তিন মাথার মোড় বলেই মানুষের কাছে কুল্পির গুরুত্ব বাড়ছিল দিন দিন। কাকদ্বীপ থেকে স্টেট বাস ছুটে আসে কুল্পিতে। ক্ষণেকের বিরতি। আবার ভোঁ করে বের হয়ে যায়। ডায়মন্ডহারবার হয়ে সেই বাস পৌঁছায় কলকাতা-ধর্মতলায়। রায়দিঘী থেকে ভায়া কুল্পি হয়ে ডায়মন্ডহারবার পর্যন্ত প্রাইভেট বাসের নিত্য যাতায়াত। ফলে কে কোথায় যাবে, তা স্থির করে স্থানীয় প্যাসেঞ্জাররা এসে কুল্পির মোড়ে অপেক্ষায় থাকে। তারপর বাস এলেই—
সেই অর্থে যত দিন গেছে, ততই দক্ষিণ ২৪ পরগণার কুল্পিমোড় জমাটি হয়ে উঠেছে। হঠাৎ করে এক পিরবাবাজির আগমণে সেই কুল্পিমোড়ে দ্বান্দ্বিক ঝড় বইতে শুরু করল আম-মানুষের মধ্যে। একেবারে নতুন জ্বর। যুক্তি বনাম অন্ধত্ব, আবেগ বনাম অভিজ্ঞতা, সেই সঙ্গে ধর্মীয় চিন্তা নিয়ে নানা দ্বিধাদ্বন্দ্ব স্থানীয় মানুষকে বার বার ছুঁয়ে যেতে থাকল। প্রশ্ন অনেক কিন্তু সংযুক্ত উত্তর খুঁজে পাওয়া সম্ভব হল না। যে যার মতো ভেবে নিতে বাধ্য হল। সত্যি সত্যি সকলের মানসিক অস্তিত্ব ঢেকে থাকল পারস্পরিক গরমিলে।
সদ্য গ্রাজুয়েট ফিরোজের প্রশ্ন, উনি যদি এত পরোপকারী, পুরনো আস্তানা ছেড়ে এখানে এসেছেন কেন?
হেকিম সমাদ্দার, পার্শ্ববর্তী গ্রামে মসজিদের জনপ্রিয় ইমাম, তেড়েফুঁড়ে প্রতিবাদ করে বললেন, কলেজে ক’পাতা পড়ে বেশ তো ঝলকমারা কথা বলতে শিখেছ?
এভাবে বলছেন কেন?
কোনো শুক্রবার তোমাকে মসজিদে আসতে দেখি নি।
কলেজ থাকলে যাব কী করে?
জানো কী, মেঘ বিশ্বনবীর মাথার উপর ছায়া দান করত।
অনেক আগে জেনেছি।
তাহলে পিরবাবাজীর কর্মকাণ্ডের উপর যুক্তির আলো ফেলতে চাচ্ছ কেন? আধ্যাত্মিকতার বিশ্বাসকে বড়ো করে দেখতে ইচ্ছা করে না?
