স্বদেশের সাতটি আকাশ
আমাদের ফুসফুস আমাদের স্বদেশ
আমাদের শ্বাসপ্রশ্বাস আমাদের নির্বাসিত দ্বীপান্তর।
যখন আমাদের পদচিহ্ন পড়ে দেশের সীমান্তে,
আমাদের স্বদেশ বয়ে চলে আমাদের শিরায় শিরায়।
বেদনার কুঞ্জবনে জন্ম হয় স্বদেশের,
অচেনা আগন্তুকের লতানে শরীরে
অদ্ভুত চাহনি ও অশ্রুবিন্দু
ঝুলে থাকে ফলের গুচ্ছের মত।
স্বদেশ আমাদের উপহার দিয়েছে সুর,
কিন্তু রুদ্ধ করে দিয়েছে সুরেলা কণ্ঠ।
আমরা অস্বীকার করতে পারি না,
পারি কি আমরা অস্বীকার করতে
আমাদের রক্তের ঋণ?
রক্ত ঝরাতে আমরা সর্বাগ্রে প্রস্তুত।
আমাদের বইয়ের পাতায়
খিদে আর রুটি সমার্থক শব্দ,
আলো এবং আঁধার
হয়ে গেছে ভেঙে যাওয়া টুকরো।
প্রেমের নানা চরম পরিণতিতেও
আশার আলো,
এবং ছন্দের মরুভূমিতে বৃষ্টির মেঘ
খুঁজে বের করবার
শিক্ষা পেয়েছিলাম আমি।
এই সেই স্বদেশ, যা আমাদের কাছে ফিরে আসে
ক্লান্ত, বিপর্যস্ত, নগ্ন
কিন্তু সে আমাদের জড়িয়ে রাখতে জানে
উষ্ণ চাদরের মত।
স্বদেশ আমাদের রক্তে লুকিয়ে রাখে সমুদ্রের উচ্ছ্বাস,
আমাদের হৃদস্পন্দন সেই সমুদ্রে ভাসায় তরণী।
আমাদের শিয়রের বালিশে
স্বদেশ গুঁজে রাখে পায়ে চলা পথ
আমাদের স্বপ্নে ঠাঁই পায় সব নগর।
আমাদের সঙ্গেই কি সবকিছু তন্দ্রায় তলিয়ে যাবে
অসীম সময়ের জন্য?
আবার জেগে উঠবার আশায় বারবার ঘুমিয়ে পড়বে?
স্বদেশ যেন সেইসব জলপাইগাছগুলো,
যারা অচেনা আগন্তুকের মত দাঁড়িয়ে থাকে,
এবং তাদের রং ও সুবাস সব কিছু অচেনা লাগতে থাকে।
এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কোথাও আমাদের জন্য এতটুকু ঠাঁই নেই…
যেন একটা লম্বা করিডোর ধীরে ধীরে দুপাশ থেকে বন্ধ হয়ে আসছে।
যেন আমাদের বেঁচে থাকাটাই একটা বিরাট কেলেঙ্কারি,
আমাদের অপেক্ষা এখন অপরাধ,
এবং আমাদের দেশপ্রেম পাপ ছাড়া কিছু নয়।
আমি তোমাকে আশ্রয় দিই
১
আমি তোমাকে আশ্রয় দিই
আশ্রয় দিই সকল উপাসনায়, সকল প্রার্থনায়।
প্রার্থনা করি আশেপাশের সব পাড়া,
সব মহল্লা, সব মিনার যেন
রকেটের হানা থেকে বেঁচে যায়।
জেনারেলের আদেশ দেবার মুহূর্ত থেকে শুরু করে
হানাদারি অভিযান হওয়া পর্যন্ত
তোমাকে আশ্রয় দিই।
আমি তোমাকে এবং বিশেষ করে
ক্ষুদেগুলোকে আশ্রয় দিই।
সেই ক্ষুদেগুলো নিজেদের হাসি দিয়েই
আছড়ে পড়বার ঠিক আগে
রকেটগুলোর যাত্রাপথ বদলে দেবার শক্তি রাখে।
২
আমি তোমাকে এবং ক্ষুদেগুলোকে আশ্রয় দিই
ক্ষুদেগুলো এখন ঘুমিয়ে আছে,
ঠিক যেভাবে পাখির ছানাগুলো ঘুমিয়ে থাকে নীড়ে।
ঘুমের মধ্যে স্বপ্নের দিকে এগিয়ে যাবার জন্য
দেয়ালা করে না তারা।
তারা জানে যে তাদের নীড়ের ঠিক বাইরে
লুকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে মৃত্যু,
হানা দেবে যে কোনো সময়।
তাদের মায়েদের অশ্রুজল এখন
