পোড়া গ্রামে পহেলা বৈশাখ // সৈয়দ আব্দুল মালিক // অসমিয়া থেকে অনুবাদ: বাসুদেব দাস

আমি এখানে আবার কেন ফিরে এলাম? বারবার ফজলের মনে এই প্রশ্নটাই আসছিল। এটাতো আমার বাড়ি নয়। সরকার থেকে দান হিসেবে পাওয়া কয়েকটি টিন বাঁশের খুঁটিতে আটকানো রয়েছে মাত্র। দরজা নেই, জানালা নেই, মাঝখানে একটা বেড়া পর্যন্ত নেই। ঘরের ভেতরে দ্বিতীয় কোনো প্রাণী নেই। কেবল দুটি গরু রয়েছে। গরু দুটিও কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে। কোনো রকম গন্ধ পায় নাকি? আমি কিসের জন্য গরু দুটিকে রামেশ্বর নেপালির বাড়ি থেকে নিয়ে এলাম? এবং ভালুকার বাড়ি থেকে আনা নতুন লাঙ্গলজোড়া-কী যে মুর্খামি! আগের লাঙ্গল জোয়াল সবই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এটাই কি আগের ভিটে? পুরোনো ভিটেতে নতুন ঘর। ফজল সেখানে আছে। একটাই ঘর। তারই এক পাশে সে থাকে, অন্যপাশে গরু দুটি- একই ঘরের ভেতরে। এক বাণ্ডিল টিন দিয়ে জাতি বাঁশের উপরে তৈরি ঘর। গোয়ালঘর, রান্নাঘর কিছুই নেই। এই চালার নিচেই সবাই- মানুষ, গরু, হাঁড়ি, সসপেন, কাঁসার বাটি। একটা মাটির কলসিতে জল। বাক্স প্যাঁটরা কিছুই নেই। বাঁশের মাচায় তৈরি বিছানা- তুলো বালিশ কিছুই নেই। মশারিও নেই। গ্রামের সমস্ত মশা বাড়িগুলির সঙ্গে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সে ছেঁড়া শার্টটা, কুর্তা আর দুটি লুঙ্গির একটি পরার জন্য রেখে বাকিটা বালিশ হিসেবে ব্যবহার করে। কখনও ঘুম আসে, কখনও সারা রাত জেগে কাটাতে হয়। তুলো,বালিশ বড় কথা নয়। টিনের চালার ঘরের ভেতরে মাথা গুঁজে থাকাটা কম কথা নয়। সেই স্কুলের মেঝেটা অবশ্য এতটা খারাপ ছিল না, অন্তত এতটা ভেজা ছিল না। তুলো, বালিশ সেখানেও ছিল না। রিলিফ ক্যাম্পে সেইসব আশা করাটাও মূর্খামি।
সেখানে একটা ব্যাপার খারাপ ছিল না। ভাত-তরকারি নিজে রাঁধতে হত না। কিন্তু বারোয়ারি রাঁধুনী রান্না করা ভাত তরকারিতে স্বাদের লেশমাত্র নেই। ক্ষুধার জ্বালা অপরিসীম না হলে কিছুই খাওয়া হত না। আর প্রতিদিন সেই ভাত আর ডাল, এবং দুটুকরো আলু আর সঙ্গে একটু নুন।

একটু মাছ না হলে ফজলের পেটে ভাত যায় না। মাছ ধরার সরঞ্জাম থাকলে তো কথাই নেই, এমনকি শুধু হাতেও সে কৈ,মাগুর,পুঁটি ট্যাংরা ধরে আনে। গ্রামের লোক তাই তার নাম রেখেছিল উদ বেড়াল। তবে রিলিফ ক্যাম্পে তাদের কে মাছ খাওয়াবে? ডালের জল আর ভাত যে পাওয়া যাচ্ছে সেটাই যথেষ্ট। যারা কাটা পড়ল না, দৌড়ে গিয়ে জঙ্গলে লুকিয়ে রইল, তারা ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পরে, অবস্থা ভালো হয়েছে ভেবে ভাতের খোঁজে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসেছিল, ওদেরকেও ধরে ধরে কেটে ফেলল। তারচেয়ে নিজের গ্রামে সংঘটিত যুদ্ধে কাটা গেলেই ভালো হত। লড়াইয়ের দিন ফজল বাড়িতে ছিল না। নদীর ওপারের লালুং গ্রামে গিয়েছিল। সেখানকার গোলক মুদৈ গত বছরই দেড়শো টাকা ধার নিয়েছিল। টাকাটা আদায় করতেই গিয়েছিল। ভলুকা বাঢ়ৈ তার লাঙলে কাঁঠাল কাঠের জোয়াল লাগিয়ে দেবে বলেছিল, সেটার জন্যও যেতে হবে। দুইটি গ্রামের মাঝখানের জঙ্গলের পশ্চিমে থাকা বিলটা ঠিক-ঠাক আছে কিনা তারও খবর করে আসতে হবে।
বাড়ির লোকজন এই সময় তাকে গ্রাম ছেড়ে যেতে বাধা দিয়েছিল। কখন কোথায় কী ঘটে যায় তা বলা যায় না। চারপাশে কাটাকাটি মারামারি চলছে।
স্ত্রী বাধা দিয়েছিল। ওদের সঙ্গে আমোদ আল্লাদ করার কী আছে। আমাদের মানুষ যেখানে যাচ্ছে সেখানেই কাটছে, মারছে। ওদের হাতে বন্দুক, বারুদ, মেশিনগান আছে। একটা দুটো নয় হাজার হাজার। আগুন জ্বালিয়ে নেভানো যায় না। ওদের উকিল হাকিমরাই নাকি বুদ্ধি দিচ্ছে- আমাদের মানুষদের মারার জন্য। বাড়ি ছেড়ে তোমার দূরে যাবার দরকার নেই… ছেলেমেয়েরাও এসময় ফজলকে বাড়ি থেকে না বেরোনোর জন্য জোর করেছিল। ফজল মুখ ভেংচে বলেছিল- ‘তোদের আমাকে বোঝাতে হবে না। তাড়িয়েছে যদি, কাটছে যদি, মারছে যদি বিদেশিদের কাটছে। আমি কি বিদেশি নাকি?’
