Home » বাঁকা পাঁজরের মেয়ে (পর্ব সতেরো ) // নুরুদ্দিন ফারাহ, অনুবাদ: লুনা রাহনুমা

বাঁকা পাঁজরের মেয়ে (পর্ব সতেরো ) // নুরুদ্দিন ফারাহ, অনুবাদ: লুনা রাহনুমা

২৮

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠার পর ইবলা অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ে। রাতে একটি খারাপ স্বপ্ন দেখেছে। আজ সকালের সূর্য মারাত্মক উজ্জ্বল। ইবলার কল্পনায় আজ প্রকৃতির আত্মবিশ্বাস আগের চেয়ে দৃঢ়, আর তাই সূর্য নিজের বীরত্ব এবং উজ্জ্বলতাকে এতো সহজভাবে মেলে ধরেছে মানুষের কাছে। ইবলার কাছে মনে হলো সে প্রকৃতির খোলা উঠানে হেঁটে এসেছে এবং প্রকৃতি এখন ওর মুখে একটি থাপ্পড় বসিয়ে দিবে, পিছন থেকে সজোরে মারবে বিষাক্ত খঞ্জর, কিংবা তাকে আজীবনের জন্য দাঁড় করিয়ে রাখবে প্রকৃতির সন্তানদের পিছনে। এখন থেকে এই প্রকৃতি সব সময় তাকে অন্যদের থেকে পিছিয়ে রাখবে, এমন একটা অনুভূতি জন্মায় ইবলা মনে। জীবনের জন্য অপরিহার্য এবং মৌলিক আত্মতৃপ্তির বিষয়গুলো যদি কেউ না পেয়েই জীবন কাটিয়ে যায়, তবে সেটি আসলে বেঁচে থাকার অস্তিত্বে প্রহসন ছাড়া আর কিছু নয়। জীবন হচ্ছে একটি পোশাকের মতো (কী এক উপমা!) এবং মানুষের অবস্থার পরিবর্তন মানুষের পোশাক পরিবর্তনের মতোই। চিরকাল একই পোশাক পরে থাকতে হলে সেটি হতো মানুষে জন্য খুবই একঘেয়ে ব্যাপার। ‘আমরা যতটা ভাবি, জীবন আসলে তার চেয়ে সহজ,’ ইবলা সিদ্ধান্তে আসে, জীবন-মুখের দিকে মুখ করে মৃদু হাসে একবার, এখন যে ঘরে আছে এই ঘরটি প্রতিবিম্বিত করছে যে জীবন-মুখ। ‘শুধু আমরাই জীবনকে বুঝতে পারি না, অথবা আমরা জীবনকে ভুল ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি,’ জোরে শব্দ করে কথাগুলো বলে ইবলা।

