অরওয়েলের মা ও বাবা
আমি মনে করি, কোনো লেখকের প্রাথমিক বিকাশ সম্পর্কে অবগত না হয়ে তাঁর উদ্দেশ্যসমূহ মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়, তাই আমি এই সমস্ত পটভূমির অবতারণা করছি। লেখকের বেঁচে থাকা সময়ের দ্বারাই তাঁর লেখার বিষয়বস্তু নির্ধারণ হবে। অন্তত আমাদের নিজেদের সমকালের অশান্ত ও বিপ্লবী যুগে বিষয়টি অতি সত্য। তবে লেখক এমন এক আবেগপূর্ণ মনোভাব নিয়ে লিখতে শুরু করেন, যেখান থেকে তিনি কখনই সম্পূর্ণরূপে সরে যেতে পারেন না। নিঃসন্দেহে, নিজের মেজাজকে নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং অপরিপক্ক পর্যায়ের কোনো বিকৃত ভাবনায় আটকে না যাওয়াই তার প্রধান কর্তব্য। তবে তিনি প্রথম দিকের প্রভাব থেকে পুরোপুরি সরে গেলে তা হয়ে ওঠে আপন লেখক সত্তাকে হত্যার সামিল।
-জর্জ অরওয়েল, কেন আমি লিখি (১৯৪৬)
অরওয়েলের বন্ধু, হিতৈষী, সম্পাদক এবং সাহিত্য নির্বাহক রিচার্ড রিস জীবনীকারদের পরামর্শ দিয়েছেন যে, জর্জ অরওয়েলকে বোঝার জন্য এরিক আর্থার ব্লেয়ারকে বুঝতে হবে। সত্যিকার অর্থে অরওয়েলকে বোঝার জন্য, তার মা ও বাবা এবং তাঁদের প্রসঙ্গকে আমাদের বর্তমানের চেয়ে আরও বিশদভাবে বুঝতে হবে।
অরওয়েল খুব কম চিঠিই সংরক্ষণ করেছেন। তাঁর লেখাতেও খুব কমই তাঁর পারিবারিক প্রেক্ষাপট প্রতিফলিত হয়েছে। দুটি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম অবশ্য রয়েছে, ‘দ্য রোড টু উইগান পিয়ার’ (১৯৩৮) এবং তাঁর প্রবন্ধ ‘কেন আমি লিখি’ (১৯৪৬)। তাঁর এই দুটি রচনায় বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের উপর শৈশব প্রভাবের অত্যন্ত মৌলিক এবং উপলব্ধিমূলক বিশ্লেষণ রয়েছে। তাঁর মায়ের সংক্ষিপ্ত দিনপঞ্জী (১৯০৫) পাওয়া যায়, কিন্তু তাঁর পিতার কাছ থেকে এমন কিছুই পাওয়া যায়নি। রিচার্ড ওয়ালমেসলে ব্লেয়ারকে বৃদ্ধ বয়সে চিনতেন এমন লোকদের কাছ থেকে কয়েকটি উপাখ্যান পাওয়া যায় মাত্র। ১৯৩৮ সালে মরক্কোতে বসবাসকালে অরওয়েল তাঁর বাবাকে পাঠানো কয়েকটি ফটোগ্রাফ এবং মাত্র একটি চিঠি পাওয়া যায়। সহজেই বোধগম্য যে, প্রাথমিক উত্সগুলোর তীব্র সংকটের ফলে জীবনীকারদের অনেক ত্রুটি রয়েই গেছে। অরওয়েলের বাবা-মা সম্পর্কে তাঁদের একমাত্র পুত্রের জন্মের সময় পর্যন্ত কতিপয় তথ্য পাওয়া যায়।
সেই সময়ে ভারতের সংযুক্ত প্রদেশ আগ্রা-অযোধ্যা’র গ্রীষ্মকালীন রাজধানী ছিল মনোরম স্থান নৈনিতাল। প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যেতে পারে, অরওয়েলের বাবা ও মায়ের ১৮৯৬ সালে নৈনিতালে দেখা হয়েছিল। ২১ বছর বয়সী ইডা মেবেল লিমুজিন তখন স্থানীয় একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। নয়াদিল্লি থেকে ৩৪৫ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বের এই শহরটির আবহাওয়া ছিল খুবই মনোরম। নৈনি তাল অর্থাৎ নৈনি হ্রদ। হ্রদটি বর্তমান ভারতের উত্তরাখণ্ডের কুমায়ুনের নৈনিতাল শহরের মাঝখানে অবস্থিত একটি প্রাকৃতিক স্বাদুপানির উৎস। নৈনিতাল হল কুমায়ুনের অন্যান্য হ্রদের সাথে কুমায়ুনের পর্যটন এবং বিনোদনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই হ্রদটি কুমায়ুনি লোককাহিনীরও একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। নৈনিতাল হলো ভারতের উত্তরাখণ্ড অঙ্গরাজ্যের কুমায়ুন বিভাগের নৈনিতাল জেলার সদর শহর। বহিঃস্থ হিমালয় পর্বতমালার পাদদেশে সমুদ্র সমতল থেকে ২০৮৪ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত পর্বতবেষ্টিত এই শহরটি নাশপাতি আকারের একটি হ্রদের উপত্যকায় অবস্থিত। এখানকার পর্বতসমূহের চূড়া থেকে দৃশ্যমান ভূ-দৃশ্যাবলি অসাধারণ। দক্ষিণে রয়েছে বিস্তীর্ণ সবুজ সমভূমি আর উত্তরে তাকালে দেখা যাবে বরফাবৃত হিমালয়ের কেন্দ্রীয় পর্বতসমূহের সারি (নন্দা দেবী, ত্রিশূল এবং নন্দা কোট যাদের মধ্যে অন্যতম)।ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের আফিম বিভাগের কর্মকর্তা ৩৯ বছর বয়সী রিচার্ড ওয়ালমেসলে ব্লেয়ার ছয় মাসের ছুটিতে নৈনিতালে গিয়ে পৌঁছেন। বছরের মাঝামাঝি সময়ে সমতল ভূমির তাপমাত্রা অসহনীয় হয়ে উঠলে ভারতীয় উপমহাদেশের অনুচ্চ এই পাহাড়ি শহরটি সৌখিন পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। এখানে একমাত্র অ-ইউরোপীয়রাই ছিল চাকর-বাকর বা সরাসরি সেবাকর্মে জড়িত।

ঐতিহাসিক নথিপত্র থেকে জানা যায় যে, ১৮৩৯ সালে প্রথম নৈনিতাল ভ্রমণকারী বলে মনে করা হয় মিস্টার পি. ব্যারনকে। তিনি ছিলেন একজন ইংরেজ চিনি ব্যবসায়ী। এক অভিযানে তিনি দুর্ঘটনাক্রমে নৈনিতালের হ্রদ পার হন। সব মিলিয়ে তিনি এতটাই মুগ্ধ হন যে, হ্রদের তীরে একটি ইউরোপীয় উপনিবেশ তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৮৪১ সালে দ্য ইংলিশম্যান ক্যালকাটা নামে সংবাদপত্রটি আলমোড়ার কাছে এই হ্রদটি আবিষ্কারের খবর প্রকাশ করে। হাতেগোনা কয়েকটি পাহাড়ি স্থানের মধ্যে বর্তমান ভারতের উত্তরাখণ্ডের নৈনিতাল ছিল অনন্য। বিশালাকার এক প্রাকৃতিক জলাধার এবং বিশাল সমতলভূমির সমন্বয়ে প্রকৃতির আশীর্বাদধন্য এক মনোরম পার্বত্য এলাকা। ১৮৮০ সালে ভূমিধ্বসের ফলে হ্রদের এক প্রান্ত ভরাট হয়ে যায়। একারণে শহরটি খেলাধুলা এবং বিনোদনের একটি জনপ্রিয় অনুশীলণ স্থানে পরিণত হয়ে ওঠে। ফ্যান্সি ড্রেস ব্যালে, গুপ্তধনের সন্ধান, নৃত্য, সৌখিন কুকুর প্রদর্শনী, নাটক মঞ্চায়ন এবং শুটিং পার্টিসমূহে নারী-পুরুষদের পরস্পর পরিচিত হওয়ার প্রচুর সুযোগ ছিল। টেনিস বা ক্রিকেট খেলা, পোলো দেখা, রোয়িং উপভোগ করার সময়, বোট রেস এবং পুরুষ বনাম প্রমীলা ক্রিকেট ম্যাচের সময়ও সেই সুযোগ অবারিত ছিল। ভারতের উত্তপ্ত এবং অস্বাভাবিক আবহাওয়ার মধ্যে নৈনিতালের আবিষ্কারটি ব্রিটিশদের জন্য একটি আশীর্বাদের মতো ছিল। মাতৃভূমির শীতল তাপমাত্রায় স্মৃতিকাতর ব্রিটিশ সাহেবরা নৈনিতালের আবহাওয়ায় স্বস্তি খুঁজে পেতেন।