বড় মেয়েটি বলেছিল, ‘জেলিলদের গ্রামটা বিদেশিদের গ্রাম ছিল নাকি? সেটা নাকি আমাদের গ্রামের চেয়েও পুরোনো মিঞাদের গ্রাম। সেখানকার মানুষদের মেরে কেটে শেষ করে দিয়েছে। প্রতিটি বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। কোথাও যেতে হবে না।’
জেলিলকেও অবশ্য কেটে ফেলেছিল। জেলিল ফজলের বাড়িতে মাঝেমধ্যে আসা-যাওয়া করত। ফজলের মেয়ের ওপরে চোখ দিয়েছিল। মেয়েরও জেলিলকে ভালো লেগেছিল। কিন্তু সেও কাটা পড়ল।
‘তোরা এমনিতেই ভয় পাচ্ছিস। আমাদের গ্রামে থাকা প্রতিটি মানুষ কতদিনের পুরোনো তা সবাই জানে। আমাদের ফেরদৌসি আলি হাই স্কুল স্থাপিত করার পঞ্চাশ বছরেরও বেশি হয়েছে। আকরাম আলীর দাদু নিজের জমি দিয়ে স্কুল ঘর সাজিয়ে দিয়েছিল। সেখানে কি কেউ বাংলা পড়াচ্ছে নাকি?’
‘ হাসিম বাজারের এম ই স্কুলটাও তো পুড়িয়ে দিয়েছে। সেটাও কি আমাদেরই লোকজন প্রতিষ্ঠা করা অসমিয়া স্কুল ছিল না? সেই কবেকার স্কুল।’
ফজল বলল, ‘আমার জন্য তোদের চিন্তা করতে হবে না। আজকে গিয়ে আগামীকাল আমি ফিরে আসব, তোরা গ্রামের মানুষদের মতে সাবধানে চলাফেরা করবি। কোনো বিপদ হলে অন্যরা যা করে তোরাও তাই করবি।’
দুদিন পরে ফজল নিজের গ্রামে ফিরে এসেছিল। এসে কাউকে দেখতে পেল না। গ্রামটাই নাই হয়ে গেছে। ওদের ঘর বাড়ি কোন জায়গায় ছিল সেটা সে নির্নয় করার চেষ্টা করল। সমস্ত ঘর বাড়ি পুড়ে একই রকম কালো ছাই হয়ে গেছে। বুড়ো মানুষ এবং ছোট ছেলেমেয়েরা বাড়িঘরের সঙ্গে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ঘর পোড়া ছাই এবং মানুষ পোড়া ছাইয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সেই ছাই মাড়িয়ে সে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিল।
এই জায়গাটাতেই তার ঘরটা ছিল। চারটি নারকেল গাছের সমস্ত পাতা জ্বলে গেছে। আগুন হয়তো অনেক দূর অব্দি উঠেছিল। দুটি আমগাছ এবং সুপুরিগাছের পাতাগুলিও জ্বলে গেছে।
ঘরের ভিটের উপর উঠতে তার খারাপ লাগল। ছাই ঢেকে ফেলেছে। তার ছোট ছেলেমেয়ে দুটিকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে।ছয় বছরের মেয়েটি অবশ্য ঘর থেকে বেরিয়ে দৌড়ে উঠোনের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। কেউ একজন এক কোপে কেটে টুকরো করে ফেলল। অন্য একজন ধড়ফড় করতে থাকা টুকরোগুলি আগুনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে হা হা করে হেসে অন্য জনকে কাটতে এগিয়ে গেল।
ফজল পরে এই সমস্ত কথা শুনেছিল।
এই ছাইগুলি তার ছেলে মেয়েদের ছাইও হতে পারে। মাড়িয়ে যেতে তার খারাপ লাগছিল। বন্দুকধারী পুলিশ কয়েকজন একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। পাহারা দিচ্ছে। খুব তেষ্টা পেয়েছিল। রৌদ্রের তাপ বেশি। সে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে এটা পাতা পুড়ে যাওয়া গাছের ছায়ায় বসল। আকাশে কয়েকটি শকুন আপন মনে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। নদীতীরের বাঁশবনে কয়েকটি কাক চিৎকার করছিল। ভিজে মাটি এবং ছাইয়ের বুক থেকে একটা দুর্গন্ধ ভেসে আসছিল। ফজলের হাত-পায়ে কোনো সার পাচ্ছিল না বলে মনে হচ্ছিল।
বন্দুক হাতে পুলিশগুলি তার দিকে তাকাতে তাকাতে কিছু কথা বলছিল এবং সিগারেট টানছিল। ওদের কয়েকটি আধপোড়া গাছ বলে মনে হচ্ছিল।
ফজলের মনে হচ্ছিল ক্ষুধার কথা সে ভুলে গিয়েছিল। ক্ষুধার চেয়ে যেন ক্লান্তিই ছিল বেশি। তার গলাটা শুকিয়ে আসছিল। সে রোদে চোখ দুটো ভালো করে মেলতে পারছিল না।
দুটো পুলিশ তার দিকে এগিয়ে এসেছিল। সে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। তার শুকনো গলাটা ভেজানোর জন্য সে একটু জল খেতে চাইল। কিছুটা দূরে কয়েকটি ঘর মিলেমিশে খনন করা পুকুরটির দিকে তাকাল। জল আছে কিন্তু অনেকটা নিচে। পুকুরের জল শুকিয়ে গেছে।
পুকুরের দিকে এগিয়ে যেতে চাইছিল বলে পুলিশ ওই পুকুরের জল খেতে তাকে নিষেধ করল। ফজল পুলিশের মুখের দিকে তাকাল- তার কথাটা সে বুঝতে পারেনি।
বেশ কয়েকটি মানুষকে কেটে পুকুরে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। লাশগুলি পচে গিয়েছিল। লোকগুলি দা-ছুরিতে লেগে থাকা রক্ত পুকুরে ধুয়েছিল। পুকুরের জল লাল হয়ে গিয়েছিল।’ পুলিশটা যেন ফজলের কাছে কৈফিয়ত দিচ্ছে। কথাগুলি ফজল ভালো করে বুঝতে পারছিল না বলে মনে হল।
‘আমার খুব তেষ্টা পেয়েছে- সে কোনোমতে বলল।
