সর্ববৃহৎ মহাকাব্য মহাভারতের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন কাহিনি। কেউ বলে গুজব, কেউ বলে কল্পনা, কেউবা বলে গালগল্প। কিন্তু মহাভারতের ঐতিহাসিক ভিত্তি প্রমাণিত। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ একে ভারতবর্ষের সহজ স্বাভাবিক ইতিহাস বলে আখ্যায়িত করেছেন। অতিপ্রাচীন এই গ্রন্থের অনেক কিছুই দৈবভাবের আভাস দেয়, কিন্তু আখ্যানের প্রত্যেক নারী পুরুষের আবেগ এবং অনুভব যেন আমাদের চিরপরিচিত। তারা যেন দূরের কেউ নন, আমাদের খুব কাছের। ক্ষেত্রবিশেষে আমরাই যেন তারা, তারাই যেন আমরা। আমাদের জীবনের প্রতিটি ধাপই যেন মহাভারতের প্রতিটি অধ্যায়, আর মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা আমাদের কুপ্রবৃত্তিগুলো যেন প্রতিনিয়ত সৃষ্টি করে চলেছে কুরুক্ষেত্র। মহাভারতের সাহিত্যগুণ সম্পর্কে হয়ত কারোরই দ্বিমত থাকবেনা। কাহিনি, কল্পনা, বাস্তব আর জাদুর মিশ্রণে গ্রন্থটি যেন প্রকৃতই একটি শিল্পকর্ম হয়ে উঠেছে।
জাদুবাস্তবতা আধুনিক সাহিত্যের এক রহস্যময় ধারা। সমসাময়িক সাহিত্যে জাদুবাস্তবতা বা ম্যাজিক রিয়ালিজম বলতে বোঝায়, কাহিনি বর্ণনায় বাস্তব পরিপ্রেক্ষিতে অবাস্তবের মিশ্রণ। প্রয়াত ডঃ আনিসুজ্জামানের “জাদুঘরে কেন যাব” প্রবন্ধটি থেকে আমরা জেনেছিলাম যে জাদু সবসময় ফাঁকি বা ভেলকি অর্থে জাদু নয়। জাদু তাই যা কিছু বিষ্ময় উদ্রেক করে। তাহলে জাদুবাস্তবতার ক্ষেত্রেও আমরা বলতে পারি, কাহিনিতে বাস্তবতার সাথে এমন কিছু অবাস্তব ধারণার মিশ্রণ যা আমাদের বিষ্ময় উদ্রেক করে, তাই জাদুবাস্তবতা। সমালোচকদের মতে, জাদুবাস্তবতা শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন ফ্রানৎস রোহ। আলেহো কার্পেন্তিয়ার ‘এল রেইনো দে এস্তে মুন্দো’র ভূমিকায় বলেছেন, ‘জাদুবাস্তবতা পাঠকের কাছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত একটি জিনিস গল্পে নিয়ে আসে।’ জাদুবাস্তবতার জনক মার্কেজ বলেছেন, ‘আমরা যে বাস্তবকে দেখি, তার পেছনে যে ধারণাটা আছে সেটাই জাদুবাস্তবতা।’
জাদুবাস্তবতার কথা এলেই সবার আগে চলে আসে লাতিন আমেরিকার নাম। মার্কেজের নিঃসঙ্গতার একশ বছর, হুয়ান রুলফোর পেদ্রো পারামোসহ বিশ্বসাহিত্য এবং বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন উপন্যাসে এবং ছোটগল্পে বারবার উঠে এসেছে জাদুবাস্তবতা। বিশ্বসাহিত্যের পাঠকমাত্রই পরিচিত দুখিনী এরিন্দেরা ও তার নির্দয় ঠাকুমার গল্পের কাঁচের রঙ বদলানোর কাহিনির সাথে। তবে এসবের বহু আগেই বেদব্যাসের মহাভারতে প্রয়োগ হয়েছে জাদুবাস্তবতার। অনেক গবেষকরা বলেন, পুরাণ কাহিনী জাদুবাস্তবতা হিসেবে গ্রহনযোগ্য নয়। কিন্তু মহাভারতকে ঠিক পুরাণ বলা চলেনা, এটা অনেকাংশেই ঐতিহাসিক সাহিত্য। মহাভারতের পাতায় পাতায় থাকা কাহিনিতে জাদুবাস্তবতার প্রয়োগ অনেকটা আয়নায় ওপর মানুষের প্রতিবিম্বের মত, অবাস্তব কিন্তু সত্যির মতই। কথাসাহিত্যিক এবং গবেষক শ্রদ্ধেয় ড. হামীম কামরুল হক তাঁর “জাদুবাস্তবতাঃ প্রয়োগ ও পরম্পরা” প্রবন্ধে বলেন,
