Home » সেফটিপিন ।। নীহারুল ইসলাম

সেফটিপিন ।। নীহারুল ইসলাম

স্ত্রী জিজ্ঞেস করল, ‘আর কতদূর বলো তো? ’
স্বামী বলল, ‘আড়াই ঘণ্টার পথ। সবে তো এক ঘন্টা হল। ’
কেরালা স্টেট ট্রান্সপোর্টের বাস। ৪৭ নং জাতীয় সড়ক ধরে ছুটে চলেছে। উত্তর থেকে দক্ষিণে। গন্তব্য ত্রিবান্দ্রম।
স্ত্রীর কোলে ওদের চার বছরের ছেলেটি ঘুমিয়ে কাদা। অবশ্য তার ঘুমানোরই কথা। সেই সকাল সাড়ে দশটায় আলেপ্পের হোটেল ছেড়ে লঞ্চে চড়ে বসেছিল। টানা ন’ঘন্টা ব্যাক-ওয়াটার জার্নি। মধ্য শুধু দু’জায়গায় দুপুরের ভাত আর বিকেলের চায়ের জন্য ক্ষণিকের বিরতি। তারপর সন্ধ্যা সাতটায় কোলাম পৌঁছে, সেখান থেকে বাসে চড়ে বসেছে। বাসটা তারপর থেকে ছুটছে তো ছুটছেই।
স্বামী নিজেও টায়ার্ড। পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসা মানে কুলিগিরি করা- এটা সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে। তবু সে পরিবার সঙ্গে করেই এসেছে। তাই বিরক্ত হতে পারছে না।
স্ত্রীর কিন্তু বিরক্তির শেষ নেই। থেকে থেকে সে বলে উঠছে, আর পারছি না! কতক্ষণে যে পৌঁছাব?
স্ত্রীর এমন কথায় স্বামীর রাগ হচ্ছে। তবু কিছু বলতে পারছে না। কারণ বাস ভরতি প্যাসেঞ্জার। তাদের কথাবার্তা, সেলফোনের টি টি-চিঁ চিঁ ছাড়াও চলন্ত বাসের যান্ত্রিক শব্দ ঘিরে ওদের দেহমনের ক্লান্তি এমন এক দুর্বিষহ বিরক্তির জন্ম দিচ্ছে যা থেকে ওরা মুক্তি খুঁজে পাচ্ছে না।
ওরা বাসের ডানদিকের জানালা-ঘেঁষা সিটে বসে আছে। দু’জনেরই দৃষ্টি জানালার বাইরে। দূরে নারকেল বনের আড়ালে আরব সাগর। অন্ধকার আকাশে তার প্রতিচ্ছায়া। দুর্বিষহ বিরক্তি থেকে মুক্তি খুঁজতে ওরা সেদিকেই তাকিয়েছিল। তার মধ্যেই ওরা দেখল হঠাৎ প্রচুর আলো। ওদের মনে হল তার মানে ওদের বাসটা কোনও বড় শহরকে অতিক্রম করছে।
হ্যাঁ, একটা বড় শহরই।
স্ত্রী জিজ্ঞেস করল, ‘ত্রিবান্দ্রম?’
স্বামী ঘড়ি দেখে বলল, ‘না।’
‘তাহলে কোন শহর এটা?’
‘জানালার ধারে বসে রয়েছো। সাইনবোর্ড দ্যাখো না!’
