মানুষের স্বভাব কেমন? // ফ্রান্সিস বেকন // অনুবাদ: মনজুরুল ইসলাম

স্বভাব প্রায়শই নিভৃতে অবস্থান করে; কখনো কখনো সেই স্বভাবকে উজ্জ্বল আলোর পাদপ্রদীপে নিয়ে আসা সম্ভব হলেও খুব কম সময়ই তা অবদমিত করা যায়। আবার যদি পেশীশক্তি প্রয়োগ করে অবদমনের চেষ্টা করা হয় তবে পরিণামে তা আরো অতি মাত্রায় দানবীয় মূর্তি ধারণ করে। মনীষীবার্তা এবং বাস্তবভিত্তিক সৎ পরামর্শ প্রদানের মাধ্যমে মানব মনে অন্তরিত নিরতিশয় জিদকে হ্রাস করা যায়; তবে ইতিবাচক চারিত্রিক বিশিষ্টতা শুধু বশীভূত করবার পাশাপাশি পুরোপুরি পরিবর্তন করতে পারে।

যে মনন আত্ম-স্বভাবের ওপর প্রভুত্ব বিরাজ করতে চায় সেই মননের অধিকারী ব্যক্তিকে কখনোই অতীব গুরুত্ববাহী অথবা অতিশয় ক্ষুদ্রতর কোনো কাজে ব্যাপৃত রাখা সমীচীন নয়, কেননা তিনি বৃহৎ কাজে ব্যর্থ হয়ে প্রবলভাবে ভেঙে পড়বেন এবং ক্ষুদ্র কাজে উত্তীর্ণ হলেও সেই উত্তীর্ণের গতিটি হবে খুবই মন্থর। এক্ষেত্রে শুরুতেই তাকে কারো সহযোগিতা নিয়ে অনুশীলন করবার সুযোগ দেয়া হবে অধিকতর বুদ্ধিদীপ্ত যেমন সাতারুরা সাঁতার শিখবার সময় ব্লাডার অথবা ভেলার সাহায্য গ্রহণ করে। তবে একটি নির্দিষ্ট সময়ে এসে তাকে অবশ্যই প্রতিকূল আবহের মাঝে অনুশীলনের সুযোগ করে দেয়া উচিত যেমনটি নৃত্যশিল্পীরা করেন, কষ্ট অনুভব করবার পরেও তারা ব্যবহার করেন পুরু আকারের জুতো।

স্বভাব যখন অতিমাত্রায় কঠোর রূপ পরিগ্রহ করে তখন তা নিয়ন্ত্রণে আনা কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। এই প্রেক্ষিতটিকে বিবেচনায় রেখে কীভাবে তা নিয়ন্ত্রণ করা যায় তার ওপর সর্বোচ্চ প্রাধান্য প্রদান করতে হবে (রেগে গেলে একজন মানুষ যেমন একটানা ২৪টি গ্রিক অক্ষর বলে)। খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে দেয়া স্বভাবকে নিয়ন্ত্রণের অন্যতম পূর্বশর্ত হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। মদ্যপায়ীরা যেমন পুরোপুরি মদ্য গ্রহণ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখবার পূর্বে ধীরে ধীরে তা ছাড়ার অভ্যেস করে থাকেন। তবে যদি কোনো ব্যক্তি বীরত্বপূর্ণ সহিষ্ণুতা অর্জন করবার মাধ্যমে ত্যাগের সংকল্প অন্তরে ধারণ করে তবে সেটিই হবে সর্বাধিক উত্তম। যদি প্রশ্ন উত্থিত হয় কার আত্মা পুরোপুরি মুক্ত, তবে বলতে হবে তিনিই, যিনি তার হৃদয়ে স্থিত তিক্ততাটুকুকে নির্মুল করবার জন্যে সকল শৃঙ্খলকে ভেঙে ফেলতে পারেন।

আবার স্বভাবকে বশীভূত করবার জন্য প্রাচীন নিয়ম যে গলদযুক্ত সেটি কিন্তু একেবারেই সত্যি নয়। বরং এই একঘেয়েমি স্বভাবকেই বশীভূত করবার জন্যই অতীতে বেত্রাঘাত প্রথা চালু ছিল এবং তা করা হয়েছিল অনেকটা জেনে শুনেই। চিরস্থায়ী ধারাবাহিকতা নিয়ে স্বভাব কখনো মানুষের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে না, করতে পারে না। তবে নিয়মিত বিরতিতে চাপ প্রদান করে থাকে। এবং যদি কোনো মানুষ প্রচেষ্টার মাধ্যমে সফলতা অর্জনে ব্যর্থ হন তবে তিনি তার সামর্থ্য অনুযায়ী ভুলগুলিই অনুশীলন করে যান। এক্ষেত্রে তাকে যদি নিয়মিত বিরতিতে প্রেষণা প্রদানের মাধ্যমে সেই অনুশীলন হতে বিরত না রাখা যায় তবে তার উগ্র স্বভাবকে কোনোভাবেই দমন করা সম্ভব হয় না।