” জাদুবাস্তববাদী লেখকের লেখায় উপস্থাপিত ঘটনাটি ঘটবে জাদুর মত, ঘটবে মূহুর্তের মধ্যে, কিন্তু সেটি যারা দেখবেন বা অনুভব করবেন, তারা সেখান থেকে এমন কিছু পেয়ে যাবেন, যাতে বোঝা যাবে ঘটনা যে কারণে ঘটছে তার মূলে আছে কোন এক গভীর সত্য, যা সম্পর্কে আর প্রশ্ন করা চলেনা, বরং সেটি চরম একটি বাস্তবতা। ”
উপরের বাক্যবন্ধটি থেকে বোঝা যায় প্রতিটি জাদুবাস্তব গল্পের পেছনেই এক তীব্র সত্য লুকিয়ে থাকার সম্ভাবনা থাকে। মহাভারতের কাহিনির পেছনে যে আরও কাহিনি আছে সেই কথা আজ অব্দি বহু বিশ্লেষকই বলেছে।মহাভারতে জাদুবাস্তবতার সফল প্রয়োগ ঘটেছে বলে সায় দেন সাহিত্যবোদ্ধারা। সম্পূর্ণ মহাভারত হয়ত অনেকেরই পড়া নেই। তাই খুব সহজ একটি উদাহরণ দিচ্ছি যা বাঙালী মাত্রই জানেন। মহাভারতে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের দৃশ্যটিই যদি আমরা মনে করি, বিবস্ত্র দ্রৌপদীর লজ্জা ঢাকতে শুন্য থেকে শত শত বস্ত্র উড়ে আসে। আমাদের সাধারণ জীবনে এ ধরণের কোন ঘটনা শুনলে হেসে উড়িয়ে দেবে সবাই। কিন্তু বেদব্যাস তার মহাকাব্যে পাঠকের মধ্যে এমন এক রহস্যের জাল বিস্তার করেছেন যে বলাই যায়, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের ঘটনাটি নিঃসন্দেহে জাদুবাস্তবতার এক অনন্য উদাহরণ। এরকম শত শত উদাহরণ রয়েছে যা মহাভারতে জাদুবাস্তবতার প্রমাণ দেয়। আর যেহেতু মহাভারত সাহিত্যের পাশাপাশি ইতিহাসও বটে, তাই বলা যায়, যে অবাস্তবতার মিশেল গ্রন্থটিতে রয়েছে, তার পেছনে হয়ত এমন কিছু সত্য রয়েছে যা মেঘের আড়ালে ঢাকা সূর্যের মত উজ্জ্বল। সেসব সত্য জানার উৎসাহ দেয় শ্রদ্ধেয়া শ্রীমতী প্রতিভা বসুর “মহাভারতের মহারণ্যে”, শ্রদ্ধেয়া ইরাবতী কার্বের “যুগান্ত” কিংবা শ্রদ্ধেয় ড. নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর বইগুলো। জাদুর পেছনের বাস্তবকে খুঁজে বেড়াচ্ছে হয়ত আমার মত আরও অনেকে। এখন সত্যের খোঁজ যেহেতু করছি তাই বোধহয় শুরুটা সত্যবতীকে দিয়েই করা উচিত।
সত্যবতী মহাভারতের এক অন্যতম রাজনৈতিক নারী চরিত্র। তিনি কৌরব এবং পাণ্ডবদের প্রপিতামহী, কুরুকুলের রাজমাতা। তার আরও একটি পরিচয় হল তিনি মহাভারতের রচয়িতা ব্যাসদেবের মাতা। ব্যাসদেব সত্যবতীর কুমারী অবস্থায় জাত সন্তান।
