১.
চোখদুটো জ্বলছে। এক পা দু পা করে এগোচ্ছে চারপেয়ে জানোয়ারটি। সাদা একটা বেড়াল। নরম শরীর। ভীতু পা। প্রথমে ভয় ছিল, ধীরে ধীরে জড়তা কাটিয়ে উঠেছে। শরীরখানি গুটিয়ে নেই, লেজটা নড়ছে অল্প। মুখে শব্দ উঠছে, ম্যাও।
– আয়, আয় না। ভয় কিসের? আয়।
মাছের মাথার লাল কান’কো বের করে দেখায় শম্ভু।
বেড়ালটি এক পা এগোয়। শম্ভুর দিকে তাকায়। এদিক ওদিক চোখের মনি ঘোরে। ধীরে শব্দ করে, ম্যাও। হয়তো কিছু বলতে চাই নিজের ভাষাতে। সে ভাষা শম্ভুর বোধগম্য নয়। তবু শম্ভু বলে – একেবারে তাজা মাছ। দ্যাখ এখনো কানকোর লাল রক্ত টকটক করছে। তোর জন্য ধরেছি মাছখান। নিজে ছিপে করে তুলেছি। আয়, আয় না। এমন তাজা মাছ খাসনি অনেকদিন।
গাছে পাখপাখলি অকারণ আলোড়ন তোলে। ঝটপটানি দেয়। সাদা রঙের জানোয়ারটি থমকে যায়।
শম্ভু বেড়ালটির দিকে তাকিয়ে। শম্ভুর চোখ জ্বলছে। আজ চোখে তার আগুন। বেড়ালটি থেমে যাওয়াতে শম্ভুর চোখের আগুন আবার ধক করে জ্বলে উঠে। কোনভাবে যদি বেড়ালটি হাতছাড়া হয়, তাহলে তার আবার পরাজয়। বারবার চেষ্টা করেছে সে বেড়ালগুলো নাগালে পাবার। কিন্তু তারা মহাখচ্চর। কিছুতেই কথা শোনে না, বাগে পায় না। কিন্তু আজ বাগে পেয়েছে। ঘরের অনেকটা কাছে চলে এসেছে। আর কয়েকটি ধাপ। তাহলেই তার অনেকদিনের পরাজিত মন জয়ের স্বাদ পাবে। জয়ের স্বাদ অন্যরকম। সে স্বাদ সে জীবনে খুব কমই পেয়েছে। একফালি ঘর, ঠিকে মজুরের জীবন কেবল পরাজয় চাষক্ষেত। শম্ভু মুখের মধ্যে ভালোবাসা প্রকাশের চেষ্টা করে।
– থামলি কেন? আয়। পেটপুরে খাওয়াবো আজ তোকে। তাজা মাছ আছে। বিলের তাজা মাছ। তোর মালিকের বাড়িতে কী সব খাস প্যাকেটের খাবার, ওতে কী স্বাদ আছে? তোর মালিকের টাকা আছে, কাঁড়ি টাকা খরচ করে প্যাকেটের খাবার কেনে, কিন্তু তাজা রক্তের স্বাদ অন্যরকম! একবার আয়, জন্মের মতো ভুলতে পারবি না।
বেড়ালটি অনেকটা এগিয়ে গেছে। শম্ভুর ঘরের দরজা হাট করে খোলা। ভেতরে অন্ধকার।
২.
টুকটুকিকে না পেয়ে অস্থির হয়ে উঠেছিল বৈশালী। যাকে পেল তাকেই জিজ্ঞেস করে, টুকটুকিকে দেখেছো? সাদা রঙের বেড়ালটা আমার। দুদিন থেকে ঘরে আসে নি।
বৈশালীর উৎকন্ঠায় কেউ, সহানুভূতি দিল, কেউ মুখ টিপে হাসলো, কেউ বলল বড়লোকিপনা, বেড়ালের পিছনে কাঁড়িকাঁড়ি টাকা খরচ করে যাচ্ছে। অথচ একটা পুরাতন কাপড় দেয় না কাজের লোককে। মেয়ের বিয়েতে সাহায্য চাইতে গেলে মুখ ঘোরায়। বাপের চাকরি, মা এর চাকরি, টাকা ফুরানোর লোক নাই, বেড়ালের পেছনে ঢালছে। বিয়ে থা ও করে না! ধামড়ি বুড়ি হচ্ছে দিন দিন।
টুকটুকি বৈশালীর ভীষণ প্রিয় বেড়াল। বৈশালীদের বাড়িতে বেড়ালের সংখ্যা নেহাৎ কম নয়। লোকে বলে বেড়ালের বাড়ি। দোতালা বাড়িখানিতে সারা বাড়িময় বেড়ালের অবাধ বিচরণ। বৈশালীর শোবার ঘরে, ডাইনিং এ, বারান্দায় হুলো মেনিদের নিশ্চিত আবাস। সকাল বিকাল রান্না হয় তাদের জন্য। প্যাকেট প্যাকেট আসে শুকনো খাবার। বৈশালীর এই বেড়ালপ্রীতি নিয়ে সমস্যা কম হয়নি পাড়াগাঁএ। শহরে এসব নিয়ে কথা হয় না, কিন্তু শহর ছাড়িয়ে এক অজ পাড়াগাঁয়ে বেড়ালের জন্য এত প্রেমকে মানুষ আদিখ্যেতা বলে।
বৈশালীদের বাড়ি পাড়াতে একমাত্র দোতালা বাড়ি। সমুদ্রের মাঝে দ্বীপের মতো তারাই একমাত্র ‘হাজরা’ উঁচু রক্ত। আসে পাশে কিছু ছড়িয়ে আছে মন্ডল বাউরি। আর বাকি মান্ডি কিস্কু হেমব্রম।
শম্ভুর পুরো নাম শম্ভু হেমব্রম। বৈশালীদের সবচেয়ে নিকট প্রতিবেশী। আর সবচেয়ে শত্রুতাও বেশি দুই পক্ষের। শত্রুতা কবে থেকে শুরু হয়েছে কেউ জানে না। তবে শত্রুতা টিকিয়ে রাখতে কেউ পিছপা হয় না কোনও ভাবে।
টুকটুকি নিঁখোজ হবার দু দিন পরে খবরটা পেল বৈশালী। মন্ডলদের এক বৌ কাজ করে আইসিডিএস সেন্টারে। পাড়ার রাস্তায় তার যাতায়াত প্রতিদিন। তার কথাতেই কানে এল, রাস্তার শেষে, যেখানে আসড়া গাছের জঙ্গল সেইখানে নাকি পচা গন্ধ!
৩.
সাদা বেড়াল, যার নাম টুকটুকি তার মৃতদেহ পাওয়া গেল পচা গন্ধ ধরা অবস্থায়। মুখের ভেতরে কালো পচা রক্ত, চোখ খুঁচিয়ে মনি উপড়ানো। প্লাস্টিকের ক্যারি ব্যাগে করে লাশ নিয়ে এল বৈশালী।
আরেক টুকটুকির বয়স পাঁচ বছর শম্ভুর ছোট মেয়ে। বৈশালী তাকে পাকড়াও করে বেড়াল মারার ইতিহাস শুনলো। এবং শম্ভুকে কিছু না বলে থানায় গেল এনিম্যাল ক্রুয়েলিটি এক্টে শম্ভুকে জেল খাটানোর জন্য।
শম্ভু তখন মাছ ভাত খেয়ে আতা গাছের নীচের ছায়ায় বসে মাছের চার তৈরি করছিল।
টুকটুকি হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল, বাবা বৈশালী পিসি বেড়ালটার কথা জিজ্ঞেস করছিল।
‘করুকগা। বেড়ালই মারিছি, মানুষ তো মারিনি।’ বিড়বিড় করে বলে শম্ভু। তারপর মেয়েকে কোলে বসিয়ে বলে – জানিস যে জমিটার উপর তোর পিসির দোতালা বাড়ি সেটা আমাদের ছিল।
টুকটুকি বুঝতে পারে না, দোতালা বাড়ি কীভাবে তাদের থাকতে পারে। সে বলে – বাবা বাড়ি টাও?
– না রে কচি, ওমন বাড়ি কী আমরা বানাতে পারি! বাড়িটা ওদের তবে জমিটা আমাদের। আমার বাপের বাপ লিখে দিয়েছিল নাকি জমিটা। মিথ্যা কথা ওসব। ওদের জমিতে হাল দিত ঠাকুরদা, বুঝলি। লিখা পড়া জানতক না। আগকার যুগের লোক। তা তোর বৈশালী পিসি কী জিজ্ঞেস করলো তোকে?
– জিজ্ঞেস করছিল যে, বেড়ালটাকে আমরা পিটায়ছি কিনা।
– পিটালি দিয়েছি বেশ করিছি। বড়লোক বলে বড্ড দেমাক। বাড়িতে এতোগুলা হাঁসমুরগির বাচ্চা, সব খায়ে ফালাচ্ছে। বলতে গেলে বলে, “বেড়াল আমি পুষবো তাতে যা খুশি তুমি করে নাও। পয়সার লেগে তো মুরগী পোষো তোমার সব হাঁসমুরগীর যত দাম হয় আমি দিয়ে দেবো, যদি বেড়ালে খায়। আমি বেড়াল তোমাদের মতো পয়সার জন্য পুষি না।অবলা প্রাণী, কেউ দেখার নেই তাই পুষি। আমার বেড়াল তোমাদের মুরগী খেতে যাবে না, ওদের জন্য খাবার আসে,মাসে যে টাকা ওদের পেছনে খরচ হয় তা তোমার সারামাসে ইনকাম হয় না।” দেমাগ কী। পয়সার দেমাক, জাতের দেমাক। উঁচু জাত বলে যেন আমাদের সব কিনা রেখেছে। তুমি জাত রাখো তুমার কাছে, আমার কী তাতে!
টুকটুকি বাপের দিকে চেয়ে বিড়বিড় করা শোনে। কিছুই বোঝে না। কিন্তু বৈশালী পিসিকে দেখে কেমন জানি ভয় লাগছিল। কেমন ধমক দিচ্ছিল। বলছিল, বল তোরা মেরেছিস বেড়াল? তোদের কী ক্ষতি করেছে, যে মেরেছিস? তোরা ছোটলোকের জাত, কেবল মেরে খেতে জানিস, সাপ ব্যাঙ যা পাস তাই খাস, তোদের প্রাণে কোন মায়া মমতা নেই?
সত্যি কথা বলতে টুকটুকিরও খারাপ লাগছিল নিথর হয়ে যাওয়া টুকটুকিকে দেখে, কেমন নরম তুলোর মতো। কিন্তু বৈশালীকে দেখে প্রাণ ধুকপুক করছিল তার। যেন আগুন বেরোচ্ছে চোখ দিয়ে । কী জোরে জোরে কথা বলছিল ফোনে কারো সাথে।বলছিল, শেষ করে দিতে মন চাইছে। যেমন করে মেরেছে তেমনি করে চোখ তুলে নি সব কটার। পুলিশ ডেকে সব কটাকে জেল দিব। যাচ্ছি আমি থানায়। আমি ছাড়বো না এদের। ছোটলোক মূর্খ চাষা সব।
৪.
পুলিশ থানার ভেতরে মেঝেতে বসে আছে শম্ভু। একটি চেয়ারে বসে আছে বৈশালী। জনা দুয়েক খাকি উর্দি পরা পুলিশ দলিল দস্তাবেজের মধ্যে কী যেন খুঁজে যাচ্ছে। জনা দুয়েক নীল ইউনিফর্ম পরা সিভিক পুলিশ বাইরে বসে।
বৈশালীর চোখ কেঁদে কেঁদে ফুলে গেছে। তার চোখ জ্বলছে। আগুন ঝরছে।
সিভিক পুলিশের একটি ছেলে এসে বৈশালীকে ডাকলো, ম্যাডাম আপনাকে স্যার ডাকছে।
পুলিশ অফিসার এমন কেস প্রথম পেয়েছেন। জেনারেল ডাইরি নিয়েছেন তিনি কিন্তু বৈশালী চাপ দিচ্ছে এফ আই আর এর জন্য। এফ আই আর নিলে অনেক হ্যাপা, পশু চিকিৎসককে ডাকা, পোস্ট মর্টেম করানো, কেস গড়াবে বহুদূর……
মানুষের জীবনের কত সমস্যা এখনো ফাইল বন্দী। সেখানে বেড়াল মারা! অফিসার মনে মনে একটা বাজে শব্দ উচ্চারণ করলেন। কিন্তু সামনে ইয়াং লেডি, তার সামনে বেশি কিছু বলা যায় না।
‘ দেখুন ম্যাডাম, যে ঘটনাটা ঘটেছে সত্যি কিছু বলার নেই। এমন নিষ্ঠুরভাবে মারা হয়েছে দেখলে বুক কেঁপে উঠে, এরা মানুষ নয় এরা জানোয়ার। ‘
বৈশালী আবার চোখের জল মোছে। বলে – আপনারা এফ আই আর টা নিন, তারপর আমি ওকে দেখবো। জেলের ঘানি যদি না টানিয়েছি তাহলে আমার নাম নেই।
আবার একটা নোংরা শব্দ প্রয়োগ করে অফিসার মনে মনে। মনে মনেই বলে, বিয়ে থা ঠিক সময়ে হলে মাথায় দোষ পড়তো না, বেড়ালের জন্য এসেছে ঢলাতে।
মুখে বলে – ম্যাডাম, অবশ্যই আমি এফ আই আর নেব। তা আপনি জব করেন? বাবা কী করেন?
– বাবা রিটায়ার্ড করছে, রেল কর্মচারী ছিলেন। আমি পরীক্ষার প্রিপারেশন নিচ্ছি। মা সরকারি নার্স। আপনি হয়তো চিনবেন মা কে। কোভিড ভ্যাকসিনের সময় হসপিটালে একবার গন্ডগোল হলো, ক্রাউড সরাতে আপনারা গিয়েছিলেন। ওই ক্রাউডে শম্ভুর দলবল ছিল, ওদের আমাদের উপর কেবল শত্রুতা।
অফিসার মনে মনে হাসেন। নরম জায়গাটাই তো খুঁজছিলেন তিনি।
– হ্যাঁ হ্যাঁ। আরে সেদিন তো আমরা আরেকটু দেরি করলে বিপদ হয়ে যেত। হসপিটাল ভাংচুর হতো। আরে বুঝতেই তো পারছেন সব অশিক্ষিত ছোটলোক চাষার দল। মাথায় কেবল গোবর পোরা। কিছু হলেই গন্ডগোল। আমার বাড়ি শহরে বুঝলেন, এই গ্রামে চাকরির জন্য বাধ্য হয়ে এসেছি। আমারও ভয় লাগে, কিছু হলে থানায় ঝামেলা করতে চলে আসে। আপনাকে একটা রিকুয়েষ্ট আছে, আপনি যদি এফ আই আর টা করেন তাহলে কিছুদিন আপনাদের বাড়িতে পুলিশ প্রোটেকশন নিতে হবে।
বৈশালী হকচকিয়ে যায়, বলে – কেন? পুলিশ প্রোটেকশন কেন?
– আপনার বাড়ির কনডিশন যা শুনলাম, বাই চান্স ধরুন ওরা যদি এই কেস-ফেসের চক্করে রেগে গিয়ে একটা হামলা করে আপনাদের উপর তখন কী হবে? আমাদের একটা দায়িত্ব আছে তো। আপনি একা লেডি। বাবা বয়স্ক, শরীর নিশ্চয়ই খুব ভালো নয়। ওরা যেমন রাগী লোক, যদি অবলা জানোয়ার খুন করতে পারে, তাহলে রেগে গিয়ে আপনাদের উপর যদি কিছু করে বসে!
বৈশালীকে চিন্তিত দেখায়। কপালে ঘাম বিন্দু বিন্দু। সত্যি তো। তাদের বাড়ির সবচেয়ে কাছে ওরায় থাকে।
অফিসার বুঝতে পারে, প্রাণের ভয়ে বেড়ালের জন্য ভালোবাসা যাচ্ছে একটু করে।
বলে – ম্যাডাম আপনি চাইলে এফ আই আর নিতেই পারি, কিন্তু কেস চলবে অনেকদিন। বছরের পর বছর। কবে শাস্তি হবে ঠিক নেই। আর আপনাদের উপস্থিত থাকতেই হবে।
অফিসার একটু অপেক্ষা করেন। তারপর বলেন – তারচেয়ে ম্যাডাম আপনাকে বলি, এফ আই আর টা না করতে। শম্ভুকে আমরা ভালো মতো শিক্ষা দিয়ে দিচ্ছি। আপনি নিশ্চিত হয়ে বাড়ি যান, এমন কাজ আর করবে না।
৫.
একটা ছোট কবরের ছবি। নীচে সাদা কাগজে কালো স্কেচপেনে লেখা, ‘রেস্ট ইন পিস টুকটুকি ‘
ফেসবুকে অজস্র কমেন্টে ভরে গেল বৈশালীর প্রোফাইল। অজস্র সহানুভূতি। অসংখ্য প্রতি উত্তর, পাশে আছি কোন দরকার লাগলে বলবেন।
ঘুম আসছিল না শম্ভুর। ঘটাং ঘটাং করে ফ্যান চলছে। টুকটুকি, তার মা ভাইবোনেরা ঘুমিয়ে আছে নিশ্চিতভাবে। তারা খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল, যখন তাকে সিভিক পুলিশ ডেকে নিয়ে যায়। তাদের এতটুকুই শান্তি, যে ঘরের মানুষ ঘরে ফিরেছে।
শম্ভুর ঘুম আসে না। শম্ভুর ঘুম আসে না কেন, শম্ভু বুঝতে পারে না। বেড়ালটির কথা মনে পড়ে, আদুরে চোখগুলো ভাসে সামনে, বড়লোকদের আদুরে বেড়াল। কোনদিন তাদের মতো খাবারের চিন্তা করতে হয় না।
শম্ভুর অফিসারের দেওয়া গালাগালিগুলো কানে বাজে। নিজেকে পশুপাখির চেয়েও ইতর লাগছিল তখন।
বাইরের মাচায় বসে শম্ভু আকাশ পাথাল ভাবতে থাকে। সামনে বৈশালীদের বাড়ি। আলো জ্বলছে না কোন ঘরে। হয়তো সবাই নিশ্চিতভাবে ঘুমাচ্ছে। শুধু সে ঘুমাতে পারছে না। একটা বেড়ালের চেয়েও অধম লাগছে নিজেকে ।