কিন্তু একজন মানুষ যে তার স্বভাবের ওপর প্রভুত্ব বিস্তার করতে পারে- সেই ধারণায় তাকে আস্থা স্থাপন করতে দেয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বস্তুত স্বভাব বেশিরভাগ সময়ই অন্তরায়িত থাকে। লালসা কিংবা বিশেষ বিশেষ মুহূর্ত সেটিকে আবার অন্তরের ভেতরের রক্ষিত সুপ্তাবস্থা থেকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলে ঠিক যেন ঈশপের গল্পের সেই বালিকাটির মতো, যে কিনা ইঁদুর থেকে নারীতে রূপান্তরিত হয়েছিল। এবং আশ্চর্যজনকভাবেই সুযোগ বুঝেই টেবিলের ওপর উন্মুখ হয়ে বসে থাকতো, আর যদি তার সামন দিয়ে ইঁদুর যেত, মুহূর্তেই সেটিকে খপ করে ধরে ফেলতো। সুতরাং, ব্যক্তিকে হয় নেতিবাচক পরিস্থিতিকে এড়িয়ে চলতে হবে নয়তো সেই পরিস্থিতিতে বারবার পড়তে হবে যাতে তা ক্রমান্বয়িকভাবে তার কাছে স্বাভাবিক বলে প্রতীয়মান হবে।

একজন মানুষের প্রকৃত স্বভাব উপলব্ধি করা যায় বন্ধুসঙ্গের মাধ্যমে। কেননা বন্ধুরা যখন একত্রিত হয় তখন তাদের কথোপকথনে কোনো ধরনের ভন্ডামী খুঁজে পাওয়া যায় না। বন্ধুরা সহজেই আবেগের সর্বোচ্চ মাত্রায় উত্তরিত হতে পারে যেহেতু সত্য বিষয়গুলি আপনাআপনি তাদের কথোপকথনে প্রতিফলিত হয়। এবং এ ধরনের পরিবেশে রীতি, নীতি, বিশ্বাস সবকিছুই বিতর্কের উর্ধ্বে অবস্থান করে।

তারাই প্রকৃত অর্থে হৃদয়ে প্রসন্নতা ধারণ করতে পারে যারা নিজ পেশার সাথে সহজেই নিজেদের মানিয়ে নিতে পারেন। বিপরীত অবস্থা হলে তারা সবসময়ই স্ব-বিরোধী আচরণের প্রেক্ষিতটিকে স্বীকার করেন। মুক্তি পেতে যখন তারা সে বিষয়ে আলোচনা করেন তখন তাদের ওপর তা কোনো প্রভাবই ফেলতে পারে না।

অধ্যয়নের ক্ষেত্রে যদি কোনো বিষয় কারো কাছে ভালোলাগার উদ্রেক না ঘটাতে পারে তবে সেটি আত্মস্থ করবার ক্ষেত্রে সেই ব্যক্তিকে দীর্ঘ সময় ধরে পরিশ্রম করে যেতে হয়। কিন্তু বিষয়টি যদি তার কাছে ভালো লাগে তবে স্বল্প সময়েই সেটিকে তিনি হৃদয়াঙ্গম করে নিতে সক্ষম হন। যেহেতু সেই বিষয়ের প্রতি তিনি তার গভীর মনোনিবেশটিকে কেন্দ্রীভূত করতে পারেন।

প্রকৃত অর্থে, একজন মানুষের স্বভাব সাধারণত ধাবিত হয়, হয় বনজলতার দিকে অথবা আগাছার দিকে। এজন্য সঠিক সময়ে বৃক্ষের গোড়াটিকে জল সিঞ্চনের মাধ্যমে সিক্ত করতে হবে নতুবা আগাছাগুলিকে কেটে নির্মূল করতে হবে।

(প্রবন্ধটি ফ্রান্সিস বেকনের ইংরেজি ‘অব ন্যাচার ইন ম্যান’ প্রবন্ধ থেকে অনূদিত।)

[বিচিত্র অভিজ্ঞতার অধিকারী ফ্রান্সিস বেকনের (১৫৬১-১৬২৬) চিন্তা এখনও প্রাসংগিক। রাজনীতি, দর্শন ও মানব মনে প্রোথিত নানা জিজ্ঞাসার সমাধানে আজো দারস্থ হতে হয় বেকনের। ইউরোপে আধুনিক চিন্তাচেতনা বিকাশে পথিকৃতদের মধ্যে অন্যতম তিনি। চিকিৎসা ও বিজ্ঞান শাস্ত্রের সীমাবদ্ধ ধারণার বিপক্ষে তার তীব্র কণ্ঠস্বর আমাদের জোগায় প্রাণিত হবার অসীম শক্তি। রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে শুধু লেখক হিসেবেই জীবন অতিবাহিত করলে তার লেখার প্রাচীর কত উঁচু হতো সেটি অনুমান করা মুশকিল। তবে দীর্ঘ এই অভিজ্ঞতা এবং ব্যক্তি জীবনের অনুসন্ধিৎসা থেকে তিনি যা সৃজন করেছেন, সন্দেহাতীতভাবেই তা সর্বশ্রেণীর মানুষের জন্য হয়ে আছে; জীবনের সত্য অণ্বেষণে এক অনবদ্য মহার্ঘ্য হিসেবে। অলংকার ও উপমার নিখুঁত ব্যবহার এবং জটিলতাযুক্ত দীর্ঘ বাক্যের পরিবর্তে সরল বাক্যে পাঠকের মননে গভীর প্রভাব সৃষ্টির ক্ষমতা শুধু তাকে জ্যাকবীয় যুগের শ্রেষ্ঠ প্রাবন্ধিক হিসেবে গড়ে তোলেনি, বরং বর্তমানেও তার প্রাসঙ্গিকতাকে নিশ্চিত করেছে দৃঢ়ভাবে।]

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ভাষা
Scroll to Top