মূলত ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত ব্যক্তিরাই নৈনিতালের বসতি স্থাপন ও উন্নয়নের পাশাপাশি পর্যটনের সূচনার কৃতিত্বের দাবীদার। এই উদ্যোগটি মূলত কিংবদন্তি শিকারী-পরিবেশবিদ জিম করবেটের মা মেরি জেনের কৃতিত্ব বলা যেতে পারে। তিনিই কার্যত পাহাড়ি শহরটির পর্যটন বিষয়ক কর্মকাণ্ডের জননী ছিলেন। কারণ তিনিই সর্বপ্রথম দর্শনার্থীদের থাকার জন্য আবাসিক স্থাপনা বা অধুনা প্রচলিত হোম স্টে নির্মাণ করেন। মেরি জেন বসবাস করতেন মুসৌরি এবং নৈনিতালের পাহাড়ে এবং নৈনিতালেই তিনি ১৯২৪ সালের ১৬ মে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর শেষ বিশ্রামের স্থানটিও এই শহরের কোলে অবস্থিত। তাঁকে সেন্ট জন-ইন-দ্য-উইল্ডারনেস চার্চের কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। এডোয়ার্ড জেমস করবেট বা জিম করবেটের বাবার নাম ছিল ক্রিস্টোফার উইলিয়াম। আইরিশ বংশোদ্ভূত ক্রিস্টোফার ছিলেন নৈনিতাল ডাকঘরের পোস্টমাস্টার। করবেটের চার বছর বয়সে বাবা মারা যান, করবেটের বড় ভাই টমাস পিতার সূত্রে ডাকঘরের চাকরিটি পান। নৈনিতালের আয়ার পাটায় ওঁদের বাড়িটির নাম ছিল ‘গার্নি হাউস’। নৈনিতাল ছিল করবেট পরিবারের গ্রীষ্মাবাস। জিম করবেটের লেখায় পাওয়া যায়, নৈনি হ্রদের পাশের নৈনি দেবীর মন্দিরের চার মাইলের মধ্যে তিনি অন্যান্য প্রাণী সহ বাঘ, চিতা, ভাল্লুক ও সম্বর দেখেছেন এবং ওই একই জায়গায় একশো আটাশ জাতের পাখি শনাক্ত করেছেন। জিম করবেটের নামেই “করবেট ন্যাশনাল পার্ক” নামকরণ করা হয়েছে। তবে ইতিহাসের এই অংশটি মনে হয় সময়ের গর্ভে চাপা পড়ে গেছে। মনোরম শৈল শহরটি এখনও প্রতি বছর পর্যটকদের ভিড়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠে।

‘অরওয়েল অ্যান্ড রিলিজিয়ন’(২০১৭) গ্রন্থে মাইকেল ব্রেনান প্রস্তাব করেন যে, ইডা মেবেল লিমুজিনের পরিবার রোমান ক্যাথলিক ধর্মমতাবলম্বী ছিল। ইডা সম্ভবত নৈনিতালের সেন্ট জোসেফ ক্রিশ্চিয়ান ব্রাদার্স বয়েজ স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। ব্রেনান অনুমান করেছিলেন যে ইডার মা থেরেসা ক্যাথরিন হ্যালিলির(১৮৪৩-১৯২৫) নামের মধ্যে একটি গোঁড়া ক্যাথলিক সংমিশ্রণ ছিল এবং বাবা ফ্র্যাঙ্ক ম্যাথু লিমুজিন (১৮৩৫-১৯১৫) ছিলেন ফ্রান্সের ধর্মপ্রাণ ক্যাথলিক অঞ্চল বলে খ্যাত লিমোজেসের বাসিন্দা। প্রামাণিক তথ্যসমূহ এই বিবৃতিকে সমর্থন করে না। হ্যালিলি’র নিজের বাবা-মা বর্তমান শ্রীলংকার কলম্বোর বিখ্যাত অ্যাংলিকান গির্জা সেন্ট পিটারস চার্চে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। ফ্রাঙ্ক এসেছিলেন ফ্রান্সের বোর্দো থেকে। বোর্দো অঞ্চলের পাদরিরা ঈশ্বরভক্তির চেয়েও তাদের দ্রাক্ষাক্ষেত্রের জন্য বেশি পরিচিত ছিলেন। প্রমাণ রয়েছে যে ফ্রাঙ্কের ঠাকুরদা আন্তোইন লিমুজিন (১৭৬৪-১৮৪১) যিনি তাঁর নাতির মতো কোনো জাহাজের কাপ্তান ছিলেন। তিনি ইডা লিমুজিনের জন্মের একশ বছর আগে রোমান ক্যাথলিক চার্চে বাপ্তিস্ম নিয়েছিলেন। ইডার পরিবার নিজেদেরকে রোমান ক্যাথলিক বলে মনে করত এমন কোনো ইতিহাসও নেই। আবার এটাও লক্ষণীয় যে, লিমুজিন এবং হ্যালিলি গোষ্ঠীর বেশ কয়েকজন সদস্য ছিলেন ফ্রিম্যাসন। ফ্রিম্যাসন হল ১৮ শতক থেকে ক্যাথলিক চার্চ কর্তৃক নিষিদ্ধকৃত একটি গোপন সমাজ। এটাও উল্লেখযোগ্য যে, ফ্রাঙ্ক ম্যাথু লিমুজিনের প্রথম স্ত্রী ছিলেন এলিজা ফ্যালন (১৮৪১-১৮৬৫)। অকালমৃত্যুর কারণে তাঁকে এবং তাঁর দুই সন্তানকে ১৮৬৫ সালে বার্মার মৌলমেইন শহরের অ্যাংলিকান কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
‘থ্যাকার‘স ইন্ডিয়ান ডাইরেক্টরি’তে (১৮৯৭) মিস ইডা মেবেল লিমুজিনকে নৈনিতালে “প্রথম শিক্ষক, বালিকা বিদ্যালয়” হিসাবে তালিকাভুক্ত করেছে। সেক্ষেত্রে মাত্র দুটি সম্ভাবনা দেখা যায়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের রেকর্ডে বিদ্যমান নেই, তবে এমন কিছু স্পষ্ট প্রাসঙ্গিক সূত্র মোতাবেক ইডা লিমুজিন তখন সেইন্ট মেরি‘জ কনভেন্ট হাই স্কুলে নয়, অল সেইন্টস ডায়োসেসান হাই স্কুলে নিযুক্ত ছিলেন। “থ্যাকার‘স ইন্ডিয়ান ডাইরেক্টরি” অরওয়েলের মাকে “ফার্ন কটেজে” বসবাসকারী নারী হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। এই বাসভবনটি তখন “ডায়োসেসান স্কুল ফর বয়েজ”-এর প্রাক্তন অধ্যক্ষ মিস্টার আর জে এলিয়ট নামের জনৈক ইংরেজের মালিকানাধীন ছিল। ১৮৬৯ সালে ৫ জুন প্রতিষ্ঠিত ভারতের বর্তমান উত্তরাখণ্ড রাজ্যের নৈনিতালে অবস্থিত শেরউড কলেজ ছিল সহ-শিক্ষামূলক একটি আবাসিক বিদ্যালয়। ‘দ্য ইকোনমিক টাইমস’ এই স্কুলটিকে “ইংল্যান্ডের ইটন কলেজের সমতুল্য … প্রাচীন, সমৃদ্ধ এবং জনপ্রিয় স্কুলগুলোর একটি হিসেবে বর্ণনা করেছে”। ডক্টর কন্ডন ও এইচ এস রেইডের মস্তিষ্কপ্রসূত এই ধারণাটি ভারতের সপ্তম প্রধান ধর্মাধ্যক্ষ রেভারেন্ড রবার্ট মিলানের পৃষ্ঠপোষকতায় নৈনিতাল ডায়োসেসান বয়েজ হাই স্কুল নামে রূপ ধারণ করে, যেমনটি শেরউড নামে পরিচিত ছিল। পূর্বে ডায়োসেসান গার্লস হাই স্কুল নামে পরিচিত শেরউডের শাখা বিদ্যালয়টি পরবর্তীতে নৈনিতালের অল সেইন্টস কলেজের শাখা হয়ে ওঠে। সেই সময়ে অজস্র ভর্তির আবেদন প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ, এর ফলে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষাব্যবস্থার জনপ্রিয়তা ও সাফল্যের আঁচ পাওয়া যায়। একারণেই এরপর বালক থেকে বালিকা শাখা আলাদা করা হয় এবং পরবর্তীতে রামসে হাসপাতালের কাছে স্টোনলেতে স্থানান্তরিত হয়।
