এ এক অদ্ভুত লাইব্রেরি। এই আকালে এসেও লোকের ভীড় কমে না, অথচ তাদের বেশিরভাগই পাঠক নয়। তবু আসে। রেগুলার আসে। ভদ্রতার খাতিরে টেবিলের উপর স্টিকার লাগানো আছে, ‘আস্তে কথা বলুন’। কিন্তু এত ভদ্রতা এখানকার নিত্য আগমনকারীদের জেনেটিক্সে নেই। তারা দুপুরের পর থেকে জমতে থাকে, কয়েক ঘণ্টা প্রচণ্ড তাণ্ডব চালিয়ে রণে ভঙ্গ দেয়।
এর মধ্যে একটা প্যাটার্ন আছে। একটা অদ্ভুত অনুক্রম। লাইব্রেরি খোলে দুপুর বারোটায়, তখন এর সামনের রাস্তা দিয়েও কোনো মাছি চলাচল করে না। বেলা দুইটার দিক কিছু মানুষ আসা আরম্ভ করে। এই মানুষগুলো অনিয়মিত। আশেপাশেরই কেউ, কখনো বা নির্জনতাসন্ধানী কিছু প্রেমিক-প্রেমিকা। এরা বেশিরভাগই এসে হয় বেবাক দৃষ্টিতে বইয়ের তাকের দিক চেয়ে থাকে, নয়তো ফিসফিসিয়ে গল্প করতে করতে একে অন্যের গায়ে ঢলে পড়ে। তবে প্রতিদিনই এই মুখগুলো বদলায়। এবং ভীষণরকম বিস্ময়করভাবে এই সময় দুয়েকজন পাঠকও আসে। তারা একেকটা বই নিজ দায়িত্বে সিঁড়ি বেয়ে উঠে পেড়ে নেয়। এরপর অখণ্ড মনোযোগে কয়েক ঘণ্টা যাবৎ অক্ষরগুলো গোগ্রাসে গিলে নিঃশব্দে বিদায় নেয়। যেকোনো পাঠাগারের জন্য এটাই স্বাভাবিক দৃশ্য হলেও এই লাইব্রেরিতে এই লোকগুলোই সংখ্যালঘু, এরাই বেমানান।
বেলা চারটের মধ্যে লাইব্রেরি ভরে যায় টুপি-জোব্বা-দাড়িতে। এরাও পাঠক। সাচ্চা পাঠক। কেউ বা থুতনিতে সদ্য আট-দশখানা দাড়ির অধিকারী হওয়া কিশোর, কেউ বা পঞ্চাশের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে। সম্ভবত ওয়াজের বক্তব্যের জন্য রসদ সংগ্রহে বেরোয়। এরা কেউ বসে না, অলওয়েজ স্ট্যান্ডবাই। কোনোকিছুতে অরুচি নেই এদের। জীবনানন্দ থেকে সুফিয়া কামাল, সব চেখে চেখে দেখে দেখে রেখে দেয়। দুয়েকজন গোপনে হুমায়ুন আজাদ বা প্রবীর ঘোষ নিয়েও এক কোণায় গিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। অনিয়মিত দর্শকগুলো অখণ্ড কৌতূহলে মাঝেমধ্যে এদেরকে দেখে আর উদ্দেশ্য বোঝার চেষ্টা করে, কিন্তু শেষমেশ হাবেভাবে পাঠক সত্তা বৈ আর কিছু আবিষ্কার করতে না পেরে তারাও মুখ ফিরিয়ে নেয়।
