Home » অসুখ // ইরফানুর রহমান রাফিন

অসুখ // ইরফানুর রহমান রাফিন

নাম?
– নাফিসা আহমেদ।
বয়স?
– ২৩।
কী কারণে এসেছেন?
– ডায়ালাইসিস।

প্রত্যেক রবিবার আর বুধবার। বিকেলবেলা। একই রুটিন।

বলতে বলতে নাফিসার এটা মুখস্ত হয়ে গেছে। সামনের জুন মাসে গিয়ে এক বছর হবে। পাক্কা এক বছর।

আজকে অবশ্য রিসিপশনে অন্য একটা লোক ছিল। কারণটা বলতেই সে চোখ সরু করে তাকাল। ২৩ বছর বয়সী মেয়ে ডায়ালাইসিস করাতে এসেছে?

কার?
– আমার।
সাথে কে এসেছে?
– সাথে কেউ আসেনি, আমি একাই এসেছি।
মেয়েমানুষ একা এসেছেন?
– ভাই এতো ভ্যাজরভ্যাজর করবেন না তো, রিসিট কেটে টাকাটা নেন, আমার তাড়া আছে।

লোকটা বিরক্ত হল। নাফিসা সেই বিরক্তি দেখেও দেখল না যেন। দুনিয়ায় সবাইকে অতোটা পাত্তা দিতে হয় না।

৩৪০০ টাকা রিসিপশনে দিয়ে সে রশিদ নিল। ইনভেস্টিগেশন কপি ফার্মাসির কাচের দেয়ালের ভেতরে একটা টুলের ওপর বসে ঝিমাতে থাকা লোকটার দিকে সাবধানে ছুঁড়ে দিল। কাস্টমার কপি দলিল হিশাবে নিজের কাছে রাখল।

নতুন বিল্ডিংয়ের লিফট। সাত তলা। ডায়ালাইসিস ইউনিট।

ইউনিটে ঢুকতেই রুবি আপা জানালেন, বাইরে বসেন। একটু সময় লাগবে। ৬ নাম্বারটা খালি হতেই আপনাকে দিয়ে দিচ্ছি।

একটু না, তার মানে, ভালোই সময় লাগবে। আধ ঘন্টার আগে বেড খালি হবে না। ৬ নাম্বার বেডে ওটা সালেহা আন্টি না?

সালেহা আক্তার আর নাফিসার ডেট সপ্তাহের একই দিনগুলিতে, তফাৎ কেবল উনার যখন শেষ হয়, ওর শুরু হয়। আগে সাথে ছেলে আসতো উনার, দেখত নাফিসা। এখন একাই আসেন।

একমাত্র ছেলে, কোথায় যেন চাকরি পেয়ে গেছে। ছেলেটা একটু চুপচাপ। নাফিসার সাথে একবার কি দু’বার দৃষ্টিবিনিময় হয়েছে, দু’জনেই সৌজন্যের হাসি ফিরিয়ে দিয়েছে একে অপরকে, কথা হয়নি।

তবে ছেলেটার মার সাথে একদিন কথা হয়। একা একা আসে শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেন। নাফিসা তাড়াতাড়ি বলে, বাসা তো কাছেই, খালাম্মা! রিকশা নিয়ে চলে আসি, সমস্যা হয় না। শুনে সন্তুষ্ট হন নাই মহিলা, বুঝেছে সে। বিস্ময়ের কারণ তো দূরত্ব না, একাকীত্ব ওর। তবে মহিলার ভদ্রতাজ্ঞান অসামান্য, কেন একা একা আসে, এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেননি।

দরজা ঠেলে বেরিয়ে জানলা লাগোয়া চেয়ারে বসলো সে। কালবৈশাখী চলছে এখন। মে মাস, যে-কোনো মুহূর্তে হঠাৎ বৃষ্টি নামবে।

গত মে-তে সামির ওকে ছেড়ে চলে গেছিলো, দিনতারিখ ভুলে গেছে, আসল কথা হচ্ছে মনে রাখতে চায় না। গাধা টাইপের ছেলে, ভেবেছে নাফিসা কখনোই আর সুস্থ হবে না, হাত-মুখ-ফোলা নতুন বৌ … সমাজ কী বলবে! অথচ ডাক্তার কিন্তু নাফিসাকে পরিষ্কার করে বলেছেন, যেহেতু তার হাই বিপি বা ডায়াবেটিস এসবের কিছুই নাই, একসময় ডায়ালাইসিস বন্ধ করে দিয়ে শুধু ওষুধপত্রেই ওকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব।

যাক। ভালো থাকুক। মনে মনে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল নাফিসা, সুন্দর দেখে সুস্থ একটা মেয়ে বিয়ে করে কিছু সুস্থ বাচ্চাকাচ্চার বাপ হোক।

তারপর হেসে ফেলল। মাত্র এক বছরেই কতো ভিণ্ডিকেটিভ হয়ে গেছে। অথচ ও তো কখনো এমন ছিল না!