ই. অ্যাটকিনসনের ১৮৮২ সালের হিমালয়ান গেজেটিয়ার অনুসারে: “১৮৭২ সালে ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ১০০ জনে উন্নীত হয়, কিন্তু তারপরও বাসস্থানের সংকুলান না হওয়ার দরুন অনেক আবেদন প্রত্যাখ্যান করতে হয়। কমিটি তখন একটি মানানসই স্কুল ভবন নির্মাণের জন্য সাধারণ জনগণের কাছে সাহায্যের আবেদন করে। আবেদনের জবাবে সাধারণ জনগণ অকৃপণ হস্তে অর্থ দান করতে থাকে। এর ফলে ১৮৭৩ সালে বালক বিদ্যালয় নির্মাণকল্পে কমিটি বিশাল প্রাতিষ্ঠানিক ভবন এবং চমৎকার মাঠসহ শেরউড এস্টেটটি ক্রয় করে। এটি সম্ভবত ভারতে এই ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে সেরা স্থান এবং স্থাপনার নিদর্শন হয়ে ওঠে।”
এই তথ্যটি উন্মোচনের ফলে অরওয়েলের মা যেখানে শিক্ষকতা করতেন, সেই স্কুলের প্রাথমিক ইতিহাস সম্পর্কে একটি ভাল ধারণা পাওয়া যায়। ইডা লিমুজিনের বোন নেলি লিমুজিনসহ স্বজনেরাও ছিলেন, যারা রেঙ্গুনের ডায়োসেসান গার্লস হাই স্কুলে কাজ করতেন। মিস্টার আর জে এলিয়ট তাঁর বাড়িটি একজন নতুন শিক্ষককে ভাড়া দিয়েছেন বলে বিবেচনা করা হয়। উপরের আলোচনায় উল্লেখিত মনোমুগ্ধকর কুটিরটি এখনও বর্তমান। বাড়িটির ভেতরদিকে একটি ছোট উপাসনালয় রয়েছে যা মূল মালিক রবার্ট রিড তাঁর ‘ক্যাথলিক স্ত্রী’র জন্য নির্মাণ করেন। ইডা লিমুজিন কেন নৈনিতালে শিক্ষকতার চাকুরি করতে এসেছিলেন? বাস্তবে এর কোনোটিই এই প্রশ্নের পর্যাপ্ত উত্তর দেয় না। বলা হয়ে থাকে, তিনি এমন কারও প্রেমে প্রতারিত হয়েছিলেন যে তাঁকে এই শহরে নিরুপায় ও অসহায় অবস্থায় ফেলে চলে যায়। অথবা সম্ভবত তিনি দুঃসাহসী ছিলেন এবং মৌলমেইনে থাকা তাঁর পরিবার থেকে দূরে নৈনিতালে চাকরির সুযোগটি স্বেচ্ছায় লুফে নিয়েছিলেন। উপরোক্ত দুইটি বক্তব্যেরও নির্ভরযোগ্য কোন সূত্র নেই, শুধুই জল্পনা বলা যেতে পারে।
রিচার্ড এবং ইডা লিমুজিন ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই জুন নৈনিতালের সেন্ট জন-ইন-দ্য-উইল্ডারনেস চার্চে বিয়ে করেন। বিয়ের সনদ অনুসারে বলা হয়ে থাকে যে, ইডা লিমুজিনের বোনদের মধ্যে একজন বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন এবং রিচার্ড ডব্লিউ ব্লেয়ারের পক্ষে লক্ষ্ণৌয়ের অধিবাসী জনৈক আইনজীবী বন্ধু উপস্থিত ছিলেন। তবে, কোনো ক্যাথলিক স্কুলের একজন শিক্ষক স্থানীয় অ্যাংলিকান চার্চে বিয়ে করবে- এরকম ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা খুবই কম। রিচার্ড ডব্লিউ ব্লেয়ার ছিলেন ভারত সরকারের আফিম বিভাগে কর্মরত। ১৮৬০ সাল থেকে চীনের সাথে একচেটিয়াভাবে আফিম ব্যবসা সরকারীভাবে বৈধ ঘোষণা করা হয়। রিচার্ড মাত্র ১৮ বছর বয়সে ভাগ্য অন্বেষণে এই চাকুরিতে এসে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর অনুল্লেখ্য কর্মজীবন সম্পর্কে অল্প কিছুই জানা যায়। তিনি বছরের শুরুর দিকে একজন আফিম এজেন্ট হিসেবে সমগ্র জেলায় ঘুরে বেড়াতেন, ঘুরে ঘুরে তিনি পপি চাষীদের অগ্রিম দাদন দিতেন এবং তাদের বুড়ো আঙ্গুলের টিপসই নিতেন। তিনি একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর ফসলের গুণগত মান পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে আবার চাষীদের কাছে ফিরে যেতেন। কাজটি স্পষ্টভাবে বিরক্তিকর এবং একঘেয়েমি রকমের ছিল।
সেকালের গেজেটেড এবং বাংলা সরকারের অধীনে কর্মরত চিকিৎসা, পুলিশ, শিক্ষা এবং অন্যান্য বিবিধ বিভাগের অধীনস্থ কর্মকর্তাদের পরিষেবার ইতিহাস তালিকার দ্বিতীয় খণ্ডে দেখা যায় যে, বেচারা রিচার্ড ডব্লিউ ব্লেয়ার ১৮৭৫ সালে প্রথমে সহকারী সাব-ডেপুটি আফিম এজেন্ট হিশেবে চাকুরিতে যোগদান করেন। এরপর থেকে প্রায় ফি-বছর তিনি বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে বদলীর আদেশ পেতে থাকেন। ৫৫ বছর বয়সে তাঁর অবসর গ্রহণ পর্যন্ত তিনি সাব-ডেপুটি আফিম এজেন্ট পদে কর্মরত ছিলেন। প্রায় কুড়ি বছর ধরে তাঁর কর্মস্থল বদল হতেই থাকে। বলাবাহুল্য যে, কর্মস্থলের কোনোটিই তেমন মনোরম স্থান ছিল না। ১৮৯০-এর দশকে একবারই মাত্র রিচার্ড ডব্লিউ ব্লেয়ার বাংলা প্রেসিডেন্সির বিহারের তেহতার গয়া জেলায় ছয় বছর কর্মরত ছিলেন। সেই সময়, ১৮৯৮ সালের ২১ এপ্রিল তারিখে গয়া শহরেই ব্লেয়ার দম্পতির প্রথম কন্যাসন্তান মার্জোরি ব্লেয়ার জন্মগ্রহন করেন। এরপর ব্লেয়ার দম্পতির বিয়ের ছয় বছর পর ১৯০৩ সালের ২৫ জুন হিমালয় পর্বতমালার পাদদেশে তখনকার বাংলা প্রদেশের অন্তর্গত বিহারের মোতিহারিতে তাঁদের একমাত্র পুত্রসন্তান এরিক আর্থার ব্লেয়ার (জর্জ অরওয়েল) জন্মগ্রহণ করেন। নিচের ছবিটি সম্ভবত ১৯০৩ সালের ৩০ অক্টোবর তোলা হয়েছিল। ওইদিন অরওয়েল প্রোটেস্ট্যান্ট, রিজিয়ন্স বিয়ন্ড মিশনারি ইউনিয়নে বাপ্তিস্ম গ্রহণ করেছিলেন। ১৮৭৩ সালে রিজিয়ন্স বিয়ন্ড মিশনারি ইউনিয়ন ছিল হেনরি গ্র্যাটান গিনেস ডিডি এবং তাঁর স্ত্রী ফ্যানি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত একটি প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টান মিশনারি সমাজ।

এছাড়াও রিচার্ড ডব্লিউ ব্লেয়ার আরেকটি স্থানে দীর্ঘ সময় চাকুরি করেন, ইতিহাসখ্যাত সেই স্থানটির নাম মুঙ্গের। বর্তমানে ভারতের বিহার রাজ্যের ৩৯টি জেলার অন্যতম হল এই মুঙ্গের। মুঙ্গের নামটির ব্যুৎপত্তি নিয়ে একাধিক কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। একটি কিংবদন্তি অনুসারে, মুঙ্গের নামটি প্রাচীন মুদ্গগিরি নাম থেকে এসেছে। মহাভারতে এবং দেবপালের তাম্রলিপিতেও এই নামটি পাওয়া যায়। অন্যমতে এই নামটি এসেছে ঋষি মুদগল বা গৌতম বুদ্ধের শিষ্য মৌদগল্যায়নের নাম থেকে। মুঙ্গের জেলার ভূখণ্ডটি প্রাচীনকালে অঙ্গ মহাজনপদের অন্তর্গত ছিল। মহাভারতে কর্ণকে অঙ্গের রাজা বলা হয়েছে। পাল সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল মুদ্গগিরি বা মুঙ্গের। বাংলার নবাব মিরকাশিম ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য মুঙ্গেরে গঙ্গার তীরে তিন দরজাবিশিষ্ট একটি দুর্গ নির্মাণ করেন। ব্রিটিশ শাসনের প্রথম দিকে মুঙ্গের ভাগলপুর জেলার অংশ ছিল। ১৮৩২ সালে মুঙ্গেরকে পৃথক জেলার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। যাই হোক, রিচার্ড ডব্লিউ ব্লেয়ার তাঁর পুত্র জর্জ অরওয়েলের জন্মের এক বছর পর মুঙ্গেরে বদলী হন। সেই থেকে অবসর নেওয়া পর্যন্ত তিনি ওখানেই কর্মরত ছিলেন।