হাত দিয়ে ইবলা নিজের শরীর স্পর্শ করে। চাদরের নিচে তার নগ্ন দেহ; নিজের লিঙ্গটিতে একটা হালকা আঁচড় দেয়, তারপর হা হা করে হাসে। ‘এটি আমার সম্পদ, আমার একমাত্র ধন, আমার মাটির ব্যাঙ্ক, আমার অর্থ, আমার অস্তিত্ব।’ লিঙ্গের উপর হাতটি রেখে কিছুক্ষণ সেটিকে অনুভব করে ইবলা। ভাবে, বোকা পুরুষদের সাথে বিছানায় অরুচিকর খেলা খেলতে খেলতে সে কি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। লিঙ্গের জায়গাটা একটু স্যাঁতসেঁতে হয়ে আছে। তারপর ইবলা ধীরে ধীরে হাতটিকে পেটের দিকে তুলতে থাকে: পেটের চামড়া নরম এবং অমসৃণ। এরপর সে নাভি স্পর্শ করে এবং নাভির ভেতর থেকে কিছু ময়লা বের করে আনে। নখের উপর ঝুলতে থাকা ময়লাটুকুর দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর সেটিকে বিছানার নীচে ফেলে দেয়। পায়ের আঙ্গুলের ডগা থেকে মাথার উপর অংশ পর্যন্ত নিজেকে একটি চাদর দিয়ে ঢেকে রেখেছে ইবলা। নিজের দিকে ভালো করে তাকায় এবং নিজের শরীর সম্পর্কে নতুন একটা কিছু আবিষ্কার করে ইবলা এই মুহূর্তে। আক্ষরিক অর্থে ইবলা নিজেকে অবলোকন করছে আজ— এটি এমন একটি কাজ যা সে আগে কখনও করেনি। আগে কখনই সে তার শারীরিক গঠন বা অঙ্গপ্রতঙ্গের সাজসজ্জা নিয়ে মাথা ঘামায়নি। এতদিন সে মনে করেছে তার এই শরীরটিকে খুঁটিয়ে দেখা কেবল পুরুষের কাজ, যে এর প্রতি আগ্রহবোধ করবে। এখন সে বুঝতে পারছে তার শরীরে যে পরিবর্তনগুলি এসেছে তা ভীষণ আশ্চর্যজনক। দুই পা প্রসারিত করে এবং মাথা একটু উঁচু করে নিজেকে দেখে ইবলা, আবিষ্কার করে তার বয়স বাড়ছে। তার শরীরের মাংস এখন নরম আর তুলতুলে। আর একজন ত্রিশ বছরের মহিলার মতো দেখাচ্ছে তাকে। ইবলার দুই ঠোঁটে কিছু ফাটল হয়েছে, যেন ওর ঠোঁট জোড়ায় অজানা শয়তানেরা চুমু খেয়েছে। ওর জিভের তালুর নিচে মাঝদিকে লালচে দাগ পড়েছে। ওর স্তন জোড়া এতো নরম যেন মাখন: তারা বুক থেকে ঝুলছে, ওগুলো এখন আর ওর শরীরের সাথে একটি সমন্বিত অংশ গঠন করে শরীরের সাথে লেগে নেই, যেন তারা কখনোই ওর শরীরের অংশ ছিল না। ইবলা ভেবেছিল সে খেলায় হেরে গিয়েছে: না বুঝেই সে একজন বেশ্যায় পরিণত হয়েছে। এরপর ইবলা গায়ের চদরটিকে পেট পর্যন্ত নামিয়ে দিলো। এবার আর মাথা উঁচু করলো না সে, আর তাই এখন চোখের সামনে স্তনের পাহাড় দুটি ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। এক হাত দিয়ে বাম স্তনটিকে স্পর্শ করে ইবলা। এবং এরপর যেন সে মনে করলো অন্য স্তনটি এতে ঈর্ষান্বিত হতে পারে তাকে উপেক্ষা করা হয়েছে বলে, তাই সে দ্রুত অন্য স্তনটিকে স্পর্শ করে, স্তনবৃন্তের উপর মৃদু চাপড় দেয়, কিংবা বলা যায় একটি মন ভুলানো স্পর্শ দিতে থাকে। ইবলা স্তনদুটিকে এমনভাবে চেপে ধরে, যেমন করে আপনি একটি লেবু চিপে থাকেন যার ভেতর কোন রস নেই। স্তনের ভিতরে শস্য দানা আকারে খুব ছোট। ইবলা বেশ জোরে চাপ দেয় এবং ব্যথা লাগে সেখানে। এরপর চোখ বন্ধ করে, মনে মনে শূন্যতার বলয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকে অবিরল, মনের জগতে এমন কিছু তৈরি করতে থাকে, যার অস্তিত্ব আগে কখনো ছিল না, আর যা পরেও কখনো তৈরী হবে না।

হঠাৎ দরজায় একটি টোকা পড়ে, তারপর আবার থেমে গেল।

‘দরজা খোল,’ একটি নারী কণ্ঠস্বর কথা বলে দরজাটা ওপাশ থেকে। ইবলা বুঝতে পারে এটি আশা। ‘দরজা খুলে বাইরে এসো। মাওলানা এসেছেন। জলদি করে আসো। ওঠো।’ ঘরের ভেতর থেকে ইবলা গলায় এমন একটু শব্দ করে শোনায় যেন সে এইমাত্র ঘুম থেকে উঠলো। আশাকে জানায় সে খুব তাড়াতাড়ি আসছে।

