Home » বাঁকা পাঁজরের মেয়ে (পর্ব ষোল ) // নুরুদ্দিন ফারাহ, অনুবাদ: লুনা রাহনুমা

বাঁকা পাঁজরের মেয়ে (পর্ব ষোল ) // নুরুদ্দিন ফারাহ, অনুবাদ: লুনা রাহনুমা

২৭

নিজের ঘরে এসে ইবলা বিছানায় শুয়ে দীর্ঘক্ষণ ধ্যান করে। পিটপিট করে দুই চোখের পাতা খোলে আর বন্ধ করে। চোখের পাতার পাপড়ির ঝাপটায় বাতাস ছুঁয়ে যায় দুই চোখ।

আশা বলেছে একজন মাওলানা এসে তার উপর কোরান পাঠ করবেন, মাওলানাকে খবর পাঠানো হয়েছে। ইবলা মনে মনে ভাবে, ‘জীবন আসলে কী? শহর এবং গ্রামের মধ্যে আসলে কোনো পার্থক্য নেই। কিংবা, মঙ্গলবার, বুধবার, বৃহস্পতিবার, শুক্রবার, শনিবার, রবিবার, সোমবার, মঙ্গলবারের ভেতর কোন পার্থক্য নেই: যেখানে শুরু হয়েছিল আবার সেখানেই ফিরে যায় সব। এই পৃথিবীর কোন আরম্ভ নেই এবং শেষও নেই। এটি ক্রমাগত ঘুরছে আর ঘুরছে। হয়তো একটা কিছুকে কেন্দ্র করে তার চারপাশে ঘুরছে, অথবা আপন মনে, অথবা আপনাকেই কেন্দ্র করে বৃত্তাকার বলয়ে ঘুরছে, কিংবা নিজের কাঁধে কাঁধ রেখে ঘুরছে কেবল। এই পৃথিবী একটি নিত্যকর্ম, এখানে বেঁচে থাকা নিত্যকর্ম। যখন তাদের প্রিয় পুত্র, কন্যা বা বন্ধুরা মাটিতে অদৃশ্য হয়ে যায় তখন লোকেরা তেমন আশ্চর্য হয় না (যেমন আশ্চর্য হবে বলে আশা করা যেত।), বরং তারা মনে করে আল্লাহ তাদেরকে কেড়ে নিয়েছেন। যখন তাদের সাজানো গোছানো জীবনে বিশৃঙ্খলা তৈরী করতে একটি নবজাতক শিশু পৃথিবীতে আসে, তখন তারা সেই দুর্যোগ নিয়ে মাথা ঘামায় না। তারা অভ্যস্ত জীবন থেকে সরেও যায় না। এর বদলে তারা, শিশুর আগমন উপলক্ষে আনন্দ করার জন্য অন্যান্য প্রাণীদের গলা কেটে দেয়। জীবনের ব্যবহার আসলে কী? বিশেষ করে আমার মত একজন মানুষের জন্য? আমি একটি জড় বস্তু ছাড়া আর কিছুই নই। আমি একেবারেই কিছু না। আমাকে পেতে আউইলকে কোন খরচ করতে হয়নি: তিনি আমাকে বা আমার কোনো আত্মীয়কে কোনো যৌতুক দেননি। এমন কি তিনি আমার কোন আত্মীয়কে চিনেন না পর্যন্ত, যার কাছে তিনি চাইলে যৌতুক দিতে পারতেন। হয়তো আমাকে পেতে তার কোনো মূল্য পরিশোধ করতে হয়নি বলেই আউইল অন্য আরেকজন নারী, একজন শ্বেতাঙ্গ নারী, যে আমাদের খোদাকে বিশ্বাস করে না, যে একজন বিধর্মী, তেমন একজন সাদা নারীর পেছনে ছুটেছে।