অরওয়েলের জন্মের অনেক আগে থেকেই তাঁর জীবনের সুত্রগুলো উপনিবেশের গভীর বুননে বোনা হয়েছিল। মোতিহারিতে অরওয়েল যে বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেখান থেকে মাত্র ঢিল ছোঁড়ার দূরত্বে ছিল আফিম সংরক্ষণের গুদাম। ১৯৮৩ সালে স্কটিশ সাংবাদিক ইয়ান জ্যাক অরওয়েলের জন্মস্থানটি পরিদর্শন করেন, এর আগের কয়েক দশক ধরে বাড়িটি অবহেলিত অবস্থায় পড়ে ছিল। অরওয়েলের বিশ্বখ্যাত উপন্যাস ‘১৯৮৪’ এর সাথে মিল রেখে প্রতীকীভাবে উল্লেখযোগ্য ১৯৮৪ সালে একটি নিবন্ধ প্রকাশের পরিকল্পনা হাতে নেন জ্যাক। আর সেই কারণেই অরওয়েলের শিকড় সন্ধান করতে তিনি এর আগের বছর ভারত ভ্রমণ করেন। পরবর্তীতে সেই নিবন্ধে জ্যাক উল্লেখ করেছেন যে, শহরবাসীদের প্রায় কেউই বিশ্বনন্দিত এই লেখকের স্থানীয় শিকড় সম্পর্কে অবগত ছিলেন না।

ভারতের বিহার রাজ্য সরকার ২০১৪ সালে ঘোষণা করে যে, অরওয়েলের জন্মস্থান হিসেবে শনাক্ত স্থান মোতিহারিতে অবস্থিত বাংলোটি বিশ্বের প্রথম অরওয়েল জাদুঘর হিশেবে পরিচিত হবে। মোতিহারিতে তাঁর জন্মস্থান এবং পৈতৃক আবাসকে ঐতিহাসিক গুরুত্ববাহী সুরক্ষিত স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। জর্জ অরওয়েলের জন্মের স্মৃতি বিজড়িত জরাজীর্ণ ঔপনিবেশিক বাংলোটিকে ভারতের সংরক্ষণবাদীরা পুনরুদ্ধার করার কাজ শুরু করেন। বিহার রাজ্য সরকার বাড়িটিকে লেখকের নামে উত্সর্গ করে একটি জাদুঘরে রূপান্তর করার পরিকল্পনা ঘোষণা করে। ১৯০৩ সালের ২৫ জুন অরওয়েল তিন কক্ষবিশিষ্ট যেই বাড়িটিতে জন্মগ্রহণ করেন তার পাশাপাশি, মোতিহারির ছোট্ট শহর এলাকায় আরও কয়েকটি ছোট কটেজ এবং একটি বড় গুদাম রয়েছে। এই স্থাপনাসমূহকে আফিম সংরক্ষণের জন্য ব্যবহার করা হত। অরওয়েলের বাবা রিচার্ড ডব্লিউ ব্লেয়ার ভারত-নেপাল সীমান্ত ঘেষা এই প্রত্যন্ত শহরে আফিম বিভাগে কাজ করতেন। তিনি পপি চাষীদের তত্ত্বাবধান করতেন এবং চীনে রপ্তানির জন্য আফিম সংগ্রহ করতেন। কয়েক বছর আগে “বিহার প্রাচীন স্মৃতিস্তম্ভ (সুরক্ষা) আইন, ১৯৭৬”-এর অধীনে রাজ্য সরকার এর চারপাশের জমি অধিগ্রহণ করে। এর আগে বহু বছর ধরে জমিটি একটি সরকারি স্কুলের দখলে ছিল। এমন অনেক ভবনই ধ্বংসাবশেষে রূপান্তরিত হয়েছে, কিন্তু অরওয়েলদের বসবাসের বাংলোটি এবং কাছাকাছি একটি কটেজ এখনও দাঁড়িয়ে আছে। আফিম গুদামটিকেও পুনসংস্কার করা হয়েছে। সংস্কার করার পর অবশেষে বাড়িটিকে একটি জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়েছে। রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা আশা করেন যে, জাদুঘরটি শেক্সপিয়রের স্ট্রাটফোর্ড-আপন-অ্যাভন বা টলস্টয়ের ইয়াসনায়া পলিয়ানার মতো একটি তীর্থস্থানে পরিণত হবে।
ভারতের বর্তমান বিহার রাজ্যের পূর্ব চম্পারন জেলার এই মোতিহারী থেকেই মহাত্মা গান্ধী ১৯১৭ সালে আইন অমান্য আন্দোলন (সত্যাগ্রহ) শুরু করেন, যা অবশেষে ৩০ বছর পরে ব্রিটিশদের ভারত থেকে প্রস্থান করতে বাধ্য করে। বিহারের চাষীরা যথাক্রমে চীন এবং ইউরোপের লাভজনক বাজারের জন্য আফিম এবং নীল উৎপাদন করতে বাধ্য হতেন। তাদের দুর্দশা দেখে মহাত্মা গান্ধী অনুপ্রাণিত হন। অরওয়েলের বাবা আফিম সংরক্ষন ও রপ্তানির দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। অরওয়েলের পূর্বপুরুষগণ অর্থাৎ ব্লেয়ার, হ্যালিলি, ফেইন, হেয়ার এবং লিমুজিনরা সাম্রাজ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন মাত্রায় সেবা দিয়েছেন। আরও অনুসন্ধানযোগ্য একজন আত্মীয় হলেন তাঁর আরেক মাতামহ উইলিয়াম আগর হ্যালিলি (১৮১৬-১৮৮৬), তিনি সিলন (শ্রীলংকা) সিভিল সার্ভিসে শুল্ক দপ্তরের প্রিন্সিপাল কালেক্টর পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।
১৯০৫ সালের ইডা লিমুজিনের ডায়েরিতে দেখা যায় যে তাঁর একটি সক্রিয় সামাজিক জীবন ছিল। তিনি ফটোগ্রাফি করতেন এবং তাঁর ভাইবোনদের বিশেষ করে নিজ বোন নেলি লিমুজিনের সঙ্গ উপভোগ করতেন। ১৯১২ সাল পর্যন্ত মিস্টার ব্লেয়ার ভারতে চাকুরিরত ছিলেন বলে ইডা তাদের সন্তানদের একাই লালন-পালন করেছেন। ১৯০৭ সালে রিচার্ড ডব্লিউ ব্লেয়ার তাঁর পরিবারের সাথে দেখা করার জন্য একটি লম্বা ছুটিতে ইংল্যান্ডে যান। এরপর ১৯০৮ সালে তাঁদের দ্বিতীয় কন্যা এভ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। ফরাসি বংশোদ্ভূত পিতার সন্তান হওয়া সত্ত্বেও ইডা লিমুজিন সেকালের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের মতো জীবনধারায় অভ্যস্ত ছিলেন। দুই মহাদেশের মাঝামাঝি স্থানে তিনি তাঁর সংসার পেতেছিলেন। তাঁর গতিপথের সময়রেখা সম্পর্কে আরও গভীর গবেষণার দাবী রাখে।
