লিওন ট্রটস্কির আজ মৃত্যু বার্ষিকী। তাঁর রাজনীতি, তাঁর মনীষা, রুশ বিপ্লবে তাঁর অবদানের বিষয় আলোচনার জন্য বহু তাত্ত্বিক-বিশেষজ্ঞ আছেন। আমরা বরং অন্যদিকে একটু মনযোগ দিই না কেন?
১৯২৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল লিওন ট্রটস্কিকে। যদিও রুশ বিপ্লবে লেনিনের পরই ছিল তাঁর গুরুত্ব।
রুশ দেশ ছেড়ে ইস্তাম্বুলের কাছাকাছি মারমারা সাগরের ছোট্ট এক উপকূলীয় দ্বীপে প্রথমে বসবাস শুরু করেন ট্রটস্কি। চার বছর ছিলেন সেখানে। বহুমুখী বিপদের মুখেই সময়টি কেটেছে তাঁর এখানে। বলশেভিক বিপ্লব বিরোধী একদল অভিবাসীর বিরাগভাজন হন তিনি পূর্বপরিচিতির কারণে। আবার তখনকার সোভিয়েত নেতৃত্বের তরফ থেকেও জীবনাশঙ্কা ছিল। ইউরোপের বন্ধুরা তখন স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে ট্রটস্কির নিরাপত্তায় এগিয়ে আসলেন।
১৯৩৩ সালে ফ্রান্স ট্রটস্কিকে আশ্রয় দিতে রাজি হয়। শর্ত ছিল প্যারিসে ঢুকবেন না তিনি কখনো। কিন্তু রাজনৈতিক বন্ধুদের সঙ্গে বৈঠক করতে গোপনে প্যারিস আসতেন তিনি। ১৯৩৫ সালে ফ্রান্স থেকেও বের করে দেয়া হয় তাঁকে।
এরপর ট্রটস্কি নরওয়েতে যান। সোভিয়েত প্রভাবে নরওয়ে সরকার ১৯৩৬-এর শেষদিকে গৃহবন্দি করে রাখে তাঁকে।
ট্রটস্কির পরবর্তী গন্তব্য ছিল মেক্সিকো। এখানেই ফ্রিডা কাহলোর সঙ্গে তাঁর পরিচয় ও প্রেম। ‘দ্য ব্লু হাউস’ নামে মেক্সিকোতে যে বাড়িতে তিনি প্রথম থাকতেন সেটা ছিল দিয়েগো রিভেইরা ও তাঁর স্ত্রী ফ্রিডার।
রিভেইরা ও ফ্রিডা উভয়ে ছিলেন প্রতিভাবান চিত্রশিল্পী। তবে রিভেইরা স্থানীয় শিল্পবোদ্ধা মহলে তখন এতটাই প্রভাবশালী ছিলেন যে ফ্রিডার মতো নবীন প্রতিভাবানদের পেশাগত বিকাশে তার মদদ দরকার হতো। সে সূত্রেই তাদের বিয়ে হয় বলে কথিত ছিল।
ট্রটস্কির বিশেষ অনুরাগী ছিলেন বামপন্থী রিভেইরা ও ফ্রিডা উভয়ে। মেক্সিকোতে ট্রটস্কিকে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে রিভেইরার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু দেশটিতে স্বাগত জানানোর মুহূর্তে ফ্রিডাই ছিলেন কেবল জাহাজ-বন্দরে।
রিভেইরার সঙ্গে সম্পর্ক বেশি সময় টেকেনি ট্রটস্কির। ফলে একই এলাকায় অন্য একটি বাড়িতে উঠতে হয় তাঁকে। এসময়ই ট্রটস্কি লিখছিলেন বিখ্যাত গ্রন্থ ‘রুশ বিপ্লবের ইতিহাস।’
ফ্রিডা ও ট্রটস্কি : প্রেম ও প্রণয়
ফ্রিডার সঙ্গে ট্রটস্কির প্রেমের পটভূমি তৈরি করে দিয়েছিলেন অনেকখানি রিভেইরাই। বয়সে তিনি ছিলেন ফ্রিডার অনেক সিনিয়র আর যৌনজীবনে ছিলেন চরম অবিশ্বস্ত। ফ্রিডার বোন ক্রিস্টিনার সঙ্গে বহুদিন ধরে রিভেইরার সম্পর্কে ক্লান্ত ফ্রিডা বন্ধু হয়ে ওঠেন ট্রটস্কির– শেষোক্তজনের বয়স তখন ৫৮। আর ফ্রিডার মোটে ৩০।
