লেপ // ইসমত চুগতাই, উর্দু থেকে অনুবাদ: সফিকুন্নবী সামাদী

[ইসমত(১৯১৫-১৯৯১) ভারতীয় ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, চিত্রনাট্যকার। বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ উর্দু কথাকারদের একজন। নারীজীবন, প্রেম, যৌনতা, শ্রেণী-সংঘর্ষ তাঁর গল্পের বিষয়। কথাশিল্পে নিজের সময়কে তুলে ধরতে সিদ্ধহস্ত। যুক্ত ছিলেন প্রগতি লেখক সংঘের সঙ্গে, বিশ্বাস ছিল তাঁর বাস্তববাদে। ‘লেপ’ তাঁর শ্রেষ্ঠ গল্প গুলোর একটি। এটি অনুবাদ করা হয়েছে মূল উর্দু থেকে।]

        শীতের দিনে আমি যখন লেপ গায়ে দিই, তখন দেয়ালে তার ছায়া যেন হাতীর মত দুলতে থাকে আর হঠাৎ আমার মন পেরিয়ে আসা সময়ের পর্দায় দৌড়াতে থাকে। অনেক কিছু মনে পড়তে থাকে।

      মাফ করবেন, আমি আপনাদেরকে লেপ বিষয়ে নিজের রোমান্টিক গল্প বলতে চাইছি না, লেপের সাথে কোনো ধরনের রোমান্টিক ভাবনা জুড়ে দেয়াও  যায় না। আমার মতে, কম্বল কম আরামদায়ক, এ কথা ঠিক, কিন্তু তার ছায়া এতটা ভয়ানক হয়ে ওঠে না, যতটা হয় যখন কোনো লেপের ছায়া দেয়ালে কেঁপে ওঠলে।

     এ তখনকার কথা যখন আমি ছোট ছিলাম এবং ভাই আর তাদের বন্ধুদের সাথে মারামারি করতে করতে দিন কাটিয়ে দিতাম। কখনো-কখনো আমার মনে হয়, হতচ্ছাড়া আমি এত ঝগড়াটে কেন ছিলাম। ওই বয়সে, যখন আমার অন্য বোনেরা প্রেমিক জোগাড় করছিল, আমি আপন-পর সব ছেলে-মেয়ের সাথে ঝগড়া-ফ্যাসাদে মশগুল ছিলাম।

     এই কারণেই আম্মা যখন আগ্রা যাচ্ছিলেন তখন আমাকে হপ্তাখানেকের  জন্য তাঁর এক পাতানো বোনের কাছে রেখে যান। আম্মা জানতেন, তাঁর ওখানে একটা ইঁদুরের বাচ্চাও ঢুকতে পারে না, আর আমি কারো সাথে ঝগড়া-ফ্যাসাদ করতে পারব না। এ তো আমার জন্য  শাস্তিই  ছিল। হ্যাঁ, আম্মা আমাকে বেগম জানের কাছে রেখে গেছেন। সেই বেগম  জান  যার লেপ এখনো আমার মস্তিষ্কে গরম লোহার দাগের মত সুরক্ষিত। এ সেই বেগম জান যার গরীব বাবা-মা নবাব সাহেবকে জামাতা করেছিলেন। কারণ, নবাব সাহেবের বয়স একটু বেশি হলেও ছিলেন পুণ্যবান। কখনো কোনো বাজারী মেয়েকে তাঁর ওখানে দেখা যায়নি। নিজে হাজী ছিলেন, আরো অনেককে হজ করিয়েছেন।

     কিন্তু তাঁর ছিল এক আশ্চর্য শখ। মানুষের কবুতর পালার পাগলামী থাকে। কেউ তোতা পালে। কারো থাকে মোরগের লড়াইয়ের নেশা। এসবকে ঘৃণা করতেন নবাব সাহেব। তাঁর এখানে থাকত কেবল কয়েকজন শিক্ষার্থী।  নওজোয়ান, ফর্সা, ক্ষীণকটি ছেলে যাদের খরচ বহন করতেন তিনি।

     কিন্তু বেগম জানকে বিয়ে করে তো তিনি তাকে অন্য সম্পদের সাথে ঘরে রেখে ভুলে যান আর বেচারী হালকা-পাতলা কোমল বেগম জান একাকিত্বের যন্ত্রণায় মিলিয়ে যেতে থাকে।