বিকেল পাঁচটায় অনুপম এসে কফির মেশিন অন করে, কেটলিতে চায়ের জল উঠিয়ে দেয়। আর তখনই একে একে জুটতে থাকে সব রেগুলার উপদ্রব। ছয়-সাতটা নিষ্কর্মা তরুণ দিয়ে এই পর্ব আরম্ভ হয়। অনুপমের উপর হামকি ধামকি করে আগে চা বা কফি বাগিয়ে নেয়। এরপর সবগুলো চেয়ার এদিক ওদিক থেকে কুড়িয়ে নিয়ে এসে শুরু করে জগৎ সংসারের সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। সরকারের প্রতি অমূল্য দিক নির্দেশনা থেকে আরম্ভ করে মাঝেমধ্যে ঈশ্বরের কীরকম আচরণ করা উচিত তা নিয়েও আলোকপাত করে থাকে এরা। লাইব্রেরিয়ান ওয়াজির নওয়াজ ফ্যালফ্যাল চোখে এদের দিক তাকিয়ে থাকে।
অন্ধকার যত ঘন হয়, লাইব্রেরিতে সামগ্রিক চুলের পরিমাণ তত কমতে থাকে। নেহাৎ কয়েকজন ব্যতিক্রমী বাদে পাঠককুল এবং জোব্বাকুলের সবাই ততক্ষণে বিগত। সন্ধ্যার ফাঁকে ফাঁকে দুয়েকটা ঝিঁঝিঁপোকা আওয়াজ ছাড়তে শুরু করে, লাইব্রেরির কোণায় কোণায় জমে থাকা মশাদের উদ্দেশ্যে ওয়াজির সাহেব এসে স্প্রে ছিঁটিয়ে দিয়ে যায়। তখনই একে একে টাকমাথার সুধী বুজুর্গদের আগমন। প্রথমে আসে গামছা কণ্ঠে সাবেক সুকণ্ঠী ফরমান শাহ। উনি ঢোকামাত্র চেয়ার ছেড়ে দিয়ে নিষ্কর্মা তরুণ গোষ্ঠীর দুতিনজন যথাবিহিত সম্মানপ্রদর্শনপূর্বক উঠে দাঁড়ায়। ফরমান শাহ লাইব্রেরির শত সহস্র বইকে এক ঝলকেই উপেক্ষা করে গিয়ে সরাসরি চিনি ছাড়া চায়ের অর্ডার দেয়। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই পদার্পণ করেন নুরুন্নবী প্রধান। ওঁর টাকের জৌলুসে লাইব্রেরি আরও আলোকিত হয়ে ওঠে, তারই আভাস পাওয়া যায় নিষ্কর্মা শ্রেণীর উল্লাস কলরবে।
নুরুন্নবী প্রধানের প্রধান আগ্রহের জায়গা হলো বিপরীত লিঙ্গ। বয়সের ব্যাপারে ওঁর তেমন ছ্যুতমার্গ নেই, সবরকমই চলে। তবে মধ্যবয়স্ক ফর্সা ধরণের মহিলা তাঁর গোপন আগ্রহের জায়গা। মাঝেমধ্যে ছেলেমেয়েদেরকে পাশের গানের স্কুলে দিয়ে এক মহিলা সস্তা ডিটেকটিভ উপন্যাস পড়তে আসেন, তাকে দেখলে নুরুন্নবী প্রধানের আর আহ্লাদের সীমা থাকে না। আশপাশ থেকে তরুণ গোষ্ঠীর কয়েকজনকে বিতাড়িত করে সেখানে এনে সেই মহিলাকে বসান। মহিলার উদ্দেশ্য নিঃসন্দেহে নির্ভেজাল, উনি ওই ডিটেকটিভ উপন্যাস পড়ে নির্মল আনন্দ পেতেই আসেন। কিন্তু প্রধান তো তা হতে দিতে পারেন না। উনি ভোকাল কর্ডের সুর বিভিন্ন তারে চড়িয়ে চড়িয়ে মহিলাকে একের পর এক প্রশ্নে জর্জরিত করতে শুরু করেন। সেখানে বিগত সরকারের প্রতি মহিলার মনোভাব জানতে চাওয়া থেকে আরম্ভ করে সূক্ষ্ম যৌনতার কাতুকুতু পর্যন্ত সবই থাকে। সাদাসিধে ভদ্রমহিলা এই টাকের দ্যুতিতে দিশেহারা হয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠেও যেতে পারেন না, আবার বসে বই পড়ার মতো অবস্থাও আর অবশিষ্ট থাকে না।
নুরুন্নবী প্রধানকে নিয়ে আরও গোটাকতক বাক্য উৎসর্গ না করলেই নয়। এই প্রধান আবার প্রধানত একজন সুপ্ত দার্শনিক। হেগেল থেকে ফুকো পর্যন্ত সবার নাম ইনি মুখস্থ করে রেখেছেন। মাঝেমধ্যে ছদ্মনামে খোলা ফেসবুক একাউন্টে প্লেটো বা সক্রেটিসকে তীব্র কটাক্ষ করে পোস্ট করেন। অতি বিস্ময়করভাবে সক্রেটিস বা প্লেটোর তরফ থেকে কোনো প্রত্যুত্তর আসে না। এতে নুরুন্নবী প্রধান ধরেই নেন যে সক্রেটিস নিঃসন্দেহে তাঁর কাছে নিঃশর্ত পরাজয় স্বীকার করেই নিয়েছে, প্লেটো বোধহয় লজ্জায় মাথা লুকানোর জায়গা পাচ্ছে না। পরেরদিন লাইব্রেরিতে এসে নিষ্কর্মা গোষ্ঠীর আসরে বসে এই অবিসংবাদিত বিজয় এবং তার সাথে বোনাস হিসেবে নিজের বিজয়ী দর্শনেরও বিস্তৃত বর্ণনা দেন।
রাত নয়টার সময় শেষ ওস্তাদ হিসেবে আসেন সাবেক জেলা প্রশাসক মহব্বত খান। পায়ে কোনোপ্রকার সমস্যা না থাকা সত্ত্বেও এই ভদ্রলোক হাতে একখানা প্রকাণ্ড লাঠি নিয়ে লাইব্রেরিতে ঢোকেন। কলম্বিয়া বিমানবন্দরে মাঝেমধ্যে এই ধরণের লাঠির ভেতর কোকেন পাচারের অপরাধে কাউকে কাউকে গ্রেফতার হতে দেখা যায়। তো যাহোক, এসেই উনি সেই প্রকাণ্ড লাঠিখানা ওয়াজির নওয়াজের টেবিলের উপর বিকট শব্দ করে রেখে দিয়ে বইয়ের তাকের দিকে যান। সাধারণত হাজার পৃষ্ঠার কমে ওঁর রুচি হয় না। হরিচরণের অভিধানের সাইজের একখান বই বের করে নিয়ে উনি পড়ার টেবিলের দিকে অগ্রসর হন। সেখানে তখনো উপবিষ্ট পাঠক সমাজের দুয়েকজনের সামনে গিয়ে বিড়বিড় আরম্ভ করেন।
দেশটার কী হলো! একজন সিনিয়র সিটিজেন দাঁড়িয়ে আছে, আর আমার ছেলের চেয়েও ছোটো ছোটো একেকজন চেয়ার দখল করে আছে!
