লুনা রাহনুমার কবিতা

খাঁচার পাখি

আরাম বিলাস পরিত্যাগ করে
নিজ হাতে বিছিয়েছি সুগন্ধি ফুলের শয্যা।
উঠানে বুনেছি জলপাই গাছ,
সজনে ডাটা আর কৎবেলের সুস্থ সবল চারা।
মুঠো মুঠো বিশ্রাম ছিটিয়ে দিয়েছি
খাসির রেজালা, বোরহানি আর আমের চাটনির মিশ্রণে।
মুখের কয়েকটা মিঠা কথায় বিকিয়ে দিয়েছি জীবনের শখ,
সাধ আর অতীত যৌবনে লিখে রাখা যাবতীয় আহ্লাদের সম্পূর্ণ তালিকা।
সেই কবে থেকে শুধু নিজেকে বদলে নিয়ে
আয়নায় দেখি তোমার পছন্দের একজনকেই,
অবিকল তোমার স্বপ্নের মতো যে নারী!

এসো, এবার তাহলে তুমি আমাকে বহুত খুব পেয়ার করো।
মহব্বতের মোহরে এমন ভারী করে দাও আমার শাড়ির শিফন আঁচল
যেন
আমি আর কোনোদিন তোমার কব্জা ভেঙে উড়তে না পারি!

ক্ষয়ে গেলে মন

দূরত্ব বাড়ে,
ক্রমাগত দুঃসহ দূরত্ব গ্রাস করে নেয়
আমাদের সহজাত সম্পর্ককে।
পাশাপাশি বসে একই দিকে চেয়ে থেকেও
আমরা মনে মনে উল্টো পথে হাঁটি।

তুমি কি জানো কে দায়ী এই বিমুখতার জন্য
আমি? নাকি, তুমি?
ডিপ্লোমেটিক জবাব দিতে বলতেই পারো,
আমরা দুজনেই।

গাছেদের যখন পাতা ঝরে যায়
সবুজহারা গাছের ডালে যখন আর এসে বসে না একটিও পাখি,
তখনো গাছ মাথা নত করে না আরেকটি গাছের কাছে,
ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে অনড় রুগ্ন শাখা প্রশাখা মেলে।
অথচ মানুষের সম্পর্কে বিক্ষোভ এলে,
অহংকারী মানুষ দানব হয়ে ওঠে
হিংস্রতায় ক্ষত বিক্ষত করে
আপন হাতে গড়ে তোলা সম্পর্ককে।

প্রেম ক্ষয়ে যায়,
একটি দুটি করে হাজারো অভিমান
তিল তিল করে পাহাড় গড়ে মনের জমিনে।
মানুষের হৃদয়ে বসবাস করা সুখ
আর মনের ঘরে আলো আলো প্রেম
নিভে যায় কখন- দুজনের কেউ টের পর্যন্ত পায় না।

ধ্বসে পড়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ওরা কেউ একটুকু ভাবে না:
একদিন খুব সাগ্রহে কাছে এসেছিলাম আমরা।
একদিন খুব ভালোবেসে পাশে বসেছি আমরা।
তারপর, এতদিন পর, আজ, এমন একটা দিন এসেছে
নিঃশ্বাসের কাছাকাছি বসেও আমরা
স্বস্তি খুঁজে পাই একমাত্র দূরত্বেই।

কাঁকর

গতকাল রাতে খাওয়ার সময়
একটা আস্ত কাঁকর পাওয়া গিয়েছিল সাদা ভাতের সাথে।
কাঁকরটি তোমার থালায় না পড়ে
আমার বাদামি থালায় পড়তে পারতো।
কিংবা টুনি আর বাবাইয়ের থালাতেও পড়তে পারতো।
সে কাঁকরের নিজস্ব ইচ্ছে, কার থালা বেছে নেবে।

তুমি আরাম করে পটলের দোলমার সাথে
একদলা ভাত মেখে মুখে দিয়ে দাঁতে চিবুতেই
করকর শব্দে কাঁকড়টি গুঁড়ো হলো তোমার মুখের ভেতর।
পাশের চেয়ার থেকে শব্দ পেয়ে আমি ভাবলাম
পটলের সাথে বিচি রয়ে গিয়েছিল বুঝি বেখেয়ালে!