     কি জানি তার জীবন কোথা থেকে শুরু হয়। সেখান থেকে যখন সে জন্ম নেবার মতো ভুল করে বসে? নাকি সেখান থেকে যখন সে এক নবাবের বেগম হয়ে আসে এবং সঙ্কীর্ণ খাটের জীবনযাপন করতে শুরু করে? নাকি যখন থেকে নবাব সাহেবের এখানে ছোকরাদের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে? তাদের জন্য সুস্বাদু হালুয়া এবং অন্যান্য খাবার যেতে থাকে আর বেগম জান বৈঠকখানার দরজা দিয়ে নরম কোমরওয়ালা ছোকরাদের থলথলে পায়ের ডিম এবং সুগন্ধিত মিহি মসলিনী  কুর্তা দেখে দেখে যেন অঙ্গারের ওপর গড়াগড়ি  দিতে শুরু করে ।

     অথবা যখন থেকে সকল মানত ব্যর্থ হয়, তাবিজ-কবজ-টোটকা এবং রাতের অজিফা পাঠও শেষ হয়ে যায়। পাথরে কি কখনো জোঁক ধরতে পারে? নবাব সাহেব তার জায়গা থেকে একবিন্দুও নড়েন না। বেগম জানের মন ভেঙে যায়, সে বিদ্যাচর্চার দিকে আকৃষ্ট হয়। কিন্তু সেখানেও তার কোনো প্রাপ্তি ঘটে না। প্রেমের উপন্যাস এবং আবেগী কবিতা পড়ে পড়ে মন আরো ছোট হয়ে যায়। রাতের ঘুম চলে যায়। জান-প্রাণ ছেড়ে দিয়ে বেগম জান হতাশার স্তুপে পরিণত হয়।

     বেগম জান  চুলোয় দিয়েছে সেই সব কাপড়চোপড়, কাপড়চোপড় তো কাউকে প্রভাবিত করবার জন্যই। এখন নবাব সাহেব না অবসর পান মসলিনী কুর্তা ছেড়ে এদিকে মনোযোগ দেবার, না কোথাও যেতে দেন বেগম জানকে। বিয়ের পর বেগম জান যখন এখানে এসেছে তখন থেকে আত্মীয়রা এসে মাসের-পর-মাস থেকে চলে গেছে। এই বেচারী যে বন্দী সে বন্দীই থেকে গেছে।

     এই আত্মীয়দের দেখে তার রক্ত আরো জ্বলে যায়। তারা মজা করে পয়সা ওড়ায়। উত্তম ঘি-মাখন খায়। শীতের জামা-কাপড় বানাতে চলে আসে। আর নতুন তুলোর লেপ থাকতেও  বেগম জান ভীষণ শীতে জমে যায়। প্রত্যেকবার পাশ ফেরার সাথে সাথে লেপ নতুন চেহারা বানিয়ে দেয়ালের ওপর ছায়া ফেলে। কিন্তু কোনো ছায়া এমন নেই যা তাকে জীবিত রাখার জন্য যথেষ্ট। তবে ছাই বেঁচে থাকবে কেন? বেগম জানের জীবন যাই হোক, তাকে যাপন করা তার ভাগ্যে লেখা ছিল, সে যাপন করতে থাকে এবং ভালই যাপন করে।

     নিচে পড়তে পড়তে রব্বো তাকে সামলে নেয়। ঝটপট দেখতে দেখতে তার শুকনো শরীর ভরভরন্ত হতে শুরু করে।

     গাল চকচক করে ওঠে আর সৌন্দর্য ফুটে বেরোয়। এক আশ্চর্য তেল মালিশ করে বেগম জানের মধ্যে জীবন ঝলমল করে ওঠে। মাফ করবেন, সেই তেলের উপকারিতা এবং ব্যবহারবিধি বড় বড় সাময়িকীতেও আপনারা পাবেন না…।

     আমি যখন বেগম জানকে দেখি তখন তার বয়স চল্লিশ-বেয়াল্লিশ হবে। উফ…কি শানদার ভঙ্গিতে সে ডিভানের ওপর আধশোয়া অবস্থায় ছিল! আর রব্বো তার পিঠের কাছে বসে কোমর টিপছে। বেগুনি রঙের একটা শাল তার পায়ের ওপর পড়ে। তাকে জাঁকালো মহারাণীর মতো দেখাচ্ছিল।