ইডা লিমুজিন ১৮৭৫ সালে লন্ডনের দক্ষিণ উপকণ্ঠের তখনকার এক আধা-গ্রামীণ, নতুন আবাসিক শহরতলী পেঙ্গে এলাকার হ্যালিলি নিবাসে এক পারিবারিক ছুটির সময় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মা ছিলেন ইংরেজ এবং তার বাবা ফরাসী বংশোদ্ভুত। সেখানে তাঁর বাবা সেগুন কাঠের ব্যবসা এবং নৌকা নির্মাণ শিল্পের ব্যবসা করতেন। বলা হয়ে থাকে পরে তিনি চাউলের ব্যবসা করতে গিয়ে অনেক অর্থদণ্ড দিয়েছেন। ইডা লিমুজিনের মা ছিলেন শক্তিশালী চরিত্রের এবং যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার অধিকারী একজন নারী। ১৯২২ সালে যখন তাঁর দৌহিত্র এরিক আর্থার ব্লেয়ার (জর্জ অরওয়েল) যখন বার্মায় ইম্পেরিয়াল পুলিশের চাকুরিতে যোগদান করতে যান, তখনও তিনি বেঁচে ছিলেন। ইডার শৈশবকাল কেটেছে বার্মার মৌলমেইনে, তবে ১৮৮৬ সালে তাঁর ১১ বছর বয়স থেকে তিনি তাঁর দুই বোনের সাথে ইংল্যান্ডের বেডফোর্ড হাইস্কুলে পড়াশুনা করেন। বিয়ের আগ পর্যন্ত তিনি ফরাসী পাসপোর্টেই ভ্রমণ করেছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, অরওয়েলের মা ইডা লিমুজিনের ফরাসি বংশের বাস্তব অনুধ্যায় এড়িয়ে গিয়ে দাবী করা হয় যে, তাঁর মায়ের পরিবার ইয়র্কশায়ার থেকে এসেছিল, উপনিবেশের চাকুরি ও সাম্রাজ্যের সাথে সেই বংশেরও গভীর সংযোগ ছিল। ইডার জীবনসঙ্গী নির্বাচন বিষয়ে ভাবতে গিয়ে অরওয়েলের জীবনীকাররা প্রায় সময় হতবুদ্ধি হয়েছেন। রিচার্ড ডব্লিউ ব্লেয়ারের তুলনায় যথেষ্ট কম বয়সী, বুদ্ধিমান, অধিকতর পরিশীলিত, আর কিছুটা উড়নচণ্ডি ইডাকে একজন অসম বিয়ের পাত্রী হিসাবে বর্ণনা করেছেন। ইডা ব্লেয়ার তাঁর স্বামীর চেয়ে আঠারো বছরের ছোট হলেও ছিলেন অত্যন্ত প্রাণবন্ত, সবার থেকে একটু আলাদা, অতিশয় পড়ুয়া এবং সবদিক থেকে অপেক্ষাকৃত আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারিনী। ইডা লিমুজিন ছিলেন একজন বাস্তববাদী নারী যিনি কঠিন পরিস্থিতিতেও স্থির থাকতে পারতেন, তাঁকে কখনই নিরানন্দ থাকতে দেখা যায়নি। সেই যুগে বিবাহ অনুষ্ঠানের স্বার্থে বয়স ও মেজাজের অসঙ্গতিগুলিকে মেনে নেওয়া হয়। অনেকেই মনে করতেন অরওয়েলের মা ও বাবা হয়তো কিছুটা অসুখী দম্পতি ছিলেন কিন্তু যদি তাদের দুজনের মধ্যে কোনো একজনকে সেই দিনের ভাষায় জিজ্ঞাসা করা হত, “তারা কি সুখী বিবাহিত দম্পতি ছিল?” তাহলে জবাবটি হত ‘হ্যাঁ’। রিচার্ড স্পষ্টতই একজন সহনশীল এবং সহজ-সরল ধরনের মানুষ ছিলেন। কতিপয় পরিচিতজনের স্মৃতিচারণ থেকে এটাও জানা যায় যে, রিচার্ডের বয়স বাড়ার সাথে সাথে তিনি কিছুটা খুঁতখুঁতে এবং রক্ষণশীলও হয়ে উঠেছিলেন ।
অরওয়েলের পিতামাতার এই অসঙ্গতিগুলি তাঁদের ছেলের আপাতবিরোধী, কিছুটা চমকপ্রদ এবং পরস্পরবিরোধী ব্যক্তিত্ব ব্যাখ্যা করার জন্য প্রায়শই প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। একটি আমূল, অর্ধেক প্রেমে সে কেন একজন বিদ্রোহী হয়ে উঠল! উদাহরণ হিশেবে বলা যেতে পারে, জর্জ অরওয়েলের রচনাবলী সাধারন পাঠকের কাছে যেমনটি প্রতিভাত হয়, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রতি তাঁর মনোভাব ছিল সেইসবের চেয়েও জটিল।
জর্জ অরওয়েল সর্বপ্রথম ক্ষুধা, দারিদ্র্য এবং সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে লেখালেখিতে আসেন ‘ডাউন অ্যান্ড আউট ইন প্যারিস অ্যান্ড লন্ডন’, ‘বার্মিজ ডেজ’, ‘দ্য রোড টু উইগান পিয়ার’ এবং কতিপয় ব্যক্তিগত প্রবন্ধের মাধ্যমে। প্রবন্ধসমূহ ছোটগল্পের মতোই এবং ‘দ্য স্পাইক’, ‘আ হ্যাঙ্গিং’ প্রভৃতি প্রবন্ধ তাঁর নিজের প্রকৃত নাম ‘এরিক আর্থার ব্লেয়ার’ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল। একজন যুবক হিসেবে ভারতীয় ইম্পেরিয়াল পুলিশে পাঁচ বছর চাকুরি করার পর ‘ভবঘুরে ও নিঃস্ব’ হওয়ার অভিজ্ঞতাসমূহ তাঁর নিজের মতামত রূপান্তরে সহায়তা করেছে। অরওয়েলের পূর্বপুরুষরা দাস ব্যবসা থেকে কীভাবে সম্পদ এবং সুযোগ-সুবিধা অর্জন করেছিলেন এবং তাঁর পিতা কীভাবে পুরো কর্মজীবন জুড়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে চীন দেশে আফিম রফতানির কাজ করেছেন, তা প্রায়শই আলোচনা করা হয় না। অরওয়েল নিজের লেখায় সাম্রাজ্যবাদ বা তাঁর বেড়ে ওঠার সময় সম্পর্কে কোনোটিই উল্লেখ করেননি।
অরওয়েলের বাবার সাথে কোনো বিষয়বস্তু সম্পর্কে আলোচনার কার্যত কোন প্রমাণ নেই। তবে রিচার্ড ডব্লিউ ব্লেয়ারের ১৯১২ সালে অবসর যাওয়ার পরে ভারতে চাকুরিকালীন অভিজ্ঞতার গল্পগুলো তাঁর ছেলেকে বলেছেন বলেই ধরে নেওয়া যায়। যদি তাই হয়, তাহলে অরওয়েলের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে সেইসব গল্পের কীরকম প্রভাব পড়েছিল? ১৯২২ সালে কিশোর বয়সে উপমহাদেশের বার্মা ভূখণ্ডের মাটিতে পা দিয়ে ভারতীয় ইম্পেরিয়াল পুলিশের কর্মকর্তা হিসাবে অরওয়েলের নিজের কর্মজীবনে পিতার কীরকম প্রভাব পড়েছিল? তাঁর প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে তাঁর পিতাও ব্রিটিশ রাজের অধীনে একটি চাকুরি করেছেন। একজন সাব-ডেপুটি আফিম এজেন্টের কাজ মোটেই চমকপ্রদ ছিল না। তা সত্বেও উপমহাদেশে প্রায় চার দশক চাকুরি করার কারণে তাঁর বাবার কাছে অবশ্যই অনেক গল্পের ভান্ডার জমে ছিল।
পূর্বেকার অরওয়েল গবেষকদের অজানা একটি বিষয় সম্প্রতি গবেষণায় উঠে এসেছে। রিচার্ড ডব্লিউ ব্লেয়ার তাঁর কর্মজীবনের প্রথম দিকে গ্রেট ফামিন(১৮৭৬-১৮৭৮) বা দুর্বিসহ মন্বন্তরের সময় দক্ষিণ ভারতের বেলারিতে দুর্ভিক্ষ ত্রাণ কর্মকর্তা পদে ছিলেন। এক তীব্র খরার ফলে দাক্ষিণাত্য মালভূমিতে ফসল নষ্ট হওয়ার কারণে ১৮৭৬ সালে এই মহা দুর্ভিক্ষ শুরু হয়। সেই সময় দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতের মাদ্রাজ ও বোম্বাইয়ের ব্রিটিশ-শাসিত প্রেসিডেন্সিসহ মহীশূর ও হায়দ্রাবাদ রাজ্যকে এই মহা দুর্ভিক্ষ দুই বছর ব্যাপী মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। ১৮৭৭ সালে উত্তর দিকের অঞ্চলসমূহ দুর্ভিক্ষ কবলিত হয়। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় প্রদেশ এবং উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের কিছু অংশ এবং পাঞ্জাবের একটি ছোট অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত ছিল। দুর্ভিক্ষ শেষ পর্যন্ত ৬৭০,০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে প্রভাবিত করে এবং মোট ৫৮,৫০০,০০০ মানুষের জীবনে দুর্ভোগ বয়ে আনে। দুর্ভিক্ষের অতিরিক্ত মৃত্যুহারের ফলে সর্বনিম্ন ৫.৬ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু এবং সর্বোচ্চ ৯.৬ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়েছে ধরা হলেও একটি সচেতন আধুনিক জরিপে ৮.২ মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুবরন করে বলে বিবেচনা করা হয়। এটি ১৮৭৬-১৮৭৮ সালের দক্ষিণ ভারতের দুর্ভিক্ষ এবং ১৮৭৭ সালের ‘মাদ্রাজ দুর্ভিক্ষ’ নামেও পরিচিত। ভারতে ব্রিটিশ শাসনামলের অনেক দুর্ভিক্ষের মধ্যে এর ভয়াবহতা ছিল উল্লেখযোগ্য।