পুলিশ তাকে একটু দূরে ওদের ক্যাম্পে নিয়ে গেল এবং টিউবয়েলের জল খেতে দিল। সে এক গ্লাস এক গ্লাস করে চার গ্লাস জল খেল। জলে একটা কাঁচা রক্তের গন্ধ রয়েছে বলে মনে হল তার। কাঁচা রক্ত শুকিয়ে গেলে যেরকম গন্ধ করে সেরকম গন্ধ। তার বমি আসছে বলে মনে হল। পুলিশেরা তার সমস্ত খবর নিয়ে তাকে একটা রিলিফ ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিল।ভলুকাদের গ্রামে যাবার সময় পরনের পোশাক ছাড়া একটি লুঙ্গি, একটি বেনিয়ান সে নিয়ে গিয়েছিল। অতিরিক্ত কাপড়গুলি এখন তার কাজে এল। রিলিফ ক্যাম্পে কয়েকটি কথায় তার বড় অস্বস্তি হয়েছিল। ক্যাম্পের মানুষগুলি কয়েকটি আলাদা আলাদা গ্রামের। প্রায় মানুষগুলিই চুপচাপ থাকে। খুব বেশি কথাবার্তা বলে না। যেন কে কী কথা বলে কেউ যেন কান পেতে শুনে, অন্য কাউকে গিয়ে বলে দেবে। লোকগুলি কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। যেন সবাই কিছু সার্কাসের জন্তু- রিং মাস্টার একটু দূরে সরে গেলেই একে অপরের ওপর ঝাপিয়ে পড়বে।
একই ধরনের ভাত তরকারিতে কোনো ধরনের স্বাদ গন্ধ নেই। এভাবেই প্রতিদিন একই রান্না খাওয়াটা এক ধরনের শাস্তি।
লোকগুলির কার কী ক্ষতি হল তার একটা হিসেব মনে মনে করে নেয়। অন্য কারও সামনে খুব একটা আলোচনা করে না। যেন আমার বাইরে আমার পরিবারের প্রত্যেককে কেটে মেরে ফেলেছে কথাটা বলাও অপরাধ ক্যাম্পে। ক্যাম্পে থাকা মানুষগুলির যেন কোনো দুঃখ দুর্দশার বোধ নেই। কোনো কাজ না করে বসে থাকতে হওয়ায় ফজলের মতো অনেকের খুব বিরক্তি বোধ হতে থাকে। এমনিতেই হাতে কোনো কাজ ছাড়া এভাবে বসে থাকাটা একটা শাস্তি। কোথায় ফিরে যেতে হবে সঠিক ভাবে না জানা পর্যন্ত আর ফিরে গেলে কি অবস্থা হতে পারে বড় বেশি চিন্তা না করে প্রত্যাকেই যত দ্রুত সম্ভব ক্যাম্প থেকে ফিরে যাবার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল।
এটা আশ্রয় শিবির নয়-বন্দিশালা।
প্রচন্ড ঝড় উঠেছিল। বিদ্যুতের গর্জন, তুফান, ঘরবাড়ি গাছপালা সমস্ত কিছু লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল। ঘন ঘোর অন্ধকারে কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছিল না। সেই অন্ধকারে মানুষগুলি কী একটা যুদ্ধ করছিল। অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। কতজন তা কেউ বলতে পারে না। নিজের নিজের গ্রামে ফিরে গেলে হয়তো হিসাব বের করা যাবে কারা কারা হারিয়ে গিয়ে। এখানে রিলিফ ক্যাম্প সেই সব হিসাব করে লাভ নেই ।
সমস্ত গড়বড় হয়ে গেল।
সমস্ত ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল।
জীবন্ত মানুষ গুলি মরে গেল।
জীবন্ত গ্রামগুলি শ্মশান হয়ে গেল। আকাশের মুখে কালো ছাই।
চুয়ান্ন দিন পরে ফজলদের ক্যাম্প উঠে গেল। মানুষগুলি নিজের নিজের জায়গায় ফিরে গেল। কিছু নিখোঁজ হয়েছে-ক্যাম্পে নেই, হাসপাতালেও নেই, জঙ্গলে রয়েছে এমন কোনো খবর নেই। ফজলদের নিয়ে বাসটা এসে পোড়া গ্রামের সীমান্তে দাঁড়িয়ে পড়ল। গ্রামে গরুর গাড়ি আসা-যাওয়া করতে পারছিল না। বড় বাস ট্রাক আসা সম্ভব ছিল না। রাস্তাটা সংকীর্ণ, উঁচুও নয়। বর্ষায় রাস্তার উপর দিয়ে জল গড়িয়ে যায়। গ্রামের সীমান্তে থাকা সেতুটা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এখনো তৈরি করা হয়নি।
বাসটা দাঁড়িয়ে পড়ল।
এক এক করে এগারো জন বাস থেকে নামল। ফজলও নামল। তারও অনেক দূর থেকে কোনো এক অপরিচিত জায়গা থেকে তারচেয়েও অপরিচিত একটা জায়গায় এসেছে বলে মনে হল। বাসটা ওদের নামিয়ে দিয়ে ফিরে গেল।
ফজল চোখ দুটো বড় বড় করে চারপাশে তাকাল। জায়গাটা তার কাছে একেবারে অপরিচিত বলে মনে হল। কড়া রোদ উঠেছে। চৈত্র মাসের রোদ। ছেঁড়া জামাটা শরীর থেকে খুলে ফেলে কাঁধের উপরে রেখে দিল। তার কাপড়ের ছোট পুঁটলিটা এবং রিলিফের চাল ডালের পুঁটলিটা হাতে নিয়ে অন্যান্য মানুষগুলির পেছন পেছন ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে লাগল। তার মনের মধ্যে নিজের গ্রামে, নিজের ঘরে ফিরে আসার কোনো আনন্দ উৎসাহ নেই। বাতাসে আগের সেই পরিচিত গন্ধটা নেই। অন্য সময়ে এই চৈত্র মাসে সকালের রোদ একটি মিষ্টি গন্ধ ছড়ায়। নদীর পাড়ের জঙ্গলে বনফুল ফোটে। গাছের কচি পাতাগুলি থেকেও একটি কোমল গন্ধ ভেসে বেড়ায়।
একটা শুকনো শুকনো কাঁচা গন্ধ ফজলের নাকে এসে লাগল। শ্মশানের গন্ধ, কবরস্থানের গন্ধ। এই দুর্গন্ধ এর আগে তার নাকে কোনদিন লাগেনি। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে বলে মনে হল তার।
