১.
ইনসেস্ট প্রহিবিসনের (Incest Prohibition) মধ্য দিয়ে গড়ে উঠে পারিবারিক স্নেহ ও বাৎসল্যভাব। সভ্যতা মানুষের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করে বিধি ও শৃংখলাব্যবস্থার অধীন করে। এই ‘বিধির বিধানেই’ গড়ে উঠে পরিবার আর সমাজ।ফ্রেডরিক এঙ্গেলস লুই মর্গানের গবেষণা থেকে দেখিয়েছেন, পরিবার,আমরা বলতে পারি বাৎসল্যও, কোন শ্বাশ্বত প্রতিষ্ঠান বা অনুভব নয়,বরঞ্ছ ইতিহাসের গতিধারায় বর্তমান রূপ ও চেহারা প্রাপ্ত, এবং উৎপাদন সম্পর্কের সাথে যুক্ত। পরিবারস্থ পিতা-পুত্র,পিতা-কন্যা, মাতা-পুত্র বা মাতা- কন্যা বা ভাই-বোনদের মধ্যে যে স্নেহ ও ভালোবাসার আর্দ্র সম্পর্ক গড়ে উঠে তা যতটা না প্রাকৃতিক, আরো বেশি তা সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক। সন্তান কামনা ও সন্তানের মঙ্গল প্রার্থনার সাথে যোগ আছে যেমন জৈবিকতা ও বাৎসল্যের ‘স্বাভাবিক’ ও মনস্তাত্ত্বিক কারণের; তেমনি, যোগ আছে ধর্ম ও ক্ষমতারও। বিশ্বের অনেক সাহিত্য কর্মেই বাৎসল্যের নানা অবয়ব দেখা যায়। সুক্ষবিবেচনায় ধরা পরে সম্পর্কের ভেতরকার সমাজ-মনোতত্ত্ব। মহাভারতের ধৃতরাষ্ট্র শুধু আক্ষরিক অর্থেই অন্ধ ছিলেন না, পুত্রস্নেহেও তিনি অন্ধই ছিলেন। শতপুত্রের জনক তিনি; তার আশা, তার সন্তান ও কুরুবংশই হবে রাজত্বকারী,তার সন্তানেরা টিকিয়ে রাখবে তার ক্ষমতা, ও তার সন্তানদের মধ্য থেকেই হবে ক্ষমতার উত্তরাধিকারী। বাৎসল্যের সাথে এখানে দেখতে পাই ক্ষমতার অনুসঙ্গ। শেক্সপীয়ারের কিং লিয়ার তাঁর তিন কন্যাকেই ভালোবাসেন। বার্ধক্যে লিয়ারের জানার ইচ্ছে হয় কোন কন্যা তাকে কতটা ভালোবাসে। পিতৃ-ভালোবাসার কপট স্তুতিতে অন্ধ হয়ে লিয়ার রাজত্ব দান করেন রিগান ও গনেরিলকে,আর কর্ডেলিয়ার সত্যি পিতৃভক্তির সরল প্রকাশ লিয়ারকে তৃপ্ত করতে পারেনি বিধায় সে রাজত্বের ভাগ থেকে বঞ্চিত হয়।রাজ্য কন্যাদের ছেড়ে দিয়েও লিয়ারের যায় না রাজকীয় বিলাস-ব্যসনের সাধ ও বাসনা। রাজ্য ছেড়ে দিয়েও তিনি রাজাই থাকতে চেয়েছেন,পিতা হতে পারেননি যেন-বা। বাৎসল্যের ভুল অভিমুখ এবং লিয়ারের সত্তায় পিতা ও রাজার দ্বন্দ্ব রচনা করেছে এ নাটকের বিয়োগাত্মক পরিণতি। বাৎসল্য যে সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যাগত তা টের পাওয়া যায় “ইদিপাস” নাটকে। জোকাস্টা ও ইদিপাস স্বামী-স্ত্রী হিশেবে বসবাস করে এই সত্য না জেনেই যে, তারা আসলে মা-ছেলে। যখন সত্য উন্মোচিত হয়,জোকাস্টা আত্মহননের পথ বেছে নেয়,আর ইদিপাস নিজেকে করে ফেলে অন্ধ। জোকাস্টা তার স্বভাবজ ও প্রাকৃতিক মাতৃত্বের অনুভবে ইডিপাসকে চিনে নিতে পারেননি। লাইউসও চৌরাস্তার মোড়ে পরিত্যক্ত পুত্র ইদিপাসকে দেখে বাৎসল্যরসে অভিভূত হননি। ঘটনা-পরম্পরায় ইদিপাসের মা-ই হয়েছে তার স্ত্রী,আর সন্তানরা হয়েছে পিতার ভাই-বোন। সম্পর্কের বিচিত্র জটাজালে ইডিপাস ত্রস্ত ও কাতর।তবুও,ইডিপাস তার কন্যাদেরকে আকুল হয়ে ডেকে বলে, ধরো তোমাদের এই ‘পিতা’ ও ‘ভ্রাতার’ হাত। এভাবেই বাৎসল্য যুক্তি আর অযুক্তি,প্রাকৃতিক আর সাংস্কৃতিক-এর মাঝামাঝি অবস্থান করে।