ফিরোজ চুপ করে থাকল।
মনে রেখো, পিরবাবাজী আমাদের ধর্মের লোক।
উপস্থিত সকলে হেকিমের সমর্থনে ঝড় তুলে দিল। তারা বলল, তুমি ঠিক বলেছ হেকিমদা। এটুকুন ছেলের মুখে পিরবাবাজিকে নিয়ে এসব কথা মানায় না।
দমকা হাওয়ার টানে সুতোছেঁড়া ঘুড়ির মতো হেকিমের কথার তোড়ে এবং সম্মিলিত সমর্থনের প্রাবল্যে ফিরোজের প্রসঙ্গ সকলের মন থেকে মুহূর্তে মুছে গেল।
ফিরোজ বুঝল অন্য কিছু। হেকিম চাচুর ধর্মীয় আবেগের কাছে তার কথার যুক্তিজাল আদৌ পাত্তা পেল না।
গণতন্ত্রে লোকবল শেষ কথা। ভ্যাপসা গরমে ফ্যানের হাওয়া না থাকলে শরীরকে যেমন বিশ্রি গুমোট সহে নিতে হয়, ঠিক তেমনি ফিরোজ চুপ করে থাকতে থাকতে নিজের আত্মিক ভারে নিজেই নুয়ে পড়ল। হার্দিক সমর্থন যোগাতে প্রিয় বন্ধু প্রবীর পিছনে দাঁড়িয়ে থাকলেও পরিস্থিতির ভয়ে রা করতে পারল না।
মৃদু বাতাসে পাতা নড়ার মতো হেকিমের বলিষ্ট সমর্থনে কুল্পিমোড়ে পিরবাবাজির জনসমর্থন বেড়েই চলেছে। কোনো আর্থিক চাহিদা নেই, মানুষকে উপকার করাই তাঁর একমাত্র জীবনব্রত। এ তো প্রচণ্ড শীতে বয়ে যাওয়া বসন্ত বাতাসের সমতুল্য। পরের শুক্রবার আম-মানুষের সেই বোধ আরও তীব্র হয়ে উঠল। ইতিম্যে তাদের জানা হয়ে গিয়েছিল, মাগরিবের নামাজ শেষ করে পিরবাবাজি পরমেশ্বরের কাছে কাতর প্রার্থনায় মগ্ন থাকেন, তারপর সমাগত লোকজনদের দরকার নিয়ে কথা বলেন।
সামনের চত্বরে ততক্ষণে ভীড় জমে উঠেছে। উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে হেকিমের সান্ত্বনা, বাপেরা, একটু অপেক্ষা করতেই হবে। পিরবাবাজি নামাজ শেষ করে দোয়া চাইবেন, দোয়া নেবেন, সেসব আপনাদেরকে মুঠো মুঠো করে বিলিয়ে দেবেন। তাঁর জীবনের মাহাত্ম্য এমনিই।
লোকজন শুনতে শুনতে কেমন যেন তন্ময় হয়ে পড়ল। অচেনা পুলকের ছোঁয়া সকলের মধ্যে। বাতাস যেমন মেঘকে ঠেলে সামনে এগিয়ে নিয়ে চলে, ঠিক তেমনি উপস্থিত সকলের মানসিক গলিপথে পিরবাবাজির প্রতি গভীর বিশ্বাস জমে বরফে পরিণত হয়ে থাকল। ভাবনার দুরন্ত পথে সবার মনের ইমেজ কেমন যেন হিমালয়ের মতো উঁচু হয়ে উঠছে।
সন্ধের ভ্রুকুটি দুচোখে মেখে পিরবাবাজী বারান্দার উপরে এসে বসলেন। মুখে মৃদু হাসি। ছোটো ছোটো কথা। ভিতরে অদ্ভুত মোচড়। —বাপেরা বলো, কে কী প্রয়োজনে এসেছ?
ছেলেটার হাত জন্ম থেকে এত দুর্বল যে ঠিকমতো নাড়াচাড়া করতে পারে না।
বয়স কত?
সাত-আট বছর হবে।
সঙ্গে এনেছেন?
এই তো আমার পাশে দাঁড়িয়ে।
কোথা থেকে আসছেন?
ফলতা থেকে।
ওখানে আমার পুরনো ডেরা ছিল। এখন অনেকেই আসছে ফলতা থেকে। পিরবাবাজী ছেলেটার হাতে ফুঁ দিতে শুরু করলেন। বিড় বিড় করে আত্মস্থ মন্ত্রগুলো পড়ে চলেছেন। সকলের দুচোখ ছেলেটার অচল হাতের দিকে। মাত্র কয়েক মিনিট পরে পিরবাবাজির বিনয়ী উক্তি, খোকাবাবু, হাতটা ধীরে ধীরে নাড়তে শুরু করো তো?
পারবু নি গো।
তা বললে হয়?
কোনোদিন পারি নি।
এখন পারবে, চেষ্টা করে দ্যাখো না।
ছেলেটা হাত নাড়তে শুরু করল। কোনো অসুবিধা নেই। পিরবাবাজির দুঠোঁটের ফাঁকে রহস্যময় হাসি। উপস্থিত সকলকে উদ্দেশ্য করে শুধু বললেন, সবই খুদাতাল্লার মহব্বত।
চমকে উঠল সবাই। এত প্রত্যক্ষ যোগসূত্র? বিড় বিড় করে দোয়া চাইলেন আর খুদাতাল্লা সঙ্গে সঙ্গে তা মঞ্জুর করে দিলেন?
