলো। ইবলা ভীষণ বিরক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তার মুখ হা হয়ে গেছে।
অনেকক্ষণ হেসে লোকটি বলে, ‘তুমি দেখতে সুন্দর। কোথা থেকে এসেছ তুমি?’
লোকটি যে ভাষায় কথা বলছে, তা অনেকগুলো উপভাষার মিশ্রণে তৈরী, যা এখন সোমালি প্রজাতন্ত্র নামে পরিচিত। টিফোর কথা ইবলা বুঝতে পারছে না।
‘জি, আপনি কী বলছেন?’ ইবলা প্রশ্ন করে।
‘তুমি এই দক্ষিণী উপভাষাগুলির সাথে পরিচিত নও?’ এবার সে সাধারণ সোমালি ভাষায় কথা বলছে।
‘আপনি কী বলছেন আমি বুঝতে পারছি না। কী জানতে চাইলেন আমার কথা?’
‘তুমি কোথা থেকে এসেছ?’
‘ওগাডেনিয়া।’
‘কোন অংশ থেকে?’
‘আমি জানি না। কাল্লাফো থেকে বেশি দূরে না: আপনি জানেন এটি কোথায়?’
‘ওটি এখন ইথিওপিয়ায় পড়েছে,’ টিফো বলে।
‘সেটা কোথায়?’ ইবলা জিজ্ঞাসা করে।
‘তোমার এলাকার কাছাকাছি কোথাও,’ টিফো প্রসঙ্গটিকে উড়িয়ে দিল। এই প্রসঙ্গে আলাপে আগ্রহ নেই তার।
লোকটি পায়ের জুতো খুলে ফেলেছে। গায়ের কাপড় খুলতে শুরু করেছে। তারপর বিছানায় শুয়ে পড়ে তৎক্ষণাৎ চিৎ হয়ে। নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের সাথে সাথে তার বিশাল পেটটি উঠা নামা করছে। প্যান্টের বেল্ট আলগা করলো টিফো।
‘তুমি কতদিন ধরে মোগাদিসিওতে আছো?’ প্রশ্ন করে।
‘এক মাসের বেশি হবে,’ ইবলা জবাব দিল।
ইবলা ভাবছে হয়তো একদিন এভাবে এক হাত থেকে আরেক হাতে বদল হবার পালা শেষ হবে তার। এখন পর্যন্ত কোনদিন কোনো কাজের জন্য অনুতাপ করেনি সে। টিফোকে বিয়ে করার পরামর্শ ছিল আশার। আউইলকে বিয়ে করার পরামর্শ ছিল বিধবার। গ্রামে একজন বৃদ্ধের সাথে বাগদানের (তার নামটি পর্যন্ত ভুলে গেছে এখন সে) পরামর্শ ছিল তার দাদার। সব সময়ই প্রতিটি সিদ্ধান্তের প্রস্তাব কারো না কারো কাছ থেকে পরামর্শ হয়ে এসেছে তার কাছে। সেগুলোকে হয় সে গ্রহণ করেছে অথবা প্রত্যাখ্যান করেছে। একজন মানুষ জীবনে নানাজনের কাছ থেকে পরামর্শ পেয়ে থাকে। এই পৃথিবীতে আগমনের সময় থেকে শুরু হয় এই প্রবাহ, এবং মৃত্যু হবার পরেই শেষ হয় পরামর্শ পাবার এই প্রক্রিয়া। ‘এটা করো; ওটা করো; এটা করো না; ওটা করো না,’— এই তো মানুষের জীবন। কিন্তু এটি একটি জীবন যেটিকে বিষ দিয়ে বিষাক্ত করা হয়েছে। আমাদেরকে বিষ খাওয়ানো হয় ওষুধের মতো। এই ওষুধেই আমরা বেঁচে থাকি, যে ওষুধ আমরা খাই এবং পান করি। কিন্তু আমরা কি তা অনুধাবন করতে পারি?