ভারত, চীন, দক্ষিণ আমেরিকা এবং আফ্রিকার কিছু অংশ জুড়ে ঘটে যাওয়া খরার ফলে ফসলহানীর বৃহত্তর এক ধকলের অংশ ছিল এই মহা দুর্ভিক্ষ। শক্তিশালী এল নিনোর প্রভাবে অর্থাৎ দক্ষিণ আমেরিকা সংলগ্ন প্রশান্ত মহাসাগরে উষ্ণ জলের স্রোত উৎপন্ন হয়, আর এর ফলে বিশ্বের অনেকাংশে আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটিয়ে দেয়া জলবায়ু এবং ভারত মহাসাগরে সক্রিয় এক জোড়া সমান এবং বিপরীত চুম্বকীয় পোলের মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়াকলাপের কারণে এরকম খরার প্রাদুর্ভাব ঘটে বলে ধারণা করা হয়। সেবারের খরায় ফসলের উৎপাদন কম হওয়া সত্বেও ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকারের নিয়মিত শস্য রপ্তানি অব্যাহত রাখা হয়। দুর্ভিক্ষের সময়টিতেও ভাইসরয় লর্ড রবার্ট বুলওয়ার-লিটন ইংল্যান্ডে রেকর্ড পরিমাণ ৩২০,০০০ টন গম রপ্তানির তত্ত্বাবধান করেন। এর ফলে এই অঞ্চলটি আরও বেশি খাদ্যঝুঁকিতে পতিত হয়। শস্যের পণ্যায়নের পাশাপাশি বিকল্প অর্থকরী ফসলের চাষ দুর্ভিক্ষ কবলিত অঞ্চলমূহকে প্রভাবিত করে। ঔপনিবেশিক সরকার যখন মানবকল্যাণে ব্যয় কমানোর চেষ্টা করছে ঠিক তখনই এই দুর্ভিক্ষ ঘটে। এর আগে ১৮৭৩-৭৪ সালের বিহারের দুর্ভিক্ষে বার্মা থেকে চাল আমদানি করে গনহারে মৃত্যু এড়ানো সম্ভব হয়েছিল। দাতব্য ত্রাণে অত্যধিক ব্যয় করার জন্য বাংলা সরকারকে এবং এর লেফটেন্যান্ট-গভর্নর স্যার রিচার্ড টেম্পলকে ব্রিটিশ সরকারের কাছে সমালোচিত হতে হয়। এরপর ১৮৭৬ সালে ভারত সরকারের দুর্ভিক্ষ কমিশনার থাকাকালে নতুন করে কোনো অতিরিক্ত অভিযোগের প্রতি সংবেদনশীল হয়েই স্যার রিচার্ড টেম্পল শস্যের বাণিজ্যের পাশাপাশি ত্রাণ এবং ত্রাণের জন্য যোগ্যতার কঠোর মানদণ্ডের উপর জোর দেন। তখন দুই ধরণের ত্রাণ দেওয়া হয় : সামর্থ্যবান পুরুষ, নারী এবং শ্রমজীবী শিশুদের জন্য ‘রিলিফ ওয়ার্কস’ এবং ছোট শিশু, বয়স্ক এবং অসহায়দের ‘দাতব্য ত্রাণ’।

দুর্ভিক্ষের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ার পর ১৮৭৮ সালের ১১ আগস্ট থেকে ১৮৭৯ সালের ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ মাসের জন্য আফিম বিভাগের প্রতিনিধি হিসেবে বেল্লারিতে দায়িত্ব পালন করতে যাওয়া রিচার্ড ডব্লিউ ব্লেয়ারের বয়স ছিল মাত্র ২১ বছর। তিনি অবশ্যই সেই ভয়ানক যন্ত্রণার সাক্ষী হয়ে থাকবেন যা ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের একটি প্রজন্মকে সরাসরি প্রভাবিত করেছিল। তিনি যেভাবে সাম্রাজ্যকে দেখেছেন তাতে কি এই প্রভাব পড়েছে? তাঁর একমাত্র ছেলে জর্জ অরওয়েল বার্মায় “সাম্রাজ্যের জঘন্য চাকুরি” করে পাঁচ বছরের মাথায় ইস্তফা দেন। অরওয়েল বুঝতে পারেন যে তিনি এমন একটি পেশায় যোগদান করেছেন যার জন্য তিনি অনুপযুক্ত, আর অসহ্য বিষয়গুলোকে তিনি কোনোমতেই হজম করতে অপারগ। অথচ মাত্র এক পুরুষ আগের দশ ভাইবোনের মধ্যে কণিষ্ঠ এবং ছাপোষা (অরওয়েলের পিতা) রিচার্ড ডব্লিউ ব্লেয়ারের কাছে সেই বিকল্প ছিল না।
অরওয়েলের পিতা রিচার্ড ডব্লিউ ব্লেয়ারের জীবনের যাত্রাপথ মোটেই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। তাঁর প্রপিতামহ চার্লস ব্লেয়ার (১৭৪৩-১৮২০) ছিলেন একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, তিনি জ্যামাইকার ইক্ষু চাষের বাগান ও ক্রীতদাস ব্যবসা পরিচালনা করতেন। তিনি সৌভাগ্যবান ছিলেন এবং অভিজাত পরিবারের কন্যার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর দশম তথা সর্বকণিষ্ঠ পুত্র থমাস রিচার্ড ব্লেয়ার যখন জন্ম নেয, তখন চার্লসের সৌভাগ্য-সূর্য স্তিমিত হওয়ার পথে। থমাস রিচার্ড ব্লেয়ার ১৮০২ সালে ইংল্যান্ডের হ্যাম্পশায়ারের এক্সবারিতে জন্মগ্রহণ করেন। তাই একজন ধর্মপুত্র এবং ওয়েস্টমোরল্যান্ডের মাননীয় আর্লের তুতো ভাই হওয়া সত্বেও জর্জ অরওয়েলের ঠাকুরদাদা থমাস রিচার্ড ব্লেয়ারকে জীবিকা অর্জনের তরে দেশান্তরী হতে হয়েছিল। কেমব্রিজের পেমব্রোক কলেজে মাত্র এক বছর শিক্ষালাভের পর তিনি উপনিবেশ অঞ্চলে গমন করেন। ১৮৩৯ সালে তিনি বাংলা প্রদেশের কলকাতা নগরের চার্চ অফ ইংল্যান্ডে ডিকন পদে নিযুক্ত হন। এরপর ১৮৪৩ সালে তাঁকে তাসমানিয়ায় যাজক হিশেবে পাঠানো হয়। ব্রিটিশ অভিজাত পরিবারসমূহের দরিদ্র সন্তানদের জন্য দেশান্তরের উপনিবেশসমূহে এরকম নিয়োগদানের বিষয়টি ছিল একধরনের ত্রাণসম ব্যবস্থা। ১৮৫৪ সালে অরওয়েলের ঠাকুরদাদা ডরসেটের মিলবোর্ন সেন্ট অ্যান্ড্রু-এর বিশপের প্রতিনিধি হয়ে ইংল্যান্ডে ফিরে যান। মিলবোর্ন সেন্ট অ্যান্ড্রু দক্ষিণ ইংল্যান্ডের ডরসেট কাউন্টির একটি গ্রাম এবং নাগরিক পল্লী। কাউন্টি শহর ডরচেস্টার থেকে ১৪ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে, ডরসেট ডাউনসের গভীর ঢালে একটি উইন্টারবোর্ন উপত্যকায় এর অবস্থান।

