Home » ফ্লেক্স ।। খালিদা খানুম

ফ্লেক্স ।। খালিদা খানুম

শিশুটি আকাশ দেখছিল। ছেঁড়া ফাটা কাঁথার উপর চিৎ করে শোয়ানো। কোমরে কালো ডোর, তাতে কড়ি বাঁধা। সদ্য কামানো হয়েছে মাথা। উকুনে ভর্তি হতে পারে বলে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে পরিবারের তরফ থেকে। বাচ্চাদের চামড়ার রোগ বেশি হয়। তারপর জলের সমস্যা। এক বালতি জলে কোনদিক সাফ করবে, ভেবে পায় না শিশুটির মা। জলের সমস্যার সাথে সার্ফ সোডা সাবানের ও সমস্যা আছে তা শিশুর দিকে ভালো করে তাকালেই বোঝা যায়। যে পুঁটলির মতো বালিশের শিশুটি শুয়ে আছে, সেটির কভার বোধকরি কাঁচা হয়নি কোনদিন। তেল ও ধুলোর একটি পরিপক্ক পরত তৈরি হয়েছে। যে কাঁথাখানিতে শুয়ে আছে শিশুটি সেটিরও তেমনই অবস্থা। উপরন্তু সেটি ক্ষয়প্রাপ্ত।  তবু সে কাঁথাটি নিজের জীর্নদশা ঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারেনি একটি ফ্লেক্সের জন্য। কাঁথার উপর ফ্লেক্সটি পাতা। ফ্লেক্সটি বহু মূল্যবান সম্পদের মতোই মনে করা হয়, কারন ফ্লেক্সটি পাওয়াতে কাঁথা ভেজার পরিমান কমে গেছে, তার জন্য জল ও সার্ফ-সাবুন দুটোর খরচ কম হয়। শুধু তাই নয় ফ্লেক্সটি পেতেও কম হুজ্জত পেতে হয়নি।

ফ্লেক্সটি পেয়েছিল শিশুটির মা পাড়ার এক রাজনৈতিক সভায়। বিশাল বড় মাপের এক নেতা এসেছিলেন সেখানে। বিশাল বপু, দেখলেই মনে হয় একটা বড়সড় ব্যপার আছে। শিশু আর  পরিবারের বুড়ি সদস্যটি ছাড়া সবাই গিয়েছিল সভাটিতে। পার্কের পাশে খেলার মাঠটিতে বড় মঞ্চ বাঁধা হয়েছিল। ফুলে ফুলে সাজানো। দুটো সারি লাল ভেলভেটের কভার দেওয়া চেয়ার। মাটিতে কয়েকটা সারি চেয়ার তারপর চাটাই। ‘খিচুড়ি দেওয়া হবে’ এই লোভে সবাই এসেছিল তারা। তা ছাড়াও না এসে উপায় ছিল না। এই সব সভা-সমাবেশ মিটিং-মিছিলে তাদের যেতে হয়। তারা যাচ্ছে, তাদের বাবা ঠাকুরদারা গিয়েছে। যে শিশুটি শুয়ে আকাশ দেখছে সেই শিশুটিও যাবে হাঁটার ক্ষমতা পেলে। মঞ্চের উপরের বড় ফ্লেক্সগুলো আগেই কারো না কারো জিম্মায় চলে যায়। সেদিকে হাত বাড়াইনি শিশুটির মা। যেখানে বসার জন্য কার্পেট পাতা ছিল তার পাশের রাস্তার রেলিংএ বাঁধাছিল মিডিমায় সাইজের ফ্লেক্সটি। ফ্লেক্সটির দিকে নজর দিতে গিয়ে নেতার কথা অর্ধেক কানে প্রবেশ করেই হারিয়ে যাচ্ছিল। নেতা কথা বলছিল নগরোন্নয়ন নিয়ে। নগরোন্নয়ন শব্দ অনেক কঠিন। এর মানে জানে না শিশুটির মা। তবে কিছু কিছু কথা কানে এসে আঘাত করছিল। শিশুরাই হলো জাতির ভবিষ্যৎ, শিশুদের জন্য একটা সুন্দর পরিবেশ খুব জরুরি। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন শহর, একটা খেলার মাঠ, পার্ক খুব জরুরি এই শহরে। অপরিস্কার ফুটপাতগুলো দখলমুক্ত করে গাছ রোপণ করা হবে। সবুজায়ন খুব জরুরি। একটি গাছ একটি প্রাণ। ফুটপাথে পাশে বৃক্ষ রোপণ করা হবে।