‘আমার চিন্তা হয় কথাটি সত্য কিনা যে আল্লাহ বলেছেন, “একজন মহিলার জন্য তার স্বামী নবী এবং সৃষ্টিকর্তার পর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।” কথাটি যদি সত্যি হয়, তাহলে এই জীবন যাপনের কোনো মানে হয় না। কেন আউইল অন্য একজন মহিলার (একজন শ্বেতাঙ্গ মহিলা, যিনি সবচেয়ে খারাপ) কাছে ছুটে যায়? তার সাথে যা খুশি তাই করে? এবং তারপর যখন সে আমার কাছে ফিরে আসে তখন আমাকে তার পা ধুয়ে দিতে হয়, তার জন্য খাবার রান্না করতে হয়? তাকে ছেড়ে আমি অন্য কোথাও আশ্রয় খুঁজতে যেতে পারি না, পড়ে থাকি তারই বাসস্থানে, যেটিকে আমি আমার নিজের বলেও বিবেচনা করতে পারি, অবশ্য শুধুমাত্র যদি তিনি চান, তবেই।

‘আমার মনে পড়ছে না আমি এখানে কবে এসেছি। বিরক্তি বোধ করা ছাড়া পেছনের দিকে ফিরেও তাকাতে পারি না এখন আর। মূলত আমি সবসময়ই দ্বিধান্বিত থাকি। কিন্তু যখনই মনে হয় আমার অবস্থার উন্নতি হচ্ছে, তখন এমন একটা কিছু ঘটে যা আমাকে আবারো সেই পুরানো জায়গায় টেনে নিয়ে যায়। আমি কি অভিশপ্ত কেউ? আর যদি তা হই, তাহলে আমাকে অভিশপ্ত করেছে কে?’

ইবলা অনুভব করে তার পাঁজর ব্যথা করছে। তাই সে বিছানার উপর আরেক দিকে ঘুরে শোয়। এ পর্যন্ত তার জীবনে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনাগুলোর যুক্তিযুক্ত কারণ নিয়ে ভাবতে থাকে গভীরভাবে।

‘একটা জিনিসের জন্য আমি দোষী: টিফোকে বিয়ে করা। আমার হয়তো একটু অপেক্ষা করা উচিত ছিল। কিন্তু আমি আউইলের উপর মারাত্মক ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। তাই আমি প্রতিশোধ নিতে চেয়েছি। কিন্তু সেই একটি কাজ আমার কী হাল করেছে? কার উপকারে এসেছে— তার নাকি আমার? সব দিক থেকে আমিই ভুক্তভোগী হলাম। আমি একটি লোকের সাথে বিছানায় গেলাম। যদিও কাজটি আমি ইচ্ছাকৃতভাবে করেছি, কিন্তু আমি তার পরিণতি দেখতে পাচ্ছি এখন। আমার কাজিন যে দালালের হাতে আমার হাত তুলে দিতে চেয়েছিল, সেই দালালকে আমি একবার চোখে দেখতে চাইনি। এমনকি অন্য আর যেকজন পুরুষের সাথে আমার বিয়ের কথা পাকা হয়েছিল তাদের কারোর ব্যাপারেই আমি বিন্দুমাত্র আগ্রহ বোধ করিনি। তাদের নাম যাই হোক না কেন। তারা আমার স্বামী ছিল না, এবং তাই তারা আমার কাছে নবী হতে পারে না। মানুষ কেবল তখনই নবীদের আদেশ পালন করে যখন মানুষটি সেই নবীর মতবাদ গ্রহণ করে। কিন্তু আমি একজন নারী, আর একজন নারীর অনেক ধরণের সীমাবদ্ধতা আছে। সামান্য একটা উদাহরণ দেই, আউইল কোনো মেয়েকে বিয়ে করে বাড়ি নিয়ে আসতে পারে, এবং সেক্ষেত্রে আমি একটি কথাও বলতে পারবো না। সে চাইলে আরও তিনটি বিয়ে করতে পারে। আমি আশা করি আউইল তা করুক। হয়তো, জাহান্নামের প্রতিবেশী হওয়ার চাইতে জাহান্নামের অভ্যন্তরে বসবাস করা উত্তম— যতক্ষণ পর্যন্ত না জাহান্নামের তাপ অসহ্য মনে হয়। ভাবছি আমি একটি বেশ্যা কিনা; ভাবছি কতজন আমাকে তাই মনে করে।’