দাশ নামক ধীবরজাতিবিশেষের কাছে লালিত সত্যবতীর শরীরে তীব্র মাছের গন্ধের কারণে তাকে ডাকা হত মৎস্যগন্ধা বলে। তারপর পরাশর মুনির সাথে শারীরিক সম্পর্কের জন্য মুনির আশীর্বাদে তার শরীরের গন্ধ দূর হয় এবং তার স্থানে যোগ হয় তীব্র সুগন্ধ। এক যোজন দূর থেকে তার শরীরের সুবাস অনুভব করা যেত, তাই তার নাম হয় যোজনগন্ধা। মহাভারতে সত্যবতীর জন্ম নিয়ে যে ঘটনা বর্ণিত আছে তা সত্যিই বিস্ময় জাগিয়ে তোলে পাঠকের মনে। রাজশেখর বসুর মহাভারতে সত্যবতীর জন্মগাঁথাটি বর্ণিত রয়েছে কিছুটা এভাবে,
” চেদি দেশে উপরিচর বসু নামে পুরুবংশজাত এক রাজা ছিলেন।….. উপরিচরের রাজধানীর নিকট শুক্তিমতী নদী ছিল। কোলাহল নামক পর্বত এই নদীর গর্ভে এক পুত্র এবং এক কন্যা উৎপাদন করে। রাজা সেই পুত্রকে সেনাপতি এবং কন্যাকে মহিষী করলেন। একদিন মৃগয়া করতে গিয়ে রাজা তার ঋতুস্নাতা রূপবতী মহিষী গিরিকাকে স্মরণ করে কামাবিষ্ট হলেন এবং স্খলিত শুক্র এক শ্যেনপক্ষীকে দিয়ে বললেন, তুমি শীঘ্র গিরিকাকে দিয়ে এস। পথে অন্য এক শ্যেনের আক্রমনের ফলে শুক্র যমুনার জলে পড়ে গেল। অদ্রিকা নামে এক অপ্সরা ব্রক্ষ্মশাপে মৎসী হয়ে ছিল, সে শুক্র গ্রহণ করে গর্ভিণী হল এবং দশম মাসে ধীবরের জালে ধৃত হলো। ধীবর সেই মৎসীর উদরে একটি পুরুষ এবং একটি স্ত্রী সন্তান পেয়ে রাজার কাছে নিয়ে এল। অপ্সরা তখনই শাপমুক্ত হয়ে আকাশপথে চলে গেল। উপরিচর ধীবরকে বললেন, এই কন্যা তোমার হোক। পুরুষ সন্তানটি পরে মৎস নামে ধার্মিক রাজা হয়েছিলেন। সেই রূপগুণবতী কন্যার নাম সত্যবতী, কিন্তু সে মৎসজীবিদের কাছে থাকত সেজন্য তার অন্য নাম মৎসগন্ধা।”
এখন আজকের দিনে যদি কেউ আমাদের এসে এমন একটি ঘটনা শোনায়, আমরা হয়ত বিশ্বাস করবোনা। যেমনটা মার্কেজ বলেছেন যে, আপনি যদি বলেন হাতি আকাশে উড়ছে, কেউ বিশ্বাস করবেনা। কিন্তু যদি বলেন ৪২৫ টি হাতি আকাশে উড়ছে, তাহলে হয়ত বিশ্বাস করতেও পারে। মহাভারতের পাতায় লেখক ঠিক সেভাবেই বিশদের সাহায্যে এমন এক জাদুবাস্তবতাময় পরিবেশ তৈরি করেছেন যা পাঁচ হাজার বছর ধরে প্রতিটি পাঠকের মনে এক রহস্যময় অনুভূতির জন্ম দিচ্ছে।
এখন আমরা যদি এই পুরো ঘটনাটি থেকে অবাস্তব অংশটুকু সরিয়ে দিয়ে চিন্তা করি তাহলে ঘটনাটি কি দাঁড়ায়, চলুন কিছু ব্যাপার একটু ভেবে দেখি।
প্রথমত, উপরিচর বসুর স্খলিত শুক্র গিরিকার কাছে পাঠাবার তোরজোর এবং ধীবরের থেকে পুত্র সন্তানকে রেখে দেয়া (যে পরে রাজা হয়েছিল) থেকে ধারণা করা যায়, সম্ভবত তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। তার একটি সন্তানের খুব প্রয়োজন ছিল যার জন্য তিনি একফোঁটা শুক্রও ব্যর্থ যেতে দিতে চাননি।
দ্বিতীয়ত, তিনি কি মৃগয়ায় একাই গিয়েছিলেন? সাধারণত রাজাদের একা মৃগয়ায় যেতে দেখা যায়না, আর যদি তিনি সৈন্য সামন্ত নিয়েই যেতেন তাহলে তাদের কারো হাতে শুক্রাণু পাঠিয়ে দেয়াটা কি বেশি যুক্তিযুক্ত হতনা?
