আমার পিঠের উপর কাটজিনস্কি। হৃদয় সহায় বন্ধু আমার। ফ্রন্ট থেকে বয়ে আনছি ওকে। মুহুর্মুহু গুলি, তুমুল বোমাবর্ষণ, গ্যাস আর ছুটে আসা অজস্র স্প্লিন্টারের টার্গেট এড়িয়ে সরে যাচ্ছি বিপদমুক্ত এলাকায়। কিছুটা নিরাপদ কোনো পরিখার খোঁজে। সম্ভব হলে নিজস্ব বাহিনীর সাময়িক কোনো আশ্রয়ে।কাটজিনস্কিকে বাঁচাতেই হবে। যুদ্ধক্ষেত্রে একা, অসহায়, আহত, অপারঙ্গম চলৎশক্তিহীন বন্ধুকে ফেলে কিছুতেই আমি ফিরে আসতে পারি না। কেবল নিজের প্রাণ বাঁচানোর ইচ্ছা আমার কোনোকালেই ছিল না। এখনো নেই। একজন সৈনিক তো কেবল নই। আমি একজন মানুষও।
কমরেড কাটজিনস্কি, বীরযোদ্ধা অমিত জীবনশক্তির তাজা তরুণ বন্ধু আমার, বুকের কন্দর থেকে নিঃশ্বাস নাও। ধীরে, অতি ধীরে একটু একটু করে নিঃশ্বাস নাও ভাই আমার। এই ত আর কিছু দূর। আর কিছুদিন। ফ্রন্ট ছেড়ে আমরা ফিরে যাবো খোলা আকাশের পারে। ফিরে যাবো চেনা ঘর, চেনা ইশকুল, কলেজ, পাড়ার রাস্তা, জেগে থাকা হলুদ কালো কুকুরের অবিশ্রাম ঘেউ তান, দু’ একজন নরম বুকের হঠাৎ চোখে লাগা তরুণীর সাথে মনোরম সন্ধ্যা আর বিকেল কাটাবো। মায়ের হাতের খাবার, বোনের বানানো পিঠা আর বাবার একঘেয়ে বকুনি ঘেরা বাড়িতে আমরা আবার ফিরে আসবো। শীত কেটে আবার বসন্ত এলে, সবচে সেরা ভালো জামাটি পরে আমরা দেখা করতে বেরুবো কোনো নীলচোখ তরুণীর সাথে!
সাহস রাখো কমরেড। জমানো নিঃশ্বাস থেকে শ্বাস নাও। আর অভিশাপ দাও তাদের, যারা যুদ্ধ বাঁধিয়ে আমাদের কৈশোর ছোঁয়া সদ্য তারুণ্যকে হত্যা করছে। আমাদের খুনি বানিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে আমাদের ঘৃণ্য করে তুলেছে। অভিশাপ দাও কাটজিনিস্কি। হৃদয় খুঁড়ে অভিশাপ দাও অই সব যুদ্ধবাজদের। এ ছাড়া আমরা আর কিইবা করতে পারি প্রিয়তম ভাই আমার !
নভেম্বরের তেইশ থেকে ডিসেম্বরে চার তারিখ পর্যন্ত ফ্রন্টে ছিলাম আমি। হ্যাঁ আমিই পল। পল বোমার। জার্মান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। বছর বিশের টগবগে তরুণ আমি। স্বপ্নের পাতাগুলো সবে মুখ খুলে আমাকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে। আমাকে জাগাচ্ছে। চমকে চমকে উঠছি তারুণ্যের মর্মর স্পর্শে। আর সে সময়েই আচমকা আমিসহ আমাদের চলে আসতে হলো এই মহাযুদ্ধে।
কেনো যুদ্ধ? কেনো হয় এই প্রাণঘাতী রক্তাক্ত যুদ্ধ? কারা ঘটায়, কিসের স্বার্থে? আমরা কি চিনি না তাদের? তাদের লোভকে কি জানি না আমরা?
