ওর তো বুক নেই। রায়হান রাব্বী’র গলায় বিরক্তি। গুড়োদুধের বিজ্ঞাপনে এ্যাপেরিয়েন্স একটা বড় বিষয়, এটাও আমাকে বলে দিতে হবে!
লিয়াজো অফিসার তমাল হকচকিয়ে উঠল, স্যার ঐ মেয়ে তো বিজ্ঞাপনে কণ্ঠ দেবে। আপনি আজ রাতের মধ্যে নির্বাচিত কিছু ছবি পেয়ে যাবেন।
বেশ তো, তাকে এখানে বসিয়ে রেখেছ কেন?
পেমেন্ট নিয়ে কথা বলার জন্য।
ওহ্, আর কোন উত্তরের অপেক্ষা না করে- হে হে করে হেসে ওঠে রায়হান, তাহলে আমার হোয়াটস এ্যাপে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত মডেলদের ছবি পাঠিয়ে দিও। মনে রাখবে এবারের ইনভেস্টমেন্ট শুধু বিজ্ঞাপন নয়। পোর্টে ফলস ডিক্লেয়ারেশন দিয়ে কয়েক কন্টেইনার গুড়ো দুধ আসছে। শুনলাম বড় কর্তার নারীদের প্রতি ছুকছুকানি প্রবল। আমাদের মালামাল ছুটাতে ঐ নারী হবে ট্রাম কার্ড। বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি আরো কিছু সার্ভিস এ্যানশিওর করতে হবে। চাই সফট ব্লেন্ডিং, বিজ্ঞাপন করবে কিন্তু তার অজান্তেই সে আমাদের প্রোডাক্ট হয়ে যাবে। মোটা অংকের সেল ভ্যালু দেব। যদি এক কোটি ইনভেস্ট করে পাঁচ কোটি আসে ক্ষতি কি। ভালো করে পাত্তা লাগাও।
আলাপ শুনে পাশের রুমে বসা পর্শি’র কান গরম হয়ে উঠল। কি করবে সে। বুক নেই, কথাটা শুনেই গা তার গোলাচ্ছে। এক নজরেই লোকটা তাকে মাপছিল তাহলে। এমন ভদ্র চেহারার লোক এই ভাষায় কথা বলে। পর্শি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। পাশের ওয়েটিং রুম থেকে হনহন করে বের হয়ে এল বাইরে। রাগে গলা শুষ্ক হয়ে এসেছে, ব্যাগ থেকে এক বোতল পানি আগুন নেভানোর মতো গলার অভ্যন্তরে ডকডক করে গলিয়ে দিল। এরমধ্যে লিয়াজো অফিসারের ফোন। ম্যাডাম আপনাকে দেখছি না, কোথায় আপনি?
আমি চলে এসেছি। আগ্নেয়গিরির মতো টগবগ করে কণ্ঠ ফুঁসছিল পর্শি’র। বেশ ঝাঁজাল। আপনারা অন্য কাউকে খুঁজে নিন। আপনাদের বিজ্ঞাপনের আড়ালে বিশ্রী প্ল্যানগুলো আমি টুসিকে বলে দেব। কথাটা বলতে পেরে পর্শি একটু হাল্কা হল। টুসি হল পর্শির বন্ধু। ওর রেফারেন্সে এখানে আসা। হ্যাঁ, টুসির পেছনে ওরা লগ্নি করেছে। পর্শি শুনেছে, টুসি গুড়ো দুধের একজন অন্যতম ব্যান্ড এম্বাসেডর। পর্শি রাতে টুসিকে ফোন করল। কয়েকবার রিং হল কিন্তু টুসি ধরল না। ঘণ্টাখানেক পর টুসি কল ব্যাক করল। কি রে ফোন দিয়েছিলি?
পর্শি উদ্বিগ্ন কণ্ঠে, তোর সাথে জরুরী কথা আছে।
ততোধিক শান্ত গলায় টুসি, হুম আমি জানি।
কি জানিস?
তোর গতকালের ঘটনা। শোন সোশাল মিডিয়ায় কিছু লিখতে যাস নে। আমি তোর সাথে দেখা করব। আমি বাইরে আছি, ফিরে বিস্তারিত আলাপ হবে। শুধু বলছি, ইগনোর দিস ইস্যু। তা না হলে তোর বিপদ হবে।
এরপর দীর্ঘ সময় টুসি’র ফোন নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। পর্শি বহুবার ট্রাই করেছে কোন লাভ হয়নি।
প্রায় চার মাস পর টুসি’র ফোন। সব কিছুর জন্য আমি সরি। তুই একটু আসতে পারবি।
কেন?
কথা ছিল। একটা স্কুটার নিয়ে চলে আয়।
কোথায় আসবো?