পাঠকসমাজের আবার চক্ষুলজ্জা প্রবল। তারা লজ্জিত চক্ষু অর্ধ নিমীলিত করে উঠে যায় টেবিল ছেড়ে। এরপর সেই পেল্লায় সাইজের বইখানা ওলটানো আরম্ভ করে খানসাহেব। মিনিট দশেকের মধ্যে পৃষ্ঠা সব ফুরিয়ে যায়। তখন চশমাটা খুলে টেবিলের উপর রেখে বাম হাতের বুড়ো আঙ্গুল আর তর্জনী দিয়ে নাকের গোড়া ডলতে ডলতে বলেন, নাহ পশ্চিমবঙ্গের লেখকগুলোর কোনো ডিগনিটি নেই! এই যে বইটা লিখলো, সব আমার সাবেক কলিগ আবদুল বাকুর সাহেবের থেকে কপি করেছে। সব। একদম সব। অথচ বাকুর সাহেবের কথা একবারও বললো না! কোনো ডিগনিটি নেই, কোনো ভ্যাল্যু নেই। নাহ! টেবিলে বিদ্যমান পাঠক সমাজের একমাত্র অবশিষ্ট সদস্য হ্যাঁ না ভালোমন্দ কিছুই বলে না, শুধু শুনে যায়।
এতক্ষণ এতজনের বর্ণনার ফাঁকে গল্পের নায়কের বর্ণনাই দেয়া হয়নি। এনার নাম বিপন্ন সালেক। বাপ মায়ের দেয়া অন্য কোনো নাম ছিলো, টেলিভিশন জগতে নাম লেখানোর আগে নিজের নাম পালটে এই নাম দিয়েছেন। কেউ ডাকে বিপন্ন, কেউ ডাকে সালেক। বিপন্ন সালেকের দেহের শেপ বড্ড অদ্ভুত। গোড়ালি থেকে নিতম্ব পর্যন্ত মোটামুটি যেকোনো স্বাস্থ্যবান মানুষের মতোই। এরপরই কোমরের উপর থেকে পরাবৃত্তের আকৃতিতে আচমকা উত্তল হয়ে গেছে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে দুটো বাঁশের উপর কোনো একটা ধানের গোলা বসিয়ে দিয়েছে। এই বিভ্রম ঢাকার জন্যই উনি হাঁটু পর্যন্ত লম্বা নীল রঙের এক পোলো টি-শার্ট পরে আসেন। কিন্তু নিন্দুকের মুখ তাতে বন্ধ করা যায় না। শুভ থেকে অশুভানুধ্যায়ী সবাই আড়ালে তাকে মোটু বলেই সম্বোধন করে।
নুরুন্নবী প্রধানের মত মোটুরও আকর্ষণের জায়গা হলো নারী। কিন্তু মোটুর আকর্ষণ থাকলেও নারীরা সচরাচর মোটুকে এড়িয়েই চলে। শুধু কিছু অল্পবয়সী কলেজপড়ুয়া মেয়ে যারা ছোটোবেলায় টিভিতে মোটুর কমেডি দেখতো, তারা মাঝেমধ্যে কথা বলতে গিয়ে বিগলিত হয়ে যায়। মেয়েদেরকে সম্মোহিত করার মতো কিছুই নেই মোটুর। শারীরিক আকৃতির চেয়েও দুঃসহ অবস্থা মোটুর বাগ্মীতার, কথা বলতে গেলেই একটু পর খেই হারিয়ে ফেলে। বেশিরভাগ কথাই কানে কম শোনে, শুনলেও একদমই মনে রাখতে পারে না। র্যাম বড্ড দুর্বল! লোকমুখে প্রচলিত আছে, সারাদিন অখাদ্য ফাস্টফুড খাওয়ার সুবাদে মোটুর বউও একদিন রাগ করে মোটুকে ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছে। এখন এই লাইব্রেরি থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে এক রাজসিক বাড়িতে মোটু একা একা থাকে। তবু দৈনিক কোনো নতুন নারীর সাথে সাক্ষাতের আশায় প্রচুর টাকা গাড়িভাড়া খরচ করে এই দূরে ছুটে ছুটে আসে।