গ্রামের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে ইবলার। একজন মহিলা তার দেহ বিক্রি করেছিল। মহিলার আত্মীয়রা তার সাথে বিছানায় যাওয়া লোকটিকে ধরে ফেলে এবং লোকটির শরীরে মাংসের প্রতিটি অংশে ব্যথা না হওয়া পর্যন্ত তাকে মারতে থাকে। তারপর তারা মহিলাটিকে আটক করে। মহিলার ঘর ও তার সমস্ত জিনিসপত্র আগুনে পুড়িয়ে দেয়। মহিলাটি গ্রাম থেকে পালিয়ে মোগাদিসিওতে এসে পতিতাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার আগ পর্যন্ত তারা মহিলার নামে কলঙ্ক ছড়িয়েছে সবখানে। আত্মীয়রা উত্তম সাহায্য কী করেছে সেই মহিলার জন্য? মাঝে মাঝে মানুষ ভয়ঙ্কর কাজ করতে প্রলুব্ধ হয়, কিন্তু হিংস্রতা কখনো সমস্যার সমাধান করে না; কেবল হিংস্র আচরণ এবং কঠোর প্রহার কিছুতেই সেই মহিলাকে তার পাপের জন্য অনুতপ্ত বানাতে পারতো না। কিন্তু কাজটা কি গুনাহ ছিল?

‘গুনাহ কী?’ আহা যদি জানতাম!

‘আমি জীবন ভালবাসি। আমি বেঁচে থাকতে ভালোবাসি। সবাই তাদের জীবনকে নিজের মতো করে ভালোবাসে, নিজস্ব উপায়ে। এমনকি মৃত্যুও জীবনের আরেকটি দিক ছাড়া ভিন্ন কিছু নয়। এবং যে মানুষ মৃত্যুকে ভালোবাসে, স্বাভাবিকভাবে সে বাঁচতেও ভালোবাসে। আমি কিছু জিনিসের জন্য বাঁচতে ভালোবাসি, আবার সেই একই জিনিসের জন্য আমার মরতেও আপত্তি নেই। আমি জীবন ভালোবাসি। আমি এর সব রং ভালোবাসি। আমি প্রকৃতি ভালোবাসি। আমি বৃষ্টি ভালোবাসি। আমি বসন্ত ভালোবাসি। আমি দুঃখ এবং ক্ষুধা ভালোবাসি। কিন্তু আমি এই কারণে এদেরকে ভালোবাসি না কারণ তারা আমার জন্য সুখ অথবা দুঃখ নিয়ে আসে: এখানে আমার কোন সুখ বা দুঃখ নেই। আমি পশু ভালোবাসি, যারা আমার জানা প্রকৃতির একমাত্র অংশ। এটাই আমার অদৃষ্ট— পরিচিত এই জিনিসগুলোর সাথে যোগাযোগ করতে পারা।

‘আমি কখনো কারো ক্ষতি করিনি। আর আমার সেরকম কোনো উদ্দেশ্যও নেই। আমি কখনো মিথ্যা কথা বলিনি। আর কখনো আমার প্রজন্মের বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষকে নিজের জীবন থেকে উপড়ে ফেলে দেইনি। কিন্তু আমার এই করুণ বর্তমানের জন্য কে দায়ী? আল্লাহ নাকি আমি? স্বাভাবিকভাবেই, কোনো কাজের ফলাফল খারাপ হলে আমরা সবসময় অন্য কারোর উপর তার দায় চাপিয়ে দেই। তাহলে সকল দায়ভার আল্লাহর উপর দিয়ে দেয়ার চেয়ে সহজ আর কী হতে পারে? কিন্তু সত্যি বলতে, আমার এই অবস্থার জন্য দায়ী কে? আংশিকভাবে আউইল দায়ী। কেন? কারণ সে অকস্মাৎ আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। তবে তাকে দেশের বাইরে পাঠানো হয়েছে কিছু কাজের জন্য নিশ্চয়। তাই না? তারপর সম্ভবত আমার পরিবার দায়ী। কিন্তু কীভাবে? কারণ তারা আমাকে উপযুক্ত পুরুষের সংস্পর্শে আনেনি? কিন্তু যাইহোক, “আমার পরিবার” কে? আমার ভাই এখানে আসার আগেই আমার দাদা মারা গিয়েছেন। আমার বাবা এবং মায়ের হাড়গুলি অনেক আগেই মাটির ভেতর মিশে ধুলোয় পরিণত হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য আত্মীয়স্বজন, আমার কি আছে তেমন কেউ? যদি থাকে তাহলে আমি খুব আশ্চর্য হবো। আর বাকিটুকুর জন্য আংশিকভাবে দায়ী জীবন সম্পর্কে আমার অনভিজ্ঞতা। আমি সম্ভবত সবকিছুর জন্য পরিষ্কার সমতল-ক্ষেত্র তৈরি করে ফেলতাম নিজের মনে। এবং তারপর আমি বেমালুম ভুলেই যেতাম আসলে আমি কী করছি। এটি মানুষের দুর্বলতা যে মানুষ অতীতে ঘটে যাওয়া অপ্রাপ্তি, অসম্পূর্ণতার কাছে বারবার ফিরে যেতে পছন্দ করে। অবশ্য, এটি প্রতিটি ব্যক্তির জন্য স্বতন্ত্র চিন্তার বিষয়। এখন আমার সমস্যা, আমার জীবনের পুরুষদেরকে নিয়ে। এবং এটা খুবই দুঃখের বিষয় যে তারা পরিস্থিতিটি নিয়ে সামান্যতম চিন্তিত নয়। সমস্যার সমাধান বের করতে এই যে আমি বিছানায় উল্টে পাল্টে হুমড়ি খাচ্ছি, যতখানি বুঝতে পারি, তারা এখন অন্য মহিলাদের সাথে শুয়ে আছে হয়তো— তাদের পক্ষে সবই সম্ভব।