সম্ভবত অরওয়েলের ঠাকুরদাদাই ছিলেন অভিজাত পৃষ্ঠপোষকতা উপভোগ করা এই পরিবারের একমাত্র শেষ পুরুষ। ভাগ্যের পরিহাসে এরপর তাঁর ছেলে রিচার্ড ডব্লিউ ব্লেয়ারকে ১৮ বছর বয়সে পা দিতে না দিতেই নিজের ভরনপোষণের ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। তাই তিনি ‘চাকুরি’ বেছে নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন বারোজন সন্তানের একজন, এই কারণে পারিবারিক ব্যয় কমানোর তাগিদে তাঁকে বাড়িতেই শিক্ষালাভ করতে হয়। পাবলিক স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ তিনি পাননি। তাই বিশাল ভারতীয় উপনিবেশ প্রশাসনের কোনো পছন্দসই বা কেতাদূরস্ত শাখায় তিনি যোগ দিতে পারেননি। সেই পদায়ন এবং গ্রেডিংয়ের দ্বারা মূল্যায়িত হওয়ার ফলে তিনি হৃতমান আফিম বিভাগে বিশেষ কোনো পদোন্নতি লাভ করতেও পারেননি। কয়েকটি রূপার মনোগ্রাম এবং কতিপয় আসবাবপত্রের বাইরে কোনো পারিবারিক উত্তরাধিকারও তিনি পাননি। অবশেষে এরকম অবস্থায় তিনি সামান্য পেনশনে অবসর গ্রহণ করেন।
১৯০৪ সালে ইডা ব্লেয়ার তার দুই সন্তানকে নিয়ে ইংল্যান্ডের উদ্দেশে ভারত ত্যাগ করেন। উপমহাদেশে চাকুরিরত বিলেতের পুরুষ সরকারি কর্মচারীদের স্ত্রী ও সন্তানদের পড়াশুনার প্রয়োজনে বিলেতে ফিরে যাওয়া অস্বাভাবিক ছিল না। সেই সময়কালের হিসেবে বিষয়টি খুবই সাধারণ ছিল। রিচার্ড ডব্লিউ ব্লেয়ার সাব-ডেপুটি আফিম এজেন্ট হিসাবে ১৯১২ সালে অবসর গ্রহণের আগ পর্যন্ত তাঁর চাকুরি অব্যাহত রেখেছেন। দুই সন্তানকে নিয়ে ইডা ব্লেয়ার অক্সফোর্ডশায়ারের হেনলি-অন-টেমসের ভিকারেজ রোডের ‘এরমাডেল’ নামক একটি বাড়িতে অস্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এরপর ১৯০৫ সালের এপ্রিল মাসে এই বাড়িটি ছেড়ে দিয়ে ওয়েস্টার্ন রোডে ‘দ্য নাটশেল’ নামের সামান্য বড় আকারের একটি ভাড়া বাড়িতে বসবাস করতে থাকেন। রিচার্ড ডব্লিউ ব্লেয়ার ১৯০৭ সাল পর্যন্ত তাদের আর দেখতে পাননি। ১৯০৭ সালে সাব-ডেপুটি আফিম এজেন্ট দ্বিতীয় গ্রেড থেকে সাব-ডেপুটি আফিম এজেন্ট প্রথম গ্রেডে চূড়ান্ত পদোন্নতি উপলক্ষে তাঁকে তিন মাসের ছুটি দেওয়া হয়েছিল। অরওয়েলের ছোট বোন এভ্রিল এসময়েই ইডা ব্লেয়ারের গর্ভে আসেন। এভ্রিলের জন্মের আগে রিচার্ড ভারতের মুঙ্গেরে বদলি হন। এর পর থেকে মোট চার বছর অর্থাৎ চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ করা পর্যন্ত তিনি তাঁর পরিবারের সাথে মিলিত হতে পারেননি। প্রায় সমস্ত ‘অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান’ (ভারতে বসবাসরত ব্রিটিশরা) তাদের বাচ্চাদের ইংল্যান্ডে রেখে লালন-পালনের সুবিধার্থে এরকম ত্যাগ স্বীকার করতেন। তখন থেকে ইডা ব্লেয়ার প্রতিদিন একজন ঠিকা ঝিয়ের সহায়তায় সংসারের সব কাজই করতেন। কোনো পাচক বা খাবার পরিবেশনের পরিচারিকাও তিনি রাখেননি। সংসারের বেশিরভাগ কাজ তিনি নিজেই করতেন। নিজেদের একটি বাড়ি নির্মাণের বৃহত্তর স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতেন বলেই তিনি সম্ভবত এমনই কষ্ট স্বীকার করেছেন। পরিবারের সাথে রিচার্ড ডব্লিউ ব্লেয়ারের এইরকম দীর্ঘদিনের বিচ্ছেদ এবং চুড়ান্ত অবসরের পর ইডা ব্লেয়ার একটি ‘নিজেদের বাড়ী’ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সম্ভবত অরওয়েলের স্বাস্থ্য নিয়েও নির্দিষ্ট উদ্বেগ ছিল যা মিসেস ব্লেয়ারকে ইংল্যান্ডে বসবাস করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
অরওয়েলের শৈশবের বন্ধু জ্যাকিন্থা বুডিকম তার লেখায় রিচার্ড ব্লেয়ারকে বরং একজন নীরস এবং নিস্তেজ ব্যক্তি হিসাবে উপস্থাপন করেছেন। জ্যাকিন্থার চমৎকার আকর্ষক স্মৃতিকথা “এরিক অ্যান্ড আস”(১৯৭৪) গ্রন্থে তখন তার কাছে এরিক ব্লেয়ার নামে পরিচিত পরবর্তীকালের অরওয়েল প্রসঙ্গে লিখেছেন: “পূর্ববর্তী প্রজন্মের মানুষ এরিকের বাবা রিচার্ড ডব্লিউ ব্লেয়ার (ডাকনাম ছিল ডিক) ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ৭ জানুয়ারী জন্মগ্রহণ করেন … আমাদের শিশুদের কাছে তিনি নিশ্চিতভাবে ছিলেন অতি সেকেলে এবং সহানুভূতিশীল একজন মানুষ। তিনি নির্দয় ছিলেন না – তিনি কখনও এরিককে প্রহার করেননি – তবে আমার মনে হয়, শিশুদের প্রতি তিনি খুব বেশি যত্নশীলও ছিলেন না, অথবা তিনি হয়তো বুঝতে পারতেন না। সর্বোপরি, তিনি পঞ্চাশ বছর বয়স পর্যন্ত খুব কমই নিজের পরিবারের সঙ্গ পেয়েছেন। তিনি সব সময় আমাদের সবাইকে তাঁর কাছ থেকে দূরে রাখতে চাইতেন, আমরাও তা করতে পেরে আনন্দিত ছিলাম।”
গর্ডন বোকার মন্তব্য করেছেন: “৩৭ বছর চাকরি করার পর ৫৫ বছর বয়সে রিচার্ড ডব্লিউ ব্লেয়ার বাংলা প্রদেশের আফিম সার্ভিসের সাব-অফিম এজেন্ট পদের প্রথম গ্রেডে উত্থানের পর সম্ভবত বাড়তি কিছু বরাদ্দ এবং একটি পারিবারিক পরিপূরকসহ বাৎসরিক মাত্র ৪০০ পাউন্ডের সামান্য বেশি অর্থের পেনশনসহ অবসর গ্রহণ করেন। ইডা আর সন্তান নিতে চাননি, তাই সংকল্পবদ্ধ হয়ে ডিককে আলাদা কক্ষে নির্বাসিত করেন”। অগত্যা রিচার্ড তখন স্থানীয় গলফ ক্লাবের সেক্রেটারি হন, আর সেখানেই নিজেকে ব্যস্ত রাখেন। গর্ডন বোকার বলেছেন, ”তখন বেশিরভাগ সময় একজন বিষাদময় বৃদ্ধ ব্যক্তি “এটা করবে না, ওটা করবে না” বলতে থাকতেন, আর অরওয়েলকে হামেশাই এই ধরনের কথার মুখোমুখি হতে হয়েছে“। জ্যাকিন্থা বুডিকম মন্তব্য করেছেন : “প্রকাশ্যে নয় তবুও ব্লেয়ারদের পরিবার ছিল একটি সংযুক্ত পরিবার এবং তাদের বাড়িটি আমাদের কাছে সুখী বাড়ি বলে মনে হতো। এরিক (অরওয়েল) তার বাবাকে শ্রদ্ধা করত এবং মান্য করত, তবে সে তার বাবাকে পছন্দ করত- এমনটি আমার কখনই মনে হয়নি। কিন্তু সন্দেহাতীতভাবে সে তার মা এবং বোনদের, বিশেষ করে এভ্রিলের সত্যিকারের অনুরাগী ছিল।”