     আমি তার চেহারা অসম্ভব পছন্দ করতাম। আমার মনে হত, ঘণ্টার পর ঘণ্টা একেবারে পাশে বসে তার রূপ দেখি। তার রঙ একেবারে ফর্সা। লালিমার লেশমাত্র নেই, চুল ঘন কালো আর তেলে ডোবা। আমি আজ পর্যন্ত তাঁর সিঁথি এলোমেলো দেখিনি। একটা চুলেরও এদিক-সেদিক হবার উপায় নেই। তার চোখ কালো, ভুরুর অপ্রয়োজনীয় চুল তুলে ফেলার ফলে সেগুলো ধনুকের মতো টান টান… চোখ দুটো একটু টানটান হয়ে থাকে ভারী ভারী ফোলা চোখের পাতা, মোটা মোটা চোখের পাপড়ি… তার চেহারার যে জিনিসটা আশ্চর্যজনকভাবে সবচেয়ে বেশী দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা তার ঠোঁট, সাধারণত লাল লিপস্টিকে রাঙানো থাকে, ওপরের ঠোঁটে হালকা হালকা গোঁফের মতো রেখা এবং কানপটিতে লম্বা লম্বা চুল। কখনো কখনো তার চেহারা দেখতে দেখতে আশ্চর্য লাগতে শুরু করে… অল্প বয়সের বালকের মতো…!

     তার শরীরের ত্বকও ফর্সা এবং মসৃণ। মনে হয় কেউ যেন কষে সেলাই করে দিয়েছে…আর প্রায়ই সে যখন তার পায়ের ডিম চুলকানোর জন্য খোলে আমি তখন লুকিয়ে লুকিয়ে তার চমক দেখি। তার শরীর অনেক  লম্বা এবং মাংস থাকার কারণে তাকে বেশ লম্বা-চওড়া মনে হয়, কিন্তু বেশ ভরসম এবং সুগঠিত তার শরীর। লম্বা লম্বা মাংসল ফর্সা হাত এবং সুডৌল কোমর! রব্বো তার পিঠ চুলকে দেয়, মানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পিঠ চুলকায়… পিঠ চুলকানোও তো জীবনের প্রয়োজনীয় অংশ, বরং সম্ভবত জীবনের প্রয়োজনের চেয়েও বেশী! রব্বোকে ঘরের আর কোনো কাজ করতে হয় না… সে কেবল সব সময় বেগম জানের খাটের ওপর উঠে কখনো পা, কখনো মাথা আর কখনো শরীরের অন্য অংশ টিপে দেয়। কখনো আমার মন বলে ওঠে, যখনি দেখি, রব্বো কিছু-না-কিছু টিপে দিচ্ছে বা মালিশ করছে। অন্য কেউ হলে কি হতো জানি না… আমি আমার কথা বলছি, কেউ এতটা স্পর্শ করলে আমার শরীর তো পচে গলে শেষ হয়ে যাবে।

     আর এই প্রতিদিনের মালিশ যথেষ্ট নয়। যেদিন বেগম জান গোসল করে, ইয়া আল্লাহ,  দু’ঘণ্টা আগে থেকে তেল আর সুগন্ধী উবটান***মালিশ শুরু হয়ে যায়, এতটাই হয় যে আমার তো কল্পনা করেই মন ভেঙে পড়ে। ঘরের দরজা বন্ধ করে আগুনের মালশা জালানো হয় আর চলে মালিশক্রিয়া… সচরাচর তখন ঘরে কেবল রব্বোই থাকে। অন্য চাকরানীরা বিড়বিড় করতে করতে দরজা থেকেই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিতে থাকে।

     ব্যাপার হল, বেগম জানের ছিল চুলকানির অসুখ। বেচারীর এমন চুলকানি হত যে হাজার তেল এবং উবটান মালিশ করা হত, কিন্তু চুলকানি থেকেই যেত… ডাক্তার-হেকিম বলত, কিছুই নেই। শরীর একদম পয়-পরিষ্কার। হ্যাঁ, চামড়ার ভেতরে কোনো অসুখ থাকলে থাকতে পারে…।

     ‘না, এই ডাক্তাররা না পাগল হয়ে গেছে… অসুখ হোক আপনার শত্রুর… আল্লাহ ভালো রাখুক, রক্তে গর্মী আছে।’ রব্বো হেসে বলে আর সেই সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে বেগম জানের দিকে তাকিয়ে থাকে, আর এই রব্বো, বেগমজান যতটা ফর্সা সে ততটাই কালো… বেগমজান যতটা সফেদ, সে ততটাই লালচে… যেন উত্তপ্ত লোহা…হালকা হালকা বসন্তের দাগ। হাট্টাগোট্টা শক্ত শরীর। দ্রুত চলনশীল ছোট ছোট হাত, পেটানো ছোট পেট… বড় বড় ফোলা ঠোঁট হামেশা ভিজে থাকে আর শরীর থেকে আশ্চর্য ভয়ানক গন্ধের স্ফুলিঙ্গ বেরুতে থাকে। আর তার নাদুসনুদুস ফোলা ফোলা হাত এতটাই চলনশীল যে এখন রয়েছে কোমরে, এই দেখো পিছলে চলে যাচ্ছে নিতম্বে। সেখান থেকে পিছলে চলে যায় উরুতে, তারপর দৌড়ায় টাকনুর দিকে।