‘তালাক। আমি কি তালাক চাইবো? আমাদের ধর্ম এই ক্ষেত্রে নারীর প্রতি খুব কঠোর। পুরুষদেরকে দেয়া ছাড়গুলি বরং অনেক বেশি: মনে হয় যেন ধর্মই একমাত্র সঠিক জিনিস। ওহ, আমার আল্লাহ, আমি আসলে এটা বলতে চাইনি। আমার কথা শোন, আল্লাহ; আমি অনুতপ্ত। আমি তোমার কাছে তওবা করছি। আমাদের ধর্মে কোনো ভুল নেই।

‘কিন্তু আমি কি তালাক চাইব, নাকি না? আমি কীভাবে আউইলকে বলবো আমাকে তালাক দিতে? তাহলে যে আমি একা হয়ে যাবো। সম্পূর্ণ একা। সবার থেকে আলাদা। আমার আত্মা কখনো কোনো সঙ্গী পায়নি আগে। আর ভবিষ্যতেও পাবে না। এমনকি পরের দুনিয়াতেও পাবে না। কারণ আমি এমনি এমনি অনেক ভুল করেছি। আমি ব্যভিচার করেছি: আমি আল্লাহর আইন ভঙ্গ করেছি। কিন্তু আল্লাহ যথেষ্ট করুণাময়। যদিও তিনি যখন শাস্তি দেন, তখন তিনি ভয়ংকর নিষ্ঠুর হতে পারেন। কেউ জানে না তার জন্য ক্ষমা নাকি শাস্তি অপেক্ষা করছে।

‘নিজেকে আমি একেবারেই বুঝতে পারি না,’ ইবলা ভাবতে থাকে। ‘আমি কিছুতেই বুঝি না। নবীগণ বলেছেন, প্রত্যেকের ভাগ্য আল্লাহতালার স্লেটে লেখা আছে। সবকিছু সেখানে রেকর্ড করা হয়— নাকি এখানে রেকর্ড করা হয়? মানুষের কাঁধে কি ফেরেশতা আছেন, যারা কাঁধে বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন আর মানুষের কৃতকর্মের রেকর্ড করছেন? চাঁদের মুখে একটি বড় গাছ আছে এবং সেই গাছের প্রতিটি পাতা একেকজন মানুষের জীবনের প্রতিনিধিত্ব করে। চাঁদের সেই গাছ থেকে যখন কারো জীবন পাতাটি ঝরে পড়ে, তখন পৃথিবীতে সেই মানুষটি মারা যায়। কোন মানুষ দীর্ঘ সময় ধরে বিছানায় থাকলে তার সেই পাতাটি চাঁদের গাছে শুকিয়ে যায়। কিন্তু আমি আল্লাহকে সম্মান করি এবং তিনি তা জানেন। এবং আমি প্রতিজ্ঞা করছি যে আমার মনের ইচ্ছা পূর্ণ হলে আমি যথারীতি দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বো।