ধানমণ্ডি সাতাশ। রাপা প্লাজার কাছে এসে ফোন দিস। পাশে-ই মাইডাস সেন্টারে নারী উদ্যোক্তাদের একটা মেলা হচ্ছে। আমি ওখানে আছি। ভিড়ভাট্টায় খুঁজে পেতে তোর দেরি হবে, বরং আমি-ই নেমে আসবো।
আজ বিকেলটা বড্ড মলিন। আবহাওয়া রুক্ষ। হাওয়া বাতাস নেই। পর্শি রিক্সা করে সাতাশ নম্বরের মাথায় এসে নামল। ফোন পাওয়া মাত্র পাঁচ মিনিটে টুসি হাজির। ওরা দু’জনে আবার একটা রিক্সা করে ধানমণ্ডি পনেরোর ইউনিমার্টে এসে থামলো। ফুডকোটের টেবিলগুলো খালি নেই। ওরা পুরো লবিতে পায়চারি করল কিছুক্ষণ। দুই স্কুব আইসক্রিম কিনে খেতে লাগল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। একটা টেবিল ফাকা হলে বসল দু’জনে।
কি রে টুসি আজ যে সেজেগুজে আসিসনি! তোকে কেমন বিধবাদের মতো লাগছে।
পর্শি’র খোঁচা খেয়েও টুসি’র মুখে লাজুক ভাবটা নেই। চোখে অন্যরকম ব্যক্তিত্বের আভা।
আজকাল ইচ্ছে করেই সাজি না। ঐ দেখ প্রেষ্টিগুলো ফুডকালার দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে। দেখতে মোহনীয়, লোভনীয়। কোন ফুডভ্যালু নেই, শুধুই আকর্ষণীয় করার জন্য এই তৎপরতা। ভোগ্যপণ্য সাজিয়ে রাখে রঙ দিয়ে- কি বুঝলি।
বাহ্ বেশ কথা শিখেছিস। আমার সেই ফোনের পর তুই লাপাত্তা উধাও হয়ে গেলি। হঠাৎ জরুরী তলব। কি বলবি। আমি কিন্তু ঐ ঘটনা এখনো ভুলিনি। তোর হুমকির কারণে কিছু বলিনি ঠিক কিন্তু আমি এ নিয়ে ভাবছি।
আসলে…
থেমে গেলি কেন?
যে বয়সে আমরা হাওয়ায় নাচি ঐ বয়সটাতে আমাদের গাইড করার লোকের বড্ড অভাব। আমার ভুলগুলো আমি এখন বুঝতে পারি। আমাদের ঝুমু আপাকে চিনতি।
চিনবো না কেন? ওনাকে তো কলেজের সবাই চেনে।
তখন ঝুমু আপার সাথে আমার তুমুল যোগাযোগ তিনি বললেন, আমি দেখতে এতো সুন্দরী, তুই তো ইচ্ছে করলেই বিখ্যাত হয়ে যেতে পারিস। ধর একটা দুটো বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করলি তারপর ভাগ্য ভালো হলে বড় পর্দায়ও! মনে হল এই তো আমি তড়তড় করে উঠে যাচ্ছি। আমার মধ্যে একটা ঘোর তৈরি হল। এক দিন সত্যি সত্যি ঝুমু আপা আমাকে নিয়ে গুলশানের এক বিজনেস হাউজে গেলেন। অডি গাড়িতে যাচ্ছি। স্বপ্নের মতো। ঐ অফিস থেকে বের হয়ে দামী একটা রেষ্টুরেন্টে ঢুকলাম। আমার বুক ধুকধুক করছে। আলোর ঝলকানি আমার সারা শরীরে। হিম শীতল আলো আধারির জগৎ। এই প্রথম আমি এই পরিবেশে। একটু দূরে সুইমিংপুল ঝুমু আপা সুইমিং করার প্রস্তাব প্রত্যাখান করলেন। তাকে হাগ করে বিদায় নিলেন।
আমি বললাম উনি আপনার কে? ঝুমু আপা হাসিতে লুটিয়ে পরার মতো অবস্থা। বললেন, এগুলো হলো বিড়াল। এই নগরের নাগর! ঝুমু আপা প্রায়ই আমাকে সাথে নিতেন। একদিন হল কি ঝুমু আপার মাথা ধরেছে। আমাকে বললেন আমার জায়গায় তুই আজ একটু প্রক্সি দিয়ে আয়।
কোথায়?
এই একটু লং ড্রাইভে। মঈন ভাই খুব করে বলছে আমি আর তুই যেন যাই। যাবি লক্ষী সোনা। তুই ঘুরে আসলেও চলবে।
আমি তখনো সিদ্ধান্তহীনতায় ছিলাম। ঝুমু আপার ফোনে একটা কল এলো আমার মতামত না নিয়েই ঝুমু আপা বললেন হাতে সময় নাই রে… ওঠ ওঠ তাড়াতাড়ি কর। একটু সেজে নে। বিশ মিনিট পর কলেজের গেটে ব্লু কালারের মার্সিডিজ বেঞ্জ একটা গাড়ি আসবে। তৈরি হ সোনা, তৈরি হ। তাড়া দিলেন।
পর্শি বলে উঠল, ওমনি তুই চলে গেলি!