আশার ঘরের ঠিক সামনে মাটিতে বিছানো খড়ের মাদুরের ওপর দুই পা ভাঁজ করে বসে আছে দুজন মাওলানা। তাদের গায়ে সাদা আলখাল্লা। ইবলা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে লোক দুটো সম্পূর্ণ কাজটি দ্রুত শেষ করে চলে যাবার জন্য উসখুস করছে। ঘরের ভিতর থেকে ইবলা লোক দুটোর আচরণে তটস্থতা বুঝতে পারে স্পষ্ট।

সকাল এখনো শেষ হয়নি। ইবলা নিজের ভেতরে এক ধরণের শূন্যতা অনুভব করে। মাথার ভেতরটা ফাঁপা হয়ে আছে। জানে এই মুহূর্তে হাঁটতে গেলে তার পা টলে উঠবে। পা জোড়া এতো ক্লান্ত হয়ে আছে যে এই দুটির পক্ষে শ`খানেক পদক্ষেপ ফেলা এক কঠিন প্রচেষ্টা বলে মনে হয় ইবলার কাছে। মুখের উপর দিনের আলো এসে পড়ায় মাথাটি অস্বাভাবিক রকমের ভারী লাগছে। ইবলা নিজের ক্ষুদ্র ভগ্নাংশগুলোকে খুব কষ্টে একত্রিত করে মাওলানা দুজনের দিকে এগিয়ে যায়, যারা— নিশ্চুপ-নিশ্চিত হয়ে বসে আছে; কিন্তু যে ব্যাপার সম্পর্কে একমাত্র খোদাই জানেন।

মাওলানা দুজনের ভেতর যিনি প্রবীণ তিনি ইবলাকে তাদের বাম দিকে বসতে ইশারা করলেন এবং ‘নাবাদ’— বলেন। সম্ভবত তার পাশের মাওলানার পক্ষ থেকেও তিনি বলেছেন কথাটি, কারণ নাবাদ বলার সাথে সাথেই তিনি তার সঙ্গীর দিকে তাকিয়েছেন। আশার মুখের দিকে চোখ রেখে ইবলা মাওলানার সালামের উত্তর দেয়।

বড় মাওলানা প্রশ্ন করে, ‘এখন কেমন আছেন?’ মাওলানার কথা শুনে মনে হচ্ছে যেন সে গতকাল ইবলাকে দেখেছে।

‘ভালো,’ ইবলা জবাব দেয়।

‘আশা করি আপনি আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে আরো ভালো বোধ করবেন। আপনার উপর আমি দোয়া পড়ার পর।’

মাওলানা তার সাথে নিয়ে আসা একটি কাঠের স্লেট উঁচু করে। প্রথমে সে সঙ্গীর দিকে তাকায়, সম্ভবত তার সাথে চোখের দৃষ্টিতে কিছু পরামর্শ করে নিলো। তারপর ইবলার দিকে তাকায়, সম্ভবত ইবলার মুখের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য। ছোট মাওলানাটি নিঃশব্দে বড় মাওলানার হাতে একটি কালির পাত্র তুলে দিলো। বড় মাওলানা কালির পাত্রটির নিচে চেপে ধরে সেটিকে হাতে নেয় এবং অন্য হাতের তালুর মাঝখানে রাখে পাত্রটিকে। তারপর সে ইবলাকে জিজ্ঞাসা করে একটি রেজার ব্লেড পাওয়া যাবে কিনা।

‘কীসের জন্য?’ ভীত কণ্ঠে জানতে চায় ইবলা। কারণ সে মনে করছে এরা হয়তো তার কোনো অপারেশন করবে।