মোটু লাইব্রেরিতে ঢোকা মাত্রেই সবার নজর সেদিক যেতে বাধ্য। ঢুকেই ধেই ধেই করে ছুটে যাবে একেকজনের দিকে। ফরমান ভাই ভালো আছেন? অনেক ভালো থাকবেন। নুরুন্নবী ভাই, অনেক ভালো থাকবেন। নাদিম ভাই, যুদ্ধের কী খবর? অনেক ভালো থাকবেন, হ্যাঁ? অনেক ভালো থাকবেন। ওহ! আপনার নাম যেন কী? হ্যাঁ, খালেদ ভাই অনেক ভালো থাকবেন। ঠিকাছে? অনেক ভালো থাকবেন। এরকম খানিকক্ষণ সবার কাছে গিয়ে গিয়ে আবোলতাবোল বকে নেয়। এরপর লাইব্রেরির চেয়ার টেবিলের ফাঁকে অবশিষ্ট ফাঁকফোকর গলে কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটাহাঁটি বা ছোটাছুটি করতে থাকে। কখনো ছুটে যায় বইয়ের তাকের দিকে। এরপর সেখানে গিয়ে চোখ বুজে ফেলে, দু হাত বুকের কাছে এনে উস্তাদ কেরামত খাঁ সাহেবের মত নিজের বুকের উপর তবলার বিভিন্ন বোল বাজাতে থাকে। তার সাথে বিশাল দেহটাকে নিয়ে দুলতে থাকে পেণ্ডুলামের মতো। বারোটা বাজতে পাঁচ, বারোটা বেজে পাঁচ।
লাইব্রেরিতে আরও দুই নিয়মিত সদস্য আছে। এদেরকে কেউ চেনে না। কিন্তু এরা এক কোণায় এক টেবিল দখল করে নিয়ে নীরবে সবার উপর নজরদারি করে। বাকি কেউ আগ্রহ না দেখালেও মোটু এর আগে বারো চৌদ্দবার এদের সাথে পরিচিত হয়ে আলাপ করে গেছে। কিন্তু আগেই বলেছি, মোটুর র্যাম বিচ্ছিরিরকমের দুর্বল। কিচ্ছু মনে রাখতে পারে না। প্রতিবার তার এই নতুন মানুষ দুটোর সাথে আলাপ হয়ে খুব ভালো লাগে, এবং দুজনকেই খুব ভালো থাকার দ্ব্যর্থ আহ্বান জানিয়ে বিদায় নেয়। দুয়েকদিন আবার একসাথে কফি খাওয়ার প্রস্তাবও দিয়ে গেছে। এখন এসে মনে হয়, এই প্রস্তাব না এলেই তা সবার জন্য কল্যাণকর ছিল।
কোনো এক বিষণ্ণ সন্ধ্যায় এই দুজন লোক হাতে দুখানা বই নিয়ে পড়ার ভড়ং ধরছিল আর সবার উপর নজরদারি করছিল। তখন সবে অন্ধকার নেমেছে। তবে তার সাথে সাথে এক মশলাদার ঘটনায় লাইব্রেরির পরিবেশও একদম গরমাগরম। লাইব্রেরির বাথরুম থেকে নিষ্কর্মা সমাজের কোনো এক যুবককে একটা মেয়েসহ বেরোতে দেখেছে অনিয়মিতগোষ্ঠীর কেউ একজন। তাই নিয়েই ব্যাপক তোলপাড়। দুপক্ষের বাকবিতণ্ডা আস্তে আস্তে যখন থিতিয়ে এসেছে সেসময় মোটুর আগমন। ওসব তর্ক বিতর্ককে পাত্তা না দিয়ে সোজা ঢুকে এলো ভেতরে, এসেই চোখ পড়লো ওই দুই রহস্যময় লোকের দিকে। সাথে সাথে এগিয়ে এলো।
আপনারা লাইব্রেরিতে নিয়মিত আসেন, তাইনা? আমার নাম বিপন্ন সালেক। আমি টিভিতে কমেডি করি। আপনাদের হোয়্যাটসঅ্যাপ আছে? আমরা কানেক্ট হয়ে নিই।
নাম না জানা থাকায় ওই লোক দুজনকে আমরা এখন ব্যক্তি-ক এবং ব্যক্তি-খ বলেই সম্বোধন করি। তো বিপন্ন সালেকের কথা শুনে ব্যক্তি-খ বলেই ফেললো, আরে বিপন্ন ভাই, আমরা তো সংযুক্ত আছিই। আপনি আমাদের কফি খাওয়াতে চাইলেন। কবে খাওয়াবেন?
