এক.
কবি আবুল হোসেন তাঁর আত্মজীবনী ‘আমার এই ছোট ভুবন’ গ্রন্থে তাঁর ফেলে আসা গ্রাম খুলনা জেলার ‘দেয়াড়া’কে নিয়ে যে-কথাটি বলেছিলেন, ‘নির্জন, ঘুমঘুম, পাখিডাকা, পাতাঝরা, ছায়াঘন গ্রাম’, নেত্রকোনা জেলায় প্রবেশ করে চারপাশ দেখতে দেখতে কবির আত্মœজীবনীর এই স্নিগ্ধ কথাগুলো মনে পড়ে গেল। বাংলাদেশের জেলা শহরগুলোর এক-সময়ের সাদামাটা ভাব অনেকটা বদলে গেছে। ছিমছাম মফস্বলগুলোকে স্পর্শ করেছে নাগরিক যান্ত্রিকতা, তবে কোনো এক জাদুবলে ‘নেত্রকোনা জেলা’ এখনো তার কৌমার্য ধরে রেখেছে।
অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ, জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘জ্ঞানের কাছে জীবন পরাভূত হলে জন্ম নেন একজন অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক।’ আমার নেত্রকোনা গমনের উদ্দেশ্য জ্ঞানের কাছে জীবন পরাভূত করা দার্শনিক যতীন সরকারের দর্শন লাভ।
ইচ্ছেটা অনেকদিনের, তবে রাস্তাঘাটের অব্যবস্থাপনা মনের ভাবনায় বার বার বাধ সেধেছে। ঈদুল আজহার পরদিন রাস্তায় ঝামেলা থাকবে না- এমন ভাবনা থেকে অবশেষে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করলাম। অবশ্য যাঁর বাড়িতে যাব তাঁর অনুমতি না-নিয়েই যাবার চিন্তা করা কোনোমতে শিষ্টাচারসম্মত ছিল না, কিন্তু মনের আকাক্সক্ষার কাছে ঔচিত্যবোধের চিহ্ন-টিহ্ন কীভাবে যেন উড়ে গিয়েছিল।
বস্তুতপক্ষে, পরিকল্পনা কল্পনার জিনিস হয়েই থেকে যেত যদি না উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে স্যারের জামাতা রাজীব সরকার আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসতেন। আমার অভিপ্রায় জেনে রাজীব সরকার কয়েকদিন ধরেই যোগাযোগ রাখছিলেন। স্যারের অনুমতি নেওয়া, কখন-কীভাবে রওনা করব ইত্যাকার বিষয় তিনি পরিষ্কারভাবে জানিয়ে রেখেছিলেন বলে সফরটা নির্বিঘ্নে হতে পেরেছে
মোটামুটি কাকডাকা ভোরেই রওনা করতে পেরেছিলাম। ঢাকা শহর ফাঁকা। ঈদের ছুটির পর লোকজন নিশ্চয় নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। বাড়ি থেকে যেহেতু নাস্তা করে যাই নি, গাড়িচালক নান্নুকে বলে রেখেছিলাম, জয়দেবপুরের পর কোথাও থামব। ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে নান্নু একটানে ‘পুষ্পদামে’ গিয়ে থামে। কিন্তু হলে কী হবে, ছুটির রেশ ‘পুষ্পদাম’কেও স্পর্শ করেছে। রিসোর্ট সংলগ্ন রেস্তোরাঁটি বন্ধ। কী আর করা! ভাবলাম, ময়মনসিংহ পৌঁছে যা করার করতে হবে।
ময়মনসিংহ পৌঁছুতেও সময় লাগল না, যদিও অবস্থা সেখানেও তথৈবচ। দোকানপাট সব বন্ধ। যদিও নান্নুর উৎসাহে ঘাটতি নেই। সে শহরময় গাড়ি চালিয়ে ঘুরতে লাগল, ভাগ্য সহায় হলে যদি কোনো রেস্তোরাঁ খোলা পাওয়া যায়!