খাবার প্লেট সরিয়ে রেখে বিরক্তি নিয়ে উঠে গেলে তুমি।
মুখে বললে, সারাদিন বাড়িতে বসে কী করো বুঝি না,
রান্নার আগে চালগুলো একটু বেছে নিতে পারো অন্তত!
সামান্য এইটুকুই তো কাজ তোমার এই বাড়িতে।

পাশের চেয়ারে বসে আমিও শুনলাম চুপচাপ।
তোমার মুখে পাথর ভাঙার শব্দ আর আমার বুকের ভেতর
একটা কিছু চূর্ণিত হবার শব্দ।

তুমি শুনতে পাবে না এমন নিচু গলায় বললাম,
সারাদিন বাড়ির বাইরে থাকো,
দিন শেষের সামান্য এই কয়েকটি ঘন্টা
নিজেকে একটু সামলে রাখতে পারো না বুঝি?
নিজের বদমেজাজ, বিশ্রী ব্যবহার, অকথ্য ভাষারা
এভাবেই দখল করে ফেলেছে তোমাকে আজকাল!

টুনি আর বাবাইয়ের সন্ত্রস্ত চোখের সামনে
অপহাসের দোলে ডুবে যায় আমার কথারা।
ডুবে যাই আমি অনাদরের গভীর নিগ্রহে।
আমাদের ভালোবাসা পুড়ে খাঁটি হয়
ইটের ভাটায় গনগনে আগুনের চুল্লিতে।
তারপর তারা কাঁকরের মত বিদীর্ণ হয়
দৈনন্দিন কলহের আঘাতে আর দহনের অবঘাতে।

এক সন্ধ্যায় দীর্ঘ আলাপ

নিমন্ত্রিত অতিথিদের ভেতর সবচেয়ে কম কথা বলছিলে তুমি।
ঘরের একপাশে জ্বলতে থাকা নিভু নিভু মোমবাতিটির মতো
ক্ষীণ হয়ে ভাসছিল চারপাশের সবকিছুর প্রতি তোমার অনাগ্রহের আভা।
প্রতিভূ পরমায়ু তুমি, অথচ হাসিতে কি ভীষণ অবসাদ!
তোমার গায়ের কালো জামাটির মতোই
এক অন্ধকার গহব্বরের গল্প খুঁজছিলাম আমি তোমার সর্বাঙ্গে।

বাইরে যখন শুরু হলো উদ্দাম গলাবাজি, চাপাবাজি, আর ধান্দাবাজির মহরত
ঘরের ভেতর তখন একলা হলাম আমরা দুজন।
সোফার দুই মাথা থেকে সৌজন্যমূলক দৃষ্টি ছড়িয়ে দেখছিলাম পরস্পরকে।
কফির জন্য সুগার কিউব পাওয়া যাবে কোথায়?
এই প্রশ্নের মাধ্যমে মুখ খুললে তুমি।

আমিও স্বস্তি পেলাম অবশেষে।
যাক, এবার আমাদের আলাপ হতে পারে।
পরিচয় না হয় নাই হলো ঠিক যেভাবে পরিচিত হলে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে।

আমার হাতে এক কাপ চা,
তোমার হাতে উষ্ণ কফি।
মুখোমুখি নয়, আমরা বসেছিলাম পাশাপাশি।
আমাদের চারটি চোখ একসাথে নজর রাখছিল
বাগানের এখানে ওখানে জটলা পাকানো মানুষের গোল্লায়।

একটি পার্টিতে ঠিক কতোজনকে নিমন্ত্রণ করলে
সেটিকে আদর্শ আয়োজন বলা যায়?
আনমনে প্রশ্ন করেছি আমি।

তুমি একটু হেসেছিলে। তারপর বলেছিলে,
যতজনের সংগে মন খুলে আড্ডা দেওয়া যায়,
ঠিক ততজন।