কফি খাওয়ানোর কোনো সদিচ্ছা মোটুর ছিলো না। সে হাত তুলে আশ্বাসের ভঙ্গিতে বলল, হবে, হবে ভাই। হবে। আমরা হোয়্যাটসঅ্যাপে আছি না? কথা হবে। অনেক ভালো থাকবেন। ঠিকাছে? অনেক ভালো থাকবেন।
এরপর তার চোখ গেল পাশের টেবিলেই বসে থাকা এক সনাতন পাঠিকার দিকে। পাঠিকার অল্পবয়স, রক্ত গরম। মাঝেমধ্যেই লাইব্রেরিতে আসে আর সাম্প্রতিককালের প্রোপাগান্ডা সৃষ্টিকারী কিছু লেখকের বই নিয়ে বসে সবাইকে জানান দেয়। টেবিলের পাশ দিয়ে কেউ হেঁটে গেলে বইখানা সোজা করে ধরে মলাট দেখানোর চেষ্টা করে। তো মোটুর র্যাম আবার মেয়েদের ব্যাপারে মাঝেমধ্যে খুব চমক দেখায়, মাত্র একবার আলাপ হওয়া সত্ত্বেও মেয়েটার দিকে আত্মবিশ্বাস সহকারে গিয়ে বলল, এই নামিবিয়া, কী অবস্থা তোমার।
নামিবিয়া সেই নারীকুলের অংশ যারা ছোটবেলায় টিভিতে মোটুর কমেডি দেখত। ফলে একটা হালকা ফ্যানগার্ল ভাব না চাইলেও বাইরে বেরিয়ে আসে। এবারও এলো। দন্ত বিকশিত করে মোটুর সাথে দীর্ঘ কুশল বিনিময় করল। মোটু খুব আগ্রহ নিয়ে বলল, কী বই পড়ছ?
নামিবিয়া মলাট উলটে দেখাল। মুখেও উচ্চারণ করে বলল, বাংলাদেশে স্বৈরশাসনের ফ্যাসিস্ট ন্যারেটিভ।
মোটু বলল, বাহ, খুব ভালো। খুব ভালো। কফি খেতে যাবে নাকি?
এটা সম্পূর্ণরূপে মোটুর র্যামের দোষ। সে পুরোপুরিভাবে ভুলেই গেছে যে পাশের টেবিলের দুই ব্যক্তিকে সে একটু আগে কফি খেতে যাওয়ার আশ্বাস দিয়ে এসেছে, এবং তারা এখনো এদিকে কান খাড়া করে রেখেছে। যখন খেয়াল হল ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। কফির কথা শুনে ব্যক্তি দুজন টেবিল ছেড়ে উঠে এসেছে।
চলুন সালেক ভাই, সবাই মিলে কফি খেয়ে আসি। ব্যক্তি-ক বলল।
সালেক ভাই তখন মহাফ্যাসাদে। কথা ফেরাতেও পারছে না, উগরাতেও পারছে না। তবু শেষ চেষ্টা করার জন্য বলল, আপনারা পড়ছেন না? পরে আরেকদিন যাব। এই, আপনার সাথে হোয়্যাটসঅ্যাপে কানেক্ট আছি না?