পোড়া গ্রামটিতে বেঁচে থাকা কিছু মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে। বেশিরভাগ মানুষকেই কেটে ফেলেছে। মহিলা এবং ছোট বাচ্চাদের কেউ বেঁচে নেই। কোলের এক মাসের শিশু থেকে শুরু করে দৌড়ে পালিয়ে যেতে না পারায় দশ বারো বছরের ছেলেগুলি এবং বুড়োবুড়ি সবাইকে কাটা হয়েছে। শরীরে শক্তি থাকা যুবকগুলি এবং তাদের মতোই লড়াইয়ে সক্ষম দুই চারটি মেয়ে এবং বৌ কোনোভাবে বেঁচে গেছে। কেউ আলো-আঁধারিতে দৌড়ে গিয়ে নদীতে, গর্তে বিলে আশ্রয় নিয়েছে। কয়েকজনকে সেখানেই বল্লম দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেছে।
কিছু হারিয়ে গেছে।
হারিয়ে গেছে মানে ওদের কাউকে খুঁজে পাওয়া গেল না। কোথাও বেঁচে আছে যদিও কোনো খবর পাওয়া গেল না। ওদেরকে মৃত্যুর তালিকাতেই ধরা হল।
গ্রামটি এখন কবরস্থান।
যে সমস্ত মানুষকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে, ওদের মুখে কথাবার্তা নেই। এরাও যেন এক প্রকারের মৃত মানুষ। জীবন্ত কিছু কঙ্কাল বসে রয়েছে, উঠে দাঁড়ায়, হাঁটে, কুঁজো হয়, সোজা হয়, কীসব বলে যদি ও ওদের ঠোঁটগুলি যেন নড়ে না।
বাস থেকে নামা মানুষগুলির দিকে অন্য রিলিফক্যাম্প থেকে আগেই ফিরিয়ে আনা মানুষগুলি এভাবে আড়চোখে তাকায় যেন তারা এই মানুষগুলোকে চিনতেই পারছে না।
ফজলও ওদের দিকে সেভাবেই তাকায়-মুখে কিছু বলে না।
ফজল গোঁয়ার প্রকৃতির মানুষ। কম কথা বলে, মানুষের সঙ্গে বসে ঢলাঢলি করে বেড়ায় না। গরু –ছাগল, মুরগি, হাঁস, স্ত্রী এবং ছেলে মেয়ের সঙ্গেই তার বেশি ঘনিষ্ঠতা। অন্য কিছু না হলেও তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাসের জন্য সে ঘরের পাশেই থাকা মসজিদটাতে ফজরের নামাজ পড়তে যায়। বাড়িতে থাকলে, সময় পেলে মগ্রিবের নামাজও পড়ে। সে মাটির পোকা- সারাটা দিন মাঠেই লেগে থাকে। ধান-পাট আলু বিক্রি করে সে নিজের পরিবারকে প্রতিপালন করে। এবং বিপদে-আপদে অন্যকে দু-পয়সা দিয়ে সাহায্য করে।
কিন্তু এখন তার পরিবারের সেই বেঁচে আছে। তার স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে কোথায় গলে পচে অসনাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে কে জানে। হাসপাতাল থেকে যারা এসেছে তাদের অনেককেই চেনা যায় না- কারও হাত নেই, কারও পা নেই কারও বা নাক কান নেই, কারও মাথায় হাত বুক কোমরে মস্ত বড় ব্যান্ডেজ।
ফজল নিজের গ্রামে ফিরে এসেই হঠাৎ অনুভব করে যে তার আগের পরিচিত পৃথিবীটা নাই হয়ে গেছে। আগের পরিচিত মানুষগুলি নাই হয়ে গেছে। সমস্ত মানুষ যেন এটা বিরামহীন কান্নায় পরিণত হয়েছে। মানুষগুলির নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস অন্তহীন দীর্ঘশ্বাসে পরিণত হয়েছে। কোনো একজন ঠিকাদার একদিনেই তৈরি করে দেওয়া টিনের চালা টিনের বেড়ার ঘরের ঠাণ্ডা মেঝেতে শুয়ে ফজল অনুভব করে যেন কবেই সে মারা গেছে এবং তার হাত-পাগুলি নাই হয়ে গেছে।
অন্য মানুষগুলি তার মত পরিবারের সবাইকে হারিয়ে সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েনি। ওরা অন্ধকারে বসে কী কি সব বলাবলি করছে। যেন কিছু চিন্তা করছে।
কিন্তু রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, তার চোখ বুজে আসার সঙ্গে সঙ্গে সে অনুভব করে যেন কাটা যাওয়া মানুষগুলি, ছেলেমেয়েগুলি এক এক করে ঘরের মেঝে এবং উঠোনের বুক থেকে বেরিয়ে আসছে। ওদের কারও গায়ে কাপড় নেই, সবাই উলঙ্গ। ওরা যেন কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। তার মনে হয় যেন অন্ধকারের মধ্যে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ানো কোনো মানুষই সম্পূর্ণ নয়। কারও কেবল একটি মাথা, কারও মাথাবিহীন শুধু শরীর, কারও আবার হাত-পা-মাথা কিছু নেই। কিন্তু শুধু শরীরটাই কাউকে যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে। হয়তো নিজের মাথাটা খুঁজে বেড়াচ্ছে। মাথাটা হয়তো নিজের শরীর খুঁজে বেড়াচ্ছে।
ফজল ওদের মধ্যে নিজের পরিবারের কারও হাত, মুখ দেখতে পায় কিনা সে চেষ্টা করে। কিন্তু কারও মুখ সে চিনতে পারে না।
সে বুঝতে পারল এটি তার আগের পরিচিত গ্রাম নয়। এটি একটি কবরস্থান- শ্মশান, এটা তার বাড়ি নয়। একটা কবরে সে একাই রয়েছে। এখানকার সমস্ত মানুষ কিছু কবরের মধ্যে ঢুকে আছে।
সে কেবল বোঝার চেষ্টা করে সে এবং সঙ্গের মানুষগুলি এই কবরস্থানে কেন এসেছে? কেন এখানে এভাবে থাকতে শুরু করেছে?