অই স্বর্ণদ্বীপ তাদের চাই, দূর্গ চাই, কয়লাখনি, বহতা নদী গোলাপবুক নারী, সব সব কিছু চাই তাদের। তারা স্বপ্ন দেখে, দশদিগন্তের সবকিছু কেবল আমার। আমার হবে। আমারই নাম গাইবে, জপবে। আমাকে প্রভু বলে অন্যরা নুয়ে দেবে তাদের মাথাসহ সবকিছু।
বন্ধু কাটজিনস্কি, জেগে আছ বন্ধু আমার? বল তো কতিপয় যুদ্ধবাজ শয়তানের সাথে কেনো আমরা হেরে যাই বারবার? কেনো আমরা একজোট হয়ে পৃথিবীর তাবৎ মানুষ বলতে পারি না, চাই না, চাই না এই যুদ্ধ। আমরা শান্তি চাই, স্বস্তি চাই। পৃথিবীর উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিমের প্রতিটি কোলে শান্তি আসুক। শান্তি বিছিয়ে রাখুক ঘরে ধোয়া বিছানার চাদরের মত মায়ের কোলের নিস্পাপ সুগন্ধকে।
নভেম্বরের বাইশ তারিখ। শাহবাগ। আজিজের প্রথমা দোকানের বাইরে কাঁচের দেয়ালের ভেতরে পেরেক ঝুলানো বইটি চোখ টেনে নিলো আমার। অল কোয়াইট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট। লেখক এরিক মারিয়া রেমার্ক। রূপান্তরে শেখ আবদুল হাকিম।
হালকা গুমোট। মৃদু গরম। আর অজস্র মানুষের স্পর্শ গন্ধময় চলাফেরার এক পাশে লোভীর মত দাঁড়িয়ে পড়লাম। অপরিসীম চকচকে কৌতুহলে ভেতরে ভেতরে ফেটে পড়ছি। এই সেই বই। সেই! সদ্য পালক খোলা কৈশোর আমার। সে সময়ে আলোকিত আলোড়ন তুলে দিয়েছিল এই বইটি।
একাত্তরের যুদ্ধে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছিল আমার পরিবার। আমাদের এই ছিল, অই ছিল যুদ্ধে সব পুড়ে গেছে, লুটে গেছে শুনে শুনে বেড়ে ওঠার সেই সময় আমার। অই মূহূর্তে বইটি হাতে পেয়ে, অচেনা অজানা এক জার্মান তরুণের প্রতিটি অনুভূতির সঙ্গ হয়ে, আমিও সেঁটে গেছিলাম যুদ্ধ নামের এক মহা অন্যায়ের ফাঁদে।
একাত্তরে পুড়ে যাওয়া এক কবন্ধ তালগাছ, বোমার আঘাতে ভেঙ্গে পড়া দেওয়াল, অসংখ্য গুলির চিহ্ন আর বড়দের কাছে গল্প শোনা আশ্চর্য সুন্দর এক বাড়ি, দোলনা দুলুনি বাগান আমার মনে বারবার ভেসে উঠত।
স্মৃতি বালকের ছুঁড়ে মারা রঙিন মার্বেলের মত আমি শৈশবে মনে মনে ছুটে যেতাম সেই বাড়িতে। যুদ্ধ কেড়ে নিয়েছিল যে বাড়ি। কেড়ে নিয়েছিল জমাট রসে জারানো আনন্দ, কিচেনের সুস্বাদু সুঘ্রান, অসাম্প্রদায়িক একেকটি দিনরাত, অলিখিত সুখি আত্মীয়পাঠ আর আমার মায়ের সুস্থতা আর সৌন্দর্যের অমিয়ডালি।
হেট ইউ যুদ্ধ। শুনে রাখো যুদ্ধবাজরা, জেনো রাখো, স্রেফ ঘৃণা করি তোমাদের। ঘ য়ে ঘৃণা। ঈশ্বরের অভিশাপে তোমরা যুদ্ধবাজ। পৃথিবীর শত্রু, মানুষের শত্রু তোমরা। তোমরা জানো না শান্তি কাকে বলে। জানবেও না কোনো দিন। তাই তোমরা নিজেরাই তোমাদের নিজেদের শত্রু। শত শত বছর পেরিয়ে গেলেও ক্ষমা নেই তোমাদের।
অই ভিড়, ঘন পথচলার ভেতর আমার অন্তরাত্মা বলে উঠলো, বইটা আমার আবার চাই। এক জীবনে কতকিছুই তো হারায়। হারিয়েছিও কম কিছু নয়। কিন্তু কিছু কিছু বই হারানোর দুঃখ চরম হয়ে দেগে আছে আমার মনে। কিনতে চাইছি বইটা। কিনবো সিওর। কিন্তু শেষ নভেম্বরের দিনগুলোর মত আমার টাকাপয়সাও ব্যাগের তলানিতে নিস্তরঙ্গ খুচখাচ করছে। কিন্তু মন যে চই চই, বইটা চাই চাই করছে! বইটার সামনে দাঁড়িয়েই দ্রুত হিসেব করছি। অদৃশ্য কাঁচিতে চালাচ্ছি সাংসারিক কাটছাঁট। সাথের তরুণ বন্ধুটি উস্কে দিলো, কিনে ফ্যালান আপা। না হয় কয়ডা দিন মরিচ পুড়াইয়া আলু ভর্তাই খাইলেন।