অবশেষে হালের ব্রহ্মপুত্র, পুরাতন শম্ভুগঞ্জ ব্রিজের আগে সরু, মোটামুটি পরিচ্ছন্ন একটা রোস্তোরাঁ খুঁজে পাওয়া গেল। দুজনে উদরপূর্তি করে নিলাম। খাবার মন্দ লাগল না। পাশের একটা দোকানে দশ টাকা দামের কফিও মিলল। ব্রিজের ওদিকটা বেমানানভাবে শুনশান নীরব। জ্যামহীন সেতু ধরে অপ্রত্যাশিতভাবে একটানে গাড়ি চালিয়ে রাজীব সরকারের বাতলে দেয়া পথে আমরা নেত্রকোনার পথ ধরলাম।
রাজীব সরকার বলে রেখেছিলেন, ‘শ্যামগঞ্জ বাজারে’ পৌঁছে যেন তাঁকে জানাই। এ মুহূর্তে তিনি যতীন সরকারের ‘সাতপাই’য়ের বাসায় সপরিবারে অবস্থান করছেন। শ্যামগঞ্জ থেকে নেত্রকোনা শহর বেশি দূরে নয়, আমরা যদি শহরের বাসস্ট্যান্ডের কাছে এসে দাঁড়াই তবে তিনি আমাকে সহজে শনাক্ত করে এগিয়ে নিতে পারবেন, এরকমই কথা ছিল। শ্যামগঞ্জ বাজারটা একটু অদ্ভুত। এখানে পাশাপাশি দোকানে ময়মনসিংহের গৌরীপুর এবং নেত্রকোনা জেলার সাইনবোর্ড ঝুলছে। তার মানে, বাজারটা দুই জেলায়ই পড়েছে। এরকম বিষয় দেশের অন্য জায়গায়ও দেখেছি।
এদিকের রাস্তাঘাট বেশ ভালো। নেত্রকোনা শহরে পৌঁছুতে বেশি সময় লাগল না। নির্দেশিত জায়গায় পৌঁছে কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজীব সরকারের দেখা পেলাম।
যে-কোনো নতুন জায়গায় গেলে রেলস্টেশন দেখা আমার আগ্রহের বিষয়। রাজীব সরকার কোনো এক মন্ত্রবলে আমার মনের ভাবনা পড়ে নিলেন। ডানে-বামে করে হাজির করলেন শহরের দুটো রেল-স্টেশনের একটি ‘নেত্রকোনো কোর্ট’-এ।
‘নেত্রকোনা কোর্ট’ নামটি যেমন অভিনব এর অবয়বও তেমন। একদম খোলাও নয় আবার বড় আচ্ছাদনে ঢাকাও নয়- গল্প-উপন্যাসে গ্রামের বা ছোট্ট মফস্বলের রেলস্টেশনগুলোর যে ধরনের চেহারা জেনেছি, ‘নেত্রকোনা কোর্ট’ ঠিক সেরকম। রাজীব সরকার কথাবার্তায় বেশ চৌকস। জানা গেল, প্রায় একশো বছরের পুরনো এই স্টেশনে মূলত কোর্টের কাজে আসা লোকেরা নামত বলে স্টেশনটির এমন নামকরণ। এর পাশেই শহরের একমাত্র সিনেমাহল ‘হীরামন’। সেটি গতবছর থেকেই বিলুপ্ত। রাজীব সরকার জানালেন, ১৯৭০ সালে নির্মিত এই সিনেমা হলের পতনের মধ্য দিয়ে নেত্রকোনায় এখন আর কোনো সিনেমা-হল অবশিষ্ট নেই। আক্ষেপ করলেন, দেশজুড়ে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিই হুমকির মুখে পড়ে গেছে। জানা ছিল যে, এই ব্যবসার বর্তমান হাল দেশের সর্বত্র প্রায় একইরকম। আমার নিজের শহরেও (ফেনী) চারটে সিনেমা হলের মধ্যে তিনটির বিলুপ্ত ঘটেছে, চার-নম্বরটি, যার নাম ‘দুলাল সিনেমা’- সেটির বাতিও টিম-টিম করে জ্বলছে, সম্প্রতি ঘুরে এসে মনে হল, হারাধনের শেষ ছেলেটিও যে কোনো দিন হারিয়ে যাবে।
‘কোর্ট স্টেশন’ দেখে আমরা গেলাম ‘নেত্রকোনা রেলওয়ে স্টেশন’-এ, যেটা মূলত বড় স্টেশন নামে পরিচিত । এটি অবশ্য রেল-স্টেশনগুলো সচরাচর যেমন হয় তেমন।
দুই.