পিতামাতা ও সন্তানের সম্পর্ককে ঐশ্বরিকতা দ্বারাও বিভুষিত করা হয়। বৈষ্ণবশাস্ত্রের প্রধান চার রসের একটি বাৎসল্যরস।নন্দ ও যশোদা শ্রীকৃষ্ণকে পায় বাৎসল্যভাবে। খৃষ্টধর্মে যিশুখৃষ্টকে বলা হয় “সান অব গড”। ইসলামে নবীর স্ত্রীগণকে বলা হয় “উম্মুল মুমিনিন” বা বিশ্বাসীদের মাতা,যাদেরকে মুমিনদের জন্য স্ত্রী হিশেবে গ্রহণ করাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এইভাবে,বাৎসল্যভাব পেয়েছে পূণ্য ও পবিত্রতার ভাব।
প্রাচীন এথেন্সে কন্যার ব্যাপারে পিতার সর্বাত্নক অধিকার স্বীকৃত ছিল। পিতাকে বিবেচনা করা হত কন্যার স্রষ্টা।শেক্সপীয়ারের “মিডসামার্স নাইট’স ড্রীম” নাটকে ইজিয়াস তার কন্যা হার্মিয়াকে ব্যক্তিমানুষ ভাবেন না, ভাবেন নিজের অধিগত বস্তু ও সম্পত্তি : “As She is mine,I may dispose of her”। হার্মিয়া হয় পিতার পছন্দমত পাত্রকে বিবাহ করবে নয়তো ফাঁসিতে ঝুলবে। এথেন্সের প্রাচীন আইন এইক্ষেত্রে ইজিয়াসের সহায়। এথেন্সের রাজা থিসিয়াসও বলে:
To you your father should be as a god,
One that composed your beauties, yea, and one
To whom you are but as a form in wax,
By him imprinted and within his power
To leave the figure or disfigure it.
কন্যা পিতার সৃষ্টি, ও তার হাতের মোমের পিন্ড যেন, যাকে পিতার অধিকার আছে নিজ হাতে নিজের ইচ্ছেমত আকৃতি দেবার, বা বিকৃত করবার। দেখা যাচ্ছে, পিতৃতান্ত্রিক অনুভবের সুরক্ষা দিচ্ছে এখানে রাষ্ট্র ও আইন। যদিও শেক্সপীয়ার অনন্য শৈল্পিক প্রতিভায় দেখান যে, পিতার বিপরীতে রাজার হস্তক্ষেপে হার্মিয়া নিজের পছন্দের পাত্রের সাথেই বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সুযোগ লাভ করে। যদিও,পিতার বাসনা মতোই গড়ে উঠবে কন্যা, এবং নিজের বাসনার বলি দিয়ে পুর্ণ করবে পিতৃত্বের ইগো—সামন্ত সমাজের এটাই অন্যতম মুল্যবোধ। রোলা বার্ত তাঁর “মিথোলজিস” বইতে যা যা আধিপত্যশীল সংস্কৃতির দ্যোতক, যা আমাদের অনুভূতিতে প্রায় স্বাভাবিকীকৃত হয়ে আছে এবং যাকে মনে হয় এপলিটিকাল ও নন-আইডিওলোজিকাল তাকে “Exnomination” পদটি দ্বারা প্রকাশ করেছেন। পিতৃতন্ত্রও এমনই এক ‘নর্ম’ যেটি অনেক সময়ই দৃষ্টির অগোচরে প্রশ্নহীন থেকে যায়। প্যাট্রিয়ার্কির উপস্থিতি প্রায়শই টের পাওয়া যায় না বলে এটির পরিব্যপ্ত ক্ষমতা ও অবস্থানকে প্রশ্ন করাও দুরূহ হয়। উপরোক্ত আলোচনায় বাৎসল্যের যে বিবিধ মুহুর্ত ও প্রেক্ষিত আলোচিত হলো তা ইয়েটস ও আজাদের কবিতাদ্বয়েও লভ্য।
২.