কয়েকদিন ফজলের এভাবেই পার হয়ে গেল। মাঝেমধ্যে তার মনে হয় যেন তার কোথাও কোনো পরিবার-পরিজন ছিল না। স্ত্রী ছেলেমেয়ে ছিল না। সে বাড়ি তৈরি করেনি, খেতি করেনি, ধানক্ষেত থেকে বাড়িতে বয়ে ধান আনেনি, বিয়ে-সাদি করেনি, তার কেউ ছিল না, তার কিছুই ছিলো না – সে ছিল না সে কখনও ছিল না
কিন্তু কয়েকদিন পরে সে দেখতে পেল যে এই শ্মশানে থাকার জন্য মানুষগুলি অন্য জীবন্ত মানুষের মতোই সরকারের কাছ থেকে পাওয়া টাকা দিয়ে অথবা গরুর সাহায্যে চাষ করার আয়োজন করছে। যারা মরেছে তারা মরেছে। আমাদের মধ্যে যারা বেঁচে রয়েছে তাদের তো কিছু একটা খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে হবে। চাষ না করলে কীভাবে চলবে? সরকার কি সব সময় খাওয়াবে নাকি?
কথাগুলো শুনে ফজরের প্রথমে খুব হাসি পেয়েছিল। কার জন্য খেতি করতে হবে। খেতি না করলে তোরা খেতে না পেয়ে মরবি নাকি? এতগুলো লোক মারা পড়ল, তোরাও যদি মারা যাস কার ক্ষতি হবে? আমরা তো কবেই মরে গেছি বলে মনে হয়।
দূর থেকে বোনের জামাই একদিন ফজলের খবর নিতে এসেছিল। সমস্ত পরিবারটা শেষ হয়ে যাবার জন্য দুঃখ প্রকাশ করাটা যেন পুরোনো একটি গতানুগতিক কথা, এই ভেবে তারা ফজলকে মৃত্যুর বিষয়ে বিশেষ কথা জিজ্ঞেস না করে ফজল এখন কি করবে, এই গ্রামে থাকবে না অন্য কোনো গ্রামে উঠে যাবে, কিছু জমানো টাকা আছে কিনা ইত্যাদি কথা জিজ্ঞেস করল। টাকা পয়সা বলতে কিছু নেই। সরকার দেওয়া টাকা দিয়েই কিছু একটা করে খেতে হবে। ফজল জানাল।
‘আমাদের আর চাষিদের আর কি করে খাবার মতো উপায় আছে? কি করতেই বা পারি? কি-ই বা করতে জানি? গরু দুটো এভাবেই থাকবে কি? নিজের জমি যে আছে সেটা কি এভাবেই ফেলে রাখবেঃ বোন-বোনের জামাই পরামর্শ দেয়।
একটা মাত্র পেট, যে কোনভাবে চলে যাবে। আমার আর শরীর রক্ষা করার জন্য কাদায় মাখামাখি হওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই-ফজল বলল।
‘কিছু একটা না করলে দিনগুলো কীভাবে কাটাবে? বেঁচে থাকাই মহাভার হয়ে উঠবে।’
সেটাও ঠিক। যুদ্ধ লেগেছে মাত্র দু মাস হয়েছে,বসে বসে বিরক্ত লাগছে। বাণিজ্য করে ঘুরে বেড়ানোর উপায় নেই। কোথায় কে কোন সুযোগের অপেক্ষায় বসে আছে কে জানে? একই সঙ্গে কাটা গেলেই ভালো হত। এক সঙ্গে গর্ত খুঁড়ে পুঁতে রেখে দিত। এখন কোথায় কেটে ফেলে রাখলে, কে দেখবে। মাঝখান থেকে শিয়াল কুকুরে খাবে-’ ফজল বলল।
বৈশাখের বৃষ্টি এল। নতুন জলে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে, সাঁতার কেটে খেলার জন্য গ্রামের ছেলেমেয়েরা আজ আর নেই। পুকুর পাড় থেকে উঠে আসা কৈ, মাগুর ধরার জন্য গ্রামে কেউ নেই। তবুও বৈশাখের জল মানেই নতুন চাষের জন্য প্রস্তুত হওয়ার পূর্বাভাস।
‘গ্রামটিতে হাঁস পায়রা গরু-ছাগল সব কিছুই নাই হয়ে গেছে। মানুষ এভাবে একা একা বেঁচে থাকতে পারে কি? সমগ্র জায়গাটা যেন ডালপালা সমস্ত কিছু খসে পড়া মাঘ মাসের এক জীর্ণশীর্ণ, শুকনো গাছ।’
‘লাঙ্গল, জোয়াল, মই সমস্ত কিছু বাড়ির সঙ্গেই পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে।‘
‘ বড় কুলক্ষণ বুঝতে পেরেছ? ঘরের খুঁটি পুড়লেও লাঙ্গল পোড়া উচিত নয়, দেখ, লক্ষ্মী্র অভিশাপ লাগবে।
‘লাঙ্গল, জোয়াল পোড়ার কথা বলছ। বাড়িতে বাড়িতে একটা করে কোরান শরীফ ছিল না? কোরান আল্লাহর কালাম। সবকিছু পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। আমাদের পাপ আল্লাহ কেন মাফ করবে? মানুষ বেঁচে রইলাম,আল্লাহর কালাম বাঁচাতে পারলাম না।’
‘হিন্দু গ্রাম যে সমস্ত পুড়ে গেছে সেখানেও ঘরের ভিতরে থাকা কীর্তন,দশম-যত শাস্ত্র ছিল সমস্ত পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। এই সমস্ত পাপ করার পরে দেখবে হিন্দুরাও জাহান্নামে যাবে, মুসলমানও জাহান্নামে যাবে। আল্লাহ কাউকে মাফ করবে না।’