পরের শুক্রবার পিরবাবাজিকে নিয়ে আরেকটা পর্দা প্রকাশ হয়ে গেল। ঘরের ভিতরে একা একা নামাজ সম্পন্ন করে উচ্চস্বরে এমন করে কাঁদতে শুরু করলেন যে বাইরে অপেক্ষামাণ সকলে হতচকিত না হয়ে পারল না। কান্না শেষ হতেই মাখো মাখো গলায় পরমেশ্বরের কাছে পিরবাবাজির একটিমাত্র আবেদন, সকলকে ক্ষমা করে দাও প্রভু। আমাকেও। চলমান জীবনে প্রত্যেকে নতুন আলো লাভ করুক।
ক্ষমা শব্দটাই অপরাধীকে সবচেয়ে বেশি কম্পিত করে। পাপীর মনে জাগিয়ে তোলে নতুন শক্তির নিশানা। পিরবাবাজী গম্ভীর মুখে বারান্দার উপরে এসে বসলেন। দর্শনার্থীদের মুখোমুখি হবার নতুন সন্ধিক্ষণ। একটা লোক অনেক কষ্টে পা টেনে টেনে সামনে এসে দাঁড়ালো। অঝরে কাঁদছে। একটাই কাতর মিনতি, পায়ের যন্ত্রণায় মরতে বসেছি গুরুজি। অনেক আশা নিয়ে এসেছি।
তোমার নাম কী?
ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়।
কোথায় বাড়ি?
বজবজে।
তাহলে কী আর খাটাখাটুনি করতে পারো না?
আগে পারতুম, এখন ভিক্ষে করি।
পিরবাবাজী তালে তালে মাথা নাড়ছেন।
ধৃতিমান হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। —বিশ্বাস করুন, ভিক্ষে করে এই পাঁচশ টাকা সংগ্রহ করতে পেরেছি। আপনার পায়ের কাছে রাখলুম।
বারান্দার সামনে শ’পাঁচেক লোক থম্ মেরে দাঁড়িয়ে। তাদের আভ্যন্তরীণ বিস্ময় লাট্টুর মতো ঘুরছে। মন্ত্রবলে কী লোকটাকে সারিয়ে তোলা সম্ভব হবে? পারলে পিরবাবাজী মানুষের কাছে ঈশ্বরের সমতুল্য হয়ে উঠবেন। অবশ্য কারুর কারুর মধ্যে ঘোরতর সন্দেহ অন্ধকারের মতো দ্রুত বিস্তার হচ্ছে। লোকটা বাম পা এত টেনে ফেলল যে তাকে আস্ত খোঁড়া ছাড়া অন্য কিছুই ভাবা যায় না। একটু পরে ঠাসাঠাসি জটলার মধ্যে এসে উপস্থিত হলেন সেই হেকিম সমাদ্দার। ভারি চৌকস লোক। বামপাশে দুচোখ রেখে ফিরোজকে তীব্র কটাক্ষ, আবার এখানে কেন?
দেখতে এসেছি।
তুমি তো আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাস করো না।
তাই বলে দেখতে আসতে নিষেধ আছে নাকি?
তাহলে অপেক্ষা করো, দেখবে লোকটার পা স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
তা কেবল অস্ত্রপ্রচারেই সম্ভব।
পিরবাবাজী ফুঁ মেরে অস্ত্রপ্রচারের কাজ সেরে ফেলতে পারেন।
আমি বিজ্ঞানে বিশ্বাস করি।
সূর্য কেন পশ্চিমে ওঠে না, তা কী বিজ্ঞান বলে দিতে পেরেছে?
একটা জটিল প্রসঙ্গ সবার মধ্যে দোল খাচ্ছে। পারবেন কী পিরবাবাজী? রোজা শুরু হলে সারা মাস ধরে সাধারণ মানুষ ঈদ পালনের কল্পনায় মশগুল হয়ে থাকে, সেই অর্থে উপস্থিত সকলে পিরবাবাজির অলৌকিক কেরামতি দেখার জন্যে উদগ্রীব হয়ে থাকল।
পিরবাবাজির মুখে আর কোনো কথা নেই। বারান্দার উপরে বসে মগ্ন চিত্তে বিড় বিড় করে ধর্মীয় শ্লোক পড়ে চলেছেন। দুঠোঁটের মাঝে মিষ্টি হাসি। তাতেই সারা মুখে অনন্য দ্যুতির অদ্ভুত বিস্তার। আরও কয়েক মিনিট ধরে স্তব্ধতার গহিন রহস্যভেদ। নিজের নিমগ্ন পাট থামিয়ে লোকটাকে বললেন, কাঁদিস নে ব্যাটা, খুদাতাল্লা তোকে ঠিক সারিয়ে দিবে।
খোড়া লোকটার ফোঁপানি মুহূর্তে দ্বিগুণ হয়ে উঠল। ভাঙা ভাঙা কণ্ঠস্বরে তার একটাই মিনতি, বাঁচার ইচ্ছা একেবারে শেষ হয়ে গেছে পিরবাবাজী। পা টেনে ফেলতে গেলে যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠি।
জন্ম থেকেই এমনি?
আগে কম ছিল, এখন বেড়েছে।
খুদাতাল্লা রহম করবে রে ব্যাটা। ভয় পাচ্ছিস কেনে?
ঘুটঘুটে অন্ধকারে জোনাকির আলো যেভাবে আলোর সঞ্চার করে, তেমনি একটা ক্ষীণ প্রত্যাশা খোঁড়া মানুষটার মধ্যে দোল খেতে লাগল। ভক্তদের মনে কৌতূহলের বন্যা। যেন মিথেন গ্যাস থেকে উদ্গত রহস্যময় আলো ছিটকে পড়ছে। পিরবাবাজির কড়া হুকুম, এ্যাই ব্যাটা, উপরে উঠে আয়।
লোকটা সশব্দে কেঁদে উঠল।
হতবাক পিরবাবাজী। —এভাবে কাঁদছিস কেন রে?
উঠতে পারবুনি হুজুর।
পিরবাবাজী ভাবিত হলেন, মুখ উঁচু করে তাকালেন সমবেত মানুষদের দিকে। তাতেই তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ হল। সকলে ধরাধরি করে খোঁড়াকে বারান্দার উপরে তুলে দিল।
পিরবাবাজির মৃদু তিরস্কার, এভাবে কাঁদছিস কেন রে ব্যাটা? দ্যাখ না, খুদাতাল্লা তোর উপর কেমন রহম করেন।
সমবেত সকলের মধ্যে একটিমাত্র প্রশ্নের উচ্ছ্বাস। তাহলে কী মন্ত্র পাঠের সময় পিরবাবাজী লোকটার জন্যে বিশেষ নির্দেশ পেয়ে গিয়েছেন? আবেগের ঝড় শুরু হয়েছে। কয়েক সেকেন্ড পরে তারাই দোখল, রাস্তার বিপরীতে নামকরা এমবিবিএস ভিড় ঠেলে পিরবাবাজির সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। পোষাকী নাম পরিমল ব্যানার্জী, পোকা ডাক্তার নামে পরিচিত। ডাক্তারীর সেবাধর্মে কুল্পিমোড়ে তিনিই একম অদ্বিতীয়ম। সত্বর রোগ সারানোর পাকাপোক্ত পেশাদার ডাক্তার। ‘পোকা’ শব্দটা যুক্ত হয়েছে পাকাপোক্ত শব্দের তাৎপর্যকে গভীর করে তুলতে।
পিরবাবাজী মুখ তুলে তাকালেন ডাক্তারবাবুর দিকে।
মাথার যন্ত্রণায় মরে যাচ্ছি পিরবাবাজী।
ওষুধ খান নি?
দামী ক্যাপসুল খেয়ে তো কিছুই হল না।
তাহলে কী আমাকে?