     আমি তো কখনো যদি বেগম জানের কাছে বসি, দেখতে থাকি, এখন তার হাত কোথায়… আর কী করছে।

    শীত-গ্রীষ্ম সকল সময় বেগম জান হায়দ্রাবাদী জালী কারগার কুর্তা পরে। গাঢ় রঙের পাজামা আর ফেনার মতো সাদা কুর্তা। পাখা চললেও হালকা চাদর দিয়ে অবশ্যই শরীর ঢেকে রাখে। শীত তার খুব পছন্দের। শীতের সময় আমার তার ওখানে ভালো লাগে। সে নড়াচড়া করে খুব কম। গালিচার ওপর শুয়ে থাকে… পেট চুলকোনো হচ্ছে। শুকনো ফল চিবোতে থাকে… রব্বোকে দেখে অন্য চাকরানীদের গা জ্বলে যায়। এই ডাইনী বেগম জানের সাথে খায়, সাথে উঠে-বসে… আর মাশাআল্লাহ সাথে শোয়ও। রব্বো এবং বেগম জান সাধারণের মুখরোচক আলোচনার বিষয় হয়ে যায়, যেখানেই তাদের প্রসঙ্গ আসে হাসির রোল ওঠে। লোকে বেচারী বেগম জানকে নিয়ে কত রকম কৌতুক করে, কিন্তু দুনিয়ার কারো সাথেই তার মিলমিশ নেই। আছে কেবল সে আর তার চুলকানী।

     আমি বলেছি, সেই সময় আমি অনেক ছোট এবং বেগম জানে মুগ্ধ। সেও আমাকে খুব ভালোবাসত। ঘটনাক্রমে আম্মা আগ্রা গেলেন। তিনি জানতেন যে একা একা থাকলে বাড়িতে ভাইদের সাথে মারপিট করব, ঘুরে ঘুরে বেড়াব। তাই আমাকে হপ্তাখানেকের জন্য বেগমজানের কাছে রেখে যান। আমিও খুশী বেগম জানও খুশী। যতই হোক, সে ছিল আম্মার পাতানো বোন।

    প্রশ্ন ওঠে, আমি ঘুমাব কোথায়? স্বাভাবিকভাবেই বেগম জানের ঘরে। তাই আমার জন্যও তার খাটের সাথে লাগিয়ে একটা ছোট খাটিয়া পেতে দেয়া হল। দশটা এগারোটা পর্যন্ত কথাবার্তা চলে। আমি আর বেগমজান তাশ খেলি। তারপর শোবার  জন্য আমি আমার খাটে চলে আসি। যখন আমি শুই, তখনো রব্বো বসে বেগমজানের পিঠ চুলকাচ্ছে।

     ‘মেথরানী কোথাকার…’ আমি ভাবি। রাতের বেলা হঠাৎ আমার চোখ খুলে যায়, আমার এক আশ্চর্য রকমের ভয় হতে শুরু করে। ঘরে ঘুটঘুটে অন্ধকার, সেই অন্ধকারে বেগম জানের লেপ এমনভাবে নড়ছে  যেন তার মধ্যে কোনো  হাতী বন্দী রয়েছে।

     ‘বেগম জান!’ আমি ভয়ে ভয়ে ডাকি, হাতীর নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায়, লেপ নিচু হয়ে যায়।

     ‘কি হল… ঘুমাও…’ বেগমজান কোথাও থেকে বলে।

     ‘আমার ভয় লাগছে…’ আমি ইঁদুরের মত স্বরে বলি।

     ‘ঘুমিয়ে পড়ো, ভয় কিসের… আয়াতুল কুরসী পড়ে নাও!’