শিশুটির মা এর মনোযোগ কিছুটা ফ্লেক্স এর দিকে আর কিছুটা বক্তব্যর দিকে হলেও সে খুশি হলো নেতার কথায়। নেতার টুকরো টাকরা কথার মধ্যে শুনেছিল, ‘পরিস্কার জল’ ‘ শৌচাগার ‘ ড্রেনেজ ব্যবস্থা ‘ টাইপের শব্দ গুলো। রাস্তার ধার ঘেঁষে তাদের যে বস্তিটি সেটা সত্যিই খুব নোংরা। বস্তির পর বড় রাস্তা তারপর উল্টোদিকে ভদ্রলোকদের বাস। বড় বড় দশ তলা বাড়ি। অবশ্য সেগুলোর বয়স বেশি না। শুনেছে ওখানে ঢোলকমলির জঙ্গল ছিল, রাতে শেয়াল ডাকত আর একটু বৃষ্টি হলে মনে হতো এটা একটা ডোবা। তারপর এখন সেখানে বিল্ডিং বড় বড়। তাতে অবশ্য একটু সুবিধা হয়েছে। বস্তির অনেকেই ফ্ল্যাটবাড়ি গুলোতে ঠিকে মাসির কাজ করতে পারে। ওইসব ফ্ল্যাটে কাজ পেলে তারা নিজেকে চাকরিজীবি মনে করে। শিশুটির মা ও একটি ফ্ল্যাটে কাজ করে। সেখানে সে সকাল থেকে দুপুরবেলা পর্যন্ত থাকে। প্রতিদিন শিশুর ভেজা কাঁথা কাপড় প্রতিদিন শুকনো করা খুব ঝক্কি। একে তো মোড়ের মাথা থেকে জল আনো, তারপর শুকনো করার জন্য রোদ চাই। রোদ বলতে ঝুপড়ির টালি বা ফুটপাথের রেলিং।  টালিতে পুঁইডাটার বাস সারাবচ্ছর। ফুটপাথের রেলিংটা নিয়েও কাড়াকাড়ি।

ফ্লেক্সটা হাতে পেয়েও বেগ পেতে হয়েছিল শিশুটির মা কে। কোথা থেকে উদয় হয়েছিল আরেক দাবীদার। তারা দুজনেই এক বস্তিবাসী, এক সমস্যায় জর্জরিত। তবু তারা দুজনেই জোর গলায় দাবী করছিল যে তার নিজের সমস্যা বেশি, তাই ফ্লেক্সটি তার প্রাপ্য। দুজনেই দাবী করছিল, ফ্লেক্সটি তার। কথা কাটাকাটি চলেছিল অনেকক্ষন তবু কিভাবে কি জানি শিশুটির মা জিতে গেল ঝগড়াটি ও শিশুটি পেল একটি নতুন বিছানা ।

শিশুটি হাঁটতে শিখেছে মাস ছয়েক। এখন চোখে চোখে রাখতে হয় সবসময়। ফুটপাতের পরের বড় রাস্তা। বাস ট্যাক্সি সবসময়। শিশুটি এখন বুড়ির দায়িত্বে। বুড়ি শিশুটির পিস-ঠাকুমা। স্বামীর বাড়ি ঘর করতে না পেরে বস্তিতে ফিরে এসেছিল। বিয়ে হয়েছিল বিহারের কোন গাঁয়ে। বিহারের গাঁ সম্পর্কে কারো ধারণা ছিল না। যৌবনকালের নেশায় মন মজিয়ে প্রেমিকের হাত ধরে চলে গিয়েছিল। গাঁয়ে গিয়ে দেখে সেখানে একটা পুরো পরিবার আছে। সতীনের সংসার গাই বাছুর, সন্তানে ভরপুর। সতীন তাকে দেখে খুব দুঃখী হয়নি,পরের দিন একটা গোবরমাখা ঝুড়ি ধরিয়ে দিয়ে গোয়ালঘর দেখিয়ে কিছু একটা বলেছিল দুর্বোধ্যভাষায়। বুড়ি গ্রামে থাকেনি কোনদিন। বস্তির ধারে জন্মাবধি থাকলেও গোবরের গন্ধ খুব নাকে লেগেছিল তার। তবু সে প্রতিদিন গোয়ালে যেত, অনেকটা হেঁটে কুয়ো থেকে জল আনত কলসি করে। একবেলা ছাতু আর অন্যবেলা মোটারুটি পেত সে। ধীরে ধীরে সে সব গা সওয়া হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু একদিন জঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে গেল, যখন তাকে ফিরিয়ে দিয়ে গেল কেউ বা কারা, তখন সে রাজা রানীর গল্প বলতে শুরু করেছে। প্রেমিক স্বামীটি পাগলের তকমা লাগিয়ে ফিরিয়ে দিয়ে গেল বস্তিতে। সে সব বহু অতীতের কথা।

