ভবদেব কুর্মির একটা স্মার্টফোন হয়েছে। তাতে ভবদেবের ছেলে সনাতন ফেসবুক একাউন্ট খুলে দিয়েছে।ভবদেব তাতে সারাদিন মগ্ন হয়ে থাকে।কতো কী মনের কথা লেখে। কতো ছবি তুলে লটকায়। কোলের মেয়ে শান্তাকে নিয়ে সেল্ফি তোলে। সনাতন আর শান্তাকে নিয়ে হারমোনিয়ামে গান গাইতে বসে ভিডিও তুলে আপলোড করে।
ভবদেব চাষাভুসো মানুষ।বাঁশকোঁড়া গ্রামে বিঘে পাঁচেক জমি আছে। ভবদেব তাতে চাষাবাদ করে।ধান-কলাই-সরষে- অড়লের ডাল শীতের দিনে কপি – পালংশাক-লালশাক-ধনেপাতা-বেগুন- আরও কতো কি।সামান্য তেল-মশলাটুকু কিনলে ভবদেবের আর অধিক কিছু খোলা বাজার থেকে কিনতেও হয় না। ভবদেবের বাড়িতে পেটভাতারি লোক বলতে ভব-র বৌ প্রতিমা তার তিন ছেলেমেয়ে আর বুড়ো বাপ হরিদেব।
হরিদেব যৈবনকাল থেকেই বাউন্ডুলে প্রকৃতির। এখান ওখান ঘুরে আড্ডা মেরে পাড়ার চাদোকান পালিশ করে বুকনি আউড়ে গান গেয়ে দিন কাটিয়েছে। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো যাকে বলে। বিষয় আশয়ে হরিদেবের নজর ছিল না কোনোদিনই।নেহাত জমিটুকু ছিল তাই খাওয়া-পরায় টান পড়েনি। আলস্যে কিছু জমি যে এই বেহাত হয়ে যায় নি তাএমনও নয়। এ ব্যাপারে হরিদেবের বৌ চিন্তামনি কিছু বললেই হরিদেব বিজ্ঞের মতো জবাব দ্যায় “সরকার যদি মুনে টো করে যে জমি সব লিবে তো সবওই লিয়ে লিতে পারে।আমাদের লম্ফজম্প বেথাই।”
তো এখন হরিদেবের বয়স হয়েছে তা প্রায় তিনকুড়ি পেরিয়ে চার কুড়ির কাছাকাছি ।হাতে পায়ে টান ধরেছে।এখন আর খেতির কাজা করতে পারে না হরিদেব। বৌ চিন্তামনি মারা যাবার পর আরও কেমন যেন জবুথবু হয়ে গেছে ।যৌবনের চাঞ্চল্য ঘুচে গেছে। সঙ্গী-স্যাঙাৎ রাও আজকাল বিশেষ বুড়ো মানসের ধার মাড়ায় না কেউ। সুখের পায়রা ছিল সব যখন হরিদেব নেচেকুঁদে গান গেয়ে মজাদার সব গল্প করে আসর সরগরম করে মাতিয়ে রাখতো। এখন আর তারা কেউ খোঁজ খবরটুকুও করে না।
ছেলে ভবদেব এখন লায়েক হয়েছে।যেটুক জায়গা -জমিন আছে তার নজরদারি করে। হরিদেব এক বিন্দুবিসর্গও লেখাপড়া জানে না।পেট থেকে পড়ে জ্ঞান হওয়া অবধিই লাঙল ঠেলা জমিন চষা খেতির কাজ।ইশকুল পাঠশাল যাওয়া ছিল রসিকতা। মাঝে মাঝে চোখ চেয়ে দেখতো বটে বাবুদের ছেলেপুলে জামাপ্যান বুট পরে ব্যাগ পিঠে ইশকুল যায়।বাপের কাছে কখনও বায়না করেনি এমনও নয়। কিন্তু বাপের সেই এক কথা। “গরিব চাষার ঘরে আবার ন্যাকাপড়ার শখ? চাষার ঘরে জম্ম যার জমিই তার ধন। চাষবাসই তার অবুলম্মন”।
হরিদেবের লেখাপড়া হয়নি। একবন্নও না। বংশপরম্পরায় তার পরিচয় জনমজুর। চাষা। বারবার অভিমান হয়েছে হরিদেবের বাপটার ওপর। একটা বারের তারেও কি তাকে পাঠশালে পাঠানো যেতো না? না যদি পারতো, পেমান হয়ে যেতো যে গবেট মাথা…..তবে তো ছেড়েই দিত । বাপকে রাজি করিয়ে পারেনি বলেই তাই যখন ছেলে ভবদেবের জন্ম হলো হরিদেব ঠিক করলো তাকে চাষের জমিন দেখাশুনার পাশাপাশি ভবদেবকে খানিক লেখাপড়াও শেখাবে।
ইশকুল পাশ দিল ভবদেব।কলেজে ভর্তি হোল। সে কি মস্ত কলেজ। বিশাল বিল্ডিং। খেলার মাঠ। পুকুর । খোলা জমিনে ফুল -ফল-পাকড়ের গাছ।ব্যাটাছেলে বিটিছেলে একসঙ্গে লেখাপড়া করে সেখানে। মাস্টাররাও মেয়ে-পুরুষ একসঙ্গে টিচারি করে। সেখানটায় প্রথমে গিয়ে চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল ভবদেবের। বড়ো ক্লাসঘরটায় কত্তো ছেলেমেয়ে। উল্টোদিকখানায় খানিক উঁচুতে টিচারের টেবিলচেয়ার পাতা। বিশেষ করে একজন দিদিমুনিকে ভারি ভালো লাগে ভবদেবের। ফর্সা গোলগাল চেহারা। মাথার ছোট করে কাটা কাঁচাপাকা চুল। হাসিখুশি। আর ভারি সুন্দর করে পড়ান।সহজ করে বুঝিয়ে দ্যান কঠিন জিনিস। কোথাও যেন তাঁর কথাবার্তার মধ্যে স্নেহের পাশাপাশি পিছিয়ে পড়া গরিবগুর্বো মানুষের প্রতি গভীর সমবেদনা আর সহানুভূতি আছে। সিলেবাসের পড়া পড়াতে পড়াতে কখনও কখনো দৈনন্দিন জীবনযাপনের কথা এসে পড়ে তাঁর আলোচনায়। দেশের নব্বই ভাগ গরিব মানুষের কথা। সভ্যতার শুরু থেকে উঁচুজাতের মানুষের একচেটিয়া সুবিধাভোগ….নীচুতলার মানুষকে জোর করে দাবিয়ে রাখা…..তাদের ওপর সীমাহীন অত্যাচার নামানো….বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করা…..এসব কথা শুনতে শুনতে ভবদেবের নিজের কথা মনে হয়।নিজের পরিবারের কথা মনে হয়। বাপঠাকুর্দা কতোদিন ধরে কেবল হালবলদ নিয়েই কারবার করে গেছে। লেখাপড়ার ধার মাড়ায়নি।আর লেখাপড়া না করলে যা হয় তাদের ভাগ্যেও তাইই হয়েছে। কতোজন মাথায় হাত বুলিয়ে ঠকিয়েছে বাপ-পিতেমোকে…..স্রেফ তো লেখাপড়া জানে না বলেই।
এই মেডাম কে ভারি ভালো লাগে ভবদেবের। ক্লাসে এসে এসব কথা অনেকসময় বলেন। আর ছাত্রছাত্রীদের বলেন “তোমরা ভালো করে লেখাপড়া করো।সব জিনিসটা জানো।নম্বর কতো পেলে সেটা বড়ো কথা নয়।আসল কথা পৃথিবীর অজস্র জানার জিনিসের কিছু অন্তত গভীরে গিয়ে জানো।তোমাকে যেটা জানতে হবে সেটা মনোযোগ দিয়ে যদি পড়ে জেনে নাও তো কেউ তোমার অজ্ঞতার সুযোগে তোমাকে ঠকাতে পারব না।”
এই মেডামের কাছে প্রাইভেটে পড়ার ইচ্ছে ছিল ভবদেবের। কিন্তু জানা গেল ম্যাডাম পেরাইভেট কোচিং করান না।কলেজের মধ্যেই কারুর কিছু প্রয়োজন হলে সাধ্যমতো সাহায্য করেন।ভবদেব আর কি করে। ক্লাস তো সবসময় করে উঠতে পারে না।বিশেষ করে ধান রোয়ার বা পাকবার সময় মাঠের কাজে এতো ব্যস্ততা থাকে যে ভবদেবের প্রায়ই ক্লাস করা হয়ে ওঠে না। কোনোদিন হয়তো ওই ম্যাডামের ক্লাসে যাওয়ার ইচ্ছে।কিন্তু কাজকাম সামলে এমন সময় কলেজে পৌঁছোলো ভবদেব যে তখন ম্যাডাম হয়তো ক্লাস শেষ করে ফেরার পথে। ক্লাসরুমের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ম্যাডামের ক্লাসের শেষ অংশটুকু একটু শুনে চলে যায় ভবদেব। ভারি ভালো লাগে তার বাংলা সাহিত্যের একহাজার বছরের পথচলার ইতিহাস। তার ভাঙাগড়া। তার বারবার বাঁক নিয়ে এগিয়ে চলা।যুগে যুগে তার নতুন কথন নতুন আবিষ্কার নতুন দ্বন্দ্বের রূপরেখা। মানুষ ও কিরকম এই প্রবাহের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে। সম য়ে সময়ে কালে কালে স্থান থেকে স্থানান্তরে পাল্টে যায় জনসাধারণের মুখের ভাষা খাওয়া-দাওয়া রুচি-সংস্কৃতি ধর্মকর্ম নানা কিছু। ভবদেবের এই গোটা বিষয়টাই ভারি ভালো লাগে। মাঠঘাটের সৃষ্টির কাজ সামাল দিয়ে সংসার দেখাশুনো করে বই পড়ার সময় তার বড়োই কম তবু মাঝে মাঝেই একটা আধটা বই খুলে দ্যাখে। যত্ন করে পাতা ওল্টায়। অক্ষরগুলোর ওপর আলতো আঙুল ছোঁয়ায়, উল্টে পাল্টে মলাটের গন্ধ শোঁকে। আর মনে মনে ভাবতে থাকে অনেক কথা।বহু কল্পনার রং আঁকিবুকি কেটে যায় তার মনের পর্দাখানায়। ভাবতে থাকে যদি একটু লিখতে পারতো কিছু। নিজের মনের গহনে যেসব কথা জমে আছে অনেক দিন থেকে সেসব কথা যদি শিখে রাখা আখরে জানিয়ে দিতে পারতো আরও অনেককে।
স্মার্টফোনে ফেসবুক একাউন্ট খুলে দিয়েছে ছেলে সনাতন। ভবদেব তাতে মাঝে মাঝে ছবিটবি দেখে। কেউ কিছু লিখলে পড়ে। লাইক কমেন্ট দ্যায়।ফেসবুকে কিছু বন্ধুও জুটে গেছে ভবদেবের। বেশ কিছু পুরোনো বন্ধুর সঙ্গেও যোগাযোগ হয়েছে। আজকাল একটু আধটু লেখেও সে। লিখে বেশ ভালো লাগে। বন্ধুরা মতামত দ্যায়। আর লেখা “ভালো” বললে কার না ভালো লাগে?
একদিন নিজের কথা নিজের এলাকার কথা সেখানকার মানুষজনের কথা তাদের মনের কথা প্রেম ভালোবাসা দুঃখবেদনা আশাআকাঙ্খার কথা লিখতে শুরু করলো ভবদেব।এমনিই…. নেহাতই শখের লেখা। নিজের মনের মতো।মন যা বললো তাই লিখে গেল। খানিকটা লিখে থামলো।পোস্টালো সেই লেখা।পরদিন হুহু করে ঝাঁকে ঝাঁকে শুভেচ্ছা প্রশংসা আসতে শুরু করলো। স্তুতিবাক্যের বন্যা দেখে ভবদেবের প্রথমটায় একটু লজ্জা করলো। এতোই ভালো লিখেছে নাকি সে? এতো নেহাতই সাদামাটা ভাষায় লেখা সাধারণ দৈনন্দিন জীবনের কথা আর নিজের অঞ্চলের কথা।কোনো কারিগরি তাতে নেই। তাই ফেসবুক ফ্রেন্ডদের এতো ভালো লাগছে? বড়ো লেখকদের মতো লিখলে তাহলে কি হোত? কিন্তু ভবদেব না লিখে পারে না। বুকের মধ্যে হাজার কথা কলকলিয়ে ওঠে। আঙুল ফাটিয়ে এসমাট ফোনটার ওপর শব্দগুলো কাতার দিয়ে ঝাঁপ দিতে চায়।
কেউ বলে ফেসবুকের কল্যাণে আজকাল নাকি ক অক্ষর গোমাংস লোকরাও লেখক বনে যাচ্ছে। তাহলে কি ভবদেবের লেখাগুলোই ওরকম মূর্খের মতো?আবার কেউ বলে ফেসবুকের লেখকদের কেউ কেউ দারুণ দারুণ লেখে।যাই হোক ফেসবুকে নিজের ওয়াল খুললেই ভবদেবের প্রবল ইচ্ছে জাগে
লেখার। আঙুলগুলো চুলবুলিয়ে ওঠে।
আগের দিন যতোটুকু লিখেছিল সেখান থেকে পরের প্রসঙ্গে এগিয়ে যায়। লিখে চলে।লিখে চলে।লিখে চলে। প্রতিদিনই ফেসবুক ফ্রেন্ডরা তার লেখার প্রশংসা করে। ভবদেব ভাবে সত্যিই কি এতো ভালো লিখে ফেললো সে? এতো প্রশংসা সত্যিই কি প্রাপ্য তার।
নিজেদের নদীর পাড়ের গ্রাম থেকে অনেক দূরে শহরে থাকে ভবদেবের এক বন্ধু।বন্ধু না বলে শুভানুধ্যায়ী বলাই ভালো। বয়সে অনেকটাই বড়ো। কিন্তু বড়ো ভালো মানুষ।পরোপকারী।স্নেহময়। গরিবগুর্বো নীচতলার মানুষদের ওপর অগাধ মায়া মমতা।ভবদেব খেয়ালই করেনি যে ওই বিশ্ববন্ধুদাও ভবদেবের লেখা খুঁটিয়ে পড়েছে। কোথাও 2 বেশ ভালোও বলেছেন । ধীরে ধীরে লেখা শেষ হলো ভবদেবের। গ্রামের মানুষজনদের কথা। নীচুতলার সমাজের একটা সাহসী মেয়ের দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত আর পদক্ষেপের কথা। বেশ কিছু ভবদেবের নিজের চোখে দেখা ঘটনা।আর কিছু তাকে বানিয়ে লিখতে হয়েছে।বানানো মানে ভবদেব সমাজকে জীবনকে যেভাবে দ্যাখে বা দেখতে চায় সে ভাবেই সে লিখেছে।তার চোখে যা আদর্শ তারই রূপে সাজিয়ে দিয়েছে নিজের ভাবনা ও ভাষাকে। লেখা শেষ করলো ভবদেব। বন্ধুরা ঘিরে ধরলো।বড়ো ভালো লেখা হয়েছে। এর একটা গতি করা দরকার। কি গতি? সবাই কি করে পড়বে এই লেখা? ভবদেবের ফেসবুকের বন্ধুরা অনেকেই পড়েছে।কিন্ত এর বাইরে আরও বহু মানুষ আছে ভবদেবের চেনা পরিচিত…..এমনকি যারা পরিচিত নয় তারাও যদি পড়তো এই লেখা……
বিশ্ববন্ধুদার সঙ্গে পথে হঠাৎই একদিন দেখা হয়ে গেল ভবদেবের।
বিশ্ববন্ধুদা তো ভবদেবকে দেখে উৎফুল্ল।
“চমৎকার লিখেছো ভবদেব। খুউব সুন্দর হয়েছে।এতো ভালো কলম তোমার জানতাম না তো….লিখে যাও। লেখা থামিও না। যতো লিখবে ততো লেখার হাত খুলবে। চরিত্রগুলো কি তোমার নিজের চোখে দেখা? না কি পুরোটাই কল্পনা?যাই হোক বেশ দাঁড় করিয়েছো উপন্যাস খানা।সমাজের ছবি জীবনের ছবি ফুটেছে দিব্যি।”
এক দমকে কথা শেষ করে ভবদেবের পিঠটা একটু চাপড়ে দিয়ে পেছন ফিরে চলে যাচ্ছিলেন বিশ্ববন্ধুদা। হঠাৎই কি মনে করে যেন আবার ফিরলেন।
“আচ্ছা…..তোমার বই করতে ইচ্ছে করছে না ওটা? নাকি ওরকম ফেসবুক সংস্করণই থেকে যাবে?”
ভবদেব কুর্মি বোকার মতো দেঁতো হাসি হাসে। বলে…..
“আজ্ঞে বই? কে বের করবে আমার বই? কে-ই বা কিনবে?কটা লোক চেনে আমায়?”
“তুমি রাজি থাকলে আমার চেনা প্রকাশক আছে বলতে পারি।বলবো?”বিশ্ববন্ধুদা বলেন।
ভবদেব কি বলবে??? ঠোঁটে এক চিলতে বোকা হাসি ঝুলিয়ে চুপ করে থাকে।
বিশ্ববন্ধুদা বলেন “আমরা আসলে বইপত্রের লোক তো….এসব অনলাইন টাইন আমাদের তেমন আসে না কি না তাই ভালো লেখা টিঁকিয়ে রাখতে বইএর কথাটাই আগে মনে আসে। তো যদি বলো তো একজন ভালো প্রকাশক আছে কথা বলতে পারি তার সঙ্গে।”
বিশ্ববন্ধুদার চেনা প্রকাশকের হাতেই বই বেরোলো ভবদেবের। “চন্ডালপুরের কথকতা”। চমৎকার মলাটখানা দেখেই চোখ জুড়িয়ে যায়। সুঠাম বাঁধাই। শক্তপোক্ত বইখানাকে হাতে নিয়ে গন্ধ শুঁকতে লাগলো ভবদেব। অনুষ্ঠান করে বইএর মলাট উন্মোচন হলো। বেশ নামকরা কয়েকজন মানুষ এলেন।ভবদেবের লেখা নিয়ে এতোখানি মাতামাতি হবে কখনও স্বপ্নেও ভাবেনি সে। দিনটা বড়ো সুন্দর কাটলো। রাতে বৌএর পাশে শুয়ে কড়িকাঠ গুনতে গুনতে কখনও আবেগে আবেশে কখনও লজ্জায় আনন্দে তৃপ্তিতে দুচোখে জল এসে গেল ভবদেবের।
ভবদেবের পরিচিত বন্ধুবান্ধব চেনাজানা লোকজন অনেকেই বই কিনলো।কজন পড়লো অবশ্য জানা নেই। কিন্তু প্রায় সকলেই বললো “বেশ লেখা বেশ লেখা….বেড়ে লিখেছে।দারুণ লিখেছে।” অবহেলিত নিপীড়িত পিছিয়ে পড়া কুর্মিসমাজে ভবদেবের নামে ধন্য ধন্য পড়ে গেল।
ভবদেবেরও এখন আর আগের মতো লজ্জা সংকোচ নেই। নিজের সৃষ্টি সম্পর্কে তারও এখন প্রচ্ছন্ন গর্ব। বেশ কয়েকটি খবরের কাগজ থেকে চ্যানেল থেকে ভবদেবের সাক্ষাৎকার নিতে এলো। ভবদেব প্রথম প্রথম একটু ঘাবড়ে গেল।কি বলতে হবে না বলতে হবে বুঝে উঠতে পারলো না। ইন্টারভিউ এ কথা বলার সময় সাহায্য নিল প্রকাশকের। বিশ্ববন্ধুদাও সাহায্য করলেন শুধু নয় একটি নামী দৈনিকে “চন্ডালপুরের কথকতা” র ভূয়সী প্রশংসা করে খানিকটা লিখলেন। আর তাই পড়ে বিদেশের এক অনুবাদক ভবদেবের লেখা ইংরেজিতে অনুবাদক করতে আগ্রহী হয়ে ফোন করলো। ভবদেব এমন আপ্লুত হয়ে গেল যে নিজেকে বেশ কেউকেটা মনে হোল তার।
অনুবাদের নানা শর্ত থাকে। লম্বা চুক্তি হয় প্রকাশকের সঙ্গে লেখকের। চুক্তির অজস্র ধারা-উপধারা। ইংরেজিতে লেখা ওইরকম একটা মস্ত চুক্তিপত্র হাতে এলো ভবদেবের। আর তাতে চোখ পড়তেই মাথাখানা একবারের জন্য বোঁ করে ঘুরে গেল। এসব পড়ে উদ্ধার করবে কে? কেই বা এর মানে বুঝবে।ভবদেবের আপনজন বলতে যারা তার চারপাশে আছে তাদের সকলেই চাষাভুসো মানুষ।কাকভোরে উঠে পেট বোঝাই পান্তা খেয়ে মাঠের কাজে যায়।ফিরে এসে দাওয়ায় বসে মুড়ি চিবোয়।এখন অবশ্য ঘরে ঘরে টিভির অভাব নেই।অনেকেই বই সেরিয়াল দেখে। কিন্তু এর বাইরে ইংরেজিতে চোখা চোখা ভাষায় অতোগুলো পাতা পড়ে তার মানে বোঝার বুদ্ধি কার আছে এ গেরামে?
ভবদেব পড়ে গেল মহাফাঁপড়ে। ছুটলো প্রকাশকের কাছে।
“অ মানিক দা গো….এতো সব কি লিখা আছে ইঞ্জিরি ভাষায়?”আমরা সব মুখ্যুসুখ্যু মানুষ ই সবের কিই বা বুঝি?”
মানিক মুখুজ্যে বইপাড়ার সাত ঘাটে জল খাওয়া দুঁদে প্রকাশক। ভবর পিঠটা চাপড়ে বললেন
“ভব তুই যে কী লিখেছিস তুই বুঝবি না এখন।পরে যখন কোটি টাকার মালিক হবি তখন বুঝবি।তখন কি আর এই গরিব তুশ্চু মানিকদা কে তোর মনে পড়বে রে?”
“কী যে বলো মানিকদা….আমরা গরিবগুর্বো মুখ্যুসুখ্যু মানুষ……কী একখানা লিখলাম….তার জন্য এতো কিছু….আমার তো বেশ ভয়ই লাগছে….”
দেখতে দেখতে চুক্তি সইসাবুদের দিন এসে যায়। অনুবাদক প্রকাশক আর লেখক একসঙ্গে বসবে।ভবদেবের কেমন নার্ভাস লাগে। এতো দুঃসাহস টা বোধহয় না দেখালেই ভালো হোত।কেন যে লিখতে গেল।আর ফেসবুকের ফ্রেন্ড গুলানই বা কি। যা তা জিনিসটাতে একেবারে ছপ্পর ভরে লাইক কমেন্ট দিয়ে দিল।প্রশংসার বন্যায় ভাসিয়ে দিল। আর এসব করলো বলেই না লোভের সাপের জিভটা লকলক করতে লাগলো ভবদেবের মনে? বাপের কথা মনে পড়ে ভবদেবের “ভব বাবা কখনও লোভ করবিনে।ভগমান যা দিয়েছেন সেই অল্পে সন্তুষ্ট থাকাটাই গরিব মানুষের জয়। এই পৃথিবীটায় যেটা তুই লাভ করবি সেটা যেন তুই পরিশ্রম করেই পাস ”
ভবদেবের মনে হয় এটা লেখার জন্য কি সত্যিই সে পরিশ্রম করেছে? একদম করেনি এমনটা নয়।আবার খুব কঠোর পরিশ্রম করেছে এমনও বলা যাবে না।
চুক্তি সইসাবুদের আগে কেমন একা নিঃসঙ্গ লাগে ভবদেবের। বিশ্ববন্ধুদাকে একটু পাশে পেলে ভালো লাগতো।সাহস খানিক বাড়তো।
চুক্তি নিয়ে বসলো সবাই। বিশ্ববন্ধুদা এসেছেন। আর ভবদেব সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে তার দুই দেশোয়ালি পড়শি ভাইকে। শশধর আর রাখাল। দুজনেই চাষবাস করে। মুখ্যু গরিব জনমজুর। পেটে বিদ্যে নেই কারুরই।কথাবার্তা শুরু হয়। আইন কানুনের সব জটিল ধাঁধা। হাঁ করে তাকিয়ে থাকে ভবদেব শশধর আর রাখাল।কখনো মনে হয় ঢের ডলার না কি আমেরিকার টাকায় ভরে যাবে ঘর।কখনও মানিকদাকে খুব লোভী আর মতলববাজ মনে হয়।মনে হয় ভবদেবকে খুব করে খাটিয়ে নিয়ে পরিশ্রমের কোনো দাম না দিয়ে মোটা টাকা মুনাফা করে ধাঁ দেবে মানিকদা। বিশ্ববন্ধুদা একবার মিনমিন করে “মেধাসত্ত্ব আইন” না কি বলার চেষ্টা করলেন।বোধহয় ভবদেবের পক্ষেই বলতে চাইলেন কিছু। কিন্তু মানিকদা ছোটখাট রোগাসোগা দেখতে হলে কি হবে….মাথায় গজগজ করছে লোকঠকানোর জিলিপির প্যাঁচ। ধূর্ত শেয়ালের মতো জ্বলছে যেন ভাঁটার মতো চোখগুলো।
রাখাল ওদের মধ্যে বয়সে সবচেয়ে ছোট হলেও খুব বুদ্ধি ধরে।বললো “লেখক পাবে কম আর পকাসক পাবে বেশি?এ কেমনধারা কথা? লেখক না লিখলে তো বুইটো ছাপ্পাই হবেক লাই।”
ভবদেব লক্ষ্য করে মানিকদার এতোদিন দেখা নরমসরম মুখটা কেমন হিংস্র হয়ে উঠেছে। শক্ত হয়ে উঠেছে চোয়াল। ঈষৎ বিরক্ত হয়েই বললেন ” লেখা যদি প্রকাশক না-ই ছাপবেন তো লেখক লিখে করবেনটা কি? লিখে লিখে ট্রাঙ্ক বোঝাই করবেন?”
ভবদেব বেশ মুশকিলেই পড়ে যায়। সেই তো!! সে তো এই জগতের কাউকে চেনেও না। বই বা লেখালেখি জগতের কান্ডকারখানা জানেও না। বিশ্ববন্ধু দা র কল্যাণেই তার মানিকদা অবধি পৌঁছোনো। এখন মানিকদাই যদি বেঁকে বসে তো তার আর কীই বা গতি হবে।ফেসবুকের লেখা ফেসবুকেই থাকবে।দুচারজন বন্ধু বান্ধব প্রশংসা টশংসা করবে।তারপর সময়ের নিজস্ব নিয়মে মানুষ একদিন সব ভুলেও যাবে।
ভবদেব লক্ষ্য করে রাখাল আর শশধর মানিকদার সঙ্গে বই বেচাকেনার বখরা নিয়ে বচসা চালিয়েই যাচ্ছে।
শশধরের গলাটা একটু চড়েই গেছে।
বলছে “সে যাই বলো মানিকদা, তুমি কিন্তু ভবদাকে ঠকাইতেই আছো। বিক্রিবাটা পয়সাকড়ি ভবদাকে কম দিয়ে নিজে বেশি লিছো। ইটা আমাদিগের ভালো লাগতিছে না।”
রাখালও বলছে ” ভবদা আমাদের কষ্ট করে জিনিসটো লিখলো আর তুমি অটা কিনছো তো দামটো কেন কম দিছো?”
ভবদেব লক্ষ্য করলো রাখাল শশধরদের কথায় ক্রমশ কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠেছে বইপাড়ার নামী প্রকাশক মানিক মুখুজ্যের মুখটা। কালো চকচকে যেন একখন্ড ইস্পাতের পাত। কথা বলছে না একটাও।মাথা নীচু করে বসে আছে। গালে হাত।
ভবদেব বুঝতে পারে না মানিকের প্রতিক্রিয়া। রাখাল শশধরকে আনা হয়েছিল বেকায়দায় পড়লে একটু বুদ্ধি ধার দেওয়ার জন্য। কিন্তু ডোজটাকি একটু বেশি হয়ে গেল?
বেশ খানিক পর মুখ খুললো মানিক…..
“দ্যাখো ভবদেব আমি এই বইএর ব্যবসায় দশ বছরেরও বেশি আছি।যে চুক্তিপত্র তুমি দেখলে সেটাই স্ট্যান্ডার্ড। তুমি যদি তোমার দলবল সমেত আমার ওপর চড়াও হয়ে এরকম করো তো আমিও বলে দিলাম এই প্রথম আর এইই শেষ।তোমার কোনো বইই আর আমি ছাপবো না।”
ভবদেব আর কি করে…..
শশধর আর রাখালকে ছদ্ম ধমক একটা দ্যায়।
“হেই খালবরা থামবি তোরা? মানিকদাকে ওমনটা করতিছিস কেন…..না না মানিকদা তোমার কথাই থাকবে’খনে।ওরা কী বোঝে ছেলেমানুষ?হেই চুপ যা।”
চুক্তিপত্রটা হাতে নেয় ভবদেব। কাঁচা বাংলায় মানিক বুঝিয়ে দেয় অনুবাদ হলে লেখক পাবে কুড়িভাগ আর প্রকাশক পাবে আশি ভাগ। এটাই সাফ সাফ কথা।
ওদিকে বিশ্ববন্ধুদা ক্ষীণস্বরে বলার চেষ্টা করছেন “ভবদেব তুমি ভালো করে লেখো।লেখায় মন দাও।এখন থেকে তোমার দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেল । পাঠকেরও প্রচুর প্রত্যাশা তোমার ওপর।”
ভবদেব ভাবতে থাকে। পান্তাভাত খাওয়া, মাঠে হাললাঙল বলদ চষা ভবদেব। সাতপুরুষে কেউ ইশকুলের চৌকাঠও মাড়ায়নি। জীবনের এক আশ্চর্য সন্ধিক্ষণের সিংদরজা বুঝি খুলে যাচ্ছে। তার মাথার ওপর মস্ত আকাশ।বুকের কাছে ঝাঁপিয়ে পড়া বিশ্বপ্রকৃত। পায়ে হেঁটে চললে যতোদূর চোখ যায় দুনিয়া ভরা আশ্চর্য সব মানুষ।ভবদেব এদের কথাই লেখে।এই আকাশ অরণ্য সমুদ্র পৃথিবী সমভূমি ঘিরে যে বিস্য়য়কর মানুষ তারাই ঘাই মেরে উঠতে থাকে তার ভাবনার অতলান্ত পাথারে। পারবে তো ভবদেব মানুষের রহস্যময় অন্তরের জগতে ঢুকতে?পারবে তো ভবদেব বৃহৎ এই পৃথিবীর আর প্রকৃতির সঙ্গে এর জীবজগতের আর মানুষের মেলবন্ধনের চিরনবীন চাবিকাঠিটি আবিষ্কার করতে? চন্ডালপুরের মানুষজনের আদিম মুখমন্ডল তার বেদনা যন্ত্রণা বঞ্চনা ক্রোধ আর্তি অসহায়তা সমেত নিদারুণ প্রশ্নাতীত নিয়তি লাঙলের ফলা ভেদ করে উঠে আসতে থাকে ভবদেবের আঙুলের ডগায়।