     ‘আচ্ছা।…’ আমি দ্রুত আয়াতুল কুরসী পড়তে থাকি। কিন্তু প্রত্যেক বার ‘ইয়লমু-মা-বৈনা’তে এসে আটকে যাই, যদিও পুরো আয়াত আমার মুখস্ত ছিল।

     ‘তোমার কাছে আসি বেগম জান?…’

     ‘না… বেটি…শুয়ে থাকো…’একটু কঠিন স্বরে বলে।

     তারপর দুজনের ফিসফিস করে কথা বলার আওয়াজ আসতে থাকে।

     ‘হায় রে… অন্যজন কে…!’ আমি আরো ভয় পেয়ে যাই।

     ‘বেগম জান!… চোর আসেনি তো?…’

     ‘ঘুমিয়ে পড়ো বেটা… চোর কোত্থেকে আসবে?…’ রব্বোর কোনো আওয়াজ আসে না। আমি তাড়াতাড়ি লেপের ভেতর মুখ ঢুকিয়ে শুয়ে পড়ি‌।

     সকালবেলা রাতের সেই ভয়ানক দৃশ্য আমার মনেও থাকে না। আমি বরাবরই সন্দেহবাতিকগ্রস্থ। রাতে ভয় পাওয়া, উঠে উঠে দৌড়ানো, বিড়বিড় করা –  ছোটবেলায় প্রায়ই এমন হত। সবাই তো বলত, আমার ওপর ভুতের ছায়া পড়েছে। যদিও আমার কিছুই মনে নেই। সকালে লেপটাকে নিতান্ত সুবোধ বলে মনে হয়। কিন্তু পরের রাতে আমার ঘুম ভেঙে গেলে বুঝতে পারি, খাটের ওপরই রব্বো এবং বেগম জানের মধ্যে নিচুস্বরে ঝগড়া হচ্ছে। আমি ছাই বুঝতেই পারি না কি ফায়সালা হলো। রব্বো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। তারপর বিড়ালের‌ বাসন চাটার মতো চপাশ-চপাশ আওয়াজ আসতে থাকে…উহ্! আমি তো ভয় পেয়ে শুয়ে পড়ি।

     আজ রব্বো তার ছেলের সাথে দেখা করতে গেছে। ছেলেটা ভীষণ ঝগড়াটে। তার জন্য বেগম জান অনেক কিছু করেছে। তাকে দোকান কিনে দিয়েছে। গ্রামে কাজের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। কিন্তু কিছুতেই সে স্থির হয়নি। নবাব সাহেবের এখানে কিছুদিন ছিল। অনেক কাপড় চোপড় দেয়া হয়েছে। কিন্তু কী হয়েছে কে জানে, রব্বোর সাথে দেখা করতেও আসে না। তাই রব্বোই তার কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে ছেলের সাথে দেখা করতে গেছে। বেগমজান যেতে দিত না, কিন্তু রব্বোও নিরুপায়।

     সমস্ত দিন বেগমজান পেরেশান থাকে। শরীরের জোড়ায় জোড়ায় বেদনা অনুভব করে। কিন্তু কারো স্পর্শও তার মনে ধরে না। খিন্ন বেগম জান  কিছু না খেয়ে সমস্ত দিন বিছানায় গড়াগড়ি যায়।

     ‘আমি চুলকে দিই বেগম জান?…’ আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে তাসের পাতি বাটতে বাটতে বলি। বেগমজান মনোযোগ দিয়ে আমাকে দেখতে থাকে।

     ‘আমি চুলকে দেব?… সত্যি বলছি…’ আমি তাস রেখে দিই।

     আমি কিছুক্ষণ চুলকাতে থাকি আর বেগমজান চুপ করে শুয়ে থাকে। পরের দিন রব্বোর আসার কথা ছিল, কিন্তু সে লাপাত্তা। বেগম জানের মেজাজ খিটমিটে হয়ে যায়। চা খেয়ে খেয়ে সে মাথায় ব্যথা তুলে ফেলে।

     আমি আবার চুলকাতে শুরু করি তার পিঠ! মসৃণ টেবিলের উপরিভাগের মত পিঠ… আমি ধীরে ধীরে চুলকাতে থাকি। তার কাজ করে কেমন আনন্দ হত।

     ‘একটু জোরে চুলকাও… ফিতা খুলে দাও…’ বেগম জান বলে, ‘এদিকে, এই একটু কাঁধের নিচে… হ্যাঁ… বাহ ভাই বাহ… হ্যাঁ… হ্যাঁ…’

     সে নেশাতুর ভঙ্গিতে শীতল নিঃশ্বাস নিতে নিতে সন্তুষ্টি প্রকাশ করতে থাকে।

     ‘আরেকটু এদিকে…’ যদিও বেগম জানের হাত সহজেই সেখানে যেতে পারে, সে আমাকে দিয়ে চুলকে নেয়। উল্টো আমার গর্ব হয়। ‘এখানে…ওই… তুমিতো সুরসুরি দিচ্ছ…বাহ…’ সে হাসে। আমিও কথা বলতে থাকি আর চুলকেও দিই।

     ‘তোমাকে কাল বাজারে পাঠাব… কী নেবে? ওই ঘুমানো-জেগে ওঠা পুতুল?’