ব্যক্তি-খ কথা কেড়ে নিয়ে বলল, হোয়্যাটসঅ্যাপ লাগবে না। আজকেই হোক। আমি আবার সামনের সপ্তাহে মেসিডোনিয়া চলে যাব।
দীর্ঘদিন কমেডি করার সুবাদে বিপন্ন সালেক মুখ হাসি হাসি রেখেই নামিবিয়া এবং দুই রহস্যময় ব্যক্তিকে নিয়ে গুটি গুটি পায়ে লাইব্রেরির পাশের অতি উচ্চাভিলাষী কফিশপের দিক এগোতে থাকল। কফিশপ দোতলায়। সেই দোতলা পর্যন্ত মোটুকে পেছন থেকে সিঁড়ি ভেঙে উঠতে দেখা এক বিমল বিনোদন। কফিশপে ঢুকেই ব্যক্তি-খ এর নাক মুচমুচে স্যান্ডউইচের গন্ধে ভরে গেল। মোটু বোধহয় বিপদের আঁচ টের পেয়েছিল। তাড়াতাড়ি করে বলল, আমাদের জন্য তিনটা কফি, হ্যাঁ? আমি খাব না।
তিনজনই হই হই করে আপত্তি জানাল, তবে অর্থসাশ্রয়ের জন্য মোটুর কাছে তখন আর কোনো পথ খোলা নেই নিজের অংশ কোরবানি দেয়া ছাড়া। নামিবিয়ার আবার এর মধ্যে সাধ হয়েছে কোল্ড কফি খাবে, আইস লাটে। মোটু আবারও মুখে হাসি রেখে অর্ডার নিতে আসা ছেলেটাকে বলল, ওর জন্য একটা আইস লাটে, হ্যাঁ? একটা আইস লাটে।
মোটুর বোধহয় আগে খেয়াল ছিল না যে নামিবিয়া এই নতুন দুজন ব্যক্তির সাথে পরিচিত নয়। কফি আসার ফাঁকে তাড়াতাড়ি করে বলল, এই হল নামিবিয়া। ও নাসা ইউনিভার্সিটিতে ল পড়ে, এলএলবি। নামিবিয়া তুমি থাক কোথায়?
নামিবিয়া জিহ্বা উলটে টাকরাতে ঠেকিয়ে বিকৃত বাংলা উচ্চারণে কোন জায়গার নাম যে বলল, ব্যক্তি-ক বা ব্যক্তি-খ কারওরই বোধগম্য হল না। ব্যক্তি-ক আবার পুরনো মুন্সি মেয়েদের ব্যাপারে। অল্পবয়সে এক কালে কথার জাদুতে অনেক মেয়েকে ঘায়েল করেছেন। নামিবিয়াকে গদগদ স্বরে জিজ্ঞেস করল, এদিকে মাঝেমধ্যেই আসা হয় নাকি? পারফেক্ট স্ট্র্যাটেজি, ভাববাচ্য দিয়ে আলাপ শুরু। নামিবিয়া ফের জিহ্বা টাকরায় ঠেকিয়ে তার অ্যাকসেন্টে কী কী যেন বলল, ব্যক্তি-ক এবং নামিবিয়ার আলাপ আস্তে আস্তে বেশ মাখেমাখো হচ্ছিল। ব্যক্তি-খ বোধহয় ভেতরে ভেতরে জেলাস হচ্ছিল, তাড়াতাড়ি বিপন্ন সালেককে বলে উঠল, ভাই আপনার কমেডি বাদ দিয়ে সিরিয়াস টক-শো’তে যাওয়া উচিত। খুব মানাবে।
মোটু তখন অর্থদণ্ড যাওয়ার শোকে গভীর মুহ্যমান। এহেন তৈলমর্দন তাকে টলাতে পারছিল না। তবু ঠোঁট উলটে বলল, না না ও নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই।
ব্যক্তি-খ আরও বারকতক এরকম চেষ্টা করল, কিন্তু মোটুর অডিও ইনপুট ডিভাইস দুর্বল। প্রত্যেক কথা দুই তিনবার করে বলা লাগে। এজন্য আলোচনা আর এগোল না বেশি। বরং ব্যক্তি-ক আর ব্যক্তি-খ নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করল।
