: গ্রেগর সামসা কে?
: একজন বিক্রয় প্রতিনিধি। যে ঘুম থেকে ওঠে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত খাটে।
: আপনি প্রায় সময় তার কথা বলেন কেন?
: সে একদিন মাকড়সায় পরিণত হয়; আমরাও সেইদিকে হাঁটছি। পুঁজির চাপে মানুষের ছ্যাড়াবেড়া অবস্থা। চাকরি হারানোর পর পরিবারের সদস্যরা সামসাকে ভালোভাবে নিতে পারেনি। যন্ত্রসভ্যতার বিষ ইউরোপ – পৃথিবীময় ফেরি করছে।
: যার যা আছে সে তো সেটাই দেবে নাকি!
: আসলেই তো তালগাছে ডাব পাব কীভাবে?
: ভাই আপনার কথা কেমন ঘোলা ঘোলা লাগতাছে।
: সভ্যতায় ইউরোপের অবদান দুই দুইটা বিশ্বযুদ্ধ।
: আপনি কাকে বিশ্বাস করবেন-যে হৃদয়ের কারবারি তাকে—না যে মন্ত্রকে যন্ত্র বানিয়েছে?
: চারদিক ক্লোন মানুষে ভরে যাচ্ছে। এত এত মানুষ কয়জনকে চিনি?
: চিনার দরকারটাই বা কী?
: অবশ্য না চিনলেও হয়।
: টেলিভিশন আসলো, সারা গ্রামের মানুষ এক উঠানে বইসা ভিভি দেখত। ‘বেদের মেয়ে জোসনা’র সময় সেই কী অবস্থা। ভিসিআর লাগাইয়া গ্রামের পর গ্রাম উৎসব হইছে।
: বেশি দিন আগের কথা না।
: ৩২/৩৩ বছর হইয়া গেছে।
: তুমি এসএসসি পাস করছ ’১৯-এ, আমি ’০২-এ। এই ১৭ বছরে কত কিছু বদলাইয়া গেছে?
: বদলানোই জগতের নিয়ম।
: ইংরেজরা ভারতে জনসেবার জন্য আসে নাই। এই চায়ের কথাই ধরো। বাঙালি তো চা খাইত না। তার ছিল গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ, গোলা ভরা ধান। তাকে বাধ্য করা হলো নীল চাষ করতে। জমিও মরল মানুষও মরল। চাল গম সব সেনাবাহিনীর জন্য রাইখা দুর্ভিক্ষ লাগাইল। ’৪৭-এর পর শারীরিক উপনিবেশ বিদায় হইছে। মানসিক উপনিবেশ রক্ত থাইকা বিদায় না করলে মুক্তি না।
: ভাই এই বিষয়টা বুঝলাম না।
: আরে মিয়া-মানুষ হইল মন আর মাংসের যোগফল। যৌথ দেহ, যৌথ মন চিন্তা করো।
: মানে?
: ফেসবুক ব্যবহার করে তোমার কয় টাকা আয় হইছে?
: আয় হইব কোথ থাইক্কা আমার যায় আর যায়।
: আমি পড়াশোনা করছি গ্রামে। স্কুলের বেতন ছিল ২০ টাকা। এর মধ্যে দরখাস্ত কইরা ৮ টাকা কমাইয়া ফেলতাম। অঙ্ক ইংরেজি প্রাইভেট পড়ছি ১০০ টাকা কইরা। বাবা-মা’র সঙ্গে যোগাযোগ হইত চিঠিতে। কোন্ মাসে ৪টা চিঠি লেখছি বইলা মনে পড়ে না। কুশল বিনিময় খরচ মাসে সর্বোচ্চ ১০ টাকা। তোমার গার্ল ফ্রেন্ড আছে?
: আছে।
: মোবাইল খরচ তোমারটা বলা লাগব না। আমারটা শোন। এমনও হইছে প্রচণ্ড ক্ষুধা। পকেটে আছে ১০ টাকা। ২টা সিঙ্গারা ইচ্ছে করলেই খাওয়া যায়। খাইতাম না। মোবাইলে টাকা পুরাইতাম। কথা হইল মোবাইল কোম্পানি কয়টা দেশি?