শিশুটির মা সকালেই চলে যায় কাজে। বাবা বাইরে। বছরে দু বার আসে। টাকা পাঠায় মাঝে মাঝে। মোবাইলে টাকা পাঠানোর সুবিধা হওয়াতে টাকা পাঠানোর জন্য সমস্যা হয় না। শিশুটির মা এর কাছে থাকে সে মোবাইল। যখন শিশুটির মা ঘরে থাকে তখন শিশুটি মোবাইল দেখে। ঘরে ঝুপড়ির ভেতরে ছোট আলমারিটার উপরে একটা ছোট রঙিন টিভি আছে। সন্ধ্যা হলে শিশুটির মা বাংলা সিরিয়াল দেখে। রাতে ঘুম আসার আগে পর্যন্ত । শিশুটির মা যখন থাকে না তখন বুড়ি শিশুটিকে গল্প শোনায়। কোথা থেকে সে তার গল্পের ঝুড়ি ভর্তি করেছিল কে জানে, কিন্তু তার গল্পের ঝুড়িতে গল্প ছিল অনেক। রাজারানীর গল্প সে খুব ভালো বলতো। রাজারানীর গল্পে সে রাজপ্রাসাদের বর্ণনা এমন দিত যেন সে চাক্ষুষ দেখেছে। ভালো ভালো খাবারের বর্ণনা দিত। পক্ষীরাজ ঘোড়া ছুটিয়ে সে রাজা-রাজপুত্ররা যেত আকাশ পথে। বিশাল বড় মুখ সে পক্ষীরাজ ঘোড়ার। হাঁ করে নেমে আসত আকাশ থেকে। আর ছিল রাক্ষস। সেও ছিল শক্তিশালী।  তার ও ছিল অনেক শক্তি। রাজ্যের মানুষের ফসল নিয়ে যেত সে রাক্ষস। রাজা আসত পক্ষীরাজ ঘোড়া ছুটিয়ে। তুমুল যুদ্ধ।

কেবল শিশুটি নয়, বস্তিতে থাকা আরও অনেক বাচ্চারাও বসে সে গল্প শুনতো। নির্দিষ্ট কোন রুটিন থাকেনা বস্তির বাচ্চাদের। কোন একটা সরকারি স্কুলে নাম লেখানো আছে হয়তো।  মাসে যেদিন স্কুল খোলে বাচ্চাদের মা-বাবারা গিয়ে আলু-চাল নিয়ে আসে। কখনো কখনো ক্লাস হলে নিজের নাম সই করা শেখে তারা। হাইস্কুলে নাম লেখানো হলে স্কুল যায় সবাই। তখন দুপুরের খাবার নিশ্চিত হয়। গোঁফ গজালে আর স্কুল যায় না তারা। মাথায় টাকার চিন্তা ঢোকে। কিভাবে ঢোকে, কারা ঢোকায় তা বুড়ির রূপকথার গল্পের ঝুড়ির মতোই রহস্যময়।