‘বীজ ধান যদি সরকার দেয়, চাষ না করে থেকো না। দ্রুত লাঙ্গল, জোয়াল জোগাড় করে নাও। আর নিজের জমিতে নিজেই চাষ না করলে জমি মানুষের হাতে চলে যাবে-’
ফজল দেখল গ্রামের বেঁচে থাকা কয়েকজন মানুষ চাষ করার আয়োজন করছে। সে কিন্তু জমিতে নামার জন্য মনের মধ্যে বিন্দুমাত্র উৎসাহ অনুভব করল না। এত হাড়ভাঙ্গা খাটুনি কার জন্য খাটবে? সব কয়টি ছেলেমেয়েকে কেটে ফেলেছে, ওদের মাকেও কেটে ফেলেছে, ওদের মুখটাও দেখতে পায়নি। ওদের সবাইকেই পুড়িয়ে ফেলেছে নাকি কেটে নদীতে ফেলে দিয়েছে। না গর্ত খুঁড়ে পুঁতে রেখেছে সেই খবর সঠিকভাবে দেবার মতো কেউ নেই। চাষ করেছিলাম, ব্যবসা করেছিলাম, বাড়ি তৈরি করেছিলাম, বাগান তৈরি করেছিলাম কার জন্য? ওদের জন্যই। এখন কার জন্য সে সমস্ত করে দেহ শেষ করবে? নিজের বলে যে কিছু মাটি কিনেছিলাম- কেউ যদি নিয়ে যায় নিয়ে যাক। লাগলে সরকারই নিয়ে যাক। মাটির জন্য কাটাকাটি মারামারি।
মনে মনে এই সমস্ত কথা ভাবলেও, মুখে ফজল কাউকে কিছু বলল না। বিশেষ কোনো আগ্রহ না দেখিয়ে সে লাঙ্গলের জোগাড় করল, মই পরে হলেও হবে। সে একদিন বিকেলবেলা ইতস্তত করে গিয়ে জমিটা দেখে এল, আছে। আগের মতই পড়ে আছে। আলিগুলি ক্ষয়ে যাবার জন্য জল জমা হয়নি। কিন্তু কোমল ঘাস বন জন্মেছে। ফজল মাঠে পা রাখে- কোমল হয়েছে। এ ধরনের মাটিতে গরুর কোনো কষ্ট হয় না।
পোড়া গ্রামটিতে, মৃত গ্রামটিতে বেঁচে থাকার কোনো লক্ষণ নেই। বেঁচে থাকা মানুষগুলি যেন শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া কিছু মৃত মানুষ। হাসি নেই, কান্না নেই, কথা নেই, ঝগড়া নেই। মহিলা আর ছোট ছেলে মেয়ে নেই।বাচ্চার কান্না নেই, গোয়াল, ভাঁড়ার সমস্ত পুড়ে শেষ। ইঁদুর নেই। মানুষ না থাকায় কুকুরগুলিও কোথাও চলে গেছে। ওরা নিশ্চয় পরিচিত মানুষগুলির শরীরের মাংস খেতে ভাল পায়নি। ভাতের খোঁজে ওরা কোথাও চলে গেছে।
একটা সময়ে ফজলের যে সমস্ত জিনিসকে জঞ্জাল বলে মনে হয়েছিল, এখন তার মনে হল যেন সেগুলিই না হলে বেঁচে থাকা এক শাস্তি। সমগ্র পৃথিবীটা হাতে পেলেও মানুষ একা একা বেঁচে থাকতে পারে না।
দিন এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফজলের নিজেকে বেশি নিঃসঙ্গ বলে মনে হতে লাগল। সে যেন এই নিস্তব্ধতায়, ভয়ে ভীত কবরস্থান ছেড়ে অনেক মানুষজনে পরিপূর্ণ হয়ে থাকা কোনো একটি শহরে চলে যাবে এবং চিৎকার করে করে কারও সঙ্গে কথা বলবে, ঝগড়া করবে।
এভাবে আরও কিছুদিন থাকলে হয়তো পাগল হয়ে যাব।
টিনগুলি দিয়ে লম্বা একটি ঘর তৈরি করা হয়েছে। আগের মসজিদটা জ্বালিয়ে দিয়েছে। সেই ভিটেতে বাড়িটা তৈরি হয়েছে। এখন সেটাই মসজিদ। নামাজের সময় সেখানে গ্রামের বেঁচে থাকা মানুষগুলি এসে জমা হয়। আজিমুদ্দিন মৌলভী আগে মসজিদের ইমাম ছিলেন। তাকেও কেটে ফেলেছে। তার ঘরে এবং মসজিদে থাকা কোরান হাদিস, বাংলা অসমিয়া সমস্ত বই পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। খোৎবার বইটাও পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে।
কাফরুল মুন্সি একমাত্র জুমার নমাজ পড়াতে পারা মানুষ। অন্য দুজন আছে যারা নমাজ পড়ার কাজটা মোটামুটি চালিয়ে নিতে পারেন। কিন্তু তারা জুমার নামাজ পড়াতে পারে না। বর্তমান কাফনুরেই এই জুমার নামাজ পড়াচ্ছে। মুন্সির স্ত্রী এবং ছোট ছোট ছেলে মেয়েগুলিকে কেটে ফেলেছে। বড় ছেলে দৌড়ে পালিয়ে বেঁচেছে। মুন্সি ছেলেমেয়েদের মক্তবে আরবী উর্দু পড়াতেন। এখন আর মক্তবের দরকার নেই। মক্তবের ঘরটা অন্য ঘরের সঙ্গে পুড়ে গেছে। ছেলেমেয়েদের কেটে পুড়িয়ে শেষ করেছে। মুন্সি বেকার হয়ে গেল। এখন যে কয়টি মানুষ জমা হয়, ওদের নিয়ে জামাত করে নমাজ পড়ায়।
ফজলও মসজিদে যায়।
মানুষগুলি নাই হয়ে গেল। আল্লাহ যদি নাই হয়ে যায় তিনি কী নিয়ে বেঁচে থাকবে? আল্লাহর ঘর, মসজিদ পুড়িয়ে ফেলেছে। আমরা নিশ্চয় অনেক বড় অপরাধ করেছিলাম। অন্যের গায়ে দোষ দিলে কী লাভ হবে?