: এত দেশি দেশি কইরা কী করবেন। দেশি বড়লোক হগলেই তো বিদেশে বাড়ি বানাইয়া রাখছে। তাদের আছে বেগমপাড়া। পাদ দিলেও নিজের ফাইভ স্টার হোটেল ফালাইয়া বিদেশ যায়।
: বাতাস (তরঙ্গ) বিক্রি কইরা বিদিশিরা টাকা নিয়া যাইতাছে?
: অর্থনীতি টিকাইয়া রাখছে তিন জিনিস-গার্মেন্টস শ্রমিক, প্রবাসী আর কৃষক। এই তিন জনের কোন দাম নাই। আবার তিনটা জিনিসই অনিশ্চিত।
: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পুঁজিবাদ বিপণন আর গণতন্ত্র লইয়া নামছে। দেখ তার স্বাধীনতার বয়স ২৪০ বছরের ওপরে। তারা পৃথিবীর সিংহভাগ সম্পদের মালিক। তার সুসংহত গণতন্ত্রের বিপরীতে আমাদের গণতন্ত্র কতটুকু টেকসই? আচ্ছা আমেরিকায় কি পাগল আর অধ্যাপকের ভোটের মূল্য সমান? তাদের হইছে নগরভিত্তিক রাষ্ট্র। আমাদের সমাজভিত্তিক রাষ্ট্র। শোন আজকে কথা বেশি কইতাছি। এই যে গ্রাম। গ্রাম কি আর আগের মতো আছে। এক পুকুরে সবাই গোসল করতাম। অহন বাড়িতে গিয়া দেখবা—পুকুরে গোসল করা যায় না। মাছ চাষের জন্য পুকুরের পানিতে পচা গন্ধ, হরমোন ইনজেকশন দিয়া নাকি মাছেরও ওজন বাড়ায়। সাবমার্সিবল লাগাইয়া ঘরের ভেতরে হাগাখানা, গোসলখানা—আরাম হইছে ঠিক। ব্যারামটা কেউ চোখে দেখে না।
: আইসোলেশন মানুষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
: বুঝ না কেন—লাভটা কার? ঘরে মোটর লাগাইলে, একজনের ২টা করে মোবাইল হাতে থাকলে, পশ্চিমা সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হইলে তারা আমাদেরকে চুদির ভাই বলব। আর আমরা আনন্দে বাক-বাকুম করব।
: ওই যে গ্রেগর সামসা—
: পরিণতি এক মাকরসা পৃথিবী। দাঁড়াও আমার এক ডাক্তার বন্ধু আছে। ওরে একটা ফোন দেই। রিং হচ্ছে—ধরছে না।
: আবার কল দেন।
: আজ ওর জন্মদিন। একজন ডাক্তার বন্ধু থাকলে বিপদে-আপদে সুবিধা হয়। ওরে যে কত জ্বালাতন করি। ও কিন্তু খুব পড়ুয়া। এই যে তোমার লগে তর্কফর্ক করতাছি, পশ্চিমাদের বদমাইশির খতিয়ান সে আমারে দিনের পর দিন বুঝাইছে। ছাত্র জীবনে বাম আন্দোলন করছে। আমি করছি ডান। সব শেয়ালের এক রা। রাজনীতি হইল উর্বর মস্তিষ্কের খেলা। এখন উর্বর কারা? ও ফোন দিছে। [দোস্ত তুমি কই? আবার কই বারডেমে। পয়দা দিবসের শুভেচ্ছা। সব সময় তো ভাবির কাছেই থাকো। আসো আজকে আমরা হারাইয়া যাই। আর কইও না, কিছুই ভালো লাগে না। আমরা সবাই মাকরসা হইয়া যাইতাছি। তুমি হইলা সামসার খালাতো ভাই। পাবলিক লাইব্রেরির সামনে বইসা রইছি তুই আয়। আচ্ছা দেখি কী করা যায়। আরে মিয়া কোন্ দেখাদেখি নাই। আজকে কিন্তু পূর্ণিমা।]
: আসবেন উনি?