হ্যাঁ হ্যাঁ ডাক্তারবাবু।
সামনে রাখা গ্লাসের জলে বিড় বিড় শব্দে মন্ত্র উচ্চারণ করলেন, একবার ফুঁ দিলেন, তারপর বললেন, পিয়ে লিজিয়ে, খুদাতাল্লা সারিয়ে দিবেন।
পোকা ডাক্তার পিরবাবাজির দিকে এক পলক চোখ রেখে ঢকঢক শব্দে জলটুকু খেয়ে নিলেন। চোখ বুজিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলেন বেশ কিছু সময়। পিরবাবাজিও নীরব, নিশ্চুপ, বাক্যহীন। নিজস্ব মৌনতায় মগ্ন, গভীর ভাবচেতনায় তন্ময়। মাত্র কয়েক মিনিটের সূক্ষ্ম দোলাচলপর্ব। ডাক্তারবাবু ধীরে ধীরে দুচোখ খুললেন। পিরবাবাজির তাৎক্ষণিক প্রশ্ন, কেমন লাগছে বলুন?
কুর্ণিশ আপনাকে, মাথায় আর কোনো যন্ত্রণা নেই। অসীম স্বস্তি পাচ্ছি শরীরে।
সবই খুদার আশীর্বাদ ডাক্তারবাবু। তারপর সাদাকালোয় মেশানো দাড়ির ভিতরে দু’আঙুল ঢুকিয়ে বাজপাখির মতো দুচোখ নিয়ে চেয়ে থাকলেন জড়ো হওয়া মানুষজনের দিকে। নিজস্ব জয়লাভের পরশমণি দিয়ে সকলকে চমকে দিতে চাচ্ছেন।
পিরবাবাজির ভিতরের শক্তি দেখে স্তম্ভিত উপস্থিত সকলে। ড্যাবা ড্যাবা চোখে তারা শুধু দেখল না, কুর্ণিশ জানালো তাঁর অপরিসীম আধ্যাত্মিক শক্তিকে। একজন এমবিবিএস নিজেকে সারিয়ে তুলতে যা পারলেন না, পিরবাবাজী তা করে দেখাতে পারলেন। বিস্ময়ের ঘোর সবার চোখেমুখে। তাহলে কী পিরবাবাজী নিজস্ব অন্তরশক্তি দিয়ে খোঁড়া লোকটাকে সম্পূর্ণ সারিয়ে তুলতে পারবেন?
উপরের আকাশ জুড়ে মেঘলা মেঘের বিস্তার। সমানভাবে তা ঘণীভূত হচ্ছে উপস্থিত সকলের মনের আকাশে। পিরবাবাজী সফল হতে পারবেন, কী পারবেন না, সেই দোলাচলের লুকোচুরি শুরু হয়েছে।
পঙ্গু লোকটার পায়ে একনিষ্ট মনে মালিশ করতে শুরু করলেন। ফুঁ দিচ্ছেন বারবার। পঙ্গু লোকটা আ আ শব্দে ভিতরের স্বস্তি প্রকাশ করছে। শব্দের অনুপ্রাসের সঙ্গে শারীরিক প্রশান্তি মিশে যাচ্ছে বারবার। এভাবেই চলতে থাকল, প্রায় আধ ঘন্টা।
পিরবাবাজী দ্বিতীয় পর্বে মন্ত্রপূত শুরু করলেন। বুকের উপর ডান হাত রেখে মুখটা আকাশমুখো করে বিড় বিড় শব্দে কত কী বলে চলেছেন। কয়েক মিনিট নিজেই থমকে থাকলেন, বোজানো দুচোখ খুলতে খুলতে বললেন, কেমন লাগছে বলো?