‘আপনাকে কাটার জন্য না, অন্য প্রয়োজন আছে,’ হাসতে হাসতে বলে মাওলানা।

‘এটা ছাড়াও, আমার শরীরে যথেষ্ট কাটাকুটি আছে,’ ইবলা কথা বলতে থাকে, ভুলে যায় যে মাওলানা বলেছে সে তাকে রেজার দিয়ে কাটা হবে না।

গতকাল দেখা সুন্নতে খাৎনার বর্বর অপারেশনের কথা মনে পড়ে ইবলার, এবং যেদিন তার নিজের উপর হয়েছিল একই বর্বর অস্ত্রোপচার সেই ঘটনার কথা মনে পড়ে; কুমারীত্ব হারানোর দিনটির কথাও মনে রেখেছে সে, কী ভয়ংকর যন্ত্রণা সহ্য করেছে, আর আউইলের শক্ত পেশির নিচে তার দলিত মথিত কোমল শরীরে নিদারুণ রক্তপাত হয়েছিল সেদিন।

ইবলা উঠে দাঁড়ানোর আগেই আশা আবার এসে হাজির হলো দৃশ্যপটে।

‘আপনি থাকুন। যাবেন না। আশা আমাদের জন্য ব্লেড খুঁজে আনবে,’ মাওলানা বলে। আর কী কী আনতে হবে তাও বলে দেয় লোকটি আশাকে।

‘ঠিক আছে। আমি আনছি।’

একটু পরেই আশা ব্লেড নিয়ে ফিরে আসে। মাওলানা ব্লেডটি দিয়ে হলুদ একটি নলখাগড়া চোখা করতে শুরু করলো। নলের প্রান্ত কাটতে কাটতে নিজের মনে গুনগুন করে একটি ধর্মীয় গান গাইছে সে। খড়ের মাদুরের উপর কাটা অংশগুলো পড়ছে। মাওলানা কাঠের স্লেটটি উঁচু করে ধরে কালির-পাত্রে খাগড়ার কলমটি ডুবিয়ে নিলো। তারপর কলমটি দিয়ে কাঠের স্লেটে আরবি ভাষায় কিছু লিখলো, যা ইবলার কাছে কোরানের কথা বলে মনে হলো। মাওলানা স্লেটটি লিখে ভরে ফেললো। তারপর সে আশার সাথে আবার কথা বলে। এক গ্লাস পানি এবং একটি খালি পাত্র আনতে বললো।

আশা পানি ভরা একটি গ্লাস এগিয়ে দিলো। মাওলানা স্লেটটা উঁচু করে ধরে, স্লেটের কোনা প্রান্তটা খালি পাত্রের মুখে ধরে স্লেটের উপর গ্লাসের পানি ঢেলে দিলো। তরল পানি স্লেটের উপর লেখা কালির দাগ ধুয়ে পাত্রে জমতে থাকে। এই কাজটি করে মাওলানা কিছুক্ষণের জন্য থামলো। শব্দ করে বলে, ‘হে খোদা, আপনি আমাদেরকে রহমত দান করুন, আমিন।’

‘আমিন,’ আশা ও অন্য মাওলানাটি বিড়বিড় করে বলে।

‘আমিন,’ তাদের বলা শেষ হলে ইবলাও বলে।

‘এখন তাহলে এটি পান করে নিন,’ মাওলানা বলে।

ধন্যবাদ দিয়ে ইবলা পানির পাত্রটি নিজের হাতে নিলো, কয়লা এবং আঠা দিয়ে তৈরি কালির লেখা ধোয়া দূষিত পানিতে ভরা যে পাত্র।

সাথে সাথেই ইবলা পাত্রের পানিটুকু পান করে নিলো। ‘ভালো,’ মাওলানা বললো। ‘ এবার আপনি সম্পূর্ণ ঠিক হয়ে যাবেন,’ ইবলাকে আশ্বস্ত করে বলে মাওলানা। ‘যে কোনো সময় যে কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাবেন। আমি যে পরিবারের সাথে থাকি আশা তাদেরকে চেনে। এখন আমি যাবো,’ মাওলানা ঘোষণা দিলো।