শালার র্যাম মারাত্মক লেভেলের দুর্বল। দুজনের কেউ একজন অপরজনকে বলল।
একদম। অন্য ডিভাইসেও প্রবলেম আছে। অডিও কাজ করে না, প্রসেসরও চাইনিজ মাল বোধহয়।
তবে পার্টসে সমস্যা থাকলেও ফুল বডিতে কলিজার রেশিও বেশি। বলে দুজনেই খ্যাক খ্যাক করে হাসতে শুরু করল।
মোটু ততক্ষণে টাকার দুঃখ ভুলে এদের আলোচনা বোঝার চেষ্টা করছে। জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁ? হ্যাঁ? কী নিয়ে কথা হচ্ছে।
ব্যক্তি-ক এর উত্তর তৈরিই ছিলো। বলল, আরে না ভাই। আজকে আমার কম্পিউটার নষ্ট হয়ে গেছিল, তাই সারাতে নিয়েছিলাম। তাই নিয়েই কথা হচ্ছে।
এরপর কফি এলো। কিন্তু ব্যক্তি-ক এবং ব্যক্তি-খ এর মধ্যে সাংকেতিক আলোচনা বিদ্যমান। নামিবিয়া বুঝতে পারছে না কী করবে। বিচ্ছিরি শব্দ করে পাইপে মুখ লাগিয়ে কোল্ড কফি চুষে চুষে খাচ্ছে। শুধু মোটুর মুখ থমথমে। সে চোখ আদ্ধেক বুজে পরম সুখে নিজের বুক চুলকাচ্ছে। মাঝেমধ্যে শশীকান্তের মত বুকে দুয়েকটা উল্টোপাল্টা চাটিও মারছে। কফিপান শেষে ব্যক্তি দুজন বোধহয় আরও খানিকক্ষণ বসতে চাচ্ছিল। মোটুই খানিকটা খেদিয়ে উঠিয়ে নিয়ে এলো। তবু বিল দেয়ার সময় মোটু যখন মানিব্যাগ থেকে চকচকে ৫০০ টাকার নোটখানা বের করল, অন্ধকার মুখের দিক তাকানো যাচ্ছিল না।
লাইব্রেরিতে ঢোকার মুখে মোটু থমকে দাঁড়িয়েছে। বাকি তিনজনই চমকে গেল। মোটু আস্তে আস্তে তার বিশাল বেঢপ দেহকে ঘুরিয়ে লোক দুজনের মুখোমুখি তাকাল। এরপর এদেরকে নিস্তব্ধ করে রেখে বলে চলল,
ভাই আমার র্যাম ঠিকই আছে। প্রসেসরও অত খারাপ না, আপনাদের সব কথাই বুঝেছি। কানে একটু ঝামেলা আছে, তবে ওটা জন্মগত। আর নামিবিয়া, তোমরা যে আমাকে আড়ালে মোটু বলো আমি তাও জানি। এমনকী আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে বলে তোমরা যে মজাটা নাও, সেটাও আমার অজানা না। এরপর এসব নিয়ে ঠাট্টা তামাশা জোক্স করতে হলে আমি আসার আগেই সেরে নিও বা চলে যাওয়ার পরে কোরো।
তিনজনকেই বজ্রাহতের মত নিশ্চল অবস্থায় ফেলে রেখে মোটু এক অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাঁটতে হাঁটতে অন্ধকার রাস্তা ধরে বেরিয়ে চলে গেল।
এরপর থেকে এই চারজনকে আর কখনো সুদেষ্ণা স্মৃতি পাঠাগারে দেখা যায়নি।

সমর্পণ বিশ্বাস
অপেশাদার লেখক ও চলচ্চিত্রনির্মাতা। জীবিকার খাতিরে মাঝেমধ্যে ইঞ্জিনিয়ারিংও করেন বটে। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে আগ্রহী। নিয়মিত বিরতিতে গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ সবকিছুই লেখার চেষ্টা করে থাকেন।