‘কিন্তু তুমি কী চাও?’ ইস, আমি যদি জানতাম সে কথা, আমি কী চাই! এখন আমি একজন মহিলা, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে; আমি একজন নারী, এবং আমি সমস্যায় আছি, তারমানে আমার নারীত্ব স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে। পুরুষদের মহিলা ঘটিত সমস্যা আছে, কিন্তু সেটি তাদেরকে আমাদের মতো ঝামেলায় ফেলে না। আমি একজন নারী, এবং আমার রক্তের দাম একজন পুরুষের অর্ধেক হওয়ায় এটা সুস্পষ্ট যে আমি তার থেকে নিকৃষ্ট সত্তা। আমরা এই কথা বলতে পারি না যে আল্লাহ কিছু ভুল করেছেন। তিনি সর্বশক্তিমান, আমাদের সৃষ্টিকর্তা, যিনি মানুষের মর্যাদা নির্ধারণ করেছেন। তিনি আমাকে পুরুষের অর্ধেক মূল্যবান করে তৈরী করেছেন। নিশ্চয়ই তাঁর এই কাজের পেছনে একটি ভালো কারণ আছে, নইলে তিনি কেন আমার সাথে এমন করলেন? আমি একজন নারী, এবং যেহেতু পুরুষের চেয়ে আমার আকাঙ্খা বেশি, তাই আমার দুর্বলতাগুলো একজন পুরুষের চেয়ে দ্রুত প্রকাশ পায়। একটি পুরুষের দিকে তাকালে আমি প্রলুব্ধ হই: যদি আমি এই প্রলোভনের কাছে নতি স্বীকার করি, তবে তার পরিণাম এতো তিক্ত বিষাক্ত হবে যে এর স্বাদে আমার নিজের অস্তিত্ব হারাতে হতে পারে।

‘ওহ আমার আল্লাহ, পুরুষেরা যদি জানতো নারীরা কতটা প্রলুব্ধ হয়! আমরা মুখে বলতে পারি না, সোজা প্রত্যাখ্যান করে দেই। কিন্তু মনের ভিতরে আমরা তাকে পেতে চাই। একজন পুরুষ যতখানি চায়, তারচেয়েও বেশি করে আমরা কামনা করি। অ্যারাওয়েলো, সোমালি মহিলার ভেতর সবচেয়ে বুদ্ধিমান ছিলেন যিনি, তিনি মারা যাওয়ার আগে তার সাথের-মহিলাদেরকে কিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “হে মহিলাগণ, আপনারা ‘না’ বলুন, যদিও এরপর আপনি না বলার জন্য অনুশোচনা করবেন। আপনি অনড় থাকবেন, আর, কোনো পুরুষ যেন আপনার নারীত্বের সংকল্পকে নাড়িয়ে দিতে না পারে। সর্বদা নিজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং শালীন থাকবেন।” আমার মনে হয়, তিনি তাঁর চেয়ে আপাতদৃষ্টিতে উচ্চতর পুরুষদের চেয়েও জ্ঞানী।

‘কিন্তু, আমি কেন আউইলকে “না” বলিনি? আমি আশা করেছিলাম সে আমাকে বিয়ে করার জন্য একটু জোর করুক? আর শেষে আমি অবশ্যই “হ্যাঁ” বলতাম।