ইবলা টিফোর দিকে তাকায়। টিফো ঘুমিয়ে পড়েছে। নাক ডাকছে। ‘লোকটি নিশ্চয় খুব ক্লান্ত,’ ইবলা ভাবে। আচরণ দেখে লোকটিকে ইবলার কাছে বোকা বলে মনে হয়, যদিও বলতে পারবে না কি দেখে তার এমন মনে হয়েছে। ‘নিশ্চয়ই লোকটি অবৈধভাবে পাওয়া টাকা দিয়ে তার পেট ভরেছে। নইলে তার পেটটি এতো বড়ো কেন?’ ইবলার ইচ্ছে হচ্ছে, পেটের ভেতরে কী আছে তা সে দেখে; চটকানো আলু আর শিকড় বাকর? মানুষ বলে, আমাদের পেটে একটা মেশিন আছে, যে মেশিনটি আমরা খাওয়ার পর খাবারগুলোকে পিষে ফেলে। তারা বলে যে মেশিনে কিছু গন্ডগোল হলে, বা মেশিনটি ক্লান্ত হলে, বা পচে গেলে আমাদের পেটে ব্যথা হয়। কোষ্ঠকাঠিন্য ব্যাপারটি হচ্ছে আমাদের পেটের ভেতর থাকা খাবার পেষার যন্ত্রটি ভোঁতা হয়ে যাওয়ার ফলাফল, যে মেশিনে সাধারণত প্লায়ারের মতো দাঁত লাগানো আছে।
ইবলা লক্ষ্য করলো টিফো এবার একটু একটু করে চোখ খুলছে। লোকটি তার দিকে তাকিয়ে নির্লজ্জের মতো হাসছে।
‘আমি কতক্ষণ ধরে ঘুমাচ্ছি?’ জিজ্ঞেস করে টিফো।
‘বেশিক্ষণ নয়,’ ইবলা জবাব দেয়।
‘আমাদের বিয়েটা কিন্তু গোপন।’
‘আমি জানি।’
‘ভালো। আমি যখনই এখানে আসবো, তোমাকে কিছু টাকা দিয়ে যাবো। কবে কখন আসবো, তা আগে থেকে বলতে পারবো না। সবকিছু নির্ভর করবে আমি কবে শহরে আসি তার উপর। মাঝে মাঝে আমি গভীর রাতে আসবো। মাঝে মাঝে আমি এখানে তোমার সাথে সারারাত ঘুমাতে পারবো না।’
‘বিয়েটা গোপন রাখতে হবে কেন?’
‘তুমি কি কথাটি গোপন রাখতে অপছন্দ করছো?’
‘আমি অপছন্দ করছি, তা নয়। কিন্তু ঘটনাটিকে গোপন করে রাখতে হবে কেন তা জানতে চাইছি।’
‘দেখো, আমার একজন স্ত্রী এবং বিবাহযোগ্য দুটি মেয়ে আছে। মেয়েরা মোগাদিসিওতে আছে: তারা এখানে পড়াশোনা করে। আমার ছোটো বাচ্চারা আমার স্ত্রীর সাথে বাইদোয়াতে আছে, যেখানে স্ত্রী আমার ব্যবসার ম্যানেজার। আমাদের ভেতর দ্বন্দ্ব চলছে। তাকে আমি তালাক দিতে চাই, কিন্তু এখন না।’
‘এখন আমি বুঝতে পেরেছি।’
‘ভালো। তোমার বয়স কতো?’
‘উনিশ।’
‘আমার মেয়েদের বয়স আঠারো এবং ষোল।’
‘তারা কি মোগাদিসিওতে আছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘তারা কোথায় থাকে? কার সাথে?’
‘ওদের খালার কাছে। তোমার সাথে আমার বিয়ের কথাটি কেউ জেনে ফেললে আমি ভীষণ ঝামেলায় পড়ে যাবো।’
‘কিন্তু আপনার মর্যাদার তুলনায় আমি খুব কম কিছু নই, তাই না?’
‘না। তুমি রাজকন্যার মতো সুন্দর। আমার কথায় ভুল বুঝো না। আমি খারাপ কিছু বলিনি তোমাকে।’
টিফো উঠে দাঁড়ায়। জানায় এখন সে ঘরের আলো নিভিয়ে দেবে; আলো নেভানোর আগে ইবলার কিছু বলার আছে কিনা জানতে চায়।
‘না, কিছু বলার নেই।’ ইবলা বলে।
বিছানার দিকে ধেয়ে আসা টিফোর পায়ের এলোমেলো শব্দ এসে ধাক্কা খায় ইবলার কানে। আর কিছু চিন্তা করার সময় নেই তার হাতে এখন: টিফো আর সকল পুরুষের মতোই একজন, একটি পশু, একটি জানোয়ার, একটি অসভ্য জানোয়ার, কিন্তু অবশ্যই সে বিছানায় যাওয়া পর্যন্ত একটি মেয়ের সাথে কথা বলতে পারে।
টিফো আর ইবলা বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে আছে। টিফোর অবাধ্য হাত দুটি ইবলার শরীরের উপত্যকা এবং উঁচু নিচু ঢেউগুলো নিজেরাই খুঁজে নিতে তৎপর হয়েছে।
প্রথমবার হয়ে যাবার পর টিফো বললো,
‘কিন্তু, তুমি তো কুমারী নও।’
‘আমি তালাকপ্রাপ্তা,’ ইবলা ব্যাখ্যা করে।
‘আশা আমাকে বলেনি এই কথা।’
‘সে বলেছে। নিশ্চয়ই আপনার কান এড়িয়ে গিয়েছে কথাটিকে।’
‘হতে পারে। অবশ্য এটা বেশি ভালো হলো। অনেক ভালো। কুমারী মেয়ে কে চাইবে? বিশেষ করে আমার বয়সের কেউ!’
গভীর রাত পর্যন্ত তারা দুজন বকবক করে চলে। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে টিফো জানায় সে বাইদোয়া যাবে। পরদিন আবার আসতে পারে ইবলার কাছে।
(চলবে)
বাঁকা পাঁজরের মেয়ে (পর্ব বার ) // নুরুদ্দিন ফারাহ, অনুবাদ: লুনা রাহনুমা