তৃতীয়ত, ধরে নিলাম তিনি একাই গিয়েছিলেন। ধরে নিলাম পুরো ঘটনাটিই ঘটেছিল। কিন্তু তিনি জানলেন কি করে যে ধীবররাজ যে পুত্র কন্যাটিকে নিয়ে এসেছেন, তারা তার সেই স্খলিত শুক্রের ফলেই জন্ম নিয়েছেন? নাকি না জেনেই তিনি বংশ রক্ষার্থে পুত্রটিকে গ্রহণ করেছিলেন?
এখন, ঘটনাটিকে আমি একটু অন্যভাবে সাজাচ্ছি। ধরি, ধীবররাজের বোনের নাম অদ্রিকা। অদ্রিকা অনন্য সুন্দরী, প্রায় অপ্সরার কাছাকাছি। নিঃসন্তান উপরিচর একা মৃগয়ায় গিয়ে নদীর ধারে এই জেলেকন্যার দেখা পান। তার রূপে মুগ্ধ হয়ে উপরিচর হয়ত তাকে বিবাহ করেন অথবা তাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক হয়। সন্তানের দায়িত্ব নেবেন কথা দিয়ে উপরিচর প্রাসাদে ফিরে আসেন। যথাসময়ে অদ্রিকা একটি পুত্র এবং কন্যার জন্ম দেন। কিন্তু সন্তান জন্মদানকালে তার মৃত্যু হয় (মূল ঘটনায় সন্তান জন্ম দিয়ে সাথে সাথে অপ্সরা অদ্রিকার আকাশে উড়ে যাওয়া)। ধীবররাজ সন্তানদের উপরিচরের কাছে নিয়ে আসেন। উপরিচর ছেলে সন্তানটিকে রেখে হয়ত বোনের মৃত্যুতে শোকাহত ধীবররাজের কষ্ট লাঘব করতে অথবা অদ্রিকার স্মৃতি রক্ষার্থে মেয়েটিকে তুলে দেন তার হাতে।
একটু কি বিশ্বাসযোগ্য লাগছে এই নতুনভাবে সাজানো ঘটনাটি? আমি বলছিনা যে এমনটাই হয়েছে। কিন্তু জাদুর পেছনের বাস্তবকে খুঁজতে গিয়ে কিছুটা এমন ধারণাই আমার মনে এসেছে বারবার। মহাভারতে সত্যবতীর জন্মরহস্য বলানো হয়েছিল স্বয়ং বেদব্যাস এবং তার পিতা পরাশর মুনিকে দিয়ে। কেন? যাতে মুনিবাক্য বলে অধিক বিশ্বাসযোগ্য হয়? জানা নেই আমাদের। জানার উপায়ও নেই। আমরা শুধু যা করতে পারি তা হলো ধারণা। তাও একদিক থেকে ভালো অবশ্য, কারণ সব প্রমাণিত ব্যাপারের শুরু ধারণা থেকেই হয়।