Home » লড়াকু অংলা // শিশির চাকমা, অনুবাদ: আশাধন চাকমা

লড়াকু অংলা // শিশির চাকমা, অনুবাদ: আশাধন চাকমা

চৈত্র মাসের দাউ দাউ করা তপ্ত দুপুর। উত্তাপে মাটি ফেটে গেছে। গাছের বাকল ঝরে পড়ছে। আকাশে মেঘের আনাগোনা নেই, বৃষ্টির কোন আভাস নেই। এই নীরস শুষ্ক গ্রীষ্মে জুরাছড়ি বোট ঘাটে বোটের অপেক্ষায় অংলা। গন্তব্য রাঙামাটি। হ্যাংলা পাতলা  কিন্তু শক্তিশালী লোক। কিছুক্ষণ পরপর দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালায় সিগারেট খাওয়ার জন্য। আঙুলের মাঝখানে সিগারেট। নাক আর মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছে আর ঘাটের জেলেদের জাল বোনা দেখছে এবং ভাবে জীবনের এই পিচ্ছিল পথে সে এখন কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। সে কোথায় যাবে, কতদূর যাবে। অংলা একজন জাত লড়াকু। আত্মগোপনে সংগ্রামরত ছিল প্রায় দেড় যুগ। তার পা পড়েনি এমন কোন জায়গা নেই। উত্তরাঞ্চল দক্ষিণাঞ্চল সবখানে তার বিচরণ ছিল। সুখ-দুঃখের ধারাপাত অনেক দীর্ঘ।

দেশের জন্য জাতের জন্য সে মুক্তিপাগল। মুক্তিসংগ্রামে সে যে কোনো প্রান্তে যেতে রাজি, তার কোনো আপত্তি নেই। ঘোর অন্ধকারে বর্ষাকালে পিচ্ছিল সংকীর্ণ পথে শিকারীর সজাগ চোখে সে হেঁটেছে উত্তরাঞ্চল থেকে দক্ষিণাঞ্চল, দক্ষিণাঞ্চল থেকে উত্তরাঞ্চল। এ প্রাণ নিয়ে খেলা, যে কোনো সময় মৃত্যু হতে পারে। একটাই জীবন এভাবে মনের সিন্দুকে বন্ধক রেখে চলা। এক কথায় সুঁইয়ের ডগায় জীবন।

স্ত্রীর সাথে দেখা হয় না নিয়মিত। বছর ছ’মাসে একবার মাত্র দেখা হয়। প্রিয়তমা স্ত্রীর নাম কাঞ্চনা। সাত বছর বয়সী একটা ছেলে আছে তাদের। নাম ধুবচান। অংলা বাড়ি যাচ্ছে না প্রায় এক বছর হল। ছুটি পাচ্ছে না। অনবরত চােখে ভাসে তার সোনা মোহরের চেয়ে প্রিয় পুত্রকে। আরও তার চােখে ভাসে তার ছেলে কেচকমুরির (এক ধরণের নীলরঙা পতঙ্গ) মতো উড়ে বেড়াবে। এভাবেই দিন কেটে যায় অংলার। একদিন মিজোরাম সীমান্তে এক যুদ্ধে শত্রুর মুখোমুখি লড়াইয়ে তার পায়ে একটা গুলি লাগে এবং আহতাবস্থায় ধরা পড়ে শত্রুর হাতে। তাকে পেয়ে টেনে হিঁচড়ে ধরে নিয়ে গেল শত্রুরা। এখন তার জীবনে নেমে এল ঘোর অন্ধকার। শরীরে অত্যাচারের নির্মম চিহ্ন। শরীরের চামড়া ছিড়ে গেছে। একটা আলাদা ট্রাইব্যুনালে তার বিচার হল। রায় হলো যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

 জেলখানার ভিতরে অংলা। খাঁচার ভিতর বাঘ। জেলখানার চার দেয়াল শরীরকে বন্দি করতে পারলেও, তার মনোবলকে বন্দি করতে পারেনি। জেলখানায় বন্দি অবস্থায়ও সে ভাবে দেশ জাতের কথা, লড়াই সংগ্রামের কথা। সেই সাথে ভাবে তার প্রিয় স্ত্রী ও পুত্র ধুবচানের কথা। অংলা লড়াইয়ে সবসময় শিরদাড়া উঁচু রাখে, দ্বিধাহীন।

অংলা জীবন বন্ধক রেখেই লড়াই করতে পারে। সে যেন মাংসাশী বাঘের মতোন। জেলহাজতে বিভিন্ন কাজ করতে হয় তাদের। সেখানে সবাই অংলাকে ভালোবাসে। নানা অনুষ্ঠানে অংলা উপস্থিত থাকে। জেল বন্দী অন্যদেরেকও সে লড়াই সংগ্রামের কথা শোনায়। পাহাড়ের কথা শোনায়। সবাই অবাক হয়ে মনােযাগী হয়ে শােনে তার কথা। এভাবেই অংলার জেলখানার দিনগুলি কাটতে থাকে।