বুকের ভিতর কী ভীষণ ধড়পড় করছে, খুব ভয় পাচ্ছি।
ওরে ব্যাটা, খুদাতাল্লা শরীরে ভর করলে এমনি হয়। তু সাহস করে উঠে দাঁড়া।
সকলে স্তম্ভিত হয়ে চেয়ে থাকল পঙ্গু লোকটার দিকে। এও কী সম্ভব? যাকে ধরে বারান্দায় তুলে দিতে হয়েছে, সে কী করে উঠে দাঁড়াবে? দ্বিধাদ্বন্দ্বের প্রবল ঝড় সবার মধ্যে। একটু পরে তারাই অবাক হয়ে দেখল, পঙ্গু লোকটা দিব্যি উঠে দাঁড়াতে পারল।
পিরবাবাজির চড়া হুকুম, হাঁটতে শুরু কর্ রে ব্যাটা, খুদা তোর ব্যারাম সারিয়ে দিয়েছেন।
লোকটা দিব্যি হেঁটে চলল সামনে, তার পায়ে সেই টান আর নেই, যন্ত্রণার তীব্রতা নেই, স্বস্থির খুশি ঝরে পড়ছে মুখের বলিরেখায়।
শুধু স্তম্ভিত নয়, উপস্থিত জনতা কেমন যেন হতচকিত। কার্যত পরের দিন থেকে পিরবাবাজির কাছে আরও বেশি করে ভিড় জমতে শুরু করল। পিরবাবাজির সেবা অনাবিল কিন্তু কোনো চাহিদা নেই। পরবর্তীতে যারা আসতে শুরু করল, তারাই ভাবল, শুধু ভাত গালে ওঠে না। বিনিময় না দিয়ে উপকার নিতে চাইল না তারা। কেউ তেলপড়া নিতে এল, বিনিময় চাইতে হল না, খুশি হয়ে দিয়ে গেল। কেউ জলপড়া নিতে এল, পিরবাবাজী দিব্যি ফুঁ মেরে দিলেন। সামগ্রিক মূল্যায়ন হল, প্রতিদিন হাজার হাজার টাকা আসতে শুরু করল পিরবাবাজির মাহাত্মের গুণে।
আশেপাশের আম-মানুষ নতুন মোহে পড়ে যেতে বাধ্য হল। ফিরোজ এসব খোঁজ নিতে এল রবিবার বিকেলে কিন্তু ইমাম হেকিমকে দেখে শরীর লুকিয়ে সরে পড়তে বাধ্য হল। লোকটা কী ভীষণ সাংঘাতিক। সামনাসামনি এঁড়ে-তেজ দেখানোর এক নস্বর মানুষ। ফিরে যেতে যেতে ফিরোজের মধ্যে একটাই প্রসঙ্গ মাথা তুলে দাঁড়ালেও দ্রুত পায়ে চলার ছন্দে তা মিলিয়েও গেল।
পরের শুক্রবার পিরবাবাজী ঘরের ভিতরে নামাজে নিমগ্ন হয়ে পড়েছেন। দোয়া চাওয়ার সময় দুহাতের মুঠো সামনে মেলে ধরে অঝরে কাঁদছেন। —হে পরমেশ্বর, সকলের অপরাধ নিজ গুণে ক্ষমা করে দিন। আমরা অপরাধী আপনার অধীনে। অনুগ্রহ করে আমাদের মুক্তির জন্যে শেষতম অবস্থান গ্রহণ করুন।
কক্ষের সামনে তখন জনতার উপচে পড়া ভিড়। কেউ জলপড়া নিতে, কেউ তেলপড়া নিতে, কেউ মাদুলি নিতে এসেছে। পিরবাবাজির কড়া নির্দেশ, শৃঙ্খলা মেনে দোয়া নিলে খুদার কুদরতে তা খাঁটি বরকত হয়ে ওঠে।
ঠিক সেই সময়ে সকলে হতচকিত হয়ে দেখল, একটা প্রাইভেট কার এসে থামল পিরবাবাজির ঘরের সামনে। গাড়ির ভিতর থেকে নেমে এলেন এক ভদ্রলোক তার একমাত্র ছেলেকে নিয়ে— যার ডান হাত জন্ম থেকে সম্পূর্ণ অচল। খাওয়া সারতে হয় বাম হাতে।
পিরবাবাজী মাথা তুলে তাকালেন ভদ্রলোকের দিকে। ঝর ঝর করে কাঁদছেন তিনি।
এভাবে কাঁদবেন না। প্রয়োজনের কথাটুকু বলুন।
বড়ো বিপদে পড়ে আপনার শরণাপন্ন হয়েছি।
পোকা ডাক্তার আবার এসেছেন পিরবাবাজির কাছে কিন্তু তাঁকে নিয়ে আম-মানুষের মধ্যে আর আগের কৌতূহল নেই। অদ্ভুত এমবিবিএস, নিজের অসুখ নিজেই সারাতে পারেন না।
পিরবাবাজী ডাক্তারবাবুর দিকে মুখ তুলে তাকালেন।
পোকা ডাক্তার তখন পেটের যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে উঠেছেন। মুখ চেপেও গোঙানির শব্দ বন্ধ করতে পারছেন না।
চারদিকে স্তব্ধতার চমক। পিরবাবাজী কী পারবেন এ সমস্যা সামাল দিতে?