: আসবে। নিশান, ১৮/১৯ বয়সে তুমি যেই বোধের কাছে পৌঁছাইছ। তোমারে কিছু বলার নাই। তোমার সাথে কথা বলা মানে নিজের সাথেই কথা বলা। আমার বন্ধু আসুক তুমি মজা পাইবা। তোমার কথা বলো—
: কি আর বলব, আপনাকে তো আগেই বলেছি, আমার কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে হইনি। ভেবেছিলাম চারুকলাতে হবে সেখানেও না।
: প্রতিষ্ঠান কি করো জান? আমাদেরকে ছেঁটে দেয়। প্রতিষ্ঠানে কে বেশি লাভবান হয়? প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা একটা এভারেজ পিপল তৈরি করে। সেই প্রকল্পে প্রতিভাবানরা কাট খায়। একেবারে লো প্রতিভার ছেলেটা এভারেজ মান অর্জন করে টাকা কামাইয়ের মেশিন হয়ে যায়। তার প্রকৃত অর্থে কোন শিক্ষা কিংবা সংস্কৃতি গড়ে ওঠে না। ঝিনুকের ক্যান্সারের নাম কিন্তু মুক্তা। সত্যি বলতে কী তুমি আমি হচ্ছি—পড়া মুখস্থ করতে না-পারা শিক্ষাব্যবস্থার ডিজঅর্ডার। সংখ্যায় আমরা ১% কিংবা তারও কম। সমাজ আমাদের দায়িত্ব নেবে না। পরিবার নেবে না।
: একদম তাই। আমাদের কী করা?
: সেটাই ভেবে ভেবে মরে যাব। হা হা হা…
[ফোনের রি টোন… তুই কই? আসবি না। আরে ব্যাটা পাবলিক লাইব্রেরির সিঁড়িতে বইসা আছি। মুক্তাদির, পলাশ আর নিশানের সঙ্গে যোগ দেয়]
: দোস্ত, এতক্ষণ পশ্চিমাদের বকে তুষ কইরা ফেলছি। আবার তোকে ওদের সংস্কৃতির আত্মীকরণ-জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাইছি।
মুক্তাদির : বিষের মধ্যেও কল্যাণ আছে যদি তুমি নিতে পার। তোমার কথা পলাশের কাছে অনেক শুনেছি (নিশানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে)। ভালোই হলো আজকে তোমার সঙ্গে দেখা হলো—
নিশান : আপনাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
মুক্তাদির : ধন্যবাদ তোমাকে।
পলাশ : দোস্ত, অনেক দিন পর তোমারে কাছে পাইছি। আজকে আমরা পাগল হয়ে যাব। সকাল পর্যন্ত সীমাহীন পাগলামি করব। রাতে বাসায় যাব না। চল সবার আগে মোবাইলটা বন্ধ করি।
মুক্তাদির : ধুর কী কস।
পলাশ : আরে ব্যাটা বউতো আমারও আছে। ধর আজকে যদি মইরা যাই। তাদের কি চলব না!
মুক্তাদির : তা চলব। তাইলে বলতাছত ২৪ ঘণ্টার জন্য নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন কইরা দিতে?
[তিনটি মোবাইল একসঙ্গে বন্ধ হয়]
পলাশ বলে, আগে চলো জগন্নাথ হলে যাই। রাতের খাবার খেয়ে পুকুরপাড়ে বসে থাকব কিছুক্ষণ। চাঁদ তো না যেন প্রেমিকা। হলের পুকুরে শাপলা ফুটে আছে। কার্তিকের মাঝামাঝি তাই একটু শীত শীত লাগছে। জায়গাটা খোলা এজন্যও হয়তো। তাকিয়ে আছি এক নাগাড়ে চাঁদের বুড়ির দিকে।
সম্মানিত পাঠক চাঁদ সম্পর্কে লিখার জন্য একটা শূন্যস্থান
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
মুক্তাদির : দোস্ত, ফোন যে বন্ধ করলাম, এটা ঠিক হলো। ব্যাটা আমাকে কত জনে ফোন দেবে?
পলাশ : আরে একটা মাত্র রাত।
মুক্তাদির : আচ্ছা ঠিক আছে। ইলিয়াসকে একটা ফোন দিয়ে ফোনটা বন্ধ করে দেব।
পলাশ : ও কি তোকে কিছু খাওয়াবে বলছে?