 এদিকে অংলার প্রিয় স্ত্রী-পুত্র বিপাকে পড়েছে। কূলহীন সাগরে নিরুপায় তারা। কেউ কেউ কাঞ্চনাকে বলে, অংলার অপেক্ষায় আর থেকো না। সে আর ফিরে আসবে না। জেল থেকে কোনোদিন ছাড়া পাবে না। একদিন কাঞ্চনাকে বলা হলো, অংলা জেলখানাতে অসুস্থ হয়ে মারা গেছে। সবাই বলল, তোমার ছেলের কথা ভেবে। আবার বিয়ে কর। কাঞ্চনা আগা ভাঙ্গা লতার মতো হয়ে গেল। কী করবে বুঝতে পারে না। এভাবেই দিন কাটতে লাগল চিন্তায় চিন্তায়। পরে একসময় কাঞ্চনা মনস্থির করল আবার বিয়ে করবে। একজনকে বিয়ে করে ফেলল সে। এদিকে ধুবচানও বড় হয়েছে। এভাবেই বহু বছর কেটে যায়। কাঞ্চনা ধুবচান তারাও কোথায় যেন হারিয়ে গেল।

তেরো বছর পর অংলা জেলখানা থেকে ছাড়া পেল। ছাড়া পেয়ে সেও স্ত্রী পুত্রের কোনো খবর নিল না। কারণ জেলখানায় থাকার সময় সে শুনেছে, তার স্ত্রী কাঞ্চনা আবার বিয়ে করেছে। তাই তার হৃদয় এখন একটু ভারী হয়ে আছে। অংলাও আবার বিয়ে করল। নতুন সংসার পাতল। জীবনের নতুন পথে নামল সে। এ পথ সোজা নয়, আঁকাবাঁকা দীর্ঘ এ পথ। সময়টাও ভালো নয়, সময়টাও যেন পর, তার বিপক্ষে।

ছোট্ট একটা দোচালা ঘর তুলে সে জুরাছড়ি বাজারে থাকে। জীবন সংসার চালাতে ছোটখাটো কাজ করে। এরই মধ্যে সে তার পুত্র ধুবচানের খবর পেয়েছে। ধুবচান তার স্ত্রীকে রাঙামাটি মেটারনিটি সেন্টারে ভর্তি করেছে। রাত ৮টা বাজে। ধুবচানের স্ত্রীকে অপারেশন রুমে ভর্তি করানো হলো। ধুবচান বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছে। দুশ্চিন্তা তার স্ত্রীর যদি কিছু হয় কিন্তু আবার মাঝে মাঝে সে এই ভেবে খুশীর জোয়ারে ভাসে যে, সে এক পুত্রসন্তান লাভ করবে।

রাতে অংলা মেটারনিটি সেন্টারে গেল। ধুবচানদের খোঁজ খবর নিতে পারবে এই উদ্দেশ্যে সে সেখানে যায়। কিন্তু সে তার ছেলে ধুবচানকে চেনে না। কিছুক্ষণ পর একজন নার্স এসে বলল, ধুবচান কে? তার একটি পুত্রসন্তান হয়েছে। ধুবচান খুশী হয়ে হাসিমুখে সেদিকে চলে গেল।

 অংলা তখন বড় সজনা গাছটির নিচে দাঁড়িয়ে আছে। ওহ, তাহলে এ-ই সে ধুবচান, সে মনে মনে বলল। তখন ধুবচানের কাছে গিয় অংলা বলল, একটু এদিকে আসো। একপাশে ডেকে নিয়ে বলল, তুমি আমাকে চিনতে পারছ? ধুবচান বলল, না। ধুবচানের বাবা কোথায় সে জানে না। সে লড়াকু ছিল আর তার বাবা যুদ্ধে মারা গেছে সে শুনেছে। অংলার চোখ তখন অশ্রুতে ভিজে গেল। কিন্তু কান্না চেপে রেখে সে বলল, আমি-ই তোমার সেই হতভাগা পিতা। ধুবচান অবাক হয়ে বলে উঠল, কী! আপনি-ই তাহলে আমার বাবা! বাবা-ছেলে দুজনই একে অপরকে জড়িয়ে ধরল, কোনো কথা নেই। ওদিকে মেটারনিটি সেন্টারের পাশের রাস্তা দিয়ে গাড়িগুলো পোড়া গন্ধ ছেড়ে দিয়ে আসছে আর যাচ্ছে হর্ণ বাজিয়ে বাজিয়ে। বাবা-ছেলে কী কথা বলল, কী করল পরে তার কিছুই দেখা ও বোঝা গেল না।

শিশির চাকমা

অবসর প্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা। তিন পার্বত্য জেলার সুনামধন্য সাহিত্য সংগঠন জুম ঈসথেটিকস্ কাউন্সিল (জাক)- এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং হিলট্রেক রাইটার ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠা সভাপতি, সাহিত্য সংগঠক, সমাজকর্মী, চাকমা সাহিত্যের বিশিষ্ট কবি ও গল্পকার

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ভাষা
Scroll to Top