মগ্ন হয়ে নত মস্তকে পিরবাবাজী দুহাত তুললেন পরমেশ্বরের উদ্দেশ্যে। সামনে রাখা পাত্রে কিছু জল। বিড় বড় করে মন্ত্র উচ্চারণ করে তাতেই ফুঁ মারলেন। হাত বাড়িয়ে ডাক্তারবাবুকে বললেন, পিয়ে লিজিয়ে।
অদ্ভুত উৎকণ্ঠাজড়িত একটা বিশেষ মুহূর্ত। আগত ভদ্রলোক অপলক চোখে চেয়ে আছেন ডাক্তারবাবুর দিকে। উপস্থিত জনতা অভিনব দোলাচলে। এক্ষেত্রেও কী পিরবাবাজির অলৌকিকতা প্রমাণিত হবে? সন্ধিক্ষণ গোনার পর্ব এগিয়ে চলেছে। থেমে থেমে নীচু গলায় বাবাজির প্রশ্ন, যন্ত্রণা কী কমেছে?
আর তো টের পাচ্ছি নে।
বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর।
আগত ভদ্রলোক এত গদগদ হয়ে পড়লেন যে তৎক্ষণাৎ পিরবাবাজির পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম সেরে নিলেন। পিরবাবাজির ছোট্ট প্রশ্ন, কোথা থেকে আসছেন?
কলকাতা থেকে।
তাহলে খুদার খবর পেয়েছেন?
ভদ্রলোক তালে তালে মাথা নাড়ছেন।
কী দরকারে এসেছেন বলুন?
ছেলেটা জন্ম থেকেই পঙ্গু।
হাতে, না পায়ে?
ডান হাতটা একেবারেই অচল।
কোথাও দেখিয়েছেন?
কলকাতা মেডিকেলে ভর্তি করেছিলুম।
ফলাফল কী হয়েছে বলুন?
কোনো সুরাহা পাই নি।
বয়স কত?
ত্রিশ-বত্রিশ হবে।
পিরবাবাজির গম্ভীর উত্তর, ছেলেটাকে বারান্দার উপর তুলে দিন।
উপস্থিত সকলে হতবাক। এও কী সম্ভব? জন্মের পর থেকে ডান হাত নাড়াচাড়ায় অক্ষম। এত বয়স হয়েছে। পিরবাবাজী পারবেন কী? সবার মধ্যে দোলাচলের সমুদ্র।
হেকিম সমাদ্দার উপস্থিত হয়ে বললেন, কেন পারবেন না? মন্ত্রের শক্তি, মানুষের মুক্তি— এই নিয়েই অধ্যাত্মবাদের জয়যাত্রা।
পিরবাবাজি তড়বড় স্বরে মন্ত্র উচ্চারণ করে চলেছেন, সঙ্গে তেল-মালিশ-পর্ব চলছে। সামনের চত্বরে লোকজন ঠাসাঠাসি হয়ে দাঁড়িয়ে। কারুর মুখে টু শব্দটুকু নেই। মানসিক দোলাচল বাড়ছে। টান টান আধ ঘন্টার অনুভূতি। জোয়ার-ভাটার মতো ভিতরের কাল্পনিক উত্তাপ কখনো বাড়ছে, কখনো কমছে। পিরবাবাজির বিনয়ী কথা, খোকাবাবু, হাত নাড়তে শুরু করতে পারো।
পারব নি গো।
খুদার রহমতে ঠিক পারবে।
সকলে হতবাক হয়ে দেখল, পিরবাবাবাজির ইমেজ লোকাচারের বুক বেয়ে জীবন্ত মূর্তি হয়ে মাটির বুকে নামল। কলকাতার ভদ্রলোক পিরবাবাজির সামনে পঞ্চাশ হাজার টাকার বান্ডিল রেখে দিয়ে গদগদ হয়ে বললেন, আপনার কল্যাণে আমার ছেলে নতুন জীবন ফিরে পেল। কয়েক দিন পরে আরও পঞ্চাশ দিয়ে যাব।
পিরবাবাজির মুখে কোনো প্রত্যুত্তর নেই। যেন টাকার প্রসঙ্গ শুনতে পান নি। টাকা মাটি, মাটি টাকার মধ্যে ঢুকে পড়েছেন। ইহজগতে আছেন শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক জগতের উপর নির্ভর করে।
পরের মাসে প্রথম শুক্রবার। সকাল আটটা। পূবের আকাশে মেঘের আড়াল ঠেলে লালমুখো সূর্যের উঁকি শুরু হয়েছে। গ্রীষ্মের সময় বলেই পরিবেশে বিশ্রি গুমোট। পিরবাবাজির ডেরার সামনে সবেমাত্র লোকজনের আনাগোনা শুরু হয়েছে যদিও কুল্পি বাজারে ভিড়ভাট্টার শেষ নেই। পোকা ডাক্তারের ডিসপেনসারি দু’তিনদিন বন্ধ। আগে কখনো এভাবে পর পর এতদিন বন্ধ থাকে নি। ডাক্তারবাবু অসুস্থ হয়ে পড়েন নি তো?