মুক্তাদির : নতুন একটা মাল আনছে বলল-শুধু আমার জন্য। দামি জিনিস। যাবি নাকি-
পলাশ : নিশান তোমার সাথে তো অনেক লেকচার মারছি। আমি আসলে একটা হারামি। চল রাতের স্টেশন দেখতে কমলাপুরে যাই।
[আমরা একটা সিএনজিতে কমলাপুর আসি। পরিত্যক্ত ওয়াগন। বস্তাবন্দি মানুষের মুখ দেখতে দেখতে প্ল্যাটফর্মে হাঁটাহাঁটি। অন্ধকারে আলোর ঝিলিকের মতো মানুষের মুখ দেখা যায়।]
মুক্তাদির বলল, ইলিয়াসকে একটা ফোন দিতে হবে-
পলাশ বলল, আমিও এর আগে একবার ইলিয়াসের ওখানে গিয়েছি। লোকটা দিল দরিয়া। পাগলা আছে। বন্ধুদের মাগনা মদ খাইয়ে মজা পায়। নিশান আজকে তুমি পাগলের পাল্লায় পড়ছ। তুমি এখন যেতেও পারবে না। রাত একটা বাজে।
পলাশ : কিরে ইলিয়াস এলো-
মুক্তাদির : তুই তো মাল খাওয়ার আগেই মাতলামি শুরু করছিস।
ইলিয়াস আসে। সে যেন আমাদের গাইড, ফিলোসফারও। ভালোমন্দ পর্বের পর নিজে থেকেই বলতে শুরু করেছে-মুক্তাদির জানেন, রেলস্টেশন নগরের মধ্যে আরেক নগর; আপনি তাকে জাদুঘরও বলতে পারেন। জন্মদিন বয় মুক্তাদিরকে ইলিয়াস বলে এই স্টেশনটা ক্রাইমের আখড়াও। আমি এমন একজনকে জানি সে ১৭টা খুনের আসামি। একটা পরিত্যক্ত ওয়াগন দেখিয়ে বলল, সে ওখানে থাকত। কথাটা সে এমনভাবে বলল যেন সেখানে একটা বাঘ থাকত। তারপর বলে, চলেন আমার আখড়ায়। রেলস্টেশনের পাশেই তার অফিস।
ইলিয়াসের অফিস পাঁচ তলায়। দারোোয়ান কিছুতেই গেট খুলবে না। বলল : স্যার আমাকে মাফ করবেন। রাতের বেলা অফিস খোলার কোনো অনুমতি নাই। ইলিয়াস বলে শান্তির ছেলে (খানকির ছেলের ইলিয়াসীয় প্রমিত রূপ শান্তির ছেলে) এইটা আমার অফিস, ১৭ বছর ধরে এখানে বসি। সকালে ময়ময়সিংহ যাব ৮টায় ট্রেন। একটা জরুরি কাগজ ফেলে গেছি; তার জন্য আসলাম। ইলিয়াস এদিক সেদিন ফোন দেয় কোনোভাবেই দারোয়ানকে বুঝিয়ে ভিতরে যেতে পারে না। আমাদের সামনে তার ইজ্জতের পাংচার। ইলিয়াসের অস্থিরতা দেখে দারোয়ান বলল, আচ্ছা ঠিক আছে-ফজরের আজানের পরে আসেন। আমরা আজানের অপেক্ষা করতে থাকি। মুক্তাদির ইলিয়াসকে বলে, ধুর মিয়া আপনি ওর সঙ্গে এত খারাপ ব্যবহার না-করলেও পারতেন। আপনি কি দেখেছেন খারাপ ব্যবহার। পিস্তলটা বাসায় রাইখা আসছি। ওটা থাকলে তো শান্তির ছেলেক গুলি করতাম। মাল আজকে কয় প্যাক খাইছেন? বেশি না, ১১টার দিকে দুই প্যাক মারছি। ওতে আমার কিছু হয় না। ভাবছি আপনারা আসলে একটু নেশা-টেসা করব। ওই শালা তো ভিতরে ঢুকতেই দিচ্ছে না। ওই গুলোরে আপনি চিনেন না। সব কয়টা বদমাশ। ৫০০ টাকা দিলেই দেখতেন। ২ ঘণ্টা পর আজান তরঙ্গায়িত হলে আমরা ইলিয়াসের