বড়স্টেশন দেখা হলে আমরা ‘সাতপাই’য়ের পথ ধরলাম। যেতে-যেতে পুলিশ সুপারের কার্যালয়, সার্কিট হাউজ, নেত্রকোনা গার্লস কলেজ, নেত্রকোনা কলেজ ইত্যাদি গাড়িতে বসেই একঝলক করে দেখা হল।
‘সাতপাই’ এলাকা শহরের প্রায় মধ্যিখানে। পাশেই ‘মগরা নদী’। রাজীব সরকার কথা বলতে বলতে সময়গুলোকে অর্থবহ করে রাখলেন। জানালেন, নিজ জেলা কিশোরগঞ্জের চেয়ে শ্বশুরবাড়ি নেত্রকোনার প্রতি তাঁর আবেগ ভিন্নধর্মী। প্রয়াত পিতার চাকরিসূত্রে তাঁরা কিছুকাল নেত্রকোনায় বসবাস করেছেন। মগরা অতিক্রমকালে তিনি বললেন, দুর্গা-পূজার সময় প্রতিবছর নদীর দু’পাশে এমনভাবে আলোকসজ্জা করা হয়, যা নাকি দেখার মত। তার কথা শুনে একটু আফসোস হল, এমন রূপসী নদীটার আলোকোজ্জ¦ল রূপ বুঝি কখনো দেখা হবে না!
‘মগরা’ নাম নিয়ে তার সঙ্গে একটু মজা করার চেষ্টা করলাম। এ-শহরে কত কবি-সাহিত্যিক, নদীটার বিদঘুটে নামটা বদলে দিতে পারে না? আমার কথাটা তাঁর বোধহয় সম্মানে লাগল, তিনি তড়িঘড়ি করে বলে উঠলেন, ‘এখানে আরেকটি নদী আছে, সেটির নাম কিন্তু খুব সুন্দর, সোমেশ্বরী!’
প্রায় পৌঁছে গেছি। গাড়িটা বাড়ির কাছে ‘রামকৃষ্ণ মিশনে’র ভেতর রেখে পায়ে হেঁটে স্যারের বাড়িতে প্রবেশ করলাম।
বাড়ির নাম-‘বানপ্রস্থ’, যা আক্ষরিক অর্থে বনের ভেতর কয়েকটি ঘরসহ আশ্রমের আবহ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চারদিকে ঘন জঙ্গল। মধ্যখানে তিনটি ঘর। একটি স্যারের, একটি স্যারের অনুজ মতীন্দ্র সরকারের, তৃতীয়টি স্যারের ভগ্নীপতি উপেন্দ্র কুমার সরকারের।
রাজীব সরকারের কাছে জেনেছিলাম, কেন্দুয়ায় স্যারদের পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে তাঁরা একসময় ময়মনসিংহ শহরে বসবাস করতে থাকেন। ২০০৪ সালের দিকে ‘বানপ্রস্থে’র আরেক অংশীদার অধ্যাপক খগেশকিরণ তালুকদারের পরামর্শে নেত্রকোনার সাতপাইতে জমি কিনে এই বাড়ি করা হয়। মূলত যতীন স্যার এবং তাঁর ভাইবোনরা চেয়েছিলেন অবসরকালীন জীবনে তাঁরা তিন ভাইবোন একসঙ্গে থাকবেন। বাস্তবিকই জীবনসঙ্গীদের নিয়ে তাঁরা এখন এখানে একসঙ্গে বসবাস করছেন।