     ‘না, বেগম জান… আমি পুতুল নিয়ে খেলি না। আমি কি বাচ্চা নাকি এখনো?’

     ‘বাচ্চা নও? তবে কি বুড়ী হয়ে গেছ?’ সে হাসে। ‘পুতুল না নিলে, “বাবুয়া” নিও।’ নিজের কাপড় পরাবে। আমি দেব তোমাকে অনেক কাপড়…’ সে পাশ ফেরে।

     ‘আচ্ছা…’ আমি জবাব দিই।

     ‘এদিকে…’ সে আমার হাত ধরে যেখানে চুলকাচ্ছিল সেখানে রেখে দেয়। যেখানে চুলকায় সেখানে আমার হাত রেখে দেয় আর আমি অন্যমনস্ক ভাবে “বাবুয়া”র খেয়ালে ডুবে মেশিনের মত চুলকে দিতে থাকি… আর সে লাগাতার আমার সাথে কথা বলতে থাকে।

     ‘শোনো… তোমার ফ্রক কমে গেছে… কাল দর্জিকে দিয়ে দেব সেলাই করে নিয়ে আসার জন্য। তোমার আম্মা কাপড় দিয়ে গেছে।’

     ‘ওই লাল কাপড় দিয়ে জামা বানাব না… চামারদের মতো লাগে…’ আমি বকওয়াজ করছিলাম আর আমার হাত না জানি কোথা থেকে কোথায় চলে যায়… কথায় কথায় আমি বুঝতেও পারিনি। বেগম জান তো চিৎ হয়ে শুয়ে… আরে… আমি তাড়াতাড়ি হাত সরিয়ে নিই।

     ‘এই মেয়ে… দেখে চুলকাতে পার না… আমার আমার পাঁজরের হাড় টেনে বের করে নিয়েছ‌।’ বেগম জান দুষ্টুমির হাসি হাসে আর আমি লজ্জা পেয়ে যাই।

     ‘এদিকে এসে আমার কাছে শুয়ে পড়ো…’ সে আমাকে তার হাতের উপর মাথা রেখে শুইয়ে দেয়।

     ‘আহা, কেমন শুকিয়ে গেছ… পাঁজরের হাড় বেরিয়ে যাচ্ছে…’ সে আমার পাজরের হাড় গুণতে শুরু করে।

     ‘উঁ…’ আমি মিনমিনে স্বরে আপত্তি করি।

     ‘অই… আমি কি খেয়ে ফেলব? কেমন আঁটসাঁট সোয়েটার বুনেছে! গরম বেনিয়ানও পারোনি তুমি।’ আমি অস্থির হয়ে উঠি।

     “পাঁজরে ক’টা হাড় আছে?’ সে কথা বদলায়।

     “একদিকে নটা আরেকদিকে দশটা।’ আমি স্কুলে মুখস্ত করা স্বাস্থ্যকথার কল্যাণে জবাব দিই। তাও যেনতেনভাবে।

     ‘সরাও তো হাত… হ্যাঁ, এক… দুই…তিন…’

     আমার ইচ্ছে হয়, কোনরকমে পালাই… কিন্তু সে অনেক জোরে টানে।

     ‘উঁ…’ আমি শক্ত হয়ে যাই। বেগম জান জোরে হাসতে শুরু করে। এখনো যখন তার ওই সময়কার চেহারা মনে পড়ে, মনে ভয় লাগে। তার চোখের পাতা আরো ভারী হয়ে

গেছে। ওপরের ঠোঁটে হালকা কালো দাগ ঘিরে আছে। শীতের মধ্যেও ঘামের কোমল কোমল ফোটা তার ঠোঁট এবং নাকের ওপর চমকায়। তার হাত জমে যাবার মত ঠাণ্ডা। কিন্তু অসম্ভব কোমল যেন ওপর থেকে চামড়া তুলে নেয়া হয়েছে। সে শাল খুলে ফেলে, কারাগার মিহি কুর্তার  মধ্যে তার শরীর আটা গোলার মতো লাগে।