অফিসে ঢুকি। ওর অফিসটা বেশ সাজানো। আর যেন তর সইছিল না। বিদেশি হুইস্কির বোতলে-অ্যাপেলের জুস মেশানো হলো। মাংস আর সালাদ আগে থেকেই রেডি ছিল। শুধু ফ্রিজ থেকে নামানো হয়েছে। মিক্স বাদামের প্যাকেট খোলা হয়। ইলিয়াস বলল, ১০টার দিকে বাসায় যাই। খাওয়া দাওয়া করি, আপনাদের ভাবি কিছুতেই বের হতে দেবে না। বললাম, ডাক্তারের জন্মদিন একটু দেখা করে আসি। এই কথা বলে ঘর থেকে বের হয়ে আসলাম। বাইরে এসে মোবাইল বন্ধ করে দিছি। সকালে ময়মনসিংহে যাব। ৪টা খালি গ্লাস। নিশান বলল, আমার জন্য ঢালতে হবে না।
অন্ধকার কেঁটে যাচ্ছে, এই তিন জনের মাতলামি বাড়ছে। পলাশ বলল, মানুষ যাচ্ছে নামাজে আর আমরা মদের গ্লাস নিয়ে বসেছি। পাঁচতলা থেকে প্রাক্তন পূর্ণিমার চাঁদটাকে ১০০০ টাকার নোটে জলছাপের মতো লাগছে। মদের আসরে যতটা না নেশা তার থেকে আড্ডাটা বেশ উপভোগ্য। নিশান যেন একটা ফ্রেমে বাস্তব চলচ্চিত্র দৃশ্য দেখছে। আর মাঝে মধ্যে পলাশের সঙ্গে হু হা করছে। এর মধ্যে মুক্তাদির বলল, এই চপ চপ আজকে আমি একটা গল্প বলব। ইলিয়াস কথা বলতে চাইছিল। পলাশ বলল, এই ইলিয়াস চপ চপ শুধু মুক্তাদির বলবে আর কেউ না।
মু : আচ্ছা যা আছে দেহ ভাণ্ডে, তা আছে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে—বলো তো দেহ চালায় কে?
ই : মাথা।
মু : ঠিক ঠিক। এবার বলো? দেশের মাথা কে?
প : জনগণ।
মু : তুমি আমার বালডা জান। আরে বোকাচুদা এইটা বুঝস না? তার আগে বল? সাহস কোথায় থাকে?
প : এই কথা তো সবাই জানে বুকে।
ইলিয়াস মদের গ্লাস হাতে নিয়ে কোমর নাচিয়ে বলে, ঠিক ঠিক ঠিক।
মু : চপ চপ চপ। একটা সময় রাষ্ট্র চালাইত জ্ঞানীরা। সাহস অর্থাৎ ক্ষয়িত্ররা যখন শক্তিশালী হয়ে গেল। তখন জ্ঞানীর সাথে তার বাধল। পরে জ্ঞান আর সাহস মিলে গেল।
ই : ঠিক ঠিক ঠিক।
প : আরে বোকাচুদা পুরা কথা শুইনা নে।
ই : পেটে যদি খাবার না থাকে, সাহস আর জ্ঞান কোথ থাইকা আইব?
মু : পেট হইছে ব্যবসায়ীদের মতো। তাকে কোথ থাইকা খাবার সংগ্রহ কইরা দিছো। বুঝার দরকার নাই।
ই : পেটে খাবার দিবা তো সাহস আর জ্ঞান বাইচা থাকবো। তাই তো!
মু : তো কথা হইলো? এই পেট যদি মাথাকে চালায় তাহলে কি হবে? না জ্ঞানের সমৃদ্ধি হবে? না সাহসের বিস্তার হবে? পা তো শ্রমিক। শুধুমাত্র আদেশের অপেক্ষায় থাকে। কখনো জ্ঞানের আদেশ, কখনো সাহসের আদেশ, কখনো ব্যবসায়ীর আদেশ?
প : এখন কথা হইল, পেটের তো আর্দশ নাই। কেয়ামতের ৫মিনিট আগেও সে ব্যবসা করবে। তার একটাই ধর্ম বাপ ছেলে তার কাছে খদ্দের।
মু : পেট যদি মাথা চালায় দেহের অবস্থা কি বুঝ?