‘ চেষ্টা করছি, পড়তে পারছি না। বাসটার যা স্পিড! ’
স্বামী নিজেও চেষ্টা করল সাইনবোর্ড পড়বার। পারল না। তবে বাসটা দ্রুত চলার কারণে যতটা না, তার চেয়ে মালয়ালম ভাষার দুর্বোধ্যতার জন্য।
শেষপর্যন্ত বাসটা অবশ্য একজায়গায় দাঁড়াল। সেখানে প্রায় সব প্যাসেঞ্জার নেমে গেল। কয়েকজন উঠলও। তবে হাতে গোনা।
তাদের মধ্যে স্বামী লক্ষ্য করছে এক মালাবার যুবতীকে। যে এসে বসল ঠিক তার সামনের সিটে। জানালা ঘেঁষে।
স্ত্রী দুই মালাবার যুবককে দেখছে। যারা গিয়ে বসল যুবতীর ঠিক সামনের সিটে। বোধহয় ওরা দুই বন্ধু। একজন মোটা, আরেক জন রোগাপাতলা।
বাসটা চলতে শুরু করল আবার। ইতিমধ্যে স্বামী জানালার বাইরে দৃষ্টি গলিয়ে সাইনবোর্ড পড়ে শহরটার নাম জেনে নিয়েছে। স্ত্রীকে নামটা বলবে ভাবছে। কিন্তু বলতে পারছে না, ক্লান্তিতে তার কিছুই ভালো লাগছে না আর।
তবে স্ত্রীর এখন বেশ লাগছে। এমনিতে আলো তার ভালো লাগে। তার ওপর সাজানো গোছানো সব দোকানের সারি। কাপড়ের দোকান, গয়নার দোকান, স্টেশনারির দোকান …। এইসব দোকানে ঢুকতে পারলে তার আরও ভালো লাগত।
স্বামীর চোখে পড়ল একটা বিলেতি মদের দোকান। আর তার মনে পড়ল যে, স্টকে আর মদ নেই। আলেপ্পেতে যা কিনেছিল ব্যাক-ওয়াটার জার্নিতেই সব খতম। ত্রিবান্দ্রমে গিয়ে আবার কিনতে হবে। অবশ্য তার আগে প্রয়োজন একটা সস্তা হোটেল। তারপর অন্যকিছু।
এমনিতে কেরালা খুব কস্টলি। তার ওপর ত্রিবান্দ্রম রাজধানী শহর। আলেপ্পেতে ঘরভাড়া হাজার টাকা। তাহলে ত্রিবান্দ্রমে নিশ্চয় দু’হাজার টাকা হবে। তারপর আবার ভ্রমণসূচীতে কোভালম আছে। সঙ্গে কন্যাকুমারী। পকেটের যা অবস্থা, শেষপর্যন্ত বাড়ি থেকে টাকা চেয়ে পাঠাতে না হয়!
স্বামী চাপা উত্তেজনা অনুভব করছিল। খরচের কথা ভাবতে গিয়ে সেটা এখন আরও তীব্র হল। তাই সে আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে আনল বাসের ভেতরেই।
স্ত্রীর কিন্তু কোনও পরিবর্তন নেই। বাইরে তাকিয়ে সে কেনাকাটার স্বপ্নে বিভোর। এখন আর তার কোনও বিরক্তি নেই।
হঠাৎ কার মোবাইলের চিঁ চিঁ আওয়াজ বেজে উঠল। সেটা লক্ষ্য করতে গিয়ে স্বামীর দৃষ্টি পড়ল মালাবার যুবতীর ওপর। যুবতী কল রিসিভে ব্যস্ত। অদ্ভূত মনমোহিনী ভঙ্গি তার। কোনও বিজ্ঞাপনের মডেল যেন।
যুবতী কথা বলছে, হাসছে। তাহলে নিশ্চয় তার প্রেমিকের কল। সে তার প্রেমিকের সঙ্গে কথা বলছে। এটা ভেবে স্বামীর খুব ভালো লাগল। জানালা বেয়ে আসা পশ্চিমী হাওয়া সে তার শরীরে অনুভব করল।
মালাবার যুবতী সত্যিই সুন্দরী। ভালো করে দেখল স্বামী। তার ক্লান্তিভাব কেটে গেল। সবকিছু একটু একটু করে ভালো লাগতে শুরু করল।
কিন্তু সেটা খুব অল্পক্ষণের জন্য। হঠাৎ সে দেখতে পেল যুবতীর সামনের সিটে পেছন দিকে ঝুলে থাকা একটা লালসামাখা হাতকে। হাতটার কোনও মালিক নেই যেন। হাতটাকে একটা অশুভ হাত বলে মনে হয় তার।
হ্যাঁ, অশুভই। ওই তো ঝুলে থাকা লালসামাখা হাতখানা মালাবার যুবতীর শরীর ছুঁতে চাইছে। শরীর মানে যুবতীর উরু।
পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছে যুবতী। মোবাইলে কথা বলছে। অথচ ওই লালসামাখা হাতখানার দিকে তার কোনও লক্ষ্য নেই।
নাকি মালাবার যুবতী খুব উদাসীন?
নাকি কল-গার্ল?
খদ্দেরের ডাকে বাসে চড়ে বসেছে?
নাকি খদ্দেরের খোঁজেই বেরিয়ে পড়েছে অভিসারে?