‘আমি যদি গ্রাম থেকে পালিয়ে না আসতাম, বরং আমার দাদা যে বৃদ্ধের কাছে আমাকে তুলে দিতে চেয়েছিলেন তাকে বিয়ে করতাম, তাহলে হয়তো আমি এই সমস্ত ঝামেলায় পারতাম না,’ ইবলা ভাবে। ‘আমি আমার জীবনে কোনো কিছু করার জন্য কখনো আফসোস করিনি। কেন করবো? আমি এই অর্থে দুর্বল যে, একজন বয়স্ক লোক আমাকে যা আদেশ করে আমি তাই মেনে নেই। কিন্তু আমি কারো ক্ষতি করতে চাই না: আমি শুধু আমার যা আছে তার সেরাটুকু করতে চাই। কিন্তু এই মুহূর্তে এটি চিরন্তন ঝামেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এই মাথাব্যথা। যখনই আমি কিছু নিয়ে আফসোস করি, তখনই আমার পেট গুড়গুড় করে। এটা ভালো নয়। এতে সমস্যার সমাধানে কোন সাহায্য হয় না। আমি যাই করি না কেন, তা আমার সহজাত স্বভাব এবং আমি তা থামাতে পারি না। সম্ভবত, একমাত্র উপায় হচ্ছে, একটি ছুরি নেওয়া এবং আমার গলা কেটে ফেলা। কিন্তু আমি একজন মহিলা। আর আমি তা করতে পারি না— আমার সাহসের অভাব আছে।

‘আমাকে দেখতে একটি বিষণ্ণ উটের মতো লাগছে, যে তার একমাত্র বাছুরটিকে হারিয়েছে। উটের চেয়ে আমার একমাত্র সুবিধাজনক অবস্থানটি হলো গিয়ে আমি নিজের সাথে যুক্তিতর্ক করার চেষ্টা করতে পারি এবং কারো সাথে কথা বলতে পারি। কিন্তু কার সাথে কথা বলবো? হয়তো একমাত্র সৃষ্টিকর্তার সাথে, যাকে উদ্দেশ্য করে আমি এতদিন কোনো প্রার্থনা করিনি। শেষবার কবে নামাজ পড়েছি, মনে পড়ে না। একের পর এক আমি আমার পরিচিতজন, আমার আত্মীয় সম্পর্কগুলোকে হারাচ্ছি। আমি আমার একমাত্র ভাইয়ের আস্থা হারিয়েছি: সে আর কখনো আমার কাছে আসবে না। আমার মুখ দেখবে না। আমার কাজিন এবং তার স্ত্রীর ক্ষেত্রেও ঘটনা একই হয়েছে: তারা আমাকে পেলে জীবিত রান্না করবে। আশার কোনো প্রয়োজন নেই আমার বন্ধুত্বের। আর আমি আশাকে ছাড়া এই জায়গায় আর কাউকে চিনি না। একজোড়া দম্পত্তি, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোন বন্ধুত্ব নেই; স্বামীটি একজন পুরুষ এবং স্ত্রীটি একজন নারী, এবং স্বাভাবিকভাবেই তারা মর্যাদায় সমান নয়। বন্ধু হওয়ার আগে তাদেরকে সমান হতে হবে। আপনি যদি কাউকে ঘৃণা করেন বা অবজ্ঞা করেন তবে সে আপনার বন্ধু হতে পারে না, আপনিও পারবেন না তার বন্ধু হতে।

‘আগামীকাল সকালে, প্রথমে গিয়ে আমি নিজেই পেয়ারা কিনে আনবো,’ ইবলা সিদ্ধান্ত নেয়। ‘নবী বলেছেন, আপনি যদি পেয়ারা খাওয়ার পর চল্লিশ দিনের মধ্যে মারা যান, তাহলে আপনার জান্নাতে প্রবেশ নিশ্চিত। আশাকে বলবো আমার জন্য কিছু পেয়ারা কিনে আনতে। কিন্তু কেন, সে কথা বলবো না। আমার পেয়ারা খাওয়ার কারণটি তাকে জানানো যাবে না, কারণ তাহলে নিশ্চয় সে আমার জান্নাতে যাওয়ার ব্যাপারে হিংসা করবে এবং আমাকে অন্য কিছু কিনে দেবে। ভাবছি পেয়ারার স্বাদ কেমন হয়: নিশ্চয়ই খুব তেতো হবে, আমার ধারণা, অথবা হয়তো টক। স্বাদ যেমনই হোক, আমি খাবো। পেয়ারা কি সমুদ্রের কাছাকাছি জায়গার জন্মায়? সমুদ্র দেখতে কেমন? তারা বলে সমুদ্র মানে হচ্ছে বিশাল নীল জল। পেয়ারা সম্ভবত দেখতে সমুদ্রের মতই নীল। আর তাদের স্বাদ কি লবণের মতো?