অসহায়ভাবে অবস্থাকে মেনে নেওয়ার প্রাচীন সান্ত্বনা বাণী। তিন মাসের বাচ্চা কাটা গেলেও মা-বাপের পাপের ফল।
রাতের দিকে জোর বৃষ্টি হয়েছিল- মুষলধারে বৃষ্টি। ফজলের টিনের চালে বৃষ্টির শব্দটা যেন জোরে হয়। চোখ বুজে পড়ে থাকা ফজল কান পেতে থাকল। চার পাশে যেন ইনিয়ে বিনিয়ে কেউ কাঁদছে-কান্নাটা গ্রামের বুক থেকে নদীর পার হয়ে কোথাও বহুদূরে দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ছে। বৃষ্টি না কান্না, কান্না না বৃষ্টি ফজলের বুঝতে অসুবিধা হতে লাগল। ফজল মনে মনে নিজেকে বলল আমার কোনো দরকার নেই হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে চাষ করার। কাকে খাওয়ানোর জন্য চাষ করব? কে খাবে? হোক বৈশাখ মাস, বৃষ্টি আসুক, মাটি থাকুক। কিছু করব না, কাদায় মাখামাখি হয়ে মরার কোনো আগ্রহ নেই। সে নিজেকে বোঝাল।
তার কখন ঘুম পেয়েছিল বলতেও পারে না।
শেষরাতে ফজলের আজানের আওয়াজ কানে যেতেই ধড়মড় করে উঠে বসল। পাথালি করে রাখা টিনটা একপাশে রেখে বাইরের দিকে তাকাল, বৃষ্টি কমে এসেছে, একেবারে ছাড়েনি। পাতলা হালকাভাবে পড়ছে। ঘরে ছাতা নেই। তবু সে মসজিদে যাব বলে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল।
হঠাৎ বারান্দায় হেলান দিয়ে রাখা লাঙ্গলটার দিকে চোখ গেল। জোয়ালটা লাঙ্গলের সঙ্গে লেগে ঝুলে আছে। তার ঘরের এই পাশে থাকা গরুদুটি কি করছে সে বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে দেখল, একটা দাঁড়িয়ে আছে, অন্যটা চোখ বুঝে শুয়ে আছে।
টিনের দরজাটা সরিয়ে রেখে সে গরুদুটির কাছে গেল। সে যাবার সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে থাকা গরুটা উঠে দাঁড়াল। ফজল এক কোণে রাখা পাচনটা হাতে নিল।
হালের গরুর হালের সঙ্গে একটা বোঝাবুঝি থাকে। গোয়াল ঘরে শুয়ে থাকা গরু দুটি চোখ বুজেই হালুয়া উঠার আভাস পায়। ঘরের দরজা খোলার শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে ওরাও উঠে দাঁড়ায় এবং গোয়াল ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়। কিছু গরু গোয়ালঘরের ভেতরে পায়খানা প্রস্রাব করে গোয়ালঘর নোংরা করে। কিছু গোয়াল ঘরের বাইরে গিয়ে পায়খানা, প্রস্রাব করে।
ফজলের এখনকার গরু দুটি গোয়াল ঘরের মেঝে নোংরা করে না। গোয়াল ঘরের দরজা খুলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওরা বাইরে বেরিয়ে আসে। হালের গরু একে অপরকে জানে। যেভাবে চিনতে পারে হালুয়াকে। তার কণ্ঠস্বরকে, তার পদক্ষেপকে, সে রাগ করে আছে না ভালো মুডে আছে তার মন মেজাজ, সবচেয়ে চিনতে পারে তার প্রতি থাকা ভালোবাসাকে। পাচন দিয়ে যতই মারধর করুক না কেন, বেলা দুপুর পর্যন্ত হাল বাউক না কেন, গরুর দুঃখ কষ্টে হালোয়া সমানই দুঃখ পায়। একথা হালের গরুর চেয়ে অন্য কেউ বেশি বুঝতে পারে না। হালের গরু উপোসে থাকলে গৃহস্থের বা হালোয়ার সমস্ত শরীর কেমন যেন অস্থির অস্থির করতে থাকে।
ধানের চারাতো গজাবেই। খেতের মাঝখানে হালের গরু দাঁড়িয়ে পড়লে বিপদ। পরিচিত হালোয়ার সঙ্গে হালের গরু কাজ করতে ভয় করে না।
কয়েক মাস আগে ফজলের গোয়াল ভর্তি গরু ছিল। হালের বলদ, দুগ্ধবতী গাভি, দামড়া,ষাঁড় কী না ছিল তার। লেজতুলে দৌড়ে বেড়ানো বাছুর। গোবর ছাড়া তো ওদের এখন আর দেবার কিছু নেই। যতদিন পারা যায় ঘাস খাইয়ে ওদেরকে বাঁচিয়ে রাখাটা একটা অতিরিক্ত সমস্যা। আগে দুগ্ধবতী গাভিগুলি এবং হালের গরুগুলি দেখাশোনা করলেই চলে যেত। রাখাল ছেলেটাই পুরো গোয়ালঘরের দায়িত্ব নিয়েছিল। এখনতো গরুই নাই হয়ে গেল।
ফজল আর দুটি গরু।
সেও আবার গরুদূটি পুরোনো নয়। আগের গোয়ালের সবগুলি গরু কোথায়, কীভাবে চলে গেল, মারা গেল ফজল বুঝতেই পারল না। এই হালের একটা অনেক দূর থেকে বোনের বাড়ি থেকে চেয়ে আনা, অন্যটি হাট থেকে কিনে আনা। উচ্চতায় যদিও এক বয়স মিলে না। দুজনের স্বভাবেও মিল নেই। তবুও শৈশব থেকে গরুর সঙ্গে ফজলের সম্পর্ক। গরু দুটিকে একই হালে জুতে নিয়ে কীভাবে হাল বাইতে হয় সেটা ফজল জানে।