আমি তো তখন পুতুলের মতো। ঝুমু আপা যে ভাবে চাবি দেয়, আমি সে ভাবেই নাচি।
তারপর?
এই প্রথম আমি যাচ্ছি। গাড়িতে উঠেই দেখি মঈন ভাই। ওনার সাথে টুকটাক কথা হচ্ছিল। গাড়ি উত্তরা ছাড়িয়ে গাজীপুর অভিমুখী। তখন তিনি ইংগীতপূর্ণ কথা বলা শুরু করলেন।
সে আবার কেমন?
কথাবার্তার সারসংক্ষেপে মানে দাঁড়ায়, মনে কর নারীর দেহ-ই নাকি একটা ইন্ডাষ্ট্রি। এই দেহ কাজে লাগিয়ে অনেক টাকা কামানো সম্ভব। তারপর বললেন এই যে আমরা এখন ভাওয়াল রাজার ষ্টেটে চলে যাচ্ছি। আগের দিনের রাজ-রাজা নবাব জমিদার বাবুদের কাজ ছিল নারী সম্ভোগ। ইতিহাস বলে এ উপমহাদেশে সবচেয়ে বিখ্যাত বই হল কামসূত্র। তোমার কি মত। হো হো করে দাঁত কেলিয়ে বললেন তুমি কি বিব্রত হচ্ছ? আমার আবার মুখে কথা আটকায় না। গাড়ির ডেসবোর্ডে লাগানো ডিসপ্লেতে আইটেম সং বাজিয়ে দিলেন। গানের বিটগুলো আমাকে বিচলিত করে তুলেছে। আমি উপভোগ করছি না দেখে বন্ধ করে দিলেন। একটু পর আমরা একটা রিসোর্টে পৌঁছে গেলাম। পৌঁছা মাত্রা ওয়েলকাম ড্রিংকস এলো আমি গো গ্রাসে খেয়ে নিলাম। রিসিপশনে গিয়ে দুটো চাবি নিয়ে আমরা পাশাপাশি দুই রুমে উঠে গেলাম। আলাদা রুম হওয়ায় আমি মনে মনে স্বস্তি পেলাম। মঈন ভাই তার ব্যাগ থেকে এ্যাকহলের বোতল বের করলেন। বললেন তুমি তো খাবে না। তোমার জন্য ঐ যে জুস। সে দু’তিন প্যাগ ড্রিঙ্ক করল আমি জুস খেলাম কিন্তু আমার শরীরে প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। সম্ভবত জুসে তিনি উত্তেজক কিছু মিশিয়ে দিয়েছেন। আমি প্রচণ্ড একটা ঘোরে আছি। বললেন। চল সুইমিং করি। শরীর হাল্কা হবে। তার কথা মতো পুলে নেমে পরলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম সে আমার স্পর্শকাতর কিছু জায়গায় হাত নিয়ে যাচ্ছেন কিন্তু আমি বাঁধা দেয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি। পরে বুঝেছি, ঝুমু আপা তার কাছে আমাকে চড়া দামে বিক্রি করেছেন। ঝুমু আপার হাত ধরে আমি অনেকগুলো হাত ঘুরলাম। এখন আমার ঘোর কেটেছে। কিন্তু এই অন্ধরার জগতে থাকতে চাই না। আমি ভাবছি তোর মতো অডাসিটি সম্পন্ন মেয়েরা মিলে একটা প্লাটফর্ম গড়ে তোল, যারা ভিক্টিম তারা আর কিছু না পাড়ি নতুন করে কারো সর্বনাশ হোক সেটা ঠেকিয়ে দেয়ার জন্য কলেজ পড়ুয়া মেয়েদের সচেতন করি। একটা মনোভূমি খুব জরুরী। তোর আসার আগে নারী উদ্যোক্তা এক মেয়ের সাথে দেখা করেছি। ঠিক এই কাজে। সেও ভিক্টিম। এই কাজটা, একটা বড় মিশন হতে পারে। তুই কি বলিস?
বাহ্, হুস হয়েছে তাহলে!
বৈঠক শেষে ওরা বের হয়ে এলো। বাইরের রাস্তায় অপেক্ষমান দুটো গাড়ি। একটা অডি, আরেকটি মার্সেডিজ বেঞ্জ। দু’জন দু’জনের চোখের দিকে তাকাল। ওদের মনে প্রশ্ন কে ভিক্টিম!