‘না। না। দুপুরে খেয়ে যাবেন।’

‘আমি আর থাকতে পারবো না। আমাকে যেতে হবে। ছাত্রদেরকে পড়াতে হবে। তারা আমার জন্য মসজিদে অপেক্ষা করবে।’

‘আপনাকে বিরক্ত করার জন্য আমাদেরকে ক্ষমা করবেন,’ আশা বলে।

মাওলানা দুজন উঠে দাঁড়ায়। তারপর তারা হেঁটে চলে গেল বাড়ির বাইরের দিকে। আশা তাদের সাথে গেটের দিকে যাচ্ছে। ইবলা বসে রইলো আগের মতোই। সে ওদের তিনজনের হেঁটে যাওয়া দেখছে: ইবলা দেখতে পায় আশা বড় মাওলানার কাঁধে একটি হাত রেখেছে, তারপর সে হাতের তালু মেলে ধরেছে মাওলানার সামনে। এইভাবে আশা মাওলানাকে কিছু টাকা দিয়েছে। কিন্তু টাকার পরিমান কত তা ইবলা জানে না।

ফিরে এসে আশা ইবলাকে বলে এবার ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিতে পারে সে। ‘খাবারের সময় আমি তোমাকে ডাকবো,’ আশা বলে।

‘মাওলানাকে আপনি কতো টাকা দিয়েছেন?’

‘বেশি না। চিন্তা করো না। তুমি ঘুমাতে যাও। তোমার ভালো লাগবে।’

বিছানায় গিয়ে শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইবলার বমি লাগতে শুরু করেছে। তার পেট এমনভাবে মোচড়াচ্ছে যে তার মাথা ঝিমঝিম করে। খুব বমি ভাব হচ্ছে। ইবলা আর্তনাদ করে উঠলো, দুই চোখ বন্ধ করে ফেলেছে সঙ্গে সঙ্গে। কারণ তার খুব গরমও লাগছে শরীরে। ইবলা বিছানা থেকে নেমে ঘরের দরজা বন্ধ করে গায়ের সব কাপড় খুলে ফেললো। স্তন দুটি পূর্ণ হয়ে আছে, এবং ইবলা সেগুলোকে স্পর্শ করার সাথে সাথে অদ্ভুত এক শিহরণ অনুভব করে শরীরে। নিজের হাত দিয়ে স্তন দুটোকে আলতো ছুঁয়ে দেখে। স্তনবৃন্তের চারপাশের চামড়ার রং আগের চেয়ে গাঢ় দেখাচ্ছে। ইবলার মনে হলো সে হয়তো গর্ভবতী হয়েছে।

‘কিন্তু বাচ্চাটি তাহলে কার? টিফোর নয় তো, ওহ খোদা!’

হঠাৎ করে প্রবল প্রস্রাবের ভাব হলো। কিন্তু এই বিল্ডিংয়ের একমাত্র টয়লেটটিতে কেউ আছে দেখে সে আশার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল।

পথে আশার সাথে দেখা হয়ে যায়।

‘কী হয়েছে? আমি ভেবেছিলাম তুমি বিছানায় শুয়ে আছে এখন। নিজের ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছ না কেন?’

‘আমি টয়লেটের জন্য অপেক্ষা করছি।’

‘পেটের সমস্যা?’

‘না। শুধু প্রস্রাব পেয়েছে। কিন্তু আপনার কাছে কি লেবু আছে?’

‘আমার ঘরে নেই। তবে তোমার জন্য জোগাড় করে দিতে পারি।’

‘থাক, লাগবে না,’ ইবলা বলে।

‘তুমি কিছু টের পাচ্ছ পেটের ভেতর?’

‘না।’

‘তুমি কি নিশ্চিত?’

‘হ্যাঁ,’ ইবলা জবাব দেয়।

‘তুমি সন্তান-সম্ভবা, অথবা এমন কিছু?’