আশা বলেছে, সমুদ্রের পানি লবণাক্ত এবং সমুদ্র উপকূল এলাকায় যা কিছু জন্মায় সেগুলো অবশ্যই লবণাক্ত হবে। অনেক দূরের গ্রামে, আমরা পানির অভাবে ভুগেছি, কিন্তু শহরে প্রচুর পরিমাণে পানি আছে— তাদের আছে নদী, সমুদ্র এবং হ্রদ। আমাদের গ্রামে পশুরা তৃষ্ণায় মারা যায়, কিন্তু এখানে শহরে গ্রামের মতো অনেক পশু নেই, তবুও তাদের কাছে এই বিপুল পরিমাণ জলের উৎস রয়েছে। এটাই জীবন: যখন আপনার কিছুর প্রয়োজন হয়, তখন আপনি তা পান না। আর যখন আপনার সেটির প্রয়োজন নেই, তখন সেটি পাবেন প্রচুর পরিমাণে। আমি ভাবি কখনো কি একজন মানুষ যতখানি চায় তার সবটুকু পাওয়া সম্ভব।’

একটা অপরিচিত সুর এসে ইবলার কানে লাগলো। শব্দটি ঘরের বাইরে থেকে আসছে। যদিও কয়েক সেকেন্ডের জন্য ইবলা ভেবেছিল যে শব্দটি ঘরের ভেতর থেকে আসছে। তার ইচ্ছা করছে ঘরের বাইরে গিয়ে লোকটিকে যদি শিস বাজানো বন্ধ করতে বলতে পারতো তাহলে ভালো হতো। কারণ রাতে শিস বাজানোর শব্দে জ্বীন আসে। জ্বীন এসে শিস বাদকের মুখে মারধর করে অথবা তার আশেপাশের লোকদের মুখে মারতে থাকে, যাদের উচিত ছিল লোকটিকে শিস বাজাতে না করা। একজন মানুষ কেন শিস বাজাবে? কিন্তু তারপর আবার, কেন মানুষটি শিস বাজাবে না?

ইবলা শিস বাজানো মানুষটির সাথে কথা বলার জন্য বেরিয়ে এসেছিল, কিন্তু ঠিক যখন সে দরজার কাছে পৌছায়, এবং দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে, ঠিক তখন তার শরীরটা কেমন দুর্বল লাগতে থাকে। শরীর কেঁপে উঠছে থেমে থেমে। আকাশে তখন একটি উল্কা পড়তে দেখা যায়। ইচ্ছা না থাকলেও, ইবলা চিৎকার করে উঠেছে, ‘পড়ুক। পড়ুক। যারা সর্বশক্তিমান আল্লাহকে বিশ্বাস করে না, তাদের উপর বাজ পড়ুক।’

তারপর সে হাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুলটি কামড়ায়। চারপাশে তাকিয়ে অন্য ঘরগুলোর বাইরে বসে থাকা অন্ধকার ছায়া মানুষদেরকে দেখে। মনের ভেতর এই ভেবে হতাশ বোধ করে যে এরা হয়তো তার মতো করে ভাবে না। ‘হয়তো এরা আমার মতো তাদেরকে ঘৃণা করে না, আমি যেমন করে ঘৃণা করি তাদেরকে, যারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে না,’ ইবলা ভাবে।

ইবলা এবার ঘরের ভিতর চলে আসে। বাড়ির বাইরে শিস বাজানো থেমে গিয়েছে। ইবলা আবার বিছানায় গড়িয়ে পড়ে। শরীর টানটান করে মনের ভেতর চিন্তা ভাবনার কল্প জল্প রেলগাড়ি চালাতে আরম্ভ করে দেয়।