এরপর একটি একটি করে সল্টেড পিনাট মুখে ফেলার মত করে
আমরা আদান প্রদান করেছি কিছু সাধারণ তথ্য।
বিশ্ব অর্থনীতির ব্যাপক পরিবর্তন,
মুদ্রাস্ফীতি,
পরিবেশ দূষণ,
মার্ক্সবাদ, নারীবাদ, ধর্ম, অধর্ম।
সম্প্রতি মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাওয়া
জীবন যাত্রার খরচের কথা বললাম আমরা, খুবই সাধারণ গলায়।

কথা হতে হতে আমরা দুজন দুজনকে দেখছিলাম নিবিড়ভাবে,
অনেকটা প্রকাশ্যে গোয়েন্দাগিরি করার মত করেই।
ব্যক্তিগত কথাগুলোকে খুব সতর্কে সরিয়ে রেখে
অব্যক্তিগত, মানে যা কিছু যে কারো সঙ্গেই বলা যায়,
তেমন কিছু প্রসঙ্গে কথা বলেছি আমরা।

তুমি আধুনিকা মেয়ে, গালের ব্লাশন আর মাশকারার
বিন্দুমাত্র স্থানচ্যুতি না ঘটিয়েও
হি হি হাসির কৌতুক করলে বেশ অনেকক্ষণ ধরে।
ধীরে ধীরে আমরা দুজনেই প্রসঙ্গ বদলালাম একসময়,
যেন বা আমরা এবার একটু স্পাইস চাইছি আমাদের আলোচনায়।

বাইরে সন্ধ্যার ছাই মাখা আকাশ।
বাগানের অতিথিরা সবাই এখন কুন্ডলি পাকিয়েছে বিচ্ছিন্ন অগ্নিকুন্ডকে ঘিরে।
ঘরের ভেতরে বসেও আমরা হিমে জমে যেতে থাকি।
আসলে আমরা দুজনেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম তখন।
আসলে তখন আমাদের ভেতর থেকে
কিছু গভীর সত্য উল্কার মতো ছুটে বেরিয়ে আসার জন্য
তোলপাড় আরম্ভ করে দিয়েছিল।

-আপনি কতদিন ধরে করছেন এই কাজ?
সরাসরি প্রশ্ন করলে তুমি।

প্রসঙ্গটা উত্থাপিত হবার অপেক্ষাতেই ছিলাম আমি।
জানতাম, শেষ পর্যন্ত আমরা এখানে এসেই থামবো।
বললাম, ছয় মাস থেকে। আপনি?

-আমি আরো অনেক আগে থেকে। চার বছর!
-ইশ!

আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো আপনাআপনি, একটি ইশ!
নিজের জন্য যতটা দুঃখ হয় মাঝেমাঝে,
সেই মুহূর্তে তোমার জন্য আমার দুঃখের তীব্রতা বোধ করেছি
কয়েক লক্ষ গুণ বেশি।

এরপর আমরা জানালার পাশের ছোট্ট টেবিলটির কাছে এগিয়ে গেলাম।
এবার আমরা মুখোমুখি বসলাম।
তোমার কন্ট্রাক্ট লেন্সের আকাশি চোখ মনিরা
আমার দিকে চেয়ে ছিল তীব্র দৃষ্টিতে।
আমি লক্ষ করলাম, তোমার ওয়াটারপ্রুফ মাশকারার
ফাঁক গলে চিকচিক করছে অশ্রুর ঝলক।

আমার কণ্ঠস্বর কাঁপাকাঁপা শোনাবে জানতাম,
তবু আমি কথা বলেছি। বললাম,
দেশ থেকে এসেছিলাম লেখাপড়া করার জন্য।
এখন ভিসাগত জটিলতায় পড়ে নিজেকে বিকোচ্ছি।
`অপনা মাঁসে হরিণা বৈরী` কথাটিকে বদলে ফেলেছি,
নিজের শরীর খুঁড়ে খুঁড়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা আরকি!