তারপর ১৯১৭ সালে ৬০ বছর বয়সে রিচার্ড ব্লেয়ার ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বয়স্ক সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হয়ে সবাইকে অবাক করে দিলেন। তিনি মার্সেইলের কাছে একটি ক্যাম্পের ডিপোতে খচ্চর রক্ষনাবেক্ষণ কেন্দ্রের দায়িত্বে নিয়োজিত হন। কী অসাধারণ! অরওয়েল নিজে একসময় লন্ডন এবং প্যারিসে (১৯২৮-১৯৩১) নিঃস্ব ও ভবঘুরেদের সাথে বসবাস করার জীবন বেছে নিয়েছিলেন। এছাড়াও ইংল্যান্ডের উত্তরের দারিদ্র্য কবলিত অঞ্চল তদন্ত করার সময় কয়লা খনির শ্রমিক জীবনের অন্দরে ঢুকে যাওয়া (১৯৩৬), স্পেনে গৃহযুদ্ধকালে রিপাবলিকান মিলিশিয়াদের সহযোদ্ধা হয়ে লড়াই করতে গিয়ে ঘাড়ে মারাত্মকভাবে গুলিবিদ্ধ হয়ে পালিয়ে ফিরে আসা (১৯৩৭), দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৪৫) শেষ দিনগুলোতে মহাদেশীয় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সংবাদ সংগ্রহ করা এবং তাঁর সদ্য দত্তক নেওয়া ছেলেকে নিয়ে প্রত্যন্ত স্কটিশ দ্বীপ জুরায় নিভৃতে ‘সাধারণ জীবন’ যাপন করতে যাওয়া (১৯৪৬-১৯৪৯) – প্রভৃতি সবকিছুই সম্ভবত তাঁর পিতার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলেন। ইংরেজ লেখক এল জে হার্স্ট প্রথম বিশ্বযুদ্ধে খচ্চর এবং ঘোড়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার উপর জোর দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, “ব্রিটিশ সেনাবাহিনী আবিষ্কার করেছিল যে তাদের প্রতি মাসে প্রায় ১৫,০০০ ঘোড়া কিনতে হয়। গণনা করে দেখা হয়েছে যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর মালিকানাধীন প্রায় অর্ধ মিলিয়ন ঘোড়া নিহত হয়েছিল”। বয়স্ক সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট রিচার্ড ব্লেয়ার তাঁর কতিপয় সহকর্মীর বাপের বয়সী ছিলেন বলেই হয়ত ‘ভিড়ের মধ্যে দাঁড়াতেন না’, কারণ ১৯১৮ সালের নভেম্বরে অশ্ব সরবরাহ বিভাগে কর্মকর্তা এবং জওয়ান মিলিয়ে মোট সংখ্যাটি ছিল ১৮ হাজার ৭৭৬ জন।
তবুও অরওয়েল তাঁর বাবার ‘বীরত্ব’ দেখে বিস্মিত এবং বিব্রত হয়েছেন। যেমন বার্নার্ড ক্রিক উল্লেখ করেছেন : “ইটন কলেজে এরিকের সমসাময়িক কেউই স্মৃতি থেকে বলতে পারেননি যে তাদের সহপাঠীর বাবা কখনো সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। তখন পর্যন্ত অরওয়েল নিজ পরিবার সম্পর্কে কাউকে কিছু বলতেন না। তিনি হয়তো তাঁর বাবার হাস্যকর পদবী ও দায়িত্বের পাশাপাশি বয়সের প্রসঙ্গকেও বিব্রতকর বলে মনে করতেন। অরওয়েলের “কামিং আপ ফর এয়ার” (১৯৩৯) উপন্যাসে আমরা দেখতে পাই, জর্জ বোলিং চরিত্রটি যখন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হন, তখন সুদূর কর্নওয়ালের উত্তর উপকূলে একটি বিস্মৃত সামরিক রসদখানায় এগারো টিন ষাঁড়ের মাংস পাহারা দেওয়ার জন্য তাকে নিয়োজিত করা হয়।”
১৯৩৯ সালের জুনে অরওয়েলের পিতা যখন মৃত্যুশয্যায়, তখন তিনি সাউথওল্ডের বাড়িতে তাঁর সাথে দেখা করতে যান। ঠিক তখনই সানডে টাইমস পত্রিকায় অরওয়েলের লেখা “কামিং আপ ফর এয়ার” উপন্যাসটির একটি চমৎকার পর্যালোচনা ছাপা হয়। সিলভিয়া টপ উল্লেখ করেছেন এভ্রিল কীভাবে রিচার্ড ব্লেয়ারের বেডরুমে গিয়ে পর্যালোচনাটি তাকে পড়ে শোনান। ‘একটু পরেই তিনি শেষবারের মতো জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন’। অরওয়েল তার বাবার চোখ বন্ধ করে চিরাচরিত প্রথা অনুসারে চোখের পাতায় ব্রিটিশ মুদ্রা পেনি রাখেন এবং পরে সমুদ্রে নেমে সেগুলিকে ছুঁড়ে ফেলেন।
অরওয়েলের মা ইডা ব্লেয়ার ১৯৪৩ সালের ১৯ মার্চ ৬৭ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
———————
`George Orwell: A Life’, By Bernard Crick (1992). Harmondsworth, Middlesex: Penguin, second edition.
George Orwell and Religion, by Michael G. Brennan. Bloomsbury Academic.
`George Orwell’, By Gordon Bowker, London: Abacus.
Nainital District The Imperial Gazetteer of India, volume 18, pp. 322-323. 1908.
Women of the Raj: The Mothers, Wives, and Daughters of the British Empire in India, By Margaret MacMillan.
‘Orwell and the Appeal of Opium’ By Darcy Moore (2018). George Orwell Studies, Vol. 3, No.1, Bury St. Edmunds: Abramis Academic.
A Guide to Naini Tal and Kumaun, By C.W. Murphy, (1906) Allahabad, Pioneer Press.
Facing Unpleasant Facts: 1937–1939, George Orwell. The Complete Works of George Orwell – Volume 11, Secker & Warburg.
Fugitive from the Camp of Victory, By Richard Rees. (1961) London: Secker & Warburg.
Thacker, Spink and Co. (1897) Thacker”s Indian Directory, East India Company.
S. Guha, Environment and Ethnicity in India, 2006.
Mike Davis, 2001. Late Victorian Holocausts: El Nino Famines and the Making of the Third World. Verso, London.

মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী
তথ্য ও বিজ্ঞাপন চলচ্চিত্র নির্মাণ, আবৃত্তি ও অনুবাদ করার পাশাপাশি মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী একজন পরিব্রাজক। বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। কুমিল্লা জেলার ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান ময়নামতিতে তার পৈত্রিক আদিনিবাস। তিনি প্রথম ও পূর্ণাঙ্গভাবে ভারতবর্ষে আরবদের প্রথম বিজয় সম্পর্কিত ইসলামের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ও দুর্লভ গ্রন্থ চাচনামাহ অনুবাদ করেছেন। গ্রন্থটি বাংলাদেশসহ ভারতের বাংলা ভাষাভাষী অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে সহায়ক পাঠ্য হিসেবে বিবেচিত