একই শিরোনামে হুমায়ুন আজাদ ও ডব্লিউ বি ইয়েটসের দারুণ উপভোগ্য দু’টি কবিতা রয়েছে। কাব্যশরীরে লেপ্টে থাকা উপমা-রূপক ও ভাষার ললিত আবেগের তলদেশে কীভাবে অন্ত:সলিলা প্রবাহের মত বয়ে চলে চিন্তা-মতাদর্শ, সামাজিক বাস্তবতা, ও রূপান্তরিত সমাজের বিবিধ মুহুর্ত—তা উচ্চকিত করে তুলতে পারে এ কাব্যদ্বয়ের একত্র-পাঠ।ভালো কবিতা বোঝার আগেই হৃদয়ে সঞ্চারিত হয়,এলিয়টীয় এই বাণী মনে রেখেও বলা যায়, যেকোন কবিতার বহুকৌণিক পাঠ কাব্যপাঠের আনন্দকে বৃদ্ধি করে বৈ হ্রাস করে না। আমাদের আলোচ্য কবিতাদ্বয় সিক্ত আত্নজার জন্য জনকের স্নেহসুধায় ও বাৎসল্যভাবে। কিন্তু সেই স্নেহ-বাৎসল্যের অপূর্বতাকে ব্যবচ্ছেদ করলে আবিষ্কৃত হয় আধুনিকতার উন্মুলতা, সামন্ত সুরক্ষার বোধ আর পিতৃতান্ত্রিকতার কোমল-কঠিন সুক্ষ বুনন আর উন্মোচিত হয় ‘চিরায়ত ও সাময়িক’-এর বা ইউনিভার্সাল আর টেম্পোরালের অম্ল-মধুর সম্মন্ধ।
W.B Yeats এর A Prayer For My Daughter অনুসরণে হুমায়ুন আজাদ লিখেছিলেন “আমার কন্যার জন্য প্রার্থনা” কবিতাটি। ইয়েটসে দেখি পিতার স্বপ্নের আদলে কন্যার জীবন গড়ার আকুতি, দোলনায় শায়িত শিশুকন্যার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ। পিতার কণ্ঠই প্রধান এ- কবিতায়। কিছুটা ইতিহাস, কিছুটা পুরাণ, আর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপট মিশিয়ে ইয়েটস তার আত্নজাকে ঘিরে প্রার্থনা বুনেছেন। ইয়েটস প্রচলপন্থী। তিনি প্রথার অনুশাসন মেনে চলার পক্ষে। ইয়েটস চান তাঁর কন্যার বিয়ে হোক অভিজাত ও বংশীয় পরিবারে যেখানে মেনে চলা হয় “Ceremony” এবং “Custom”। তাঁর কন্যা হোক বিনয়ী,স্নিগ্ধ,ব্যক্তিত্ব সুদৃঢ় ও আচার পালনে নিষ্ঠ। রূপ নয়, গুণে জয় করবে সবার হৃদয় সে। একটা সুন্দর পরিবার তাঁর কন্যার এ-সদগুণগুলোকে লালন করবে,বিকশিত করবে, এই প্রার্থনা ও বিশ্বাস ইয়েটসের। রূপ মাত্রই ট্র্যাজিক, রূপসীমাত্রই একা, বন্ধুবিহীন। ইয়েটস ইশারায় নিয়ে আসেন গ্রীক পুরাণের দুই চরিত্র—হেলেন ও আফ্রোদিতিকে। Beauty এর বেদনা ও বদনামের প্রসঙ্গ তুলে তিনি যেন উপস্থাপন করেন এক ‘পিতৃতান্ত্রিক সত্য’। পিতৃহীন (Being fatherless) আফ্রোদিতি বিয়ে করে দেবতাদের অস্ত্র-কারিগর খোঁড়া হেফাস্টাসকে, পরবর্তীতে যাকে সে ছেড়েও যায়। হেলেন পায়নি বিবেচক স্বামী। প্যারিস খেয়ালী, মেনেলুস অথর্ব এক। তারা হেলেনের জীবনকে ভরে দিয়েছে সংকটে ও সন্ত্রাসে। পিতার অভিভাবকত্ব আর স্বামীর বিবেচনাবোধই যেন নির্মাণ করে নারীর সুখ ও সৌভাগ্য। যুদ্ধদিনে বা আসন্ন যুদ্ধের দামামা কল্পনায় ইয়েটস বাৎসল্যের উৎকণ্ঠা নিয়ে তার কন্যার জন্য প্রার্থনারত। তিনি চান তাঁর কন্যার নিস্পাপ কোমল হৃদয়,ঘৃণামুক্ত অন্তর। ইয়েটস তাঁর কন্যাকে শেখান:”An intellectual hatred is the worst”। ইয়েটস যখন কন্যার জন্য প্রার্থনা করেন, তখন আবডালে ছায়াপাত করেন তাঁর এক বাঞ্ছিত নারী যার নাম মড গন (Maud Gonne)।