রাতে খুব জোর বৃষ্টি হয়েছিল। বর্তমানে ফজলের ঘর চার আঙুলের মতো উঁচু। কিছুটা উঁচু, কিছুটা ভুরভুরে কাঁচা মাটি। বৃষ্টি হলে বাইরের জল চলে আসে, তখন ঘরের ভিতরে কাদা হয়। এখন বৃষ্টি কমে এসেছে, সে গরু দুটিকে উঠোনে বের করে আনে। গরুদুটি যেন তার পথ চেয়ে বসেছিল। ওরা এসে উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ল।
ফজল ঘরের ভেতরে গেল। বালিশ করে নেওয়া লুঙ্গিটার নিচে খুঁজে বিড়ি এবং দিয়াশলাই বাক্সটা বের করে নিল।তারপর একটা বিড়ি জ্বালিয়ে দাঁতে কামড়ে ধরে, বাকি বিড়ি এবং দিয়াশলাইটা লুঙ্গির ট্যাঁকে নিয়ে সে বেরিয়ে এল। বৃষ্টি তখনও একটু একটু হচ্ছে। ধীরে ধীরে ভোর হয়ে আসছে। বেশি দূরে কিছুই দেখা যায় না। ফজল লাঙ্গল জোয়াল কাঁধে তুলে নিল আর একটা পাচন হাতে নিয়ে গরু দুটিকে তাড়িয়ে নিয়ে চলল। আগের অভ্যাসবশত সে নিজেকে বলার মত বলল ‘আমি এসেছি’- মসজিদের সামনের রাস্তা দিয়ে সে গরু দুটিকে তাড়িয়ে নিয়ে এগিয়ে গেল বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে। কাফনুর মুন্সি ফজরের নমাজ পড়ে বৃষ্টির জন্য বাড়ি যেতে না পেরে মসজিদের বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল। ফজলকে ডেকে বলল-‘মাঠের জন্য বেরিয়েছিস নাকি?’
‘হ্যাঁ’, বৃষ্টি দিচ্ছে। ভাবলাম আউস দুটো বেয়ে আসি।’ ‘ভালো করেছিস, যা। একটা খবর পেয়েছিস?’
‘কিসের খবর?’ গফুরের মেজ বউ যে হারিয়ে গিয়েছিল – তাকে খুঁজে পেয়েছে, একটা পা কেটে নিয়েছে। মানুষটা বেঁচে গেছে। গত রাতে একটি বাচ্চা হয়েছে- ছেলে। রাতে আমাকে খবর দিয়েছিল। সময় পেলে খবর করিস। মেয়েটি দিলনুরের বাড়িতে রয়েছে। নিজের মানুষগুলো সবই তো শেষ হল।’
ফজল কিছুই না বলে গরুদুটিকে দ্রুত তাড়িয়ে নিয়ে মাঠের দিকে এগিয়ে চলল। হঠাৎ কিছু একটা বুঝতে না পারার কারণে ফজলের মনটা হালকা বলে মনে হল। দিলনুরের ঘরের সামনে দিয়ে সে তার জমিতে যাবে। এটা গফুরের পুত্রবধূর নবজাতকের কন্যা না? হ্যাঁ। এটা গতরাতে জন্মানো শিশুর কান্না। দিলনুরকে কাটেনি বলছে।
ঠিক আছে, ফিরে আসার সময় খবর করে যাব।’ না হলে মাঠে হাল বাইতে দেরি হয়ে যাবে। তার আর গরু দুটির পদক্ষেপ দ্রুত হল। পুবের আকাশ লাল হয়ে আসছে। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। গরুদুটি দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।
ফজল নিজেকে বলার মতো করে বলল, গফুরের মেজ বউমা। একটা পা কাটা গেলেও সে তো বেঁচে আছে। বাচ্চার জন্ম হয়েছে। ওদেরকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। চাষ না করলে আমিই বা কী খাব? সেই শিশুটি বা তার মা কী খাবে? কেউ অর্জন করলে তবেই কেউ খেতে পাবে।
তার পদক্ষেপ আরও দ্রুত হল।
তার কানে বৃষ্টির শব্দ ছিটকে এসে বাজতে থাকল-গফুরের মেজ বউমার গর্ভে জন্ম নেওয়া গতরাতের মানব শিশুর কান্নার অস্পষ্ট স্বর। ফজলের মনটা একটা কারণ বুঝতে না পারা আনন্দে ভরে উঠল। বৃষ্টি পড়ে কোমল হওয়া পায়ের নিচের মাটিটাতে সে জীবনের কোমল স্পর্শ অনুভব করল।
সে পোড়া গ্রামের সীমার বাইরে থাকা তার জমিতে পা রাখল। সেখানে পহেলা বৈশাখের বৃষ্টির নতুন জল।
——-
লেখক পরিচিতিঃ অসমিয়া কথা সাহিত্যের অন্যতম রূপকার সৈয়দ আব্দুল মালিক ১৯১৯ সনে অসমের শিবসাগর জেলার নাহরণিতে জন্মগ্রহণ করেন।যোরহাট সরকারি হাইস্কুল থেকে পাশ করে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অসমিয়া সাহিত্যে এম এ করেন। পরবর্তীকালে যোরহাট জেবি কলেজে অধ্যাপনা করেন। লেখকের গল্প সঙ্কলনগুলির মধ্যে ‘পরশমণি’, শিখরে শিখরে’, শুকনো পাপড়ি’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ‘অঘরী আত্মার কাহিনী’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ভাষা
Scroll to Top