পারাবতের ডানার মত
তাদের অনুসরণ করে,
প্রতিটি কফিনের পিছু পিছু।
৩
আমি পিতাকে আশ্রয় দিই,
সেই ক্ষুদ্র শিশুরা, তাদের পিতা, যিনি
বোমার আঘাতে ঘরটা হেলে যাবার পরে আবার
ঘরটাকে সোজা করে আগলে রাখতে চান।
সেই পিতা যিনি প্রার্থনা করেন মৃত্যুর প্রহরের জন্য…
‘দয়া করো। কিছু সময় দাও, একটু সময় ভিক্ষা দাও
তাদের, যাদের জন্য আমি জীবনকে ভালবাসতে শিখেছি।
তারা যেমন সুন্দর, তেমনি সুন্দর মৃত্যু দাও তাদের।’
৪
আমি তোমাকে আশ্রয় দিই
ক্ষত এবং মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে।
আশ্রয় দিই এই অবরোধের মহিমার মাঝে,
এই তিমিমাছের উদরের মাঝে।
আমাদের পথঘাটের প্রতিটি বোমার ক্ষত
ঈশ্বরকে মহিমান্বিত করে।
তারা ঘরের জন্য, মসজিদের জন্য প্রার্থনা করে।
এবং প্রতিবার যখন উত্তরে বোমার হামলা শুরু হয়,
দক্ষিণদিকের প্রার্থনার মাত্রা বৃদ্ধি পায়।
৫
আমি তোমাকে আশ্রয় দিই
ক্ষত এবং বেদনার হাত থেকে বাঁচাতে।
পবিত্র লিপির অক্ষরগুলি দিয়ে
আমি কমলালেবুগুলিকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই
ফসফরাসের বিষাক্ত ছোবলের হাত থেকে,
মেঘের সমস্ত রং বাঁচিয়ে রাখতে চাই
ধূলিধূসর ধোঁয়াশার হাত থেকে।
আমি তোমায় আশ্রয় দিই, কারণ
আমি জানি যে একদিন এই সব ধূলির ধূসরতা ধুয়ে যাবে,
যারা প্রেমে পড়েছিল এবং একসঙ্গে মৃত্যুবরণ করেছিল,
তারা একদিন শেষ হাসি হেসে উঠবে।
ক্ষণিকের নয় এই বহমানতা
গতকাল আমার হৃদয়ের ক্ষীণ আলোকশিখাটির উদ্দেশ্যে
বলেছিল একটি নক্ষত্র,
আমরা ক্ষণস্থায়ী নই কেউই।
কোনও কিছুই একেবারে শেষ হয়ে যায় না।
ঠিক এই আলোকশিখাটির উজ্জ্বলতার মধ্য থেকেই
যাত্রা শুরু হয় কিছু পথিকের।
প্রেমের মধ্য থেকেই জন্ম হয়েছিল তোমার।
তাই প্রেম ছাড়া কোনও কিছুই রেখো না হাতে,
প্রেম বহে নিয়ে যাও তাদের কাছে,
যাদের হৃদয় ভয়ে কম্পিত।
একদিন আমাদের নামের অক্ষরগুলোর মধ্য থেকে,
আমাদের হৃদয়ের ব্যাকুলতার অবশিষ্ট অংশ থেকেই
অঙ্কুরিত হবে সমস্ত বাগিচা।
যত সময় গিয়েছে, এই প্রাচীন ভাষা
আমাদের শিখিয়েছে
কী ভাবে অপেক্ষার মধ্য দিয়ে সেরে ওঠে
অনেক অসুখ।
কীভাবে ধীরে ধীরে স্বর্গীয় সৌরভের মত
সুন্দর হয়ে শিথিল করে দিতে পারো
তাদের ফুসফুসের কঠিন প্রকোষ্ঠ—
নিয়ে আসতে পারো
এক স্বাগত শ্বাসবায়ু, এক ঝলক অক্সিজেন।
আলতো করে আমরা পেরিয়ে যাই
সব ক্ষত,
গজের ব্যান্ডেজের মত,
একটু ত্রাণ আসবার ইঙ্গিতের মত,
একটা অ্যাসপিরিনের মত।
যদি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত ছায়াপথও ভেঙে পড়ে,
আমার অন্তরের সেই ছোট্ট আলোকশিখাটা মরে না।
সেই আলোক শিখা বলে ওঠে…
এসো, সবাই এসো আমার হৃদয়ে,
এসো, এখানেই আছে পরম শান্তি।
এসো, ঐক্যবদ্ধ হও
ওহ! আমরা কত একাকী!