আলগোছে আমার একটা হাত ধরলে তুমি।
এই প্রথম আমরা পরস্পরের স্পর্শ পেলাম।
কেমন একটা নির্ভরতার আশ্বাস ছিল আঙুলগুলোতে।

তুমি বললে, থাক ওসব কথা। অন্য কথা হোক।
আমরা দুজনেই জানি, শখ করে আসিনি এই পথে।
আমাদের চারপাশে তখন অক্সিজেনের বদলে
ভেসে বেড়াচ্ছিল অনেকগুলো স্বপ্ন মৃত্যুর হাহাকার।

এরপর আমাদের দুজনের বেদনারা একই সঙ্গে হাত ধরাধরি করে
কেঁদেছে, হেসেছে, গলাগলি করেছে আপন সহোদরার মতো।
থোকায় থোকায় রাঙা ফুলকির মতো জ্বলেছে বুকের আর্তনাদ
গভীর রাতের নিবিড়তা পেরিয়েও আরো বহুক্ষণ উন্মুক্ত থেকেছে
ওই যে বাগানে আগুনকে ঘিরে থাকা মানুষগুলোর লালসার মতো।

আমার একটা দীর্ঘশ্বাসে কথা থামালে তুমি।
বললে, দেশে ফিরে যেতে চাও?
বললাম, চাই। কিন্তু উপায় নেই। বাবা অসুস্থ। ক্যান্সারের প্যাশেন্ট। নিয়মিত টাকা পাঠাতে হয়।

তুমি বললে, বাদ দাও তাহলে। এসো আমরা বরং টেমসের পাড়ে
একটা কল্পিত প্রাসাদ গড়ার স্বপ্ন দেখি,
কাচের সেই প্রাসাদের ভেতর একই সঙ্গে সুখে থাকবে
সুয়ো রানী আর দুয়ো রানী।

বললাম, এসো তবে খুব দুঃসাহসের সাথে মনে করি,
একদিন কেউ আর আমাদেরকে পাউন্ডের বিনিময়ে কিনতে চাইবে না।
সেদিন আমরা স্বেচ্ছায় ইচ্ছার পাখা কাটাকাটি খেলবো,
আর সেদিন এই পৃথিবীর সকল পুরুষের কাছে
সবচেয়ে বেশি মূল্যবান বলে মনে হবে
মানুষের হৃদয়ের অনুভূতি,
চামড়ার বাহ্য স্পর্শের চেয়েও বেশি বাঞ্ছিত হবে
অদেখা স্বর্গীয় প্রেমানুভূতি।

ভ্রমর

বক্ষে বাঁধিয়া বিষের থলি
চক্ষে ফোটাও ফুল-
বন্ধু তোমায় প্রেমিক বলি
জানি, করছি ভুল।

পঙ্কিলে ফোটে কোমল পদ্ম
নর্দমাতে নামি নাই-
হৃদয়ে এসেছে যে প্রেম সদ্য
লাজ ঘেন্না শেখে নাই।

জোনাকিরা আলো জ্বালছে জ্বালুক
বাসুক আরেকটু ভালো-
ভুল সোহাগের কামনায় ঢুলুক
বাসনার তৃষ্ণার্ত আলো।

জাগছে তিমির রজনী তোমার
বন্দনা করে আমারই-
হউক কিছু তার মিথ্যা আদর
বাকিটুকু ক্ষমার প্রহরী।

গলিতে অনলে দোহের সম্মতি
কণ্ঠে জলের সুধা-
বুকের ভেতর পুড়ুক বসতি
উবে যাক কুজ্ঝটিকা।

শব্দের খেলায় উচ্চারণ করো
সুশোভন অনুরাগ-
চোখের তারায় পেয়ালা ভরো
প্রমোদেরও অভিলাষ।

প্রেমেতে বাঁধিয়া পরানখানি
কণ্ঠে ফোটাই ভাষা-
তোমার হৃদয়ে কামনার রাশি
আমাতে, প্রণয়েরই দুরাশা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ভাষা
Scroll to Top