আইরিশ বিপ্লবী মড গন; বৈপ্লবিক উপায়ে ও সশস্ত্র লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে তিনি আয়ারল্যান্ডকে স্বাধীন করতে চান ব্রিটেনের অধীনতা থেকে। ইয়েটসের পুন:পুন বিবাহ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এই নারী। হয়তো-বা ইয়েটস যথেষ্ঠ জাতীয়তাবাদী ছিলেন না কিংবা তাঁর প্রত্যাখ্যান ইয়েটসের কাব্যের জন্য আশির্বাদ বয়ে আনবে এই বিবেচনায় ইয়েটসের পাণিগ্রহণ করেননি মড গন। ইয়েটসের বহু কবিতায় ফিরে ফিরে এসেছেন মড গন। তিনি ছিলেন অগ্নিদীপ্ত রূপের অধিকারিণী আর বিচিত্র অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ এক নারী। সংগ্রামী, যুদ্ধংদেহী।ইয়েটস নিজ কন্যাকে যেন স্থাপিত করেন তাঁর প্রেমাস্পদ মড গন-এর বিপরীত কোটিতে। যখন ইয়েটস বলেন:
“May she be granted beauty, and yet not Beauty to make a stranger’s eye distraught“ তখন আমরা বুঝে যাই ইয়েটস তার কন্যার জন্য চান না এমন ধাঁধাঁলো রূপ যা বিভ্রান্ত করবে পথিকের দৃষ্টি, যেমনটি ইয়েটস মজেছিলেন মডের রূপে। দুই স্বামীর সাথেই বিবাহবিচ্ছেদ ও পুত্রের মৃত্যুতে এই বিপ্লবী নারীর জীবন হয়েছিল ট্র্যাজেডিরই নামান্তর। মডের প্রথম স্বামীর ঔরসজাত কন্যা ২৩ বছর বয়সী ইসিউল্ট (Iseult)কেও ৫২ বছর বয়সী ইয়েটস বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। যাহোক, ১৮৮৯ সালে ইয়েটসের সাথে দেখা হয় মড গনের আর “অ্যা প্রেয়ার ফর মাই ডটার” কবিতাটি রচিত হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর পর ১৯১৯ সালে, ইয়েটসের কন্যার জন্ম বছরেই। মড গনের স্বভাবের কঠোরতা থেকে মুক্ত থাকুক তাঁর কন্যা এই যেন চাওয়া ইয়েটসের। বিপ্লবে ও বিক্ষোভে ঘৃণা ইতিবাচক শক্তি হিশেবেই পরিগণিত। কিন্তু, ইয়েটস তাঁর কন্যার ঘৃণামুক্ত মন চান কারণ তিনি ঘৃণাকে মনে করেন সমস্ত অশুভের সর্দার। যে মানুষের মন ঘৃণাবিমুক্ত, সে তার আদিম নিষ্পাপতাকে রক্ষা করতে পারে যেকোন লাঞ্ছনা ও দুর্বিপাক থেকে। ইয়েটসের প্রার্থনায় তার কন্যা হয়ে উঠে তাঁর প্রেমাস্পদ মড গনের বিপরীত। প্রেমিকার স্মৃতি ও কন্যার শুভ’র আকাংখা— এই দুয়ের ডায়ালজিক অবস্থানও এ কবিতার অন্যতম শক্তি।