‘আমি জন্মগতভাবেই একজন বিভ্রান্ত মানুষ। যদিও সৃষ্টিকর্তা তার সৃষ্টির জন্য দায়ী, আমি দায়ী আমার কর্মের জন্য। আমি বরং আমার জীবনে আসা পুরুষগুলোকে বিশ্লেষণ করি একটু: এই ক্ষেত্রে আমার মনে হয় আমার জীবনে আসা প্রথম লোকটির কথা বলা উচিত হবে সবার আগে, যার কাছ থেকে আমি পালিয়ে এসেছি। সেই লোকটির কারণেই আমি গ্রাম থেকে পালিয়ে এসেছিলাম আর তার কারণেই আমার সাথে অন্যান্য এতো কিছু ঘটেছে এই পর্যন্ত। যা ঘটে তার সব কিছুই আল্লাহপাক দেখতে পান। এবং তিনি আমার মনের সব কথা জানেন। প্রথমত জিউমালেহকে আমি চিনতাম না। আমি তাকে কখনো দেখিনি, কিংবা কাজী আমাদের বাগদানের কথাও উচ্চারণ করেননি। তার সাথে আমার বিয়ের ব্যাপারটি ছিল শুধুমাত্র জিউমালেহ এবং আমার দাদার মধ্যে মৌখিকভাবে নির্ধারণ করা একটা চুক্তি। দিরিরের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছিল: সে ব্যক্তিগতভাবে আমাকে চিনতো না এবং আমি তাকে দেখিনি কখনো। সে কেবল আমার কাজিনের সাথে কথা বলে আমাকে বিয়ে করার বন্দোবস্ত পাকা করেছিল।

‘কিন্তু আউইল— সে-ই আমার একমাত্র স্বামী, যাকে আমি স্বেচ্ছায় বিয়ে করেছি। হয়তো পালিয়ে আসতে না হলে আমি ওকে বিয়ে করতাম না। অথবা বিয়ে করার বিষয়টি নিয়ে আরো ভাবতাম। কিন্তু আউইল আমার অবস্থার সুযোগ নিয়েছে এবং এভাবে আমার সাথে পালিয়ে যাওয়াটি তার জন্য ঠিকই ছিল। প্রথম দিকে, সে আমার সাথে বেশ অভদ্র আচরণ করেছে। কিন্তু শেষের দিকে, সে তার মনোভাব পরিবর্তন করেছিল। মাত্র দশটি দিন আমরা একসাথে কাটিয়েছি, কিন্তু এখন ছবির সেই মহিলার সাথে তার সম্পর্ক স্বাভাবিকভাবেই আমার হৃদয়ের স্বচ্ছ আয়নাটিকে ভেঙে দিয়েছে। এটি আমার হৃদয়কে ছোট ছোট টুকরো করে ফেলেছে। আর ভাঙা এই টুকরোগুলোকে জুড়ে আবার আমার হৃদয় আগের মতো হওয়া অসম্ভব। ওহ, আউইল যদি এটা জানতে পারতো— হয়তো আউইল আমাকে ছেড়ে চলে যাবে কিংবা, হয়তো সে আমার কাছে ফিরে আসবে, আমাকে কিছু অপ্রত্যাশিত এবং মিথ্যা কথার কাহিনী শোনাবে, এবং আবার আমার সাথে বন্ধুত্ব করবে। কিন্তু ধরুন, আউইল যদি টিফোর কথা জেনে যায়? এমনি মনে করুন, সে জেনে গেল, তাহলে কী হবে?

‘টিফো সম্পর্কে বেশি কিছু বলার নেই। সে একটা টাকার কুমির। আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে ধনী মানুষ। কিন্তু খুব বেশি মানুষের সাথে আমার পরিচয় হয়নি, তাই না? আমি যদি টাকা-পয়সা ও ধন-সম্পদের পেছনে দৌড়াতাম তাহলে হয়তো আমি গ্রামেই থেকে যেতাম আর আমার দাদার পছন্দ করা লোকটিকে বিয়ে করতাম: সেই লোকটিও হয়তো টিফোর মতোই বয়সী ছিল, আর এই রকমই মোটা।

‘আমার দাদার মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী,’ ইবলা ভাবে। নিজের সাথে বলা এটি হচ্ছে তার শেষ কথা।

‘আগামীকাল প্রভাত সূর্যের সাথে হয়তো কিছু সুখ আসবে আমার জীবনে,’ শব্দ করে বলে ইবলা। তারপর সে রাতের খাবার না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লো।

(চলবে)

বাঁকা পাঁজরের মেয়ে (পর্ব পনের ) // নুরুদ্দিন ফারাহ, অনুবাদ: লুনা রাহনুমা

Ajit Dash

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ভাষা
Scroll to Top