বুড়ির কাছে রাজারানীর গল্প ছাড়া পরীর গল্প থাকে, অন্ধ সাধুর গল্প থাকে, চালাক শেয়ালের গল্প থাকে। তবে বাচ্চাদের সবচেয়ে প্রিয় গল্প হলো আজব দেশের গল্প। আজব দেশে বিশাল মোটা এক রাজা থাকে। সে সারাক্ষণ ঘুমায়। ঘুম থেকে উঠে নানা রঙের পোশাক পরে দেশ ভ্রমণে বেরোয়। দেশ ভ্রমণে ক্লান্ত লাগলে দেশে এসে ঘুমিয়ে পড়ে। রাজা এতো কুঁড়ে হওয়া সত্ত্বেও রাজার দেশে অশান্তি ছিল না। কারন রাজার পোষা কুকুরগুলো ছাড়া ছিল দেশ জুড়ে। অত্যন্ত প্রভুভক্ত সে কুকুরের দল রাজার বিরুদ্ধে কেউ কথা বললেই শ্বাস নালী ছিঁড়ে দিত। রাজার মিত্র সংখ্যাও ছিল বেশ কিছু, তারা প্রজাদের এক ধরণের মন্ত্র শেখাতো সবাইকে, যে মন্ত্র শিখলে মানুষ  তোতাপাখির রূপ পেয়ে যেত।

বুড়ি গল্পটা নতুন ফেঁদেছে।

শিশুটি ধীরে ধীরে বড় হচ্ছিল। নেতাটি সমাবেশ করে চলে যাবার পর বেশ কিছুদিন নগরউন্নয়নের ব্যপারে কোন উদ্যোগ দেখা যায়নি, তাতে কারো কিছু মাথাব্যথা নেই। শিশুটির মা বরং বিনিপয়সায় একটা ওয়েলক্লথ পেয়ে খুশি ছিল।

সেদিন দুপুরবেলা বুড়ি আবার নতুন একটা গল্প ফেঁদেছে। একটা শহরের গল্প। শহরে রাজা ছিল। রাজার প্রাণ ছিল না। রাজার হাঙরের মতো দাঁত। পেট ছিল আশমানের সমান বড়। সবকিছু গ্রাস করতে চাইত সে। ইট কাঠ মাঠ ঘাট এমনকি জ্যন্ত মানুষ  সবকিছু কড়মড়িয়ে চিবিয়ে খেত নিমেষে। শহরের মানুষ ভয়ে ভেবে পাচ্ছে না কি করবে! ভাবছে পালাবে। কিন্তু পালাবে কোথায়! পালাতে পালাতে পথ যদি শেষ হয়ে যায়!

শিশুরা মন দিয়ে শুনছিল গল্প। বুক ভয়ে দুরুদুরু, যদি এমন রাজা তাদের শহরে আসে।

এমন সময় প্রচন্ড যান্ত্রিক শব্দ দুলে উঠল। দৌড়ে বেরিয়ে এল শিশুটি। প্রকান্ড এক দানব যেন বুড়ির গল্পের ঝুলি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছে। লম্বা একটা গলা এদিক ওদিক দুলছে। বড় বড় দাঁতের চাপে খেলনাবাড়ির মতো ভেঙে যাচ্ছে বস্তির ঝুপড়ি বাড়িগুলো। বস্তিতে থাকা অল্পসংখ্যক মানুষ বুঝে উঠতে পারছে না কি করবে। প্রয়োজনীয় হাঁড়িকুঁড়ি চাল ডাল নিয়ে টানাটানি করছে।পুরুষ মানুষ, জোয়ান মহিলা কেউ নেই। যারা আছে তারা চিৎকার হাহুতাশ করে চলেছে। পলকে ভেঙে যাচ্ছে ঝুপড়ি গুলো। থালা বাসনের ঝনঝন শব্দ। বালি উড়ছে, ধুলো উড়ছে। শিশুটি পায়ে পায়ে চলে এসেছে একেবারে দানবের মুখের সামনে। বিশাল যন্ত্রটির কাছে তাকে একটা লিলিপুটের মতো লাগছে। শিশুটি দেখছে  যন্ত্রটিকে। সেটা যেন মোহবিষ্ট করে রেখেছে তাকে। নড়ছে না সামনে থেকে, যন্ত্রটি এগিয়ে আসছে তবুও।

শিশুটির বিছানা হিসাবে ব্যবহৃত হতো যে ফ্লেক্সটি সেটি উড়ে এলো কোথাও থেকে। বহু ব্যবহারে জীর্ন রংচটে গেলেও ফ্লেক্সে লেখা শব্দগুলো পড়া যায় এখনো। তাতে লেখা

“এ পৃথিবী প্রতিটি শিশু বাস যোগ্য করে তুলতে হবে “

Ajit Dash

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ভাষা
Scroll to Top