‘না। আমি যতোটুকু বুঝতে পারছি, তেমন কিছু না।’

‘এখন টয়লেট ফ্রি হয়েছে। যাও, অন্য কেউ দখল করার আগেই দৌড়াও।’

আশার কথা মেনে নিয়ে ইবলা ছুটে যায় টয়লেটে। টয়লেট থেকে বেরিয়ে এলো ফ্যাকাশে এবং আতঙ্কিত মুখে। আশা এতোক্ষণে শহরের দিকে রওনা হয়ে গিয়েছে। ইবলা এক টুকরো কয়লা তুলে নিয়ে দাঁত ব্রাশের মতো করে দাঁত মাজতে শুরু করে। অনিচ্ছাকৃতভাবে কিছুটা তরল কয়লা গিলে ফেললো গলার ভেতর। এবার অনেকটা আগের মতো ভালো অনুভব করতে শুরু করেছে সে। বর্গাকার এক টুকরো মাটি হাতে নিয়ে চুষতে আরম্ভ করে ইবলা। এই সবই গর্ভধারণের লক্ষণ। আর ইবলা নিজেও ভালো করে জানে এই কথা।

ইবলা শুধু জানতে চায় তার গর্ভে কার সন্তান এসেছে। কার? ‘আউইল কিছুদিনের ভেতর বাড়ি চলে আসবে। টিফোও হয়তো এসে আমাকে তার স্ত্রী হিসেবে দাবি করে বসবে। আমি বিক্রির জন্য সাজিয়ে রাখা পুরুষের সম্পত্তি।’

নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে নিজের ঘরে চলে আসে ইবলা। ঘরের আয়নাটি হাতে নিয়ে নিজের সামনে ধরলো। আয়নার ভেতর নিজেকে দেখতে থাকে মনোযোগ দিয়ে। আয়নার ভেতর ইবলা এমন একজনকে দেখতে পাচ্ছে যাকে তার নিজের মতো লাগে না। সেখানে এমন একজনকে দেখা যাচ্ছে যে খুব ফ্যাকাশে, একটি ঝাপসা মুখ, যার চারপাশে শুধু অনেকগুলি দাগ টানা এবং যার গাল দুটি গোল গাল। আয়নার এই মুখটি সে নয়, অন্য কেউ। নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে ইবলা মুচকি হাসে। ‘খোদার কাছে কৃতজ্ঞতা এই কারণে যে আমরা দেখতে আমাদের প্রতিবিম্বের মতো নই,’ নিজেকে স্বান্তনা দেয় ইবলা। তারপর আবার ভাবে, ‘আর যদি তাই হতাম, তাহলে কেউ কি আমার দিকে ফিরে তাকাতো, কেউ আমাকে বিয়ে করতে রাজি হতো?’

‘একজন পুরুষ নাকি একজন মহিলা— কে কাকে প্রতারণা করে?’নিজেকে প্রশ্ন করে ইবলা। ‘হয়তো এই প্রশ্নগুলি আমার অন্য মানুষকে করা উচিত। আর এই প্রতিবিম্বটি যেহেতু আমার নয়, তাই এটিকেই ব্যবহার করছি না কেন? আমি কথা বলবো ওর সাথে।’

‘পুরুষ?’ মহিলা কন্ঠে কথা আরম্ভ করে ইবলা।

‘হ্যাঁ, আমি পুরুষ,’ এবার সে পুরুষ কন্ঠে জবাব দেয়।

‘আপনি কি নারীদের সাথে প্রতারণা করে থাকেন?’

‘না।’

‘তারা কি আপনার সাথে প্রতারণা করে?’

‘হ্যাঁ।’

‘তাহলে তাদের সাথে আপনার কী করা উচিত?’

‘তাদের সাথে প্রতারণা করা উচিত।’

‘কে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, আপনি পুরুষ, না কি একজন মহিলা?’

‘এই ব্যাপারে কখনো দ্বিমত হতে পারে না।’

‘কেন? কীভাবে?’