তীর্থস্থানে প্রবেশ করা গেল। দেখলাম দুটো কুকুর আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। একটু ভয় পেলাম। সারমেয় যুগলকে কতোটা বিশ্বাস করব রাজীব সরকারের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালাম। তিনি আশ্বস্ত করলেন।
ঘরের সামনে স্যারের একটি আবক্ষ মূর্তি লক্ষ করা গেল। নামফলক দেখে জানা হল, ভাস্কর অখিল পাল এটি নির্মাণ করে স্যারের ৮০তম জন্মদিনে উপহার দিয়েছিলেন।
ঘরটা যতীন সরকারের ঘর যেমন হবার কথা ছিল ঠিক তেমন। কোনো আড়ম্বর নেই, নেই আসবাবের বাড়াবাড়ি। বারান্দা পেরিয়ে প্রবেশ করলে ডানদিকে বসার ঘর আর বামে একটি শোবার ঘর। পরে দেখলাম শোবার ঘরটি সম্ভবত অতিথিদের জন্য বরাদ্দ। স্যার সস্ত্রীক ভেতরের আরেকটি কক্ষে বসবাস করেন।
নিজের কীর্তির চেয়েও যিনি মহৎ, আমাদের দেশের একজন শ্রেষ্ঠ মনীষী যতীন সরকার একসময় রুমে এলেন। যতীন সরকারের সঙ্গে দেখা হবে- বহুল কল্পিত দৃশ্যটি আর আমার কল্পনায় নেই, এটি এখন বাস্তব।
জরা শরীরকে স্পর্শ করেছে। স্যার আর্থ্রাইটিসের ব্যথায় ভুগছেন। চেয়ারে বসতে এত সময় লাগল! মুখোমুখি সোফায় বসলাম। ভেতরবাড়ি থেকে স্যারের সহধর্মিণী এলেন। তিনিও খুব অসুস্থ। স্যারের একমাত্র কন্যা সুদীপ্তা সরকার, তাঁর দুইপুত্র সাগ্নিক এবং ঋত্বিক বাবুর সঙ্গেও পরিচয় হল।
স্যার বললেন, ‘তুমি কষ্ট করে আইছ, বলো কী শুনতে চাও?’
কাঁচুমাচু করে বললাম, ‘স্যার আপনাকে দেখতে এসেছি। আপনার মত একজন মস্ত-পণ্ডিতকে নিজ চোখে দেখার স্বপ্ন সার্থক করতে এসেছি।’
এ-বেলা টুকিটাকি আলাপগুলো এমন ছিল-
‘আমি বুঝলা এমনেই কথা কই। তুমি কিছু মনে কইরো না।’
‘আপনি বলেন স্যার, আমি এদিকটার আটপৌরে ভাষা বুঝি। বলতেও পারি।’
‘অ। তোমার বাড়ি কই?’
‘ফেনী’।
স্যার হা হা করে হাসলেন, ‘তোমাদের ঐদিকের ভাষা তো কী কইতাম…’
আমি হেসে উঠলাম। ‘জ্বি স্যার, খুব নেকেড।’
আমার কথা শুনে স্যার অনেকক্ষণ ধরে হাসলেন। পাশে বসে রাজীব সরকার নোয়াখালী সম্পর্কে কী কী যেন বলছিলেন, অতটা খেয়াল করে উঠতে পারিনি। আমার সমস্ত মনোযোগ তখন স্যারের দিকে।
গল্প শুরু হল। স্যারের লেখা ইতিহাসের নতুন দিগন্ত উন্মোচনে অবদান রাখা ‘পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন’ ধরে আলোচনা করব বলে ভাবছিলাম। আলাপ ঐদিকেই গেল।
—
আরও ২ টি পর্বে চলবে…