দ্রুতগতিতে একটা পুলিশভ্যান এসে থমকে দাঁড়ালো পিরবাবাজির ঘরের সামনে। বাজারে আসা মানুষজনের মধ্যে কৌতূহলের শেষ নেই। এত পুলিশ কেন? ইমাম হেকিম বাজারে দাঁড়িয়ে সগর্বে বললেন, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী গুরুতর অসুস্থ, তাই পিরবাবাজিকে নিয়ে যেতে এসেছেন।
তখনও পিরবাবাজী বারান্দার উপর বসে একমনে মন্ত্র জপে চলেছেন। চারদিকে কোথায় কী ঘটছে, তা যেন জানার প্রয়োজন নেই তাঁর। চারজন স্পেশাল পুলিশ অফিসার নেমে এসে দাঁড়ালেন পিরবাবাজির ঘরের সামনে, জনাপঁচিশ র্যাপ বাবাজির ঘরের চারদিকে বন্দুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে। পুলিশের বড়ো কর্তা প্রীতম সেনগুপ্ত পিরবাবাজিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, you are under arrest.
মুখ তুলে তাকিয়ে পিরবাবাজির নরম প্রশ্ন, কেন জানতে পারি কী?
এখনও ভনিতা করছেন?
আমি রাতদিন খোদার খিদমতে ব্যস্ত থাকি।
আপনার প্রকৃত পরিচয় জেনে ফেলেছি।
Kindly বলবেন?
আম-মানুষের মধ্যে একটাই প্রসঙ্গ ঘূর্ণিঝড় হয়ে আছড়ে পড়ছে। একজন দিব্যজ্যোতির পিরকে এভাবে অপমান করা কী ঠিক হচ্ছে? ইমাম হেকিমের তীব্র প্রতিবাদ, আপনারা কেন একজন খাঁটি পিরবাবাজিকে—?
হেকিমকে উদ্দেশ করে পুলিশের বড়ো কর্তা প্রতীম সেনগুপ্তের স্বগতোক্তি, জানেন কী, যে ছেলেটা পায়ের টান নিয়ে এখানে এসেছিল, গত পরশু সে ধরা পড়েছে। দৈহিক শাস্তির ভয়ে সবকিছু প্রকাশ করে দিয়েছে। পোকা ডাক্তার ছিলেন পিরবাবাজির পোষা প্রিয় লোক, নকল ডাক্তারবাবু। এখন তিনি পুলিশের জালে। জন্মাবধি অচল হাতের ছেলেটার বাবাও ছিল পিরবাবাজির আর এক সাকরেদ। বাপছেলে দুজনকেই পাকড়াও করা সম্ভব হয়েছে। পিরবাবাজী আসলে ভবেশ গাঙ্গুলী, যাবজ্জীবনের কয়েদী, জেল ভেঙে পালিয়ে এসে এখানে এভাবে পুরনো সাকরেদদের নিয়ে নতুন পরিচয়ে—। আজকের দিন শেষ হলে লোকটার যাবজ্জীবনের মেয়াদ শেষ হয়ে যেত।
তখনও ইমাম হেকিম একান্ত মনে খুঁজে চলেছেন পুরনো স্মৃতির রোমন্থনে বেঁচে থাকা তাঁর প্রিয় পিরবাবাজিকে।