সবাই জিতে গিয়েছে নিজস্ব যুদ্ধগুলো
এবং তুমি পড়ে রয়েছ কাদামাটির মধ্যে
একেলা।
দারবিশ*, তুমি কি জানতে না?
যারা একাকী, পরাজিত,
তাদের কাছে ফিরে আসবে না কোনও কবিতা।
যা হারিয়ে গেছে,
চুরি হয়ে গেছে
সেগুলো ফিরে আসবে না।
আমরা কত একাকী!
এ এক অদ্ভুত অজ্ঞানকাল! অভিশপ্ত তারা,
যারা আমাদের বিভাজিত করে রেখেছিল যুদ্ধে
এবং ঐক্যবদ্ধ হয়ে মিছিল করে গিয়েছিল
তোমার শোকযাত্রায়।
আমরা কত একাকী!
এই পৃথিবী একটা খোলা বাজার
এবং সেখানে তোমার মহান ভূখণ্ডগুলি
নিলামে উঠছে… বিকিয়ে যাচ্ছে।
আমরা কত একাকী!
এ এক দাম্ভিক মূঢ় সময়,
এবং আমাদের পাশে কেউ নেই,
কেউ এসে দাঁড়াবে না পাশে।
ওহ, আমরা কত একাকী!
মুছে দাও তোমার সব পুরনো আর নতুন কবিতা
এবং তোমার সমস্ত অশ্রুজল।
এবং, তুমি… হে প্যালেস্টাইন
এসো, ঐক্যবদ্ধ হও।
—-
প্যালেস্টাইন থেকে আগত এক ছিন্নমূল পরিবারে কবি ও ঔপন্যাসিক হিবা আবু নাদার জন্ম হয়েছিল ১৯৯১ সালের ২৪শে জুন সৌদি আরবের মক্কাতে। পরবর্তীতে তিনি গাজার ইস্লামিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োকেমিস্ট্রির স্নাতক হবার পাশাপাশি চালিয়ে যান লেখালেখি। তার উপন্যাস ‘আল অক্সিজেন লেসা লিল্মোয়াতা’ (Oxygen Is Not for the Dead) ২০১৭ সালে ‘শারজা অ্যাওয়ার্ড ফর আরাব ক্রিয়েটিভিটি’ পুরস্কারে ভূষিত হয়। ২০২৩ সালে ২০শে অক্টোবর ইজ্রায়েলি বিমানহানায় গাজাতে হিবা আবু নাদা নিহত হন।
*মাহমুদ দারবিশ ছিলেন প্যালেস্টাইনের বিখ্যাত কবি।
নন্দিনী সেনগুপ্ত
জন্ম ৪ঠা জুলাই, ১৯৭১, কলকাতায়। ২০০৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূতত্ত্বে পিএইচডি। দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন। অবসরে গল্প, কবিতা লেখালেখি ছাড়াও ইংরেজি ও জার্মান ভাষা থেকে অনুবাদের কাজ বিশেষ পছন্দের।
মৌলিক কবিতার বই ২০১৬ সালে প্রকাশিত ‘অরণ্যমেঘবন্ধুর দল’। এছাড়াও ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয়েছে সিরিয়ার কবি মারাম আল মাসরির কবিতার অনুবাদ ‘শান্তি অন্তরিন’। ২০২৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে গেরহার্ট হাউপ্টমানের উপন্যাসের অনুবাদ ‘সোয়ানার রহস্যময় বিধর্মী’। সম্প্রতি প্রকাশিত হল হাইনরিশ ব্যোলের উপন্যাসের অনুবাদ ‘আদম, তুমি কোথায় ছিলে?’