স্বামীর সব কেমন তালগোল পাকিয়ে গেল। একটু একটু ভালো লাগাটাও নিমেষেই হারিয়ে গেল। ঝুলে থাকা ওই লালসামাখা হাতখানা তাকে আরও অনেক কিছু ভাবাল। আর সে ভেতর ভেতর আন্দোলিত হল। ওই লালসামাখা হাতখানাকে তার দুমড়ে মুচড়ে একাকার করে দিতে ইচ্ছে করল।
যুবতীর ওপরও তার রাগ হল। মনে মনে বলল, তুই কেমন ধারা মেয়ে বটে? তোর কোনও প্রতিরোধ নাই, প্রতিবাদ নাই! বদলে মোবাইলে খুনসুটি আছে।
স্বামী যেন কল্পনায় দেখতে পেল মালাবার যুবতীর প্রেমিক কিংবা খদ্দেরকে। যার একহাতে মোবাইল, অন্যহাতে সুরাপাত্র। যার তর সইছে না। যে যুবতীকে উড়ে আসতে বলছে। আর যুবতী বলছে, উড়েই তো আসছি সোনা। একটু সবুর করো। আর একটু …।
মোবাইলে যুবতী সে-কথায় বলছে কি?
হ্যাঁ, সে-কথায় বলছে। তবে তার প্রেমিক কিংবা খদ্দেরকে নয়, তার সামনে ঝুলে থাকা ওই লালসামাখা হাতখানাকেই।
না, এরপর আর লালসামাখা ওই হাতখানার ওপর স্বামীর রাগ হয় না। বরং তার রাগ হয় ওই মালাবার যুবতীর ওপর। অবশ্যই মন্দ মেয়ে ওই যুবতী। সময় নষ্ট করে ওর দিকে আর তাকাবে না। ওকে নিয়ে আর ভাববে না। তার চেয়ে জানালার বাইরে ছুটে চলা অন্ধকার দেখবে। কিংবা নিজের স্ত্রীকে, যে কেনাকাটার স্বপ্ন দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পুত্রের সঙ্গে নিজেও ঘুমিয়ে পড়েছে।
এইসব ভেবে স্বামী যখন মালাবার যুবতীর ওপর থেকে দৃষ্টি সরাতে যাবে ঠিক তখনই যুবতী মোবাইলে কথা বলা শেষ করল । মোবাইলটা কান থেকে নামাল। লালসামাখা হাতখানা তখন তার উরু ছুঁয়ে।
স্বামীর কৌতুহল হয়। যুবতী এবার কী করে, সে দেখবে? যুবতী ভালো মেয়ে না মন্দ মেয়ে জানবে।
ততক্ষণে যুবতী তার মোবাইলটা বাঁ-পাশের ফাঁকা সিটে রেখে নিজের গলার সোনার চেন থেকে একটা সেফটিপিন খুলতে ব্যস্ত।
সেফটিপিন আবার কী করবে সে? স্বামী ভাবল। ভাবতেই থাকল।
ওদিকে যুবতী সেফটিপিন খুলে সেটার ছুঁচলো দিকটা নিজের দু’হাতের আঙুলের চাপে সোজা করে। তারপর আশ্চর্য দক্ষতায় সেটা তার উরু ছুঁয়ে থাকা ওই লালসামাখা হাতে বিঁধিয়ে দেয়।
তা দেখে স্বামী আনন্দে লাফিয়ে উঠতে চাইল, কিন্তু লাফিয়ে উঠতে পারল না। তার আগে বাসটাই যেন আনন্দে লাফিয়ে উঠল শূণ্যে। তারপর উড়তে শুরু করল অদৃশ্য পাখা মেলে।
স্ত্রী এসবের কিছুই টের পাই না। সে ঘুমে অচেতন। কিংবা স্বপ্নের কেনাকাটা তার শেষ হয়নি তখনও।
স্বামী তাকে আলতো ধাক্কা মারল। সে চমকে উঠল। ‘কী? – কী’ বলে ব্যাপারটা জানতে চাইল।
স্বামী বলল, ‘নামবে না নাকি?’
স্ত্রী জিজ্ঞেস করল, ‘চলে এসেছি?’
স্বামী বলল, ‘হ্যাঁ। ’
স্ত্রী তখন জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখল, বাইরেটা আলোয় আলোময়। সেই আলোতে সে দেখতে পেল, রাস্তার ধারে বড় বড় হোর্ডিং। তাতে বহুজাতিক সংস্থার পণ্যের বিজ্ঞাপন। নগ্ন-অর্ধনগ্ন মডেলের ছড়াছড়ি।
স্বামীও দেখল। তবে হোর্ডিং নয়, অন্ধকার দেখল সে। যে অন্ধকারে অসংখ্য লালসামাখা হাত বিষাক্ত সাপের মতো ওইসব হোর্ডিং ঘিরে কিলবিল করছে।
স্বামী দেখতে পেল। আর ওই মালাবার যুবতীর মতো একটা সেফটিপিনের প্রয়োজন অনুভব করল।

Ajit Dash

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ভাষা
Scroll to Top