ই : পেট যদি রাজধানী হয়। মাথা আর হৃদয়ের বেইল নাই।
প : ব্যবসায়ীদের সুতোয় পৃথিবী বন্দি। তাদের হাত থাইকা ছাড়া না পাইলে মুক্তি নাই। নিশান তোমারে বলছিলাম না?
মু : ব্যবসায়ীরাই দেশে দেশে সরকার গঠন করে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণায় অর্থায়ন করে…
ই : ওই মিয়া আমার ট্রেন তো আটটায়।
মু : আপনাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে আমরা বাসায় যাবো।
ইলিয়াসকে ট্রেনে তুলে দিয়ে মুক্তাদির বলল, এয়ারপোর্ট স্টেশনে নামব। সারারাত নির্ঘুম। কখন যে ঘুমিয়ে পড়ি বলতে পারব না। শুধু জয়দেবপুর মনে আছে। ঘুম ভাঙতেই দেখি ময়ময়সিংহ। মুক্তাদির বলল, আচ্ছা ইলিয়াস আপনি মিটিং সারেন। আমরা কয়েক ঘণ্টা নিজেদের মতো ঘোরাফেরা করি। মিটিং শেষ করে ফোন দিয়েন।
কী আর করা। প্রচণ্ড ক্ষুধা নিয়ে আমরা সালাদিয়া টাইপ একটা ভাতের হোটেলে ঢুকি। বললাম কী আছে? লোকটা বলল, সরষে ইলিস। গরম ভাতের সঙ্গে সরষে ইলিশ এর থেকে ভালো অমৃত আর কী হতে পারে। আমরা তিনজন গোগ্রাসে গিললাম। পেট শান্তি তো সব শান্তি। তারপর তিনটা গামছা কিনি। ব্রহ্মপুত্রের দিকে রওনা হই। তীরে কাপড় খুলে গামছা পরি। কত দিন নদে গোসল করি না। আমরা তিনজন ডুব দিলাম, সাঁতরালাম, চিল্লালাম। একেই যেন বলে আনন্দে ভেসে যাওয়া। তীরে এসে কাপড় পরে ভেজা গামছা মাথায় বেঁধে রাখি। মুক্তাদির বলল, চল। ময়ময়সিংহ যখন এসেছি মুক্তাগাছার মণ্ডা খেয়ে যাই।
জমিদারের পরিত্যক্ত বিশাল বাড়িতে মুক্তাগাছার মণ্ডা খেয়ে খাঁ খাঁ দুপুরে আমরা ভেতর ঢুকি। পলাশ একটা কামরা দেখিয়ে বলল, ওটা বোধহয় জমিদারের বাইজিখানা। কে যেন বলছিল, ভাই দুপুর বেলা ওইখানে যাইয়েন না। আমরা কী আর সে কথা শোনি। তিনজন জমিদারের বাড়িটা ঘোরে ঘোরে দেখি। আপনা থেকেই মনের ভিতরে জমিদারের শান-শওকতের একটা চিত্র ফুটে ওঠে। বারবার চোখ যাচ্ছিল বাইজি ঘরে। আর পারছিলাম, না। ক্লান্তিতে গা এলিয়ে মেঝেতে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। কার্তিকের রোদটা ইচ্ছা ইচ্ছা লাগছিল। কখন যে ঘুমের ঘোরে হারিয়ে যাই। নূপুরের নিক্কন, বঙ্কিম কোমরে আলম্বিত বেণির দুলুনি জাগিয়ে কে যেন চোখের সামনে—রিনিরিনি ঝিনিঝিনি তালে রূপ ঐশ্বর্যের আনন্দ ঢেলে দিচ্ছিল। এ আমি কোথায়? এ কী স্বপ্ন না ঘোর। নাকি সুড়ঙ্গ পথে নিষিদ্ধ দেশে চলে এসেছি। আমি যেন রূপের ঝলকানিতে অবশ হয়ে গেছি। হাতড়াতে থাকি। একটা চিৎকার দেবার পর সংবিৎ ফিরে পাই। দেয়ালে বসে থাকা জালালি কবুতরগুলো উড়ে যায়। নিশান বলে ওঠে ভাই, আপনার কী হইছে? মুক্তাদির ভয়ার্তমুখে আমার দিকে তাকায়। কাউকেই কিছু বলতে পারি না।