কি লাগসই যুক্তি! একেবারে আমার মত।
প্রচুর হাসলাম। খুশিতে, আনন্দে। চেহারা, জেন্ডার ধারনা আলাদা হতে পারে কিন্তু পাগলদের জাত অই একই। এই ছেলেটাও এক বই পাগল। আমার মতই চোখে মনে শরীরে মস্তিষ্কে স্বপ্ন নিয়ে হাঁটে চলে, ঘুমিয়ে আবার জাগে।
নিজেকেই গিফট করে দিলাম বইটি। জন্মদিনের উপহার। মায়ের হাড় জ্বালানো, বাপির হাড় কাঁপানো, বোনদের পিত্তি গালানো আমি, বাইশ নভেম্বরের রাত বারোটা এক মিনিটে, বইটির প্রচ্ছদের সামনে পেছনের লেখাগুলো পড়ে চোখ বন্ধ করে বললাম, শুভ জন্মদিন কাজল। সেই পুরানো খেলাটা তুই আবার খেলতে পারিস এবার।
যে কোনো বই পড়ে ভালো লাগলে আমি তার কোনো একটা চরিত্র হয়ে যেতাম। এখনো যাই। মনে আছে ঠাকুমার ঝুলির গল্পের নীলকুমার হতে চেয়েছিলাম আমি। রাক্ষুসী মা আর মানুষ বাবার রাজপুত্র হতে ভালো লাগত আমার। মায়ের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সৎ ভাই ডালিমকুমারের সহায় সেই নীল কুমার ! তেমনি এই বইটি যখনই পড়তাম, আমি পল বোমার হয়ে যেতাম।
কত বছর আমি পল বোমার হই না। কত বছর আমি বন্ধুদের সাথে, একাত্তরের যুদ্ধে ভাঙ্গা দেয়ালের উপর উঠে, দুদিকে হাত ছড়িয়ে লাফ দিয়ে চেঁচিয়ে বলি না, অল কোয়াইট অন দি ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট। অল কোয়াইট —
আমার মাথার সবুজ টুপিতে এখন আর উড়ে এসে বসে না শান্তির নীল প্রজাপতি। ভালো নেই আমরা। ভালো নেই আমার দেশ। সন্ত্রাস, ধর্ষণ, খুন, আইনের অপপ্রয়োগ আর ক্ষমতার ছত্রচ্ছায়ায় চলছে অবাধ লুন্ঠন। পিঠের উপর চেপে বসে আছে অন্যায়ের নীল তিমি, উল্লম্ফ সাম্প্রদায়িকতা, ধনবান চোরদের উদ্বাহু মানসিকতা, দেশ বিক্রির খেলায় মত্ত রাজনীতিবিদ আর তাদের মোসাহেব শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, ছাত্র ফড়িয়া বেকাররা।
কোথাও এক ইঞ্চি নিরাপদ জায়গা খুঁজে পাচ্ছি না আমার প্রিয় বাংলাদেশে। আমার তরুণী মেয়ে ইশকুল, কলেজ, ভার্সিটি কিম্বা অফিস গেলে আমি উৎকণ্ঠায় ফুলে উঠি। ধর্ষকের বিচার নেই। আইনশৃখলা বাহিনীর কেউ কেউ প্রকাশ্যে উস্কে দিচ্ছে নারীবিদ্বেষ। সেনাবাহিনী জড়িয়ে যাচ্ছে খুন, রাহাজানি, অপহরণ অপকর্মে। শিক্ষায়তনে চলছে জঙ্গি চাষ। আমাদের ছেলেমেয়েরা জঙ্গি বলয়ে ঢুকে গেলো না তো ! সর্বক্ষণ কাঁটা হয়ে থাকছে বাবা মা এই ভাবনায়।
মোটা চালের দাম কেজি প্রতি পঞ্চাশ টাকা। গরীবের ভাগ্য থেকে উঠে যাচ্ছে তিনবেলা মোটা চালের ভাত। মধ্যবিত্ত দিশেহারা। শহর গ্রামের সর্বত্র নেশার উপকরণ হাতের মুঠোয়।
পিঠের উপর ভারী বোঝার মত জমে যাচ্ছে উৎকণ্ঠা। দেশের প্রতিটি কোণে কোণে অশান্তির অপচ্ছায়া। আমি আর বলতে পারি না, এই যে দেশ, আমার দেশ, আমার শান্তি সুখের বাংলাদেশ। আমি তোমায় ভালোবাসি—-

রুখসানা কাজল
রুখসানা কাজল পেশায় অধ্যাপক। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে। দেশ ও দেশের বাইরের পত্র পত্রিকায় গল্প ও নিবন্ধ লেখেন। এ পর্যন্ত দুইটি উপন্যাস, গল্পগ্রন্থ এবং অনুগল্পের বই প্রকাশিত হয়েছে।