‘আমিই সেই ব্যক্তি যে বিছানায় এবং বিছানার বাইরে যেকোনো কিছু ঘটাতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে থাকি।’

‘আপনি কি মনে করেন, আপনি নারী ছাড়াও সুখে থাকতে পারবেন এই পৃথিবীতে?’

‘হ্যাঁ, বেশ সুখেই থাকবো।’

‘আপনার সাথে সাক্ষাৎকার এখানেই শেষ,’ ফিসফিস করে বলে ইবলা।

তারপর আয়নার দিকে তাকিয়ে উচ্চস্বরে হাসতে আরম্ভ করে ইবলা। পুরুষ প্রতারক নয়? আউইল প্রতারক নয়? টিফো প্রতারক নয়? একজন নারী গুরুত্বহীন?

আবার আয়নার বুকে হেসে উঠে ইবলা। আয়নার উপর ঝুকে পড়েছে তার মুখ, লালা গড়িয়ে পড়ছে মুখ থেকে, আয়নার বুক লালা দিয়ে মেখে গিয়েছে। গায়ের কাপড় দিয়ে ইবলা আয়নাটি মুছে নিলো। ঝাপসা আয়নার পেছনে ফুটে উঠা ছবিটি অস্পষ্ট দেখাচ্ছে এখন। ‘এই যে মহিলা?’ গর্বিত পুরুষ কন্ঠে প্রশ্ন করে ইবলা, ‘তুমি কি প্রতারক?’

‘মাঝেমাঝে।’

‘কিন্তু কেন? কেন তুমি প্রতারক হও মাঝেমাঝে?’

‘কারণ পুরুষেরা আমাকে ঠকায়।’

‘কেন ওরা তোমাকে ঠকায়?’

‘আমি তাদের উপর প্রতিশোধ নেই।’

‘আচ্ছা, কিন্তু কেন এমনটা ঘটে?’

‘আমি জানি না। আমি নির্দোষ। জানি না আমার কী করা উচিত। শুধু বুঝতে পারি না মাঝে মাঝে আমি কী করি। কিছু একটা করি, কিন্তু সত্যিই সেসব কাজে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে জড়িত না করেই আমি সেগুলি করে ফেলি। আমার পুরুষটির উপর আমি সম্পূর্ণ বিশ্বাস রাখি, আস্থা রাখি, কিন্তু একবার সেটি হারিয়ে গেলে, তাকে আবার ফিরে পাওয়া খুব কঠিন কাজ। ঈর্ষা এবং নিরাপত্তাহীনতার কারণেই বেশিরভাগ ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। আপনারা পুরুষরা এসব ক্ষেত্রে কী করেন?’

‘ধরা না পড়া পর্যন্ত গোপনে কাজ চালিয়ে যাই। তোমরা মেয়েরা হলে কী করতে?’

‘তাদেরকে অনুরোধ করতাম নিজেকে শুধরে নিতে। পুরুষরা পশু এবং তারা আমাদের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। তাই আমাদের উচিত তাদের পায়ের তলা থেকে মাটি কেটে সরিয়ে ফেলা, তাদের সামনে অনুনয় বিনয় করে তাদের সাথে প্রতারণা করা, তাদের দিকে তাকিয়ে নরম আর লাজুক হাসি হাসা এবং মুখে মধু মেখে তাদের সাথে কথা বলা।’

আয়নাটা একটুখানি বাঁ দিকে সরাতেই আশার অবয়ব দেখতে পায় ইবলা। ঝপ করে হাতের আয়নাটা নিচে ফেলে দিয়ে ইবলা চুপচাপ তাকিয়ে থাকে আশার দিকে, ক্ষুধার্ত চোখ মেলে।

কিছুই না বলে, ঘর থেকে বেরিয়ে যায় আশা।

(চলবে । উপন্যাসটি আগামী পর্বে সমাপ্ত হবে।)

বাঁকা পাঁজরের মেয়ে (পর্ব ষোল ) // নুরুদ্দিন ফারাহ, অনুবাদ: লুনা রাহনুমা

Ajit Dash

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ভাষা
Scroll to Top