বা, হয়তো, সে আসলে সবসময় এমনই ছিল। সুস্থ থাকলে মানুষ কাউকেই চিনতে পারে না। অসুস্থ হলে চেনে, নিজেকে চেনে, অন্যদেরকে চেনে।

সালেহা আক্তার একটা হুইলচেয়ারে করে বেরিয়ে এলেন। রমিজ, হাসপাতালের কর্মচারী, সেই বার করে এনেছে। নাফিসাকে দেখলেন তিনি।

নাফিসা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, হাসি মুখে। ভালো আছেন, আন্টি? মহিলা কিছু বলতে পারলেন না, খুব দুর্বল। চোখগুলো জ্বলল শুধু। এই অবস্থায় মানুষ যতোটা ভালো থাকতে পারে! অনেক কষ্ট করে তিনি একটা হাত তুললেন। নাফিসা মাথা নাড়ল।

রুমে গিয়ে সে মেশিনে তার ওজন মাপল। বেশি বাড়েনি। এটা ভালো লক্ষণ।

শরীরে পানি যত কম জমবে, ওজনও তত কম বাড়বে, যেহেতু মেপে খেতে হয়।

বেডে গিয়ে আস্তে করে শুয়ে পড়লো নাফিসা। হাতে যন্ত্রপাতি লাগাতে আরো খানিকটা সময় লাগবে। তারপর চার ঘন্টা।

ঢাকা শহরে দেখার মতো তেমন কিছু নেই। ওর মনে হয়। যা আছে সে তাও দেখতে পারে না। এই চার ঘন্টা। ওকে বলা হয়েছে এই সময়টা ঘুমালে ভালো। ঘুম আসে না। রাজ্যের সব চিন্তা মাথায় এসে ভর করে।

এক এনজিও পরিচালিত হাসপাতালে এরচে অনেক সস্তায় ডায়ালাইসিস করানো যায়। নাফিসাকে কয়েকজন বলেছে। কিন্তু সে এখানেই বেশি স্বস্তি বোধ করে।

ও ভেবে দেখেছে, সামির চলে যাওয়ায় ওর যতোটা খারাপ লেগেছে, তারচে বেশি লাগে প্রস্রাব করতে না পারায়। এটা যে অসহ্য যন্ত্রণাদায়ক একটা অনুভূতি, তা কিডনি সমস্যা নেই যার, তাকে হাজার বলেও বোঝান যাবে না। আর প্রথমদিকে যখন পানি এসে ওর হাত, পা, মুখ ফুলে যেত; নাফিসা বারবার আয়নায় নিজের চেহারা দেখত।

– আমাকে কি খুব কুৎসিত দেখাচ্ছে, আব্বু?

ওর বাবা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা জামাল আহমেদ, যাকে সবাই একজন কঠোর প্রকৃতির লোক হিশাবেই জানে, তিনি এই প্রশ্ন শুনে কেঁদে ফেলেছিলেন।

– তোকে সবসময় রাজকন্যার মতো দেখায় রে মা…

বাবারা বিশ্বাসযোগ্যভাবে মিথ্যা বলতে পারে, নাফিসা ভাবে।

ভাবতে ভাবতে নাফিসার চোখ জড়িয়ে আসতে থাকে। আর ওর চিন্তাগুলোও সব জড়িয়ে যেতে থাকে। ঘুম আসছে, ঘুম।

ঘুমিয়ে যাওয়ার আগে সে একটা রিকশায় ওঠে। রিকশাটা একটা উপন্যাসের। যেখানে যুগলেরা রিকশায় পাশাপাশি বসে বৃষ্টিতে ভেজে, ভিজতে ভিজতে ইউনিভার্সিটি এরিয়ায় ঘুরে বেড়ায়।

নাফিসার রিকশাটা অন্যরকম, ওর পাশে কেউ নেই।

Ajit Dash

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ভাষা
Scroll to Top