এসময় ট্রটস্কির দ্বিতীয় স্ত্রী নাতালিয়া সিডোবা’র সঙ্গেও রিভেইরার স্বল্পস্থায়ী মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। আর ফ্রিডা মুগ্ধ ছিলেন ট্রটস্কির সাহচর্যে। ১৯৩৭-এর মেক্সিকোতে তখন তীব্র শীত।
ফিডাকে অনেক বই পড়তে দিতেন এসময় ট্রটস্কি। যার ভেতরে লুকানো থাকতো আবেগময় প্রেমপত্রও। নিকটজনের কাছে নিজেদের আবেগ আড়াল করতে ফ্রিডা ও ট্রটস্কি পরস্পরের সঙ্গে কথা বলতেন ইংরেজিতে।
‘বিটুইন দ্য কার্টেইনস্’
রিভেইরার বাড়ি ছেড়ে আসার সময়ই ফ্রিডা ট্রটস্কিকে বিটুইন দ্য কার্টেইনস্ নামে তাঁর আত্মপ্রতিকৃতি’র বিখ্যাত চিত্রটি উপহার দেন। কিন্তু ট্রটস্কি সেটা ভুলবশত ঐ বাড়িতেই ফেলে আসেন। ভিন্নমতে নাতালিয়ার আপত্তির কারণে ট্রটস্কি চিত্রকর্মটি সঙ্গে নেননি।
এই পেইনটিংয়ে ফ্রিডার হাতে একটি চিরকুটও ধরা ছিল, যাতে লেখা ছিল: ‘এই ছবি উৎসর্গ করছি– ট্রটস্কিকে, গভীর ভালোবাসার সঙ্গে; ফ্রিডা কাহলো, ৭ নভেম্বর ১৯৩৭। সান এনজেল, মেক্সিকো।’ উল্লেখ্য, ৭ নভেম্বর যেমন রুশ বিপ্লবের বার্ষিকী– তেমনি ট্রটস্কিরও জন্মদিন।
বলাবাহুল্য, প্রায় আট দশক পরও বিটুইন দ্য কার্টেইনস্ বিশ্ব শিল্পবোদ্ধা মহলে যে বিশেষভাবে আলোচিত হয় তার কারণ ট্রটস্কি। ছবিটির শিল্পমূল্যও উচ্চপ্রশংসিত। এতে ফ্রিডাকে দেখাচ্ছে অনুরাগী ও আত্মবিশ্বাসী এক সুন্দরী হিসেবে।
ফ্রিডা বিশেষ অনুরাগের মুহূর্তগুলোতে ট্রটস্কিকে ডাকতেন ‘বুড়ো’ বলে। ফ্রিডা ও ট্রটস্কি’র এই ‘সম্পর্ক’ শেষোক্তজনকে হত্যার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত বহাল ছিল। তবে এই ‘বন্ধুত্ব’-এর বিস্তারিত কোন স্মৃতিচিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না। ট্রটস্কির জীবনীকার বাট্রান্ড পার্টেনিউড লিখেছেন, শেষদিনগুলোতে ট্রটস্কি ফ্রিডার কাছ থেকে তাঁর লেখা চিঠিগুলো নিয়ে পুড়িয়ে ফেলেন।
১৯৩৮-এর নভেম্বরে ফ্রিডা কাহলো’র প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী হয় নিউয়র্কের জুলিয়ান গ্যালারিতে। সেখানেই বিশ্ববাসী ‘বিটুইন দ্য কার্টেইনস্’ ছবিটি দেখে দুই মহান চরিত্রের অমর প্রেমের অপ্রকাশিত অধ্যায় সম্পর্কে খানিকটা জানতে পারে।
১৯৪০-এ বিটুইন দ্য কার্টেইনস্ কিনে নেয় ফ্রিডার বন্ধু ক্লেয়ার লুসি। পরে লুসি তা ওয়াশিংটনের ‘ন্যাশনাল মিউজিয়াম ফর ওয়েমেন আর্ট’-এ দিয়ে দেন। আজো স্থায়ীভাবে সেখানেই আছে ঐ পোর্টেট।
উল্লেখ্য, ১৯৩৯-এ রিভেইরা ও ফ্রিডার বিয়ে ভেঙ্গে যায়। তবে পরের বছর দু’জনে আবার বিয়ে করেন। অন্যদিকে, ১৯৪০-এর ২০ আগস্ট নিজ বাড়িতেই আততায়ীকর্তৃক মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হন ট্রটস্কি এবং পরদিনই মারা যান। পরবর্তী দীর্ঘ অনুসন্ধানে দেখা যায় আততায়ীকে ট্রটস্কির রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তাঁর বাড়িতেই কাজের লোকের ছদ্মবেশে নিয়োগ দিয়ে রেখেছিল।
ফ্রিডা বেঁচেছিলেন ১৯৫৪ পর্যন্ত।