     ভারী জড়োয়া সোনার বোতাম খোলা, কলারের একদিকে ঝুলছে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, ঘরের ভেতরটা অন্ধকার হয়ে আসছে। আমাকে এক অজানা ভয়ের আতঙ্ক ঘিরে ফেলে। বেগম জান তার গভীর গভীর চোখ দিয়ে আমার দিকে তাকায়। আমি কাঁদতে শুরু করি। মাটির খেলনার মতো সে আমাকে চেপে ধরে। তার উষ্ণ উষ্ণ শরীরের স্পর্শে আমার বমি আসতে শুরু করে। কিন্তু তার মাথায় যেন ভূত সওয়ার হয়েছে। আমার অবস্থা এমন, না পারি কাঁদতে না পারি চিৎকার করতে।

     কিছুক্ষণ পর সে নিরস্ত হয়, অসহায় হয়ে শুয়ে পড়ে। তার চেহারা ফিকে এবং অনুজ্জ্বল হয়ে পড়ে। বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে শুরু করে সে। আমার মনে হয়, সে মরে যাচ্ছে… সেখান থেকে দ্রুত দৌড়ে বাইরে চলে যাই।

     আল্লাহর শুকুর, রব্বো রাতে চলে আসে। আমি ভয়ে ভয়ে শীঘ্র লেপ গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়ি। কিন্তু ঘুম কোথায়… চুপচাপ ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে থাকি।

     আম্মা ফিরে  আসছেন না কোনোভাবে… বেগম জানের সাথে আমার এতই ভয় লাগতে শুরু করে যে আমি সমস্ত দিন চাকরানীদের সাথে বসে থাকি, কিন্তু তার ঘরে পা রাখতে দম বেরিয়ে যায় আমার। আর কার কাছে বলতাম, বলতামই বা কী? বলতাম, বেগম জানকে আমি ভয় পাই! তওবা তওবা বেগমজান, যে আমাকে জান দিয়ে ভালোবাসে।

     আজ রব্বো এবং বেগম জানের মধ্যে আবার ঝগড়া হয়। আমার দুর্ভাগ্য বলুন বা অন্য কিছু, ওদের দুজনের ঝগড়াতে আমার খুব ভয় লাগে, কেননা হঠাৎ বেগম জানেরর খেয়াল হয়, আমি বাইরে ঠাণ্ডার মধ্যে ঘুরছি আর নিউমোনিয়া হয়ে মরব।

     ‘এই মেয়ে, আমার মুখে কালি মাখাতে চাও নাকি? তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি পড়ব বিপদে।’ সে আমাকে পাশে বসায়, নিজে চিলমচিতে হাতমুখ ধুতে থাকে… তেপায়াতে চা রাখা।

    ‘চা তো বানাও… এককাপ আমাকেও দিও…’ তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে বলে, ‘আমি কাপড়টা বদলে নিই।’

      সেই কাপড় বদলাতে থাকে আর আমি চা খেতে থাকি। বেগম জান নাপিত-বউকে দিয়ে পিঠ মালিশ করানোর সময় কোনো কাজে যদি আমাকে ডাকে, আমি ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে যাই আর তাড়াতাড়ি ফিরে আসি…এখন যখন সে কাপড় বদলায়, আমার খুব বিতৃষ্ণা  হয়। আমি মুখ ঘুরিয়ে চা খেতে থাকি।

     ‘হয় আম্মা!’ আমার মন কষ্টের সাথে মাকে ডেকে ওঠে, ‘আমি ভাইদের সাথে এমন কী ঝগড়া করি যে আমাকে এই বিপদে…’ আম্মা বরাবর ছেলেদের সাথে আমার খেলাধুলা পছন্দ করতেন না… আচ্ছা, বলি, ছেলেরা কি বাঘ-ভালুক যে গিলে ফেলবে তাঁর মেয়েকে… আর ছেলেও কারা? নিজের ভাই আদের  একরত্তি বন্ধু কয়েকজন। কিন্তু না, তিনি নারী জাতিকে সাততলার ওপর রাখার পক্ষে। আর এখানে বেগম জানের এই আতঙ্ক সমস্ত দুনিয়ার গুণ্ডাদের চেয়েও ভয়ঙ্কর। সম্ভব হলে সেই সময়ই পথে বেরিয়ে পড়তাম, ওখানে থাকতাম না। কিন্তু আমি নিরুপায়। বাধ্য হয়ে কলিজায় পাথর বেঁধে বসে থাকি।

     কাপড় বদলে, ষোড়শ শৃঙ্গার করে উষ্ণ সুগন্ধী আতর তাকে আরো অঙ্গার করে তোলে আর তারপর আসে আমার ওপর উত্তাপ ছড়াতে…!

     ‘বাড়ি যাব…’ আমি তার সকল কথার জবাবে বলি এবং কাঁদতে শুরু করি।

     ‘আমার কাছে তো এসো… আমি… তোমাকে বাজারে নিয়ে যাব… শোনো তো…’

     কিন্তু আমি খৈলের মতো ছড়িয়ে পড়ি। সমস্ত খেলনা-মিঠাই একদিকে আর বাড়ি যাবার জপ একদিকে।

     ‘ওখানে ভাইয়া মারবে… শাকচুন্নি…’ সে আদর করে আমাকে একটা থাপ্পড় দেয়।

     ‘মারুক ভাইয়া…’ আমি মনে মনে ভাবি… আর জেদ ধরে বসে থাকি।

     ‘কাঁচা আম টক হয় বেগম জান…’ ঈর্ষায় জ্বলতে থাকা রব্বো তার মত দেয়। আর তারপর বেগমজান অজ্ঞান হয়ে যায়… সোনার হার, যা কিছুক্ষণ আগে আমাকে পরিয়ে দিচ্ছিল, টুকরো টুকরো হয়ে যায়। মিহি জালীর দোপাট্টা ছিন্নভিন্ন হয়। সেই সিঁথি, যা আমি কখনও এলোমেলো দেখিনি, বিস্রস্ত হয়ে যায়।

     ‘ওহ…ওহ…ওহ…’

     ঝাঁকুনি দিয়ে দিয়ে সে চিৎকার করতে থাকে। আমি বাইরে চলে যাই।

     অনেক যত্নআত্তির পর বেগম জানের হুঁশ আসে। আমি যখন শোবার জন্য পা টিপে টিপে ঘরে উকি দিই, তখন রব্বো তার কোমর ঘেষে বসে শরীর টিপে দিচ্ছিল।

    ‘তোমার জুতো খোলো।’ বেগম জান পাঁজরের হাড় চুলকাতে চুলকাতে বলে আর আমি ইঁদুরের মত লেপের ভেতরে ঢুকে যাই।

   ‘সরর…সরর…ফট…কচ…’

   বেগম জানের লেপ অন্ধকারে আবার হাতীর মতো দুলছে। ‘আল্লাহ! আঁ…।’ আমার দুর্বল আওয়াজ বের হয়… লেপের ভেতর হাতী ওঠে আবার বসে যায়… আমিও চুপ হয়ে যাই। হাতী আবার গড়াগড়ি দেয়… আমার রোম রোম পর্যন্ত কেঁপে ওঠে। আজ আমি মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলাম, অবশ্যই সাহস করে শিথানের কাছে লাগা বাল্ব জ্বালিয়ে দেব।

     হাতী ফড়ফড় করছে। যেন উঠে শক্ত হয়ে বসতে চাইছে। কিছু খাবার চপ চপ আওয়াজ আসতে থাকে, যেন মজাদার চাটনি চাটছে কেউ। এবারে আমি বুঝতে পারি।

     বেগমজান আজ কিছু খায়নি…আর বেশরম রব্বো তো সব সময়ই পেটুক। অবশ্যই কিছু খাচ্ছে… আমি নাক ফুলিয়ে গন্ধ নেবার চেষ্টা করি… আতর, চন্দন, মেহেদির তাজা  সুগন্ধ ছাড়া আর কিছুই অনুভূত হয় না।

     লেপ আবার ফুলে উঠতে শুরু করে।… আমি অনেক চেষ্টা করি চুপ করে পড়ে থাকতে। কিন্তু ওই লেপ এমন আজব আজব চেহারা বানাতে শুরু করে যে আমি কেঁপে উঠি। মনে হয়, গোঁ গোঁ করে কোনো বড় ব্যাঙ ফুলে উঠছিল আর এখন লাফ দিয়ে আমার ওপর এসে পড়ে।

     ‘আঁ…না… আম্মা…’ আমি সাহস করে বলে উঠি। কিন্তু কেউ শুনতে পায় না। লেপ আমার মস্তিষ্কের ভেতর ঢুকে ফুলতে শুরু করে। আমি ভয়ে ভয়ে খাটের অন্যদিকে পা ফেলে অন্ধকারে আন্দাজ করে বিদ্যুতের সুইচ টিপে দিই। হাতী লেপের নিচে ডিগবাজি খায় এবং তারপর বিছানার সাথে লেগে যায়। ডিগবাজি খাবার সময় লেপের কোণ ফুট-খানেক ওপরে উঠে।

     ‘আল্লাহ…!’ আমি ধপাস করে নিজের বিছানায়…!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ভাষা
Scroll to Top