অন্যদিকে, আজাদ নিজের চেয়েও কন্যার উপস্থিতিকে অধিক সরব ও দৃশ্যমান রাখেন। তুলে ধরেন ষোড়শী হতে যাওয়া কন্যার বয়োঃসন্ধিকালের নিভৃত অভ্যাস ও আহ্লাদ। দু’টি কবিতাতেই টের পাওয়া যায় পিতার উদ্বেগ, আকুলতা। অশ্রুসিক্ত আখি, অস্থির উৎকণ্ঠা। আর, বিয়েতেই নারীর মোক্ষ এই অগোপন ভাবনা। কবি ভাবছেন, তাঁর কন্যা হয়তো মাড়িয়ে যাবে তার পদতলে বিছিয়ে দেয়া কোন যুবকের স্বপ্ন, আর যুবকটি কোন নির্জন কক্ষে পুড়তে থাকবে “নিজস্ব নির্মম অগ্নিতে”। ইয়েটস যখন কল্পনা করেন তাঁর কন্যার বিয়ে হবে বিত্তবান, ঐতিহ্যবাহী পরিবারে এবং তাঁর কন্যা পাবে সুখী, শান্তিময় জীবন, অন্যদিকে তখন আজাদ আশংকা করেন:
“আমার কন্যা যার ফ্ল্যাটে উঠবে, সে কি তার মন পাবে?
জয় করে নেবে তাকে? নাকি রঙিন টেলিভিশন দেখার সুখ পাবে
ঝলমলে ড্রয়িংরুমে বসে? রেডিয়োগ্রামে
কড়া বাদ্য বাথরুমে জল
বন্ধুর বক্ষলগ্ন লিপস্টিকে আলোকিত গোধূলিতে
বার বার বক্ষ থেকে খসে পড়বে সোনালি আঁচল।”
ইয়েটস তার কন্যাকে পথ দেখান, এবং আশা রাখেন সুন্দর ও সুস্থ পরিবারের। আজাদ হাহাকার করে উঠেন: “আমার কন্যার ঘর ভেঙে যাবে প্রাত্যহিক সামান্য বাতাসে”। ইয়েটসে কন্যার আছে গাইড, সুপথ বোঝাবার আপনজন। অন্যদিকে আজাদ প্রশ্নশীল:
হে আমার বন্ধ্যা কন্যা, অন্য কোনো হাত
তোমাকে কি তুলে নেবে মধ্যরাতে ভাসমান উৎসবস্রোত থেকে?
শেখাবে কান্নার অর্থ? বোঝাবে গভীর স্বরে
রোদনের চেয়ে সুখ নেই লবণাক্ত সবুজ মাটিতে?
বলবে মোমের আলো সর্বাত্মক গাঢ় অর্থময়
দ্বৈতশয্যা রচে যাচ্ছে দুই হাতে সৌর সময়।
সময় যেন বুনে যাচ্ছে এ কবিতার কথকের কন্যার জন্য সুখ ও দুঃখের দ্বৈত শয্যা। কবি জানেন, নাগরিক জীবনের উৎসবস্রোতে সুখ নেই; তার চেয়ে মোমের আলোয় ক্রন্দন গুঢ় অর্থময়। আধুনিক জীবনের বৈশিষ্ট হিশেবে নাগরিক জীবনের অনিশ্চয়তা ও উন্মুলতার যে কথা বলা হয় তার আছে ইশারা এই কবিতার। “এ দেশ বদলে যাচ্ছে” বলে আজাদের কবিতায় মৃদু হাহাকার আছে, গৃহের প্রতি উচাটন মন আছে, “বাংলার মেয়েরা আজ রান্না জানেনা” বলে আলতো দীর্ঘশ্বাস আছে। প্রযুক্তির বিকাশ আমাদের অর্গানিক জীবনের অনেকাংশকেই করেছে বিপর্যস্ত। ফ্রিজ ধরে রাখছে ‘ঠান্ডা দিঘি’ ও ‘সজীব শব্জি ক্ষেতের স্মৃতি’। ঘরের মানুষের মন না পেয়ে তাঁর কন্যা হয়তো বক্ষলগ্না হবে কোন বন্ধুর। কন্যা হারিয়ে ফেলবে স্থায়ী-অস্থায়ী সবগুলো নিজস্ব ঠিকানা। নারকীয় নাগরিক জীবনবোধ ও শেকড়হীন হয়ে যাওয়া ক্রমাগত প্রক্রিয়ার শিকার হতে পারে তাঁর কন্যা, এই আশঙ্কা পিতার। কন্যার বেড়ে উঠার নিবিড় ও আন্তরিক বর্ণনা আছে আজাদের কবিতায়।
ইয়েটসের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, তার ইতিহাসবোধ ও পুরাণচেতনাই তাঁর কন্যাকে নিয়ে তাঁর প্রার্থনার ভিত্তিভুমি। “সেকেন্ড কামিং” কবিতায় ইয়েটসের ইতিহাস বোধের হদিস মেলে। ইতিহাস, তাঁর মতে, এক বিশৃঙ্খলা থেকে এগিয়ে যাচ্ছে আর বিশৃঙ্খলার দিকে। তাই তিনি তার শিশুকন্যার ভবিষ্যত নিয়ে শংকিত, প্রথম মহাযুদ্ধ যদিও-বা শেষ হয়েছে কিন্তু তার শঙ্কা নতুন কোন যুদ্ধের আসন্ন সম্ভাবনায়। পৌরাণিক জগতেও তিনি দেখেছেন, রূপের বিপদ, নারীর অরক্ষিত-ভঙ্গুর অবস্থা। আর, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায়, যেটির অন্যতম রূপকার মড গন, তিনি জেনেছেন বৈপ্লবিক ঘৃণার চর্চা কত বিরহ-বিচ্ছেদ, মৃত্যু ও যাতনার কারণ হয়ে আসে। তাই তিনি তাঁর কন্যাকে নিরাপদ ও সুখী জীবনে দেখতে ব্যাকুল। এই সুখ কিন্তু কারো দ্বারা প্রদত্ত হবে না, তা হবে তাঁর কন্যার অর্জিত, শুভচিন্তা, দৃঢ়তা,ও নানা গুণপনা দ্বারা প্রাপ্ত। কন্যার এজেন্সি তৈরি হবে সামন্ত সুরক্ষার বৃত্তে বসবাস করে সুখী হওয়ার নিমিত্তেই যেন! ইয়েটসের কবিতাখানি যেন বলে দেয়: প্রেমিক বিপ্লবী হতে পারে, জনকেরা নয়। বিশৃঙ্খল ও নৈরাজ্যময় পৃথিবীতে কলুষতা থেকে বাঁচবার একমাত্র উপায় নিষ্পাপতার চর্চা। আত্ম-আনন্দে মগ্ন হয়ে পৃথিবীর জঞ্জাল থেকে গা বাঁচিয়ে চলবার শিক্ষা দিচ্ছেন পিতৃদেব। কলুষমুক্ত ব্যক্তিজীবনই সন্তানের রক্ষাকবচ।
যদি বিবেচনায় আনি সুকান্ত ভট্টাচার্যের “ছাড়পত্র” কবিতাটি, তবে, দেখা যাবে, কথকই দায়িত্ব নিচ্ছেন এখানে পৃথিবীর জঞ্জাল সাফ করবার। প্রতিজ্ঞা করছেন:
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি—
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গিকার।
অবশেষে সব কাজ সেরে
আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে
করে যাব আশীর্বাদ,
তারপর হব ইতিহাস
এ কবিতায় কথক নবজাতকের ভবিষ্যত করণীয়ের তালিকা করছেন না, তিনি শিশুর প্রথম চিৎকার ও উত্তোলিত মুষ্ঠিবদ্ধ ক্ষুদ্র হাতের ভেতর দেখেন “অধিকার”-এর দাবি। সুকান্তর কবিতায় অভিভাবক বিপ্লবী এক, যিনি সন্তানের ভেতরেও চাড়িয়ে দেন অধিকারের বিপ্লবী বাণী। আমাদের আলোচ্য কবিতাদ্বয়ে স্থিতাবস্থাকে হাহাকারে মেনে নেওয়া ও খাপ খাইয়ে নেয়ার কাব্যিক সম্মতি আছে।
ইয়েটস ও আজাদের দু’টি কবিতাতেই কোন না কোন ভাবে জনকের প্রেমিক সত্তা উপস্থিত হয়, বা উঁকিঝুঁকি দেয়। ইয়েটসে তো বটেই। আজাদেও। যে প্রেমিক তাঁর কন্যার মনোযোগ না পেয়ে দগ্ধ আজাদ তাঁর কন্যার সেই কাল্পনিক প্রেমিকের বেদনাকে নিজ বুকে যেন ধারন করেন। এক্ষেত্রে ইয়েটসও আজাদের সহায় হন, প্রচ্ছন্নে। আজাদ যখন বলেন:
কোনো যুবক এসে তার স্বপ্নাবলি
বিছিয়ে দিয়েই যাবে তার পদতলে
আমার কন্যা তার স্বপ্ন বুঝবে না কোনো দিন বুঝতে চাইবে না…
তখন ইয়েটসের সেই বিখ্যাত পংক্তিমালা:
I have spread my dreams under your feet;
Tread softly because you tread on my dreams -এর অনুরণন শোনা যায়। দু’কবিতার ক্ষেত্রেই আর যেটি বিবেচ্য সেটি হচ্ছে, কন্যাতো তো শুধু কন্যা নয় সে নারীও, আর যিনি জনক তিনি তো শুধু পিতা নন, পুরুষও। তাই জনক যখন কাব্যে অভিভাষণকারী তখন, ফ্রয়েড মশায়ের ভাষা ধার করে বলি, তার ব্যক্তিপুরুষসত্তার প্রক্ষেপণ বা প্রজেকশন ঘটবেই অভিভাষিতের অনুসঙ্গে।
ঈশ্বরী পাটনী দেবী অন্নদার কাছে তার সন্তানের জন্য প্রার্থনা করেছিল “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে”। খেয়েপরে বেঁচে থাকুক সন্তান, এই প্রার্থনার বাইরে আর কোন প্রার্থনা ছিল না ঈশ্বরী পাটনির। কাল ও শ্রেণিগত সীমাবন্ধতার কারণেই ক্ষুন্নিবৃত্তির বাইরে অন্য কোন মহৎ জীবনের প্রার্থনা তিনি করেননি। আজাদ ও ইয়েটসের প্রার্থনাও তাদের কাল, অব্যবহিত পরিপার্শ্ব ও মতাদর্শ নির্মিত।
কাহলিল জিব্রান তার “অন চিল্ড্রেন” কবিতায় পিতাকে (বা মাতা,বা উভয়কে) যে পরামর্শ দিয়েছেন তা যেন আমাদের আলোচ্য দুই কবিতার এক সিন্থেসিস রচনা করে। এই কবিতা উচ্চকিত করে তোলে সন্তানের কর্তাসত্তা, ও স্বাধীনতা, ও স্বাতন্ত্র্য। সন্তান পিতামাতার মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে আসলেও তারা তাদের সম্পত্তি নয়। তারা ক্রমঅগ্রসরমান জীবনাকাঙ্খার সন্তান:
Your children are not your children.
They are the sons and daughters of Life’s longing for itself.
জীবনের প্রবাহ ও গতিই চালিত করবে তাদের। পিতার অমোঘ বাসনা বা আদেশ তাদের চালক ও নিয়ন্ত্রক নয়। কাহলিল জানাচ্ছেন, আমরা ভালবাসা দিব আমাদের সন্তানকে কিন্তু চাপিয়ে দিব না আমাদের চিন্তাকে। কারণ ভুল-ত্রুটি, অভিজ্ঞতা ও পরিপার্শ্ব থেকে তারা নিজেরাই অর্জন করে নিবে তাদের জীবনবীক্ষা ও জগতদৃষ্টি। পিতামাতা সন্তানের দেহের জন্য দিতে পারে গৃহ, কিন্তু তাদের আত্মার অধিবাস ভবিষ্যতে, আর ওই ভবিষ্যত- ভ্রমণে পিতা অক্ষম, পিতা স্বপ্নেও হদিস পাবে না সন্তানের দূরগামী মনের খবর। সন্তান হচ্ছে পিতার ধনুক থেকে ছুটে যাওয়া তীর। পিতা শুধু দেখে যেতে পারে ক্রমে অসীমের দিকে ধেয়ে যাওয়া ঐ ধনুর্বাণ। ইয়েটসের “A Prayer For My Daughter” এর ৩/৪ বছর পর লেখা কাহলিল জিব্রানের এই কবিতা। যেন-বা ইয়েটসের কবিতার বিপরীত এক বয়ান এই কাব্য।
৩.
আজাদ, তাঁর কবিতায়, কন্যাকে অনেক বেশি ‘অটোনমি’ দিয়েছেন, ইয়েটসের কবিতার তুলনায়। ইয়েটসে যেখানে পিতার বাসনাই প্রধান, আজাদে সেখানে নারীর ‘হয়ে উঠা’ গুরুত্বপূর্ণ হয়। আজাদের কবিতায় পিতা অবলোকন করছেন, আর কন্যা ‘করণ’ করছেন। ইয়েটসের কবিতায় কন্যা ঘুমন্ত।আজাদের কবিতার শেষ অনুচ্ছেদে “অন্য কোন হাত” শব্দদ্বয় যে অস্পষ্টতা রচনা করে তা এ কবিতার শক্তি বটে। এই “অন্য কোন হাত”, যে মুক্ত করবে কন্যাকে ও তাকে জীবনের গভীরতর অর্থ বোঝাবে, হতে পারে অন্য কোন পুরুষ, হতে পারে কন্যার মাতা বা তাঁর অভিজ্ঞতাও। কন্যাকে নিয়ে আজাদীয় পিতার উৎকণ্ঠার কারণ হিশেবে সমাজে পুরুষতন্ত্রের হাজির-নাজির থাকার বোধ থাকা সম্ভব, থাকা সম্ভব পিতার ‘স্বভাবজ’ উদ্বেগও। তবে, এটা ঠিক, পুরুষের অনুভব মাত্রই পুরুষতন্ত্র নয়।
কবিতা দু’টিতে সামন্ত সুরক্ষার বোধ, আধুনিকতার উন্মুলতা, পুরুষতান্ত্রিকতার সুক্ষ বুনন প্রসঙ্গ আপাতত তুলে রাখলেও যা থাকে, তা হচ্ছে, পৃথিবীর দুই প্রান্তের দুই ভিন্ন সময়ের কবি ও পিতা তাদের কন্যাকে নিয়ে যে-আশংকা প্রকাশ করেছেন তাতে উদোম হয় নারীর জন্য অনিরাপদ এক পৃথিবীর ছবি, নারীর বিকাশের এক অনুপযুক্ত প্রতিবেশের বয়ান, এবং নারীর অরক্ষিত জীবনের দ্বৈত শয্যা। সাথে আছে, পিতার চিরন্তন ব্যাকুল হৃদয়, বাৎসল্যের ফল্গু। কবিতা দু’টো যদি হতো কোন মাতার প্রার্থনা তাদের কন্যাকে নিয়ে, তবে অবশ্যই কাব্যদ্বয়ের সুর ও স্বর ভিন্ন হতো। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে, ওরিয়ানা ফালাচির উপন্যাসিকা “Letter To A Child Never Born” যেখানে এক মা তার গর্ভস্থ অনাগত শিশুর সাথে কথোপকথনে তুলে আনেন জীবনের নানা যন্ত্রণা ও কদর্যতা ও অনুভব করেন নিজ শরীরে ধীরে ধীরে সন্তানের বেড়ে উঠা। দুটো কবিতা ও প্রাসঙ্গিক আলোচনার মধ্য দিয়ে এ নিবন্ধে আমরা দেখাতে চেষ্টা করেছি, কবিতার শরীরে ও অনুভূতি কাঠামোয় কীভাবে আলগোছে লুকিয়ে থাকে আমাদের সংস্কৃতি-সমাজ ও সভ্যতা বিকাশের নানা অনুসঙ্গের ইতিহাস এবং চিন্তা ও মতাদর্শের ছিটেফোঁটা। সংস্কৃতি বা চিন্তার ইতিহাসের অনুসঙ্গে পাঠ না করে নিরেট কবিতা হিশেবে পাঠ করলেও এ কাব্যদ্বয় উপভোগ্য, এবং ফরস্টার কথিত সাহিত্যের ‘এক্সপানসন’ অর্থাৎ পাঠ শেষে পাঠের যে অনুরণন ও সম্মোহন থাকে, তাও